Alapon

একজন ফেরারীর গল্প....

আমার তখন ফেরারী জীবন চলছিলো। পুলিশ আমাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে। পেলে শুধু গ্রেফতার করা হবে না, সঙ্গে সঙ্গেই ক্রসফায়ার; এমন অবস্থা। ষড়যন্ত্রমূলকভাবে আমার আদর্শিক প্রতিপক্ষরা আইসিটি মামলায় ফাঁসিয়ে দিয়েছে। আমি আত্মীয়-পরিজনহীন জীবনে তখন বেশ অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। কোনো নির্দিষ্ট জায়গায় থাকার উপায় নেই। প্রতিনিয়ত স্থান বদল করে বাঁচতে হয়।


কত বিচিত্র জায়গায়, কত বিচিত্র মানুষের সংস্পর্শে যে আমার সে সব দিবস-রজনী কেটেছে, তা আজ ভাবতেও গা শিউরে ওঠে। কখনও কখনও এমন হয়েছে, কোথাও থাকার জায়গা মেলে নি। সারা রাত পথে হেঁটে হেঁটেই রাত পার করতে হয়েছে। কত ঈদ, কত স্বজনের বিয়ে, কত সুখের কল্লোলিত আজদাহা প্রবাহ পেরিয়ে গেছে আমাকে ছাড়াই; কে কবে রেখেছে তার হিসেব!


একজন ফেরারী আসামী সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন একজন প্রাণী। পৃথিবীর চোখে ভারী নিগ্রহের নিগঢ়ে আবদ্ধ এক মানব সন্তান। মানুষ তাকে জায়গা দিতে ভয় পায়। পাছে সে জড়িয়ে পড়ে কোনো ভয়ঙ্কর জটিলতায়। আক্ষরিক অর্থে, আমার জন্য প্রতীক্ষা করার কোনো মানুষ ছিলো না। কোনো ঈদের সকালে আমার কথা মনে পড়ে চোখ ছলছল করে উঠবে; এমন একজন মানুষও আমার জন্য অবশিষ্ট ছিলো না ধরাপৃষ্ঠে।


মানুষের যখন কোনো পিছুটান থাকে না, যখন কোনো মমতামাখা চোখ প্রতীক্ষায় থাকে না, তখন সে জীবনের ব্যাপারে বেপরোয়া হতে ভয় পায় না। আমি জানতাম, যে কোনো মুহূর্তেই ঘনিয়ে আসতে পারে আমার জীবন সায়াহ্ন। থেমে যেতে পারে জীবন প্রদীপ। তবুও কী এক অচেনা আশায় বাঁচতে ইচ্ছে করতো। মনে হতো, যদি কোনো অলৌকিক দৈব শক্তিবলে বেঁচে যাই, যদি মাথার উপর ঝুলতে থাকা পরোয়ানা কখনও অবনমিত হয়, তাহলে নতুন করে বাঁচতে চেষ্টা করবো।


হৃদয়পটে কত ছবি এঁকে যেতো মন! ঘরের ভিতর থেকে ছিটকিনি খোলার মতো একজন মানুষ আমারও হবে। এক জোড়া ঘুমজাগা মমতামাখা চোখ আমার জন্যও প্রতীক্ষা করবে। ঈদের দিন আমার অনুপস্থিতি কারো বুকে চিনচিনে ব্যথা-বেদনার সৃষ্টি করবে। পরক্ষণেই মনের কোনো অদৃশ্য ইরেজার দিয়ে সে স্বপ্নগুলো মুছে ফেলতে হতো। একজন ফেরারীর আবার স্বপ্ন কি? যার জীবনেরই কোনো নিশ্চয়তা নেই, জীবন নিয়ে স্বপ্ন বোনাটা তার জন্য বড্ড বেমানান।


এই ভাবনা-দুর্ভাবনার অকূল পাথারে আমি যখন হাবুডুবু খাচ্ছিলাম, তখনই ঘটে গেলো একটা ঘটনা। প্রচন্ড শীতের রাত। কুয়াশার তীব্রতায় একহাত সামনে কি আছে তা-ও দেখা যায় না। আমি গাইবান্ধার ফুলছড়ি ঘাটের একটা চা স্টলে বসে চা খাচ্ছি। আমার পরিকল্পনা হলো, রাতের মধ্যে জামালপুর গিয়ে উঠবো। বলা বাহুল্য, আমার জায়গা পরিবর্তনের কাজগুলো সারতে হতো রাতের মধ্যেই। দিনের আলোয় বাইরে বের হওয়া আমার জন্য সহজ ছিলো না। হঠাৎ চা স্টলের মালিক রাইসু এসে বললো, “ভাই, র‌্যাবের একটা গাড়ি আসতেছে।”


স্পাইনাল কর্ড দিয়ে একটা হিম শীতল স্রোত বয়ে গেলো। কোনো কিছু ভাবার সময় আমার হাতে ছিলো না। মাথায় তখন একটাই ভাবনা, “আমাকে বাঁচতে হবে।” রাইসু বললো, “দোকানের পিছনের বেড়াটা ভাইঙ্গা দিমু। আপনে দৌড় দিবেন।” আমি বেড়া ভাঙ্গা মাত্রই শরীরের সমস্ত শক্তি একত্রিত করে দৌড় দিলাম। মনে পড়লো ছোটবেলায় পড়া ড্যানিয়েল ডিফোর লেখা “রবিনসন ক্রুশো” বইটির কথা। সেখানে একটা লাইন ছিলো, “যে জীবন বাঁচানোর জন্য দৌড়াচ্ছে, অন্যরা তার সঙ্গে পারবে কেন?”


পরদিন রাতের মধ্যেই এসে পৌঁছলাম বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার যমুনা নদীর মাঝখানের একটি চরে। এই চরে কাটানা ৪৭ দিন আমার জীবনের জন্য একটি বিরাট মাইলফলক হয়ে থাকবে। চরে সব মিলে ৮/১০ টি পরিবারের বাস। আমি গিয়ে দাঁড়ালাম চরের এক কোণের একটি জীর্ণ কুটিরের সামনে। উঁকি দিয়ে দেখলাম, একজন বয়োঃবৃদ্ধা নারী কি যেন রান্না করছে। আমি বুড়িকে ‘দাদীমা’ সম্বোধন করতেই মুখ তুলে তাকালেন। আমি তাকে আমার সমস্ত বিবরণ খুলে বললাম।


আমার জায়গা হলো সেই দাদীমার ঘরে। নির্ভাবনায় কাটতে লাগলো আমার দিবস-রজনী। এক সময় ভুলেই গেলাম যে, আমি ফেরারী আসামী। প্রতি রাতে দাদীমা তার জীবনের গল্প বলতেন। আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতাম সেই সব প্রাচীন দিনের গল্প। সপ্তাহে একদিন রাত্রিবেলা ছদ্মবেশে দোকান থেকে বাজার করে আনতাম।


দিব্যি দিন কেটে যাচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো, এভাবে জনম জনম কাটালে মন্দ হতো না। ৪৭ দিন পর যমুনার সেই চর থেকে অন্য জায়গায় চলে যেতে হলো। এরপর অনেক দিন পেরিয়ে গেছে, যমুনার পানি অনেক গড়িয়েছে। কিন্তু দাদীমার কাছে আর যাওয়া হয়ে ওঠে নি। আমি আমার ক্ষুদ্র এ জীবনে অনেক মানুষের ঋণী হয়েছি। কারো কারোটা শোধ করবার ক্ষীণ চেষ্টাও চালিয়েছি এক আধবার। কিন্তু যমুনার গহীণ চরে ফেলে আসা সেই দাদীমার ঋণ পরিশোধ করার চেষ্টা করার দুঃসাহস কখনও হয় নি। যে ঋণ জীবন দিয়েও শোধ করা যায় না, তা শোধ করার উপায় কি!

পঠিত : ৫৮৬ বার

মন্তব্য: ০