Alapon

ইমাম বুখারী রাহিমাহুল্লাহ -০১



ইসলামের মূল স্তম্ভ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লার প্রেরিত কিতাব মহা গ্রন্থ আল কুরআন। ইসলামি জ্ঞানের দ্বিতীয় স্তম্ভ আল-হাদিস। আলকুরআনের পরেই যেই গ্রন্থটির অবস্থান,তা হলো সহীহ্ আল বুখারী। এই মহাগ্রন্থের রচয়িতা ইমাম বুখারী নামে পরিচিত।

সেদিন ছিলো শুক্রবার। ১৯৪ হিজরীর শাওয়াল মাসের ১৩ তারিখ । ৮১০ খ্রিস্টাব্দের ২১জুলাই জুমা'আ বারে একসময়ের সমৃদ্ধি ও প্রাচুর্যের নগরী উজবেকিস্তানের বুখারা শহরে তিনি পৃথিবীর বুকে আগমন করেন। বুখারা শহরে জন্মগ্রহণ করেছেন বলেই বুখারী নামে সারাবিশ্বের কাছে পরিচিত হয়ে আছেন। কিন্তু তাঁর আসোল নাম হলো মুহাম্মদ। উপনাম আবু আব্দুল্লাহ। আরব রীতি অনুযায়ী পুরো নাম হলো আবু আব্দুল্লাহ্ মুহাম্মাদ বিন ইসমাঈল বিন ইবরাহীম বিন মুগীরা বিন বারদিযবাহ আলজু’ফী।

তাঁর পূর্ব পুরুষেরা পারস্যের অধিবাসী। ওনার প্রপিতামহ মুগীরা পারস্য হতেই বুখারা শহরে এসে বসবাস করেন। এবং এখানকার শাসনকর্তার হাতেই তিনি ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেন।

ওনার বাবাও ছিলেন একজন নামকরা মুহাদ্দিস।
বাল্যকালেই হারাতে হয় স্বীয় পিতার স্নেহ-শাসন ও ভালোবাসা। তাঁর মা ছিলেন একজন ফরহিজগার মুহসিনা নারী। মায়ের কাছেই লালিত পালিত হন তিনি। পিতার রেখে যাওয়া সম্পদ দিয়েই তাঁদের দুই ভাইকে মা পরিচালনা করেন,পড়াশোনা করান। তাঁর মা তাঁকে স্থানীয় বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনের জন্য ভর্তি করান। সেই স্থানীয় বিদ্যালয় থেকেই শেষ করেন প্রাথমিক শিক্ষা। এই মহা মনীষী খুবই ছোটো বয়সে (কারো কারো মতে ছয় বছর বয়সেই) মহাগ্রন্থ আলকুরআন হিফয সমাপ্ত করেন। আর হাদিস শাস্ত্রে তো তাঁর অবদান এতো এতো বেশি যে, ওনাকে হাদিস শাস্ত্রে বিশ্ব সম্রাট বলা হয়ে থাকে।

আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের জীবনের প্রতিটা পরতে পরতে তো তাঁর পরীক্ষা লেগেই থাকে। পিতা হারানোর পরে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে স্বীয় চক্ষুর দৃষ্টি শক্তিও হারিয়ে ফেলেন। বাল্যকালেই তিনি হয়ে যান অন্ধ! অনেক চিকিৎসা করে ও তাঁর দৃষ্টিশক্তি কিছুতেই ফিরে এলো না।

একজন দিব্য সুস্থ সন্তান হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে গেলে মায়েদের কী অবস্থা হয় তা তো সহজেই অনুমেয়। তাঁর এই দৃষ্টি শক্তি হারানোয় শুরু হয়ে যায় মায়ের রোদন ধ্বনি। করতে থাকেন দয়াময় মহামহিম আল্লাহর সুবহানাহু ওয়াতাআ'লার কাছে দু'য়া।


মায়ের দুয়া বৃথা যায় না। মহীয়সী সেই নারী তথা ইমাম বুখারী রাহিমাহুল্লাহ'র মায়ের সে আকুল আবেদনও বৃথা যায় নি। আল্লাহর কাছে তিনি দুয়া করেই গেছেন অনবরত।

ঘুমিয়ে পড়লেন একদিন তিনি। ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখলেন। স্বপ্নে এলো সুসংবাদ। স্বপ্নযোগে সেই সুংসাবাদ সাধারণ কোনো মানুষের কাছ থেকে পাননি। স্বপ্ন দেখলেন মুসলিম মিল্লাতের পিতা সাইব্রাহিম আলাইহিস সালামকে। জাতির পিতা ইবরাহিম আলাইহিস সালাম ওনাকে বললেন -"ওহে! তোমার সন্তানের দৃষ্টি শক্তি ফেরত চেয়ে আল্লাহর দরবারে তোমার ধর্ণা দিয়ে, দুয়া করে অবিরাম ক্রন্দনের কারণে তিনি তোমার সন্তানের দৃষ্টি শক্তি ফিরিয়ে দিয়েছেন। সুস্থ হয়েছে সে"

এমন সুসংবাদে কে না উৎফুল্ল হবে! তিনি স্বীয় পুত্রের (ইমাম বুখারীর) কাছে গিয়ে হাজির হন। প্রকৃত ঘটনা যাচাই করতে গিয়ে দেখেন সত্যি সত্যি তাঁর কলিজার টুকরো সন্তান আল্লাহর একান্ত করুণায় ফিরে পেয়েছেন দৃষ্টি শক্তি! ( আলহামদুলিল্লাহ!)

এরপর তাঁর দৃষ্টি শক্তির তীব্রতা আগের চেয়ে আরো বহুগুণে বেড়েছে! এতো বেশি পরিমাণে বেড়েছে যে, তিনি চাঁদের আলোয় লেখাপড়ার কাজ অনায়াসেই পরিচালনা করতে পারতেন। আত-তারিখুল কাবির গ্রন্থটা তিনি চাঁদের আলোয় লিখেছেন। (এতে তিনি হাদীসের রাবীদের তথা বর্ণনাকারীদের জীবনী সম্পর্কে আলোচনা করেছেন)

ছোটো বেলাতেই হাদীসের প্রতি তাঁর অনুরাগ সৃষ্টি হয়। সেই সময় থেকেই তিনি হাদিস স্মৃতিতে সংরক্ষণ করেন। তাঁর যখন এগারো বছর বয়স, তখন তৎকালীন বুখারা নগরীর একজন প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ছিলেন। ইমাম দাখিলী তাঁর নাম। দূর-দুরান্ত থেকে তাঁর কাছে হাদীসের জ্ঞান আহরণের জন্য ছাত্রদের ভীড় জমতো। জমায়েত হওয়া সেইসব ছাত্রদেরকে তিনি হাদীসের শিক্ষা দিতেন। ইমাম বুখারী রাহিমাহুল্লাহ তাঁর ক্লাসে একদিন হাজির হয়েছেন। হাদিসের ক্লাসে ইমাম দাখেলি ছোট্টো একটা ভুল করে ফেলেন। সেই ভুল দেখে ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ) নিজে ছোটো বলে হীনমন্যতায় ভোগেননি। চুপ করে বসে থাকেন নি। বিনম্রতার সাথেই ভুলটা ধরিয়ে দিলেন। প্রথম দিকে ইমাম দাখেলী একটু কড়া আচরণ করলেও ইমাম বুখারী নমনীয় আচরণ মিশিয়ে যখন বললেন 'উস্তায' আপনি দয়া করে আপানার পাণ্ডুলিপিটা যদি দেখতেন....!! ইমাম দাখেলী তখন পাণ্ডুলিপি দেখে তাঁর ভুল স্বীকার করেন এবং বলেন; তোমার কথায়ই ঠিক। এবং প্রাণ ভরে দু'য়া করেন ছোট্টো সেই বালক বুখারীর জন্যে!

ষোল বছর বয়স অবধি তিনি নিজ জন্মভূমিতেই সকল বড়ো বড়ো হাদিস শাস্ত্রের পণ্ডিতদের নিকট শিক্ষা অর্জন করেন। সে বয়সেই তিনি ৭০ হাজারেরও অধিক হাদিস স্মৃতিতে ধারণ করতেন। শুধু হাদিসের মতন ( মূল কথা) নয়, সনদসহ মুখস্থ ছিলো। তৎকালীন সময়ের আরেকজন বিখ্যাত মুহাদ্দিস - ইমাম সলিম ইবনে মুজাহিদ ওনাকে জিজ্ঞেস করেছেন যে, তুমি নাকি সত্তর হাজার হাদিস মুখস্থ পারো? তিনি বলেন - মারফু হোক মাওকুফ হোক, উহাদের অধিকাংশ রাবীর আবাসভূমি, জন্ম-মৃত্যু সন অন্যান্য সকল বিষয় বলে দিতে সক্ষম আমি!

হাদিস শাস্ত্রে তাঁর পারদর্শিতা এতো বেশি পরিমাণ ছিলো যে, তিনি যখন হাদিস সংগ্রহের জন্য বিদেশে রওয়ানা দিচ্ছেন –তখন ওনাকে তৎকালীন সময়ের আরো একজন শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস -মুহাম্মদ ইবনে সালাম বয়কন্দী তাঁর গ্রন্থের ত্রুটিগুলো ধরিয়ে দেয়ার অনুরোধ করেন। এবং তিনি একব্যক্তির প্রশ্নের জবাবে তাঁর সম্পর্কে ( ইমাম বুখারী রাহিমাহুল্লাহ) মন্তব্য করেন –এই তরুণ এমন এক ব্যক্তি, যার সমকক্ষ কেউ নেই!

এই মন্তব্য যখন করেন, তখন তাঁর বয়স ষোলো বছর।
এরও বহু পর, মানে যখন ইমাম বুখারী রাহিমাহুল্লাহ বয়সের পূর্ণতায় পৌঁছেছেন তখনও এমন মন্তব্য করেছেন তৎকালীন সময়ের বিদগ্ধ ইমামগণ।

ওনার সম্পর্কে ইমাম ইবনে খুজাইমা (রাহিমাহুল্লাহ)ও বলেন –পৃথিবীতে ইমাম বুখারী অপেক্ষা অধিক অভিজ্ঞ এবং হাদীসের হাফেয আর কেউ জন্ম গ্রহণ করে নি।

ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল (রাহিমাহুল্লাহ) ও তাঁর সম্পর্কে বলেন –খোরাসানের যমীনে ইমাম বুখারীর অনুরূপ আর কেউ জন্ম গ্রহণ করে নি।

এই মহাপুরুষের স্মৃতি শক্তি কতোটা প্রখর, জ্ঞানের গভীরতা কতোটা বেশি তাঁর আরো একটা নমুনা হলো এই যে, তিনি যখন বসরার মুহাদ্দিসদের নিকট হাদীসের ক্লাস করতেন, তখন ছাত্রগণ খাতা-কলম নিয়ে বসে উস্তাযের নিকট থেকে হাদীস মনোযোগ দিয়ে শুনতেন এবং হাদীসগুলো খাতায় লেখে রাখতেন। ব্যতিক্রম ইমাম বুখারী! এই কাজটা তিনি করতেন না। কিছুদিন যেতে লাগলো এভাবেই....

হুট করেই একদিন তাঁর সহপাঠীগণ জিজ্ঞেস করলো যে, তুমি শুধু আমাদের সাথে বসে থাকো ক্যান? এভাবে সময় নষ্ট করে কোনো লাভ আছে কি? চুপচাপ থাকলেন তিনি কিছুদিন। তাঁদের পিড়াপিড়িতে পড়ে একদিন তিনি প্রচুর বিরক্ত হয়ে বললেন –তোমরা আমার নিকট বারবার একই প্রশ্ন করছো। তোমাদের হাদিস লিপিবদ্ধকৃত খাতা নিয়ে এসো। এতোদিন ধরে তোমরা যতো কিছু লিখেছো তা আমি তোমাদেরকে শুনিয়ে দিই। তাঁরাও খাতা নিয়ে আসলো, ইমাম বুখারী (রঃ) হুবহু সবগুলো হাদীস তাঁদের শুনিয়ে দিলেন। আরও অতিরিক্ত পনের হাজার হাদীস শুনিয়ে দিলেন। কোথাও বিন্দু পরিমাণ কোনো ভুল করলেন না। বরং তাঁদের লেখার মাঝেই কিছু ভুলচুক হয়েছিলো। বিস্ময়ে তখন তারা বিমূঢ় হয়ে গিয়েছে। তাদের লেখার মাঝে যেই ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো ছিলো সেই বিচ্যুতিগুলোও তাঁরা তখন শুধরে নিলো।

এরপর তিনি তাঁর সেই সকল সহপাঠীদের লক্ষ্য করে বললেন –এরপরও কি তোমরা আমি এখানে অযথা সময় নষ্ট করছি বলবে? সেদিন থেকেই হাদীস শাস্ত্রে তারা ইমাম বুখারীকে প্রাধান্য দেয়া শুরু করলেন।

মাত্র ষোলো বছর বয়সে তিনি তাঁর মা এবং বড়ো ভাইয়ের সাথে হাজ্জে বাইতুল্লাহ'র উদ্দেশ্যে মক্কাতুল মুকাররামায় গমন করেন। হাজ্জ ক্রিয়া সম্পাদনা শেষ করে তাঁর মা এবং ভাই দেশে ফেরত এলেও তিনি আসেননি। রয়ে গেলেন তিনি মক্কায়....

মক্কার প্রসিদ্ধ সব শিক্ষকদের থেকে তিনি সোহবত লাভ করেন। সকলের কাছ থেকেই কমবেশি হাদীসের জ্ঞান আহরণ করে নিজের জ্ঞানের যে তীব্র তৃষ্ণা, সেই তৃষ্ণা নিবারণ করেন।

দুই বছর পরে তিনি মক্কা নগরী থেকে মাদিনাতুল মুনাওয়ারায় গমন করেন। সেখানেও তিনি হাদীসের শিক্ষাদানে যাঁরা ব্রতী ছিলেন, তাঁদের থেকে ইলমুল হাদীসের শিক্ষা গ্রহণ করেন। মাদিনার এই যে সফরটা, এই সফরেই তিনি '' তারিখুল কাবির'' নামক গ্রন্থখানা প্রণয়ন করেন। আর তা করেন চাঁদের আলোতেই।


তাঁর সফর যে শুধু মক্কা-মদিনার সীমানায় সীমিত ছিলো তা নয়। দ্বীনের মারকায মক্কা-মদীনায় হলেও প্রিয় নবী সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সবগুলো হাদীস,সবগুলো বাণী এই দুই জায়গায় পাওয়া ছিলো অসম্ভব। রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু অা'লাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবাগণ (রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুমা) ছিলেন দ্বীনের জন্য নিবেদিত প্রাণ। ধ্যানে-জ্ঞানে, স্বপ্ন-সাধনায় ছিলো শুধু দ্বীনের প্রচার-প্রসার ও বিজয়! তাই তাঁরাও যাঁর যে দিকে সুযোগ হয়েছে সে সেদিকেই চলে গিয়েছেন দ্বীনের বার্তা নিয়ে। ইসলামের পয়গাম নিয়ে। আল্লাহ -রাসুলের বাণী নিয়ে। ছড়িয়ে গিয়েছেন তাঁরা চতুর্দিকে....

তাই ওনার ( ইমাম বুখারী রাহিমাহুল্লাহ) সফর শুধু মক্কা-মদিনাতেই সীমাবদ্ধ না রেখে তিনি সফর শুরু করলেন দেশে দেশে। জনপদে জনপদে। যেখানেই সন্ধান পেয়েছেন হাদীসের সেখানেই ছুটে গিয়েছেন। যেই জনপদেই ছিলো হাদীসের উস্তায, সেই জনপদেই গিয়েছেন, শিখেছেন হাদীস।করেছেন হাদীসের জ্ঞানকে সমৃদ্ধ।

খোরাসানের বিভিন্ন অঞ্চল তো তিনি ভ্রমণ-পরিভ্রমণ করেছেনই। এর বাহিরে যে সমস্ত দেশ-অঞ্চলে ভ্রমণ করেছেন তার মধ্যে মক্কা-মদীনা ছাড়াও রয়েছে ইরাক, হিজাজ, সিরিয়া, মিশর, কূফা,বগদাদ এবং আরও বহুসংখ্যক শহর-নগর।

এই যে এতো দেশে এতো শহরে তাঁর সফর, এই সফরগুলো তিনি এক সাথে একবারে করেন নি। এর পেছনে জীবনের অনেক বড়ো অংশই ব্যয় করেছেন তিনি।

এমনিতেই মুহাদ্দিসগণ হাদীস সংগ্রহের জন্য কঠিন পরিশ্রম করতে হয়েছে, আর ইমাম বুখারী( রাহিমাহুল্লাহ) তো কতোটা কঠোর নিয়ম-পদ্ধতি ফলো করতেন তা তো সকলেরই কমবেশি জানা আছে। সেই কঠিন নিয়ম-নীতির জন্য তিনি কতোটা বেশি দুঃসহ সাধনা করতে হয়েছে, কতো হার্ড পরিশ্রম করতে হয়েছে, কতোটা প্রতিকূলতা দু’পায়ে মাড়িয়ে যেতে হয়েছে, কতো বিপুল বিপদ অতিক্রম করতে হয়েছে তা তো আর বলার অপেক্ষা রাখেনা।

সে সময়ের সফরে না ছিলো উপযুক্ত জানবাহন, না ছিলো সহজলভ্য কোনো যোগাযোগ ব্যবস্থা! ছিলো না আজকের মতো হোটেল রেস্তোরাঁর কোনো জাঁকজমকপূর্ণ বন্দোবস্ত! জাঁকজমকপূর্ণ তো দূরের কথা, নরমালও তো ছিলো না। যার কারণে তিনি কখনো উপবাসে দিনাতিপাত করেছেন। কখনো আহারের অভাবে লতাপাতা খেয়ে জীবনধারণ করেছেন। বহু বছর রুটির সঙ্গে কোনো তরকারি খাননি। কখনো কখনো দু-তিনটে বাদাম দিয়ে ক্ষুধার জ্বালা নিবারণ করেছেন। সাওয়ারীর অভাবে পা দুটো ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে। সব কষ্ট তিনি হাসিমুখে সয়ে নিয়েছেন। করে নিয়েছেন সকল যাতনাকে আপন। তবুও উদ্দেশ্য থেকে একরত্তিও সরে আসেন নি। এতোসব বিপদ-মুসিবতেও ভেঙে পড়েন নি। তাঁর যে হিমাদ্রীসম অটল-অনড় ও অবিচল মনোবল আর সাহস–সে সাহস-উদ্যোম আর অনড় মনোভাবে কখনো বাটা পড়েনি! ছিড় ধরেনি।

আজকের যুগে আমরা তো ইলম অর্জন করি। এরপর ভাবি –এই তো, আমার জীবীকা উপার্জনের একটা হিল্লে হলো। কিন্তু তিনি কি তা করেছেন? কোনো ইমাম-ই তা করেন নি! উল্টো নিজের সমুদয় সম্পদ অকাতরে বিলিয়ে দিয়ে রিক্তহস্তে ফিরে আসতেন আপন নীড়ে। করতেন অন্যান্য সাধক ও ছাত্রদেরও পৃষ্ঠপোষকতা। জ্ঞানীদের পৃষ্ঠাপোষকতা ছাড়া তো জ্ঞান বিকাশের যে ধারা, তা অতোটা ছড়ায় না।

ইমাম বুখারী'র (রাহিমাহুল্লাহ) এক খন্ড যমীন ছিলো। এই জমি থেকে তিনি প্রতি বছর সাত লক্ষ দিরহাম ভাড়া পেতেন। এই বিশাল অর্থ থেকে তিনি খুব সামান্যই নিজের ব্যক্তিগত কাজে খরচ করতেন। বিশাল এই যে অর্থ, এর সম্পূর্ণটাই তিনি ইলম অর্জনের এবং অভাবীদের অভাব বিদূরিত করার জন্যে ব্যয় করতেন। তাঁর সঙ্গে সব সময় দিনার ও দিরহামের থলে থাকতো। হাদিসের ছাত্র, হাদিসের শিক্ষকদের মধ্যে যারা অভাবী ছিলেন তাদেরকেও তিনি দান করতেন দু'হাত ভরে।

এতো এতো সফর, হাদিস চর্চায় ও সংগ্রহে তাঁর অপরসীম ব্যস্ততায়ও আল্লাহর স্মরণে-ইবাদাতে একদমই পিছিয়ে ছিলেন না তিনি। যতোটুকুন জানা যায়, তিনি প্রতি বছর রমাদ্বান মাসের প্রতিদিনের যে তারাবীহ, সেই তারাবীহ'র নামাযের পর প্রতি তিন রাত্রিতে একবার কুরআনুল কারিম খতম করতেন।
প্রতিদিন শেষ রাতে স্বলাতুত তাহাজ্জুদ আদায় করতেন।

এই যে ইবাদাত, এটা করতেন নিরবে-নিভৃতে। তাঁর সাথে থাকতেন মুহাম্মদ বিন আবু হাতিম আল ওয়াররাক। একসাথে থাকার পরেও তিনি টের পেতেন না। একদিন তিনি জিজ্ঞেস করলেন যে,
আপনি আমাকে ঘুম থেকে কখনোই জাগিয়ে তোলেন না ক্যান? (ইমাম বুখারী) জবাব দিলেন –
তুমি যুবক মানুষ। তোমার ঘুমের প্রয়োজন, তাতে ব্যাঘাত ঘটাতে চাই না আমি!

একটুখানি ভেবে দেখুন, অন্যের বিষয় নিয়ে, মানে বান্দার হক্ক নিয়ে কতোটা বেশি সচেতনতা আর ইবাদাতের মাঝেও কতোটা বেশি খুশু-খুজু তাঁর।

আমরা তো নিজেকে মুখলিস, মুহসিন আর মুত্তাকী প্রমাণ করার জন্যে হলেও একটু-আধটু আশপাশকে জানান দেয়ার চেষ্টা করি!

তিনি যে পুরোপুরি শুধু হাদিস শাস্ত্র নিয়েই ছিলেন, ভিন্ন কিছুর খবর ছিলো না এমনটাও নয়। সাহিত্যেও ছিলো ওনার পদচারণা। আল্লামা তাজুদ্দীন সুবকী তাবাকাতে কুবরা নামক গ্রন্থে তাঁর কিছু কবিতাও উল্লেখ করেছেন। ইমাম আবু আব্দুল্লাহ হাকিমও তাঁর রচিত কিছু কবিতা তুলে এনেছেন ।

তিনি সবসময় চেষ্টা করেছেন সকল প্রকার কলঙ্কের কালো দাগ হতে নিজেকে বিমুক্ত রাখার । সন্দেহের শামীয়ানায় নিজেকে কখনোই যুক্ত করতে বা শামিল হতে দেন নি। নিজের বিশ্বস্ততা অটুট রাখবার প্রয়োজনে সীমাহীন ত্যাগ করতেও ছিলেন প্রস্তুত। আর তার জন্য অর্থ সম্পদকেও পদতলে পিষ্ট করতে কিংবা উত্তাল-গভীর সমুদ্রের গহীন বক্ষেও ছুঁড়ে ফেলে দিতে দ্বিধা-সংকোচ করতেন না!

পূর্বেই তো বলা হয়েছে যে, ইমাম সাহেব নানান দেশে নানা জনপদে সফরে বের হয়। তেমনিভাবে একদিন তিনি সফরে বের হলেন। এক দুষ্ট ও ধূর্ত লোক এসে বসলেন তাঁর পাশে। জমালেন খাতির। ইমাম সাহেব তো সরল মানুষ। বিশ্বাসীরা সরল হয়। সহজ হয়। লেকটা গল্প পাকাতে লাগলেন তাঁর সাথে। তিনিও তাকে বিশ্বাস করলেন। গল্প করতে থাকলেন তার সাথে....

ইমাম বুখারী'র (রাহিমাহুল্লাহ) কাছে ছিলো এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা। এই স্বর্ণমুদ্রার কথাটা তিনি বলে দিলেন তার কাছে, গল্পচ্ছলে। সরল মনে।

লোকটা তো লোভী। দুষ্ট। কপট। ধূর্ত। ধুরন্ধর। ফন্দিবাজ। সে ফন্দি আটলো। হঠাৎ লোকটা চারিদিক মুখরিত করে কাঁদতে লাগলো, বিলাপ করে। উচ্চস্বরে….

তার সে কান্নার আর্তনাদ জাহাজের ইথারে ইথারে ছড়িয়ে পড়লো। এমন আর্তনাদ শুনে সবাই কি আর বসে থাকতে পারে ? পারলো না জাহাজের যাত্রীরাও। ছুটে এলো সবাই। ব্যাকুল হয়ে। দলে দলে....

সকলের জিজ্ঞাসার জওয়াবে লোকটা বললো তার স্বর্নমুদ্রা চুরি হয়ে গেছে। হতচকিত হয়ে ওঠেন ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ)! বুঝতে পারেন তার ধূর্তামি আর দুরভিসন্ধি। মানুষজন সকলের আসবাবপত্র খুঁজতে লাগলো। একেবারে তন্ন তন্ন করে....

এদিকে ইমাম বুখারী রাহিমাহুল্লাহ'র কাছে একহাজার স্বর্ণমুদ্রা আছে। মনের আকাশে চিন্তার কালো মেঘ জমাট বাঁধালো তাঁর। তিনি ভীষণরকম চিন্তিত হয়ে পড়লেন! লোকজন তল্লাশি চালিয়ে তাঁর নিকট পেয়ে যাবেন স্বর্ণমুদ্রা। তখন তাঁকে অবিশ্বাস করলে তো তাঁর এতোদিনের অর্জিত যে বিশ্বাস, সে বিশ্বাসের ভিত্তিতে আঘাত আসবে। কলঙ্কের দাগে দগ্ধ হবেন। হাদিসের বিশ্বস্ততার ওপর আঘাত আসবে। নাহ্! এ হতে পারে না! ভাবতে লাগলেন তিনি...

আল্লাহ যাকে হেফাজত করেন তাঁকে তো সবরকম বিপদ থেকেই বিমুক্ত রাখেন। বিমুক্ত থাকার কৌশলও শিক্ষা দেন। হঠাৎ তাঁর মাথায় বুদ্ধি এলো। তিনি সবার অগোচরে টুপ করে সমুদ্রের গহীন জলে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন তাঁর নিজস্ব সম্পদ- সেই একহাজার স্বর্ণমুদ্রার থলে। এদিকে মানুষজন তল্লাশি চালাতে লাগলেন...

ইমাম বুখারী'র (রাহিমাহুল্লাহ) কাছে আসলেন সকলে। তল্লাশি করা হলো। ফেলো না কিছু। ভেস্তে যায় সেই বাটপারের দুরভিসন্ধি।

ইমাম সাহেব সম্পদ বিসর্জন দিয়েও আল্লাহর একান্ত অনুগ্রহে ধরে রেখেছেন তাঁর দীর্ঘদিনের অর্জিত মান-ইজ্জত ও বিশ্বস্ততা।

আর এদিকে সেই কপট-প্রতারক লোকটার মুখোশ মানুষের সামনে আলগা হয়ে যায়। উন্মোচিত হয়ে পড়ে তার স্বরূপ। তাকে সবাই তিরস্কার করতে লাগলো। প্রতারণাকারীরা লাঞ্ছিত হয়। অপবাদকারীরা প্রত্যখ্যাত হয়। সে-ও হলো....

পরে জাহাজ থেকে নামার সময় লোকটি নিরিবিলি ইমাম বুখারী রাহিমাহুল্লাহ'র সাথে মিলিত হয়ে জিজ্ঞেস করে, আপনার সাথের একহাজার স্বর্ণমুদ্রা কী করেছেন, কোথায় রেখেছেন? উত্তরে তিনি বললেনঃ তোমার চক্রান্ত বুঝতে পেরেছি।

সেটা ছিলো এক কঠিন পরিস্থিতি। সেই পরিস্থিতিতে আমি একহাজার স্বর্ণমুদ্রার মায়া ত্যাগ করে রাসুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদিসের মর্যাদ অক্ষুন্ন রাখার দৃঢ় সিদ্বান্ত গ্রহণ করেছি। সে জন্যে আমি তা পানিতে ফেলে দিয়েছি।

||আমিরুল মু'মিনিন ফিল হাদীস " ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ) '' পর্ব-০১|


(এই লেখা কপি করা নিষেধ। কোনো ক্রমেই কপি করা যাবেনা। লেখক মানে আমি অনুমতি আপাতত দিচ্ছি না।)
~রেদওয়ান রাওয়াহা

পঠিত : ৯০৮ বার

মন্তব্য: ০