Alapon

কবিগুরুর নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির গল্প........

নোবেল পুরস্কারকে ধরা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে সম্মানজনক পুরস্কার। বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেল এই পুরস্কারের প্রচলন করেন। ব্যক্তিজীবনে আলফ্রেড নোবেল রসায়নবিদ, প্রকৌশলী ও অস্ত্রনির্মাণ প্রতিষ্ঠানের মালিক ছিলেন। নিজের সবচেয়ে বড় আবিষ্কার ডিনামাইটের ধ্বংসাত্মক ব্যবহার দেখে শেষজীবনে খুবই অনুতপ্ত হয়ে পড়েছিলেন তিনি। আর এ কারণে মৃত্যুর বছরখানের আগে একটি দানপত্র তৈরি করেন।

দানপত্র অনুযায়ী ১৯০১ সাল থেকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সম্মাননা নোবেল পুরস্কারের প্রবর্তন করা হয়। সেই থেকে প্রতিবছর পদার্থবিজ্ঞান, রসায়নশাস্ত্র, শারীর ও চিকিৎসাবিজ্ঞান, শান্তি এবং সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ নোবেল পুরস্কার দেয়া হচ্ছে। ১৯৬৯ সাল থেকে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কারের প্রবর্তন করা হয়।
প্রথম বাঙালি হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। শুধু তাই নয়, এশিয়া মহাদেশে তিনিই প্রথম নোবেলজয়ী। বাংলা সাহিত্যেও এখন পর্যন্ত এ পুরস্কার আর কেউ পাননি। সে-ও শতবর্ষ পাড় হয়ে যাওয়া আগের কথা।

১৯১৩ সালের ১৫ নভেম্বর কলকাতায় টেলিগ্রামে খবর আসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। কবির নোবেল পাওয়ার খবর সেদিন শুক্রবার কলকাতার সান্ধ্য দৈনিক ‘এম্পিয়ার’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। কবির ঠিকানা সুইডিশ একাডেমির জানা ছিল না। এতবড় একজন কবি তাকে খুঁজে পাওয়া তো আর কঠিন কিছু নয়। তাই খোঁজখবর নিয়ে লন্ডন থেকে টেলিগ্রাম করে খবরটি সরকারিভাবে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে পাঠানো হয়। সেই টেলিগ্রামে লেখা ছিল : SWEDISH ACADEMY AWARDED YOU NOBEL PRIZE LITERATURE PLEASE WIRE ACCEPTATION SWEDISH MINISTER.

টেলিগ্রাম পেয়ে কবির জামাতা নগেন্দ্রনাথ ১৬ নভেম্বর সকাল সাতটার পর পরই কবিকে জানান। কবি তখন শান্তিনিকেতনে অবস্থান করছিলেন। আশ্রমের শিক্ষক এবং ছাত্র সকলেই এ সংবাদ শুনে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েন। স্টকহোমে রবীন্দ্রনাথের হয়ে পুরস্কার গ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয় সেখানকার ব্রিটিশ রাজদূতকে।

১৯১৩ সালের ১০ ডিসেম্বর পুরস্কার গ্রহণ করেন গ্রেট ব্রিটেনের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার মি. ক্লাইভ। পরের বছর ২৯ জানুয়ারি কলকাতার গভর্নর হাউসে বিশেষ অনুষ্ঠানে লর্ড কারমাইকেল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে পুরস্কারের মেডেল ও ডিপ্লোমা তুলে দেন। পুরস্কারস্বরূপ সঙ্গে একটি ব্যাংক চেকও ছিল। সেই চেকে কত টাকার উল্লেখ ছিল নিশ্চয়ই জানতে ইচ্ছে করছে আপনাদের? চেকটিতে ১ লাখ ১৬ হাজার ২৬৯ টাকা উল্লেখ ছিল।

এবার কবি কীভাবে নোবেল পেলেন সেই ঘটনা বলি। কবি ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে বিলেত গিয়েছিলেন চিকিৎসার জন্য। ফেরেন পরের বছর অক্টোবরে। যাওয়ার সময় সঙ্গে ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থটি নিয়ে গিয়েছিলেন। ভক্তিরসের এই কবিতার বইয়ের ভূমিকা লিখে দেন আইরিশ কবি ইয়েটস। উৎসর্গ করেন আরেক কবি রোটেনস্টাইনকে।


বইটি প্রকাশ করে লন্ডনের ইন্ডিয়া সোসাইটি। বইটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করে। এর আলোচনা-সমালোচনা বেরোয় বিলেতের ‘টাইমস’, ‘নেশন’ এবং ‘ম্যানচেস্টার’ নামক তিনটি প্রথম শ্রেণির দৈনিকে। নোবেল পুরস্কারের নিয়মানুসারে প্রার্থীর নাম বিধিবদ্ধভাবে প্রস্তাব করতে হয়। এটা করেছিলেন কবির বন্ধুদের মধ্যে একজন। তার নাম টমাস স্টার্জমুর। বেশ কয়েক বছর বজায় রাখা হয়েছিল এই গোপনীয়তা। কিন্তু কাব্যের সৌরভ যখন ছড়িয়ে পড়ে তখন তা রুখবে এমন সাধ্য কার? তাইতো কবিকে এই সম্মান দেওয়া হয়।

মজার ব্যাপার হলো, ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পুরস্কার পান। কিন্তু একে ‘গীতাঞ্জলি’র হুবহু অনুবাদ বলা যাবে না। কারণ ‘গীতাঞ্জলি’ থেকে ৫৩টি গান; পূর্ববর্তী দশকে কবির লেখা ‘গীতিমাল্য’ থেকে ১৬টি, ‘নৈবেদ্য’ থেকে ১৬টি, ‘খেয়া’ থেকে ১১টি, ‘শিশু’ থেকে ৩টি এবং ‘কল্পনা’, ‘স্মরণ’, ‘চৈতালী’ ও নাটক ‘অচলায়তন’ থেকে একটি করে কবিতা নিয়ে ইংরেজিতে ‘গীতাঞ্জলি’ বইটি প্রকাশ করা হয়েছিল।

১৯১২ সালের ১২ জুন কবি লন্ডন পৌঁছান। বিলেত যাওয়ার সময় তিনি ‘গীতাঞ্জলি’র বেশ কিছু কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। লন্ডনে পৌঁছে সেগুলো রোটেনস্টাইনকে পড়তে দেন। রোটেনস্টাইনের মাধ্যমে কবিতাগুলো আইরিশ কবি ডব্লিউ বি ইয়েটসের কাছে পৌঁছালে কবিতাগুলো পড়ে তিনি মুগ্ধ হন। পরবর্তীতে আগ্রহী হয়ে ইয়েটস ‘সং অফারিংস’-এর ভূমিকা লিখে দেন। ওহ্, বলাই হয়নি ‘সং অফারিংস’ হলো ‘গীতাঞ্জলি’র ইংরেজি সংস্করণ।

১৯১২ সালের ১ নভেম্বর রোটেনস্টাইনের উৎসাহে ইংরেজিতে ‘সং অফারিংস’ নামে লন্ডনের ইন্ডিয়া সোসাইটি থেকে মাত্র সাড়ে সাতশ কপি বই প্রকাশ করা হয়। ১৯১৩ সালের মার্চে ম্যাকমিলান লন্ডন এবং নিউইয়র্ক থেকে বইটি একযোগে প্রকাশ করে। নোবেল পাওয়ার আগেই বইটির ১০টি সংস্করণ বের হয়।


১৯১২ সালের ১৬ জুন লন্ডনে রেলস্টেশন থেকে হোটেলে যাওয়ার পথে ‘গীতাঞ্জলি’র ইংরেজি পাণ্ডুলিপিটি হারিয়ে যায়। অনেক চেষ্টার পর সেই পাণ্ডুলিপি ফেলে যাওয়া মালামালের অফিস থেকে উদ্ধার করা হয়। এবার ভাবুন, সেদিন যদি পাণ্ডুলিপিটি কবি খুঁজে না পেতেন তাহলে কী সর্বনাশটাই না হতো!

পঠিত : ৮৫৬ বার

মন্তব্য: ০