Alapon

মাওলানা ভাসানী কেন বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে হারিয়ে গেলেন?

বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে মাওলানা ভাসানীর নাম হারিয়ে গেলো কেন তা নিয়ে ভাবছিলাম। মজলুম জননেতা খ্যাত বাঙ্গালীর স্বাধিকার আন্দোলনের সিংহ পুরুষ মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর দীর্ঘ এক বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন রয়েছে। এদেশের অসংখ্য মানুষের হৃদয়ে ঠাঁই হয়েছে মাওলানা ভাসানীর নাম। ১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনে পাকিস্তানকে আসসালামু আলাইকুম বলে বিদায় জানিয়ে বাঙ্গালীর স্বাধীনতা আন্দোলনের এক ঐতিহাসিক সূচনা করেছিলেন তাতে কোন সন্দেহ নেই।


তবে পাশাপাশি এটিও সত্য তাঁর রাজনৈতিক দর্শন এবং সাংঘর্ষিক রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে রয়েছে বিস্তর বিতর্ক। এদেশের হাজার হাজার মানুষের মনে এখনো যে প্রশ্ন ঘুরপাক খায় সেটি হলো মাওলানা ভাসানীর মত জননেতার নাম হঠাৎ করে কেন রাজনীতির অঙ্গন থেকে হারিয়ে গেলো? এর পেছনে কি কি কারণ ও বাস্তবতা কাজ করেছে?


৫ জানুয়ারি, ১৯৭১ সালে তাঁর দল ভাসানী ন্যাপের ৮২৯ জন নেতা একযোগে মাওলানা ভাসানীর প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করে পদত্যাগ করেন (বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস, ড. মোহাম্মদ হান্নান)। এদিন এক সাংবাদিক সম্মেলনে বয়োবৃদ্ধ জননেতা হাজী দানেশও ভাসানী ন্যাপ থেকে তাঁর পদত্যাগের কথা জানান। তিনি বলেন, ‘মাওলানা ভাসানীর অরাজনৈতিক কার্যকলাপের দরুণই তিনি ন্যাপ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। ন্যাপ মাওলানার পকেট সংঘটনের পরিনত হয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। (দৈনিক পাকিস্তান, ৬ জানুয়ারী ১৯৭১)


৭ জানুয়ারী ভাসানীর প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করে বিবৃতি দেন পার্টির প্রভাবশালী ৮ নেতা। এদের মধ্যে আনোয়ার জাহিদ, মোহাম্মদ সুলতান, নুরুল হুদা, কাদের বক্স প্রমুখ অন্যতম। তাঁরা অভিযোগ করেন মাওলানা ভাসানী কমিটির সভা না ডেকে একাই সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ করছেন। তাঁরা এটা মানতে পারেন না। (দৈনিক পাকিস্তান, ৮ জানুয়ারী ১৯৭১)


৮ জানুয়ারী ভাসানী ন‌্যাপের সিনিয়র সহসভাপতি হাজী দানেশ ন্যাপের মধ্যে কোন্দল বৃদ্ধি এবং দেশের উভয় অংশে জনগনের শত্রুদের হাত শক্তিশালি করে শোষণের পথ প্রশস্ত করার জন্য মাওলানা ভাসানীর বিরুদ্ধে পুনরায় অভিযোগ তোলেন। এদিন মাওলানার উদ্দেশ্যে হাজী দানেশের এক খোলা চিঠিতে আরো অভিযোগ করা হয়, ভাসানী শাসকগোষ্টীর সাথে যোগসূত্র রেখে জনগনের স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করেছেন।


খোলা চিঠিতে জননেতা হাজী দানেশ দু:খ-ভারাক্রান্ত মনে লিখেন, ‘আমি এই আশা নিয়ে ন্যাপে যোগদান করেছিলাম যে, আপনার নেতৃত্বে দেশে গণতন্ত্র ও শোষণমুক্ত সমাজব্যবস্থা কায়েম হবে। গত ১০ বছরে আমি তার বিপরীত দেখতে পাচ্ছি। আমার মতে, আমাদের ব্যর্থতার কারণ হচ্ছে, দলের অভ্যন্তরে অপনার একনায়কত্ববাদী নীতি।’ চিঠিতে আরো বলা হয়, ইসলামী সমাজতন্ত্রকে ন্যাপের লক্ষ‌্য ঘোষনার পূর্বে দলের কাউন্সিল হয় ডাকা হয় নি। লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ মর্যাদা দাবি করার পূর্বে কারো সাথে আলাপ করা হয়নি। এতে আরো বলা হয়, জাতীয় কাউন্সিল নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া সত্ত্বেও আপনি একক সিদ্ধান্তে নির্বাচন বর্জনের স্লোগান শুরু করেন।’


খোলা চিঠিতে ভাসানীকে উদ্দেশ্য করে আরো বলা হয়, ‘আপনি বিশ্বাস করতেন যে ইস্কান্দার মির্জা ও আইয়ুব খান দেশে সমাজতন্ত্র কায়েম করবে। আইয়ুবের বিরুদ্ধে বামপন্থী শক্তিগুলোকে সংগঠিত করার ব্যাপারে আপনার অনীহা এটাই প্রমাণ করে যে, শোষকশ্রেণীর প্রতিনিধিত্বকারী শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে আপনার যোগ ছিল। অামি এটা বিশ্বাস করতে পারি না যে, আপনার ও ন্যাপের এ ধরনের নীতির মাধ্যমে লাখ লাখ শোষিত মানুষের মুক্তি আসবে।’ ( ভাসানীর কাছে হাজী দানেশে চিঠি, দৈনিক পাকিস্তান, ৮ জানুয়ারি ১৯৭১)


বস্তুত মাওলান ভাসানীর ‘খেয়ালখুশির রাজনীতি ও রহস্যময় আচরণ’নিয়ে সবসময়ই এরকম কথা উঠেছে। তাঁর এসব অরাজনৈতিক গতিবিধি তাঁর পার্টিকে এবং কর্মী ও ঘনিষ্ঠজনকে প্রতিনিয়তই বিব্রত করত। ফলে সেদিন হাজী দানেশের মতো অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিলেন। এছাড়াও জাতীয় ঐকমত্যের প্রশ্নে বেশ কিছু বিষয়ে তাঁর সাংঘর্ষিক অবস্থান তাঁর মতো একজন বিশাল মাপের জননেতাকে প্রশ্নের মুখোমুখি করে দিয়েছিলো।

পঠিত : ১৭৯৬ বার

মন্তব্য: ১

২০২০-১১-১৬ ১২:২১

User
আহমেদ আফগানী

কাগমারি সম্মেলন পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে ছিল না। সেটা ছিল তার নিজ দলের নেতা সোহরাওয়ার্দির বিরুদ্ধে। সেসময় পাকিস্তানের ক্ষমতায় ছিল ভাসানীদের দল আওয়ামী লীগ। সে আসসালামু আলাইকুম বলে মূলত সোহরাওয়ার্দির সাথে তার অনুসারীদের সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা বলেছেন। এবং কিছুদিন পর তিনি আওয়ামীলীগ ছেড়ে ন্যাপ গঠন করেছিলেন। আইয়ুবের আমল থেকে তিনি আইয়ুবের দালাল হিসেবে ছিলেন। এরপর তার প্রতারণা ও রাজনীতিতে অসততার জন্য তিনি রাজনীতি থেকে হারিয়ে যান।

submit