Alapon

‘বছর দশেক লেখালেখি করে বুঝতে পারলাম, এ বিষয়ে আমার কোনো প্রতিভা নেই’

১৮৬২ সালে প্রকাশিত হয় ভিক্টর হুগোর বিখ্যাত উপন্যাস ‘লা মিজারেবল’। হৈচৈ পড়ে যায় চারিদিকে। হুগোর খুব ইচ্ছে হলো বইটির কাটতি কেমন হচ্ছে জানার। তিনি এই মর্মে প্রকাশকের কাছে একটি পত্রও লিখলেন। পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষুদেপত্র বোধহয় এটা। তিনি খালি লিখলেন একটি জিজ্ঞাসা (?) চিহ্ন। প্রকাশকও কম জানেন না। তিনি উত্তরও পাঠালেন উপযুক্ত ভাষায়। তাঁর জবাব ছিল বিস্ময়বোধক (!) চিহ্ন।


মার্ক টোয়েনের সময় আমেরিকান ট্রেনগুলো চলত বেশ ধীরগতিতে। একদিন টোয়েন কোথাও যাওয়ার জন্য ট্রেনে চেপে বসলেন। কিছুক্ষণ পর কামরায় উঠল টিকিট চেকার। টোয়েন গম্ভীর মুখে চেকারের দিকে একটা 'হাফ টিকিট' বাড়িয়ে দিলেন। বুড়ো মানুষের হাতে 'হাফ টিকিট' দেখে টিকিট চেকার অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী দাদু, হাফ টিকিট কেটেছেন কেন? আপনি কি জানেন না চৌদ্দ বছরের বেশি হলে হাফ টিকিট কাটতে মানা?' মার্ক টোয়েনের সরল জবাব, ‘যখন ট্রেনে উঠেছিলাম, তখন বয়স চৌদ্দই ছিল। কে জানত, ট্রেন গন্তব্যে পৌঁছতে এত লেট করবে!'


মার্ক টোয়েনকে নিয়ে সত্য-মিথ্যা মিলে আরো অনেক গল্প প্রচলিত আছে। টোয়েন একবার এক সাংবাদিক বন্ধুকে বললেন, "বছর দশেক লেখালেখি করার পর বুঝতে পারলাম এ ব্যাপারে আমার কোন প্রতিভা নেই।" এটা বুঝবার পরও তুমি লেখালেখি চালিয়ে যাচ্ছ যে? বন্ধুর এই প্রশ্নে টোয়েইন উত্তর দেন, উপায় কি? ততদিনে যে রীতিমতো বিখ্যাত হয়ে গেছি!"


কথিত আছে, গোরস্থানের চারপাশে দেয়াল তোলার জন্য মার্ক টোয়েনের কাছে চাঁদা চাইতে যাওয়া হলে তিনি বলেন, "সমাধিস্থলের চারদিকে দেয়াল দেয়ার কোন প্রয়োজন দেখি না। কারণ যারা ওখানে থাকে তাদের বাইরে বেরিয়ে আসার ক্ষমতা নেই। আর যারা বাইরে থাকে তাদের ওখানে যাবার কোন ইচ্ছে নেই!"


আইরিশ লেখক ও নাট্যকার জর্জ বার্নার্ড শর মুখের দাড়ি ছিল মোটামুটি বিখ্যাত। একবার এক রেজর নির্মাতা কোম্পানি তাদের নতুন রেজরের প্রচারণার অংশ হিসেবে বার্নার্ড শকে নতুন এই রেজর দিয়ে দাড়ি কামানোর অনুরোধ করল। বিনিময়ে দেওয়া হবে মোটা অঙ্কের টাকা। শর রাজি না হয়ে বললেন, তার বাবা যে কারণে দাড়ি কামানো বাদ দিয়েছিলেন তিনিও ঠিক একই কারণে এ ঝামেলা ধরে রেখেছেন।


কোম্পানির লোকজন কারণটি জানতে চাইলে বার্নার্ড শ বললেন, ‘আমার বয়স তখন পাঁচ হবে। বাবা দাড়ি কামাচ্ছেন। আমি তাকে বললাম, বাবা তুমি দাড়ি কামাচ্ছ কেন? তিনি এক মিনিট আমার দিকে নির্বাক তাকিয়ে থেকে বললেন, "তাই তো, আমি এ ফালতু কাজ করে সময় নষ্ট করছি কেন?"- এই বলে তিনি জানালা দিয়ে রেজরটি ছুঁড়ে ফেললেন, জীবনে আর কখনো তা ধরেননি।


বিখ্যাত ইংরেজ কবি ও সাহিত্য সমালোচক ড্রাইডেন ভীষণ পড়ুয়া মানুষ ছিলেন। বই থেকে চোখ তুলতেন না দেখে একদিন তাঁর স্ত্রী অভিমান করে বললেন, ‘তুমি যেভাবে বইয়ের ওপর মুখ গুঁজে পড়ে থাকো তাতে তোমার স্ত্রী না হয়ে বই হলে বোধহয় তোমার সান্নিধ্য পেতাম বেশি!’ ড্রাইডেন বই থেকে মুখ না তুলেই বললেন, ‘সে ক্ষেত্রে বর্ষপঞ্জি হয়ো, বছর শেষে বদলে নিতে পারব!’


প্রখ্যাত মার্কিন নাট্যকার ও’নীলকে পরিচালক রাসেল ক্রুসো তাঁর ওয়াইলডারনেস নাটকটির দৈর্ঘ্য খানিকটা ছোট করার অনুরোধ করেন। ও’নীল নাটকটি পনের মিনিট কমিয়েছেন বলে জানালেন। পরিচালক ক্রুসো খুশি হয়ে কোন দৃশ্যটি বাদ দিয়েছেন জানতে চাইলে ও’নীল বলেন, ‘কোনো দৃশ্য বাদ দিইনি। আমি খালি নাটকের বিরতির সময়টুকু বাদ দিয়েছি।’


ড্রাইডেন এবং ও’নীলের মতোই রসবোধসম্পন্ন মানুষ ছিলেন বিখ্যাত লেখক অস্কার ওয়াইল্ড। তাঁকে একবার অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে মৌখিক পরীক্ষায় গ্রীক ভাষায় লেখা ‘নিউ টেস্টামেন্ট’ থেকে ‘প্যাশন’ অংশের কয়েক লাইন অনুবাদ করতে বলা হয়। ওয়াইল্ড সঠিকভাবে দশ বারো লাইন অনুবাদ করার পর পরীক্ষক সন্তুষ্ট হয়ে থামতে বললে ওয়াইল্ড বলেন- ‘স্যার, প্লিজ গোটা অংশটাই আমাকে অনুবাদ করতে দিন। বাড়তি অনুবাদ করার জন্য আমাকে বাড়তি কোন মার্কস দিতে হবে না। গল্পটা জানার আমার ভীষণ আগ্রহ হচ্ছে।’


রসবোধে বাঙালি লেখকরাও পিছিয়ে নেই। একবার বিত্তশালী দেব নারায়ণ দে’র বাড়িতে একটা বড়সড় অনুষ্ঠানের আয়োজনকে সামনে রেখে খরচাপাতির ফর্দ লেখা হচ্ছিলো। উপস্থিত ছিলেন প্যারীচাঁদ মিত্র। খরচের ফর্দ দেখে প্যারীচাঁদ মিত্র বললেন- ‘এসব খরচ কিছু বাড়িয়ে দিন।’ দেব নারায়ণ দে বললেন- ‘আপনি খরচ বাড়াতে বলছেন। টাকাটা কে দেবে শুনি?’ প্যারীচাঁদের তাৎক্ষণিক জবাব- ‘নিশ্চয় আপনি দেবেন। আপনার নামের আগে দে, নামের পরেও দে। দিতে আপনাকে হবেই।’


লেখক বঙ্কিম চন্দ্র এবং দীনবন্ধু মিত্র যে বন্ধু ছিলেন তা আমরা জানি। দীনবন্ধু একবার আসাম থেকে বন্ধু বঙ্কিমের জন্য একজোড়া জুতো কিনে লোক মারফত পাঠালেন। একটা চিরকুটে লিখে দিলেন- ‘জুতো কেমন হয়েছে জানিও।’ বঙ্কিম চিরকুটটি পড়ে হাসতে হাসতে উত্তরে লিখে দিলেন- ‘ঠিক তোমার মুখের মতো!’


লেখকজীবনে হাস্যরসের কথা এভাবে বলে শেষ করা যাবে না। আমাদের বাঙালি লেখকদের ভেতর সবচেয়ে বেশি যার রসবোধ ছিল সেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কয়েকটি রসবোধের উদাহরণ টেনে এই গদ্যের ইতি টানবো। কলকাতার জোড়া সাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে একবার বসেছে গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের গানের জলসা। রবীন্দ্রনাথও উপস্থিত ছিলেন। শ্রোতারা এক পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ধরলেন একটা গান গাইতে। রবীন্দ্রনাথ হাসি মুখে বললেন, গোপেশ্বরের পর কি এবার দাড়িশ্বরের পালা?


শান্তিনিকেতনে সভা বসেছে। যে ঘরটিতে সভা বসেছে সেটি সম্বন্ধে কেউ কেউ আলাপ করছিলেন। রবীন্দ্রনাথ হঠাৎ বলে উঠলেন- এ ঘরটিতে একটা বাঁ-দোর আছে। শুনে ঘরসুদ্ধ লোক একেবারে হতবাক। রবীন্দ্রনাথ তাদের অবস্থা দেখে মুচকি হেসে বললেন- বাঁদর নয়, আমি বাঁ-দোরের কথা বলছি। দেখছ না ঘরটির ডান দিকে একটি দরজা এবং বাঁ-দিকেও একটি দরজা।


এক সাহিত্যসভায় লেখক বনফুল অর্থাৎ বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় ভাল বক্তৃতা করেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন রবীন্দ্রনাথও। সভায় সকলে বনফুলের বক্তৃতার খুব প্রশংসা করলে রবীন্দ্রনাথ বললেন, বলাই তো ভাল বক্তৃতা দেবেই কারণ বলাই তো ওর কাজ।


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একবার মৈত্রেয়ী দেবীর আতিথ্য গ্রহণ করলেন। রোজই বিভিন্ন রকমের নিরামিষ রান্না হয়। একদিন হঠাৎ মগজ পরিবেশন করা হলে রবীন্দ্রনাথ বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, 'এ পদার্থটি কী?' মৈত্রেয়ী দেবী উত্তর দিলেন- "মগজ"। কবি দুষ্টুমি করে বললেন, "বিশ্ব কবির ‘ব্রেনে’ ঘাটতি পড়েছে, এ কথাটি সোজাসুজি বললেই হতো!”

পঠিত : ৪২২ বার

মন্তব্য: ০