Alapon

আমার ঘটক জীবন......

ছাত্রজীবনেই অর্ধ-ডজন পরিবার থেকে বিয়ের প্রস্তাব পাবার বিরল সৌভাগ্য হয়েছে আমার। এরমধ্যে ২/১ টা পেয়েছি আমার প্রাগৈতিহাসিক ঘটকালি প্রতিভার সাক্ষর রাখতে গিয়ে। দেখা গেছে, মেয়ের মা পাত্রের পরিবর্তে ঘটককে পছন্দ করে ফেলেছেন! আমার সেই ঘটকালি ক্যারিয়ারকে যখন একের পর এক ব্যর্থতায় নিদারুণ অস্তিত্বের সংকটে পড়তে দেখলাম, তখন সত্যিই উদ্বিগ্ন না হয়ে পারলাম না।


ঘটকালি সংক্রান্ত ব্যাপারে ঝেড়ে কাশার আগে একটা গল্প বলি। বিখ্যাত লেখক মার্ক টোয়েন একবার তাঁর এক সাংবাদিক বন্ধুকে বললেন, "১০ বছর লেখালেখি করার পর বুঝলাম, লেখালেখিতে আমার কোনো প্রতিভা নেই।" সাংবাদিক বন্ধুটি টোয়েনকে জিজ্ঞেস করলেন, "এটা জানার পরও লেখালেখি করে যাচ্ছো যে?" মার্ক টোয়েন উত্তর দিলেন, "উপায় কি! ততোদিনে মোটামুটি বিখ্যাত হয়ে গেছি।"


আমার অবস্থা মার্ক টোয়েনের মতোই। ক্লাস টেন থেকে ঘটকালি করছি। দীর্ঘ ৭/৮ বছর ঘটকালি করার পর আবিষ্কার করলাম, এখানে আমার প্রতিভা শুধু যে নেই তা নয়, বরং শূন্যেরও খানিকটা নিচে। লোকজন আমাকে জিজ্ঞেস করে, "ঘটকালিতে সাফল্যের হার কত?" আমি বলি, "০.০৫ ভাগ।" তারা হাসতে হাসতে বলে, "তাহলে ছেড়ে দিচ্ছো না কেন? ঝুলে থাকার মানে কি?" আমি অবিকল মার্ক টোয়েনের মতো করে বলি, "উপায় নেই। ঘটক হিসেবে আমি বিখ্যাত হয়ে গেছি।"


ঘটকালি ছেড়ে দেয়ার চেষ্টা যে এক আধবার করি নি তা কিন্তু নয়। এটি আসলে ঠান্ডা মাথার মানুষদের কাজ। আমি ঠান্ডা মাথার মানুষ নই, কখনোই ছিলাম না। দ্রুত রেগে যাবার বাজে অভ্যাস আছে আমার। প্রবল মেজাজ খারাপ করে কতবার বলে ফেলেছি, “যাহ! আর কোনো দিন ঘটকালি করবো না। ঘটকালিকে সালাম।” কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম, এই জিনিস আমার রক্তে মিশে গেছে! এই জিনিস ছেড়ে বেঁচে থাকা অসম্ভব।


লোকজন আমাকে ফোন করে পাত্র-পাত্রীর সন্ধান চায়। আমি কাউকেই নিরাশ করি না। বঙ্গবন্ধুর মতো দরাজ কণ্ঠে বলি, “ঠিক আছে। আমি দেখছি ব্যাপারটা।” সেই ‘দেখতে’ গিয়ে আমার জীবন আলুভর্তা হয়ে যায়। আমি হাসি হাসি মুখে আলুভর্তা হবার অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করে যাই। মাথায় হয়তো গানও বাজতে থাকে, “জ্বলে পুড়ে মরার মাঝে যদি কোনো সুখ থাকে, তার নাম ঘটকালি......।”


একবার খুব হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটলো। সম্বন্ধটাকে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছি। ঘটকদের একটি প্রধান দায়িত্ব হলো- ছেলে মেয়ে উভয়ের পক্ষেই ওকালতী করা। স্বর্প হয়ে দংশন করে ওঝা হয়ে ঝাড়া। আমি ওঝা হয়ে ঝাড়ার কাজটি অত্যন্ত সূচারুরুপে সম্পন্ন করে এনেছি প্রায়। এবার দেখাদেখি পর্ব। ঘটক হিসেবে উভয় পক্ষের প্রবলতম গুরুত্ব লাভ করলাম। প্রচুর খাবারও পেটে পড়লো। ছেলে পক্ষ মেয়ে দেখার পর বললো-“পছন্দ হয় নি।” সঙ্গে সঙ্গে আমার চোখে পানি চলে এলো। এই চোখের পানি কাউকে দেখানো যায় না।


আরেকবার অনেক খাটাখাটুনি করে বিয়ে ঠিকঠাকের পর্যায়ে নিয়ে আসতে পারলাম। উভয় পক্ষই মানসিকভাবে বিয়ের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। ছেলে-মেয়ে পরস্পর পরস্পরকে পছন্দ করে ফেলেছে। মনে মনে ভাবলাম, "এবার আমার সাফল্য সুনিশ্চিত।" আমি গরুর হাড় চিবানোর প্রস্তুতি নিচ্ছি; এমন অবস্থা। দেখা গেলো, বিয়ের তারিখ ঠিক করতে গিয়ে বিয়ে গেছে ভেঙ্গে!


এতো কিছুর পরও মনে হয়, ঘটক জীবন সুন্দর। মন্দ নয় তো! দুজন মানুষের স্বপ্নাতুর জীবনের সূচনা হবে আমার হাত ধরে। বর্ষণমুখর কোনো সন্ধ্যারাতে টিনের চালে বৃষ্টির রিনিঝিনি শব্দের অনুরণন শুনতে শুনতে কত না ভালোবাসাবাসির গল্প করবে তারা! তখন কি আমার কথা মনে পড়বে একটুখানি? না পড়লে না পড়ুক। "বনের পাখিরে কে চিনে রাখে, গান হলে অবসান/ চাঁদেরে কে চায়, জোছনা সবাই যাচে/গীত শেষে বীণা পড়ে থাকে ধূলি মাঝে।"

পঠিত : ৫৯৭ বার

মন্তব্য: ০