Alapon

আমার স্মৃতিতে শহীদ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ......

২০০৫ সাল। রংপুরের মিঠাপুকুর কলেজ মাঠের ঐতিহাসিক জনসভার প্রধান অতিথি তৎকালীন সমাজকল্যাণ মন্ত্রী, জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল জনাব আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ। সেই জনসভায় আমারও উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হয়েছিলো। একদম ছোট সময়ের স্মৃতি। তবুও স্মৃতিতে মদা জাগরুক হয়ে আছে। জীবনের শেষ দিন অব্দি স্মরণে রাখার মতো স্মৃতি।


বেশভূষায় অতি সাধারণ; কিন্তু পরিচ্ছন্ন, অতিশয় বাকপটু হলেও বাহুল্যবিবর্জিত, সদা কর্মচঞ্চল-চটপটে, লক্ষ্যে অবিচল, কর্মে দৃঢ় প্রত্যয়ী, প্রখর মেধা ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন, ব্যক্তিত্বে মহীরূহ, সিদ্ধান্তে আপোষহীন, ঈমানের দীপ্তিতে দীপ্তমান ও বলীয়ান একরাশভারী মানুষের বাস্তব প্রতিচ্ছবি ছিলেন শহীদ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ। এমন ক্ষণজন্মা-প্রবাদ পুরুষের আবির্ভার সচরাচর দেখা যায় না। হয়তো হয়ে থাকে নিতান্ত কালের পরিক্রমায়; কদাচিৎ। তারা আসেন ঘোর অন্ধকারে প্রদীপ জ্বালাতে; আলোকিত করতে। পালাবদলের খেলায় তারা আবারও বিদায় নেন। কর্মে, গরিমায় ও আদর্শে মানুষের মধ্যে বেঁচে থাকেন যুগ হতে যুগান্তরে। এমনই এক কালজয়ী ব্যক্তিত্ব ছিলেন শহীদ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ।


তিনি দ্বীন বিজয়ী করতে দৃঢ়প্রত্যয়ী ছিলেন এবং ন্যায়-ইনসাফের সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশকে কল্যাণ রাষ্ট্রে পরিণত করার আমৃত্যু স্বপ্ন দেখেছিলেন। আর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সেকাজে সার্থকভাবে আঞ্জাম দিয়ে গেছেন তিনি। তিনি তার স্বপ্ন বাস্তবায়নে ছিলেন আপোষহীন, নিরলস ও ক্লান্তিহীন। দ্বীন প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ের মাধ্যমে ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তির স্বপ্ন দেখতেন শহীদ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ। আর সে লক্ষ্যে তিনি পুরোপুরি সফলও হয়েছেন। তার শাহাদাত ইসলামী আন্দোলনের জন্য সাহসের বাতিঘর হিসাবে প্রেরনা যোগাবে। মূলত এটিই শহীদ মুজাহিদের সবচেয়ে বড় সফলতা।


শহীদ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ছিলেন একনিষ্ঠ দাঈ ইলাল্লাহ। তিনি আত্মভোলা মানুষকে দ্বীনে হকের প্রতি আহবান এবং আল্লাহর জমীনে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। তিনি নিজের জীবন ও দুনিয়াবি সকল লোভ-লালসার উর্দ্ধে থেকে দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। আর মু’মিনের আসল সাফল্য তো এখানেই। পবিত্র কালামে হাকীমে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন, ‘নিঃসন্দেহে আল্লাহ মু’মিনদের নিকট থেকে তাদের প্রাণ ও তাদের ধন-সম্পদকে জান্নাতের বিনিময়ে ক্রয় করে নিয়েছেন; তারা আল্লাহর পথে জিহাদ করে, যাতে তারা হত্যা করে এবং নিহত হয়ে যায়। এর (জিহাদের) দরুণ (জান্নাত প্রদানের) সত্য অঙ্গীকার করা হয়েছে তাওরাতে, ইঞ্জীলে এবং কুরআনে; আর নিজের অঙ্গীকার পালনে আল্লাহ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর অন্য কে আছে? অতএব তোমরা আনন্দ করতে থাক তোমাদের এই ক্রয় বিক্রয়ের উপর যা তোমরা সম্পাদন করেছ। আর এটা হচ্ছে মহা সাফল্য।’সূরা আত তাওবা ১১১।


যে শাহাদাতের তামান্না নিয়ে তিনি জীবনের পথচলা শুরু করেছিলেন, ফাঁসির রজ্জুকে হাসিমুখে রবণ করে নিয়ে তিনি ইসলামী আন্দোলনের নেতাকর্মীদের দেখিয়ে গেছেন যে, ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের ফাঁসীর রশীতে ভয়ের কিছু নেই বরং এমন মর্যাদার মৃত্যু সকল মুসলমানেরই কাঙ্খিত হওয়া উচিত। আর শাদাহাতের রক্ত¯œাত পথ ধরেই যুগে যুগে দ্বীনে হকের বিজয় সূচিত হয়েছে। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশও তা থেকে মোটেই আলাদা নয়।


মূলত তার এই মহান আত্মত্যাগের মাধ্যমেই ইসলামী আন্দোলনে কর্মীদের জন্য আগামী দিনের পথচলাটা সহজ হতে সহজতর হয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে ত্যাগ ও কোরবানীর তামান্না। শহীদ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ সহ শহীদানের রক্তে ইসলামী আন্দোলনের জন্য বাংলাদেশের জমীন সিক্ত ও উর্বর হয়ে ওঠেছে। তাই এই জমীনে ফসল ফলানো এবং তা ঘরে তুলে ন্যায়-ইনসাফের ভিত্তিতে দেশকে কল্যাণ রাষ্ট্রে পরিণত করার দায়িত্ব এখন আমাদের। তাই শহীদানের স্বপ্নের সমাজ বিনির্মাণ ও অসামপ্ত কাজকে সমাপ্ত করার দায়িত্ব আপনার-আমার সকলের।


মূলত শহীদরা চিরঞ্জীব। তাদের কোন মৃত্যু নেই। তারাই আল্লাহর কাছে অধিক মর্যাদাবান ব্যক্তি। আল্লাহ রাব্বুল পবিত্র কুরআনের সুরা আল বাকারার ১৫৪ নং আয়াদে ঘোষণা করেছেন, আল্লাহর পথে যারা নিহত হন তাদের তোমরা মৃত্যু বলোনা বরং তারাই হচ্ছে জীবিত। কিন্তু তোমরা তা বোঝ না। হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, “যে কোন ক্ষত আল্লাহর রাহে পৌঁছে, কিয়ামাতের দিনে ক্ষতিগ্রস্থ মুজাহিদ এমন অবস্থায় আগমন করবে যে, তার ক্ষত হতে রক্ত ঝরবে। রক্তের রং তো (বাহ্যত) রক্তের মত হবে, কিন্তু তার গন্ধ হবে কস্তুরীর মত। বুখারী, মুসলিম।


তিনি কথাবর্তায় ও সিদ্ধান্তে বেশ কুলীন প্রকৃতির হলেও অহংবোধ তাকে কোন ভাবেই স্পর্শ করতে পারেনি। যে মর্দে মু’মিন ইসলামের জন্য নিজের জীবনকে অকাতরে বিলিয়ে দিতে পারেন তার তো অহংবোধী হওয়ার কোন সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। তিনি চলনে, বলনে ও বেশ ভূষায় অতি সাধারণ হলেও বিরল ব্যক্তিত্বের অধিকারী হওয়ার কারণেই আমাদের ক্ষয়িষ্ণু সমাজের গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেন নি বরং তা থেকে তিনি নিজেকে পুরোপুরি হেফাজত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এখানেই শহীদ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের বিশেষত্ব।


দেশের একটি বৃহত্তর ইসলামী রাজনৈতিক দলের সেক্রেটারি জেনারেল ছিলেন তিনি। বিগত ৪ দলীয় জোট সরকারের আমলে তিনি সমাজকল্যাণমন্ত্রী হিসাবে সফলভাবে দায়িত্ব পালনও করেছিল। কিন্তু তার বিরোধীরা তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি বা অনিয়মের অভিযোগ তুলতে পারেন নি। ১/১১ জরুরি সরকারের সময়ে সাবেক মন্ত্রী-এমপিদের দুর্নীতির অভিযোগে দলে দলে গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু শহীদ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের বিরুদ্ধে অনেক চেষ্টা করেও কোন দুর্নীতি বা অনিয়মের অভিযোগ উত্থাপন করা সম্ভব হয়নি। এটাই শহীদ মুজাহিদের সবচেয়ে বড় সাফল্য। কিন্তু এর পরেও জরুরি সরকার তাকে গ্রেফতার করে জেলে নিয়েছিল। মিথ্যাভাবে হলেও তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনতে পারেনি।


মূলত মন্ত্রীসভা কমিটিতে উপস্থিত থাকার কথিত অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। একজন মন্ত্রী ৫ বছর মন্ত্রণালয় চালালেন অথচ তার বিরুদ্ধে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তোলা গেল না তা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে খুবই বিরল ঘটনা। আর আমাদের দেশের ক্ষয়িষ্ণু রাজনীতির প্রেক্ষাপটে তো একেবারেই নজীরবিহীন। আর সে বিরল দৃষ্টান্তই স্থাপন করে গেছেন শহীদ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী।

পঠিত : ৯৬৬ বার

মন্তব্য: ০