Alapon

"টলস্টয় নিজেই একটি পৃথিবী।"

লিও টলস্টয় আমার প্রিয় সাহিত্যিক কিভাবে হয়ে উঠেছিলেন বলতে পারি না। বেশ কিছু ছোটগল্প পড়ে আমি সত্যিই বিমুগ্ধ না হয়ে পারি নি। টলস্টয়ের লেখা “ওয়ার অ্যান্ড পিস” মাস্টারপিস একটি উপন্যাস। যা তাঁকে ইতিহাসে মহানায়কের কাতারে সমাসীন করতে উল্লেখযোগ্য ভুমিকা রেখেছে।

টলস্টয় সম্পর্কে উনিশ শতকের ব্রিটিশ কবি ও সমালোচক মেথু আর্নল্ড বলেন, "টলস্টয় শুধু এক শিল্পকর্ম নয়, বরং জীবনের একটা অংশ।" তিনি যথার্থই বলেছিলেন। টলস্টয়ের লেখাগুলোতে জীবন ও নীতিবোধ ফুটে উঠেছে। তিনি 'শিল্পের জন্য শিল্প'- এ মতবাদ বিশ্বাস করতেন না। তার মতে, সাহিত্য হবে জীবনের জন্য। মানুষের চিরায়ত কামনা ও শান্তির অন্বেষা টলস্টয়ের সাহিত্যকে অমর করে রেখেছে।

টলস্টয়ের অধিকাংশ লেখায় অবাস্তব কল্পকাহিনী অনুপস্থিত। তাকে নিয়ে বিখ্যাত রাশিয়ান লেখক ম্যাক্সিম গোর্কি বলেন, "টলস্টয় নিজেই একটি পৃথিবী।" শুধু রুশ সাহিত্যের ইতিহাসে অন্যতম সেরা লেখকই নয়, বরং বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক ও সাহিত্যক হিসেবে বিবেচনা করা হয় তাকে। সাহিত্যমান ও লেখার বিচারে তার সমকক্ষ সাহিত্যিক খুব কমই দেখেছে বিশ্ব।

বিশ্বসাহিত্যের বিস্ময় এই ক্ষণজন্মা মানুষটির জন্ম ১৮২৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর (২৮ আগস্ট, পুরাতন ক্যালেন্ডার অনুযায়ী); রাশিয়ান সাম্রাজ্যের টুলা প্রদেশের ইয়াস্নায়া পলিয়ানার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। ইয়াস্নায়া পলিয়ানা রাশিয়ার রাজধানী শহর মস্কো থেকে ১৩০ মাইল দক্ষিণে অবস্থিত, যেখানে টলস্টয় তার জীবনের সেরা সময়গুলো কাটিয়েছেন এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যকর্ম রচনা করেছেন।


তার পুরো নাম কাউন্ট লেভ (লিও) নিকোলায়েভিচ টলস্টয় । বাবা ও মা উভয় দিক থেকেই তিনি ছিলেন খাঁটি অভিজাত পরিবারের বংশধর। বাবা কাউন্ট নিকোলাই ইলিচ টলস্টয় ছিলেন বিশাল জমিদারির মালিক। টলস্টয় ছিলেন পিতা-মাতার চার সন্তানের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ। দুর্ভাগ্যবশত তার জন্মের দুই বছর পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই ১৮৩০ সালে তার মা মৃত্যুবরণ করেন। মায়ের মৃত্যুর পর তার দেখাশোনার ভার ছিল তার ফুফু আলেকজান্দ্রার উপর।


টলস্টয়ের প্রথম জীবনটা শুধু হারানোর মধ্য দিয়েই গিয়েছে। এ সময়ে তিনি একের পর এক তার অভিভাবকদের হারাতে থাকেন। ১৮৩০ সালে মায়ের মৃত্যুর কয়েক বছর পর ১৮৩৭ সালে তার বাবাও মৃত্যুবরণ করেন। বাবার মৃত্যুর এক বছর যেতে না যেতেই তার দাদীও দেহত্যাগ করেন এবং ১৮৪১ সালে তার অভিভাবক ও ফুফু আলেকজান্দ্রা মৃত্যুবরণ করেন। এরপর তিনি আরেক ফুফুর অভিভাবকত্ব গ্রহণ করেন, তিনি থাকতেন কাজান শহরে। ফুফু টলস্টয়কে নিজের সাথে কাজানে নিয়ে গেলেন।


ফরাসি ও জার্মান গৃহশিক্ষকের মাধ্যমে বাড়িতেই প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করেন তিনি। পরবর্তী সময়ে তার ফুফুর সাথে কাজানে থাকাকালে তিনি কাজান বিশ্ববিদ্যালয়ে অরিয়েন্টাল ল্যাঙ্গুয়েজ কোর্সে ভর্তি হন, কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখায় বরাবরই অমনোযোগী ছিলেন। বছর শেষে যা হবার, তা-ই হলো, খারাপ করলেন পরীক্ষায়। ফলাফল খারাপ হবার জন্য তাকে তুলনামূলক সহজ, আইন অনুষদে স্থানান্তরিত করা হয় । সেখানেও একই অবস্থা, পড়ালেখা অমনোযোগ।


আইন অনুষদে পড়ার সময় তিনি ফরাসি রাজনৈতিক দার্শনিক মন্টেস্কুর দ্য 'স্পিরিট অভ লজ' এবং ক্যাথরিন দ্য গ্রেটের 'নাকাজ' (আইনের কোডের নির্দেশাবলি) এর উপর একটি তুলনামূলক লেখা লিখেছিলেন। এ সময় তিনি সাহিত্য ও নীতিশাস্ত্রের উপর আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তিনি ইংরেজ সাহিত্যিক লরেন্স স্টার্ন এবং চার্লস ডিকেন্সের সাহিত্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। এ সময় বিশেষ করে তিনি ফরাসি দার্শনিক জাঁ জ্যাক রুশোর লেখার প্রতি আগ্রহ অনুভব করেন। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখায় তিনি মনোযোগী ছিলেন না। অবশেষে কোনো ডিগ্রি ছাড়াই ১৮৪৭ সালে কাজান বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করেন।


বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার পর তিনি জন্মস্থান ইয়াস্নায়া পলিয়ানায় ফিরে আসেন। সেখানে তার বাবার বিশাল জমিদারি ছিল। সেখানে তিনি গ্রামের কৃষকদের সাথে কৃষিকাজ করার মনস্থির করেন। কিন্তু সেখানেও ভালো করতে পারেননি। এমতাবস্থায় তার সেনা কর্মকর্তা বড় ভাই নিকোলাই কোনো এক ছুটিতে বাড়িতে আসেন আর তাকে দেখে সেনাবাহিনীতে ভর্তি করে দেওয়ার কথা ভাবেন।


টলস্টয়কে বলার পর তিনিও রাজি হয়ে যান এবং ভাইয়ের সাথে ককেশাসের উদ্দেশে যাত্রা করেন। ককেশাসে তিনি কয়েক বছর সৈনিক হিসেবে কাটান। তার ককেশাসে কাটানো সময়ের অভিজ্ঞতার আলোকে পরবর্তী সময়ে তিনি লিখে ফেলেন তার জীবনের অন্যতম সাহিত্যকর্ম 'ককেশাসের বন্দী ও কসাক'।


একদিকে চলছে সৈনিক জীবন, সেই সঙ্গে সাহিত্যকর্মও চালিয়ে যেতে থাকলেন টলস্টয়। ককেসাসে থাকা অবস্থায় তিনি নিজের আত্মজীবনীমূলক ট্রিলজি উপন্যাসের কাজ শুরু করেন। কয়েকমাস পর শেষ করলেন আত্মজীবনীমূলক উপন্যাসের প্রথম পর্ব 'শৈশব'। সেখানে তিনি মূলত তার শৈশবের স্মৃতিচারণ করেন।


স্থানীয় একটি পত্রিকায় পাঠিয়ে দিলেন লেখাটি। পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন নেক্রাসভ নামের এক ভদ্রলোক। কয়েকমাস পর 'শৈশব' পড়ে তিনি মুগ্ধ হয়েছেন বলে টলস্টয়কে চিঠি লিখেন। সম্পাদকের প্রশংসায় উৎসাহিত হয়ে শুরু করে দিলেন উপন্যাসের দ্বিতীয় পর্ব 'কৈশোর'।


ইতিমধ্যে ক্রিমিয়ার যুদ্ধ শুরু হয়েছে। ১৮৫৪ সালের নভেম্বরে যুবক সৈনিক টলস্টয়কে ককেশাস থেকে পাঠানো হলো ক্রিমিয়ার সেভাস্তপোলে। সেখানে তিনি ক্রিমিয়ার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ক্রিমিয়ার যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে টলস্টয় বিহ্বল হয়ে পড়েন। যুদ্ধের সহিংসতা দেখে যত দ্রুত সম্ভব তিনি সেনাবাহিনী ছাড়তে চান। যুদ্ধ শেষ হতে না হতেই তিনি সেনাবাহিনী থেকে ইস্তফা দেন।

সেনাবাহিনী ছাড়ার পর তিনি সেন্ট পিটার্সবার্গে চলে গেলেন। কিছুদিন সেখানে থেকে কয়েকটি সাহিত্যকর্ম রচনা করেন। তারপর সেখান থেকে আবার নিজের জমিদারি ইয়াস্নায়া পলিয়ানায় ফিরে গেলেন। সেখানে শুরু করলেন আত্মজীবনীমূলক উপন্যাসের তৃতীয় পর্ব 'যৌবন'। তার এই আত্মজীবনীমূলক ট্রিলজি (শৈশব, কৈশোর ও যৌবন) উপন্যাস তার জীবনের এক জীবন্ত চিত্র। সেখানে তিনি তার শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের স্মৃতিচারণ করেছেন।


ইয়াস্নায়া পলিয়ানায় কিছুদিন জমিদারি দেখাশোনা করার পর স্থির করলেন ইউরোপ ভ্রমণ করবেন। ইউরোপ ভ্রমণের উদ্দেশ্যে প্রথমেই গেলেন তৎকালীন ইউরোপের সংস্কৃতির কেন্দ্রস্থল প্যারিসে। প্যারিস ভ্রমণ শেষে গেলেন সুইজারল্যান্ডের জেনেভায়। জেনেভায় কয়েকদিন থাকার পর ফিরে এলেন রাশিয়ার মস্কোতে। কিছুদিন পর এক ডাক্তারের মেয়ে সোফিয়াকে বিয়ে করেন টলস্টয়।


টলস্টয় সোফিয়ার সাথে ইয়াস্নায়া পলিয়ানায় নিজের জমিদারিতে বাস করতে শুরু করেন। পরবর্তীতে এই দম্পতি ১৩ সন্তানের জন্ম দেন । ভ্রমণ ও বিবাহ শেষে এবার আবারও সাহিত্য সাধনায় মনোযোগী হয়ে ওঠেন তিনি। ১৮৬৩ সালে প্রকাশিত হয় উপন্যাসিকা 'কসাক'। কসাক রাশিয়ায় জনপ্রিয় হয় এবং টলস্টয় জনপ্রিয় সাহিত্যিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।


এরপর শুরু করলেন তার বিখ্যাত উপন্যাস 'ওয়ার এন্ড পিস'। উপন্যাসটি ১৮৬৫ থেকে ১৮৬৭ সালে পর্যন্ত সিরিয়াল আকারে 'দ্য রাশিয়ান মেসেঞ্জার' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এরপর ১৮৬৯ সালে দীর্ঘ পাঁচ বছরের কঠোর সাধনার ফলশ্রুতিতে একত্রে বই আকারে প্রকাশিত হয়। প্রকাশের সাথে সাথেই এটি পাঠক ও সমালোচকদের প্রশংসা পেতে থাকে। এই উপন্যাসের মাধ্যমে টলস্টয় খ্যাতির শীর্ষে আরোহণ করেন।


উপন্যাসটি ১৮০৫ থেকে ১৮১৩ সাল পর্যন্ত রাশিয়ার সমাজের বিভিন্ন পটভূমিতে লেখা। বারো শতাধিক পৃষ্ঠা এবং ছয় শতাধিক চরিত্র নিয়ে বিশ্ব সাহিত্যের ইতিহাসে অমর এক সাহিত্যকর্ম হিসেবে অধিষ্ঠিত হয়ে আছে এটি। এই উপন্যাসের প্রভাব এতটাই বেশি যে এটি অবলম্বনে অনেকগুলো সিনেমা ও টিভি সিরিজ তৈরি হয়েছে।


উনিশ শতকের শুরুতে ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ান বোনাপার্টের রাশিয়া আক্রমণ ও এর পরিপ্রেক্ষিতে পাঁচটি অভিজাত রাশিয়ান পরিবারের মধ্যে ভাঙা-গড়ার যে খেলা তারই কাহিনী এই উপন্যাস। ইতিহাসের সাথে কল্পনার সংযোগে এক কালজয়ী সাহিত্যে পরিণত হয় ওয়ার এন্ড পিস।

পঠিত : ৬৩৫ বার

মন্তব্য: ০