Alapon

||আনন্দাশ্রু||



১. সোহান বরাবরই প্রকৃতি প্রেমি। পাহাড়ি ঝরণাধারা, সমুদ্রের স্রোতধারা, পাখির নীড়ে ফেরা, নদীর কলতান–তার বরাবরই ভালো লাগে। নিজেকে নিমগ্ন রাখে প্রকৃতির এতোসব রূপের গহীন অরণ্যে....


শীতকালটা অনেকের কাছে বিরক্তিকর ঠেকলেও তার কাছে অনেক ভালো লাগে। এমন সময় বিন্দু বিন্দু শিশির জমে থাকে গাছের পাতায়, ঘাসের ডগায়, টিনের চালে।

অতিথি পাখির আগমনে এদেশের সৌন্দর্যকে আরো বিকশিত করে তোলে। এই যে শীতের অতিথি পাখিদের আগমনের মিছিল –সে মিছিল দেখে নিজেকে, নিজের মনের চোখকে মাতিয়ে রাখে সোহান । পাখিদের ডানা মেলে ওড়াউড়ির মতোই তখন তার মনের মাঝে আনন্দের মিছিল ওড়াউড়ি করে।

কিন্তু এবার আর আগের মতো শীতের পাখি আসছে না এদেশে। চারদিকে ক্যামন এক অদ্ভুত মৌনতা। হবেই না বা ক্যান–কারণ পাখিদেরকে শিকার করে নিজেদের উদগ্র খায়েশের বন্দনা করতে এখানের মানুষগুলো বড্ড ব্যাকুল! তাই আর অতো পাখি আসছে না।


নিজ গ্রামের পাশ কাটিয়ে সোহান গেলো সুদূর কাঞ্চন নগরে। এই কাঞ্চন নগরে তার ফুফুর বাড়ি। এবার এখানেই ঝাঁকে ঝাঁকে অথিতি পাখি আগমন করছে এবার। প্রতিদিন পাখির কলকাকলিতে মুগ্ধ হতে অনেকদিন থেকেই এখানে মানে তার ফুফুর বাড়ি রয়েছে সোহান।

অসংখ্য পাখির ভীড়ে এক-জোড়া পাখিকে তার অসাধারণ ভালো লাগে। হিজল গাছের মগডালে তারা বাসা বেঁধেছে। তাদের কিচিরমিচির শব্দে তার মনে এক অনিন্দ্য আনন্দের দ্যোতনা সৃষ্টি করে। এরা একসাথে সকালে বের হয়ে পড়ে। আবার সন্ধ্যে হলে ফিরে আসে। সকালে তাদের খুনসুটি দেখে দিন শুরু করে আর শেষ বিকেলে সূর্যের লালিমায় পাখিদের নীড়ে ফেরার পরের মধুর খুঁনসুটিতে সে দারুণ বিমুগ্ধ হয়। পাখিদ্বয়ের মান-অভিমান আর মৃদু ঝগড়াঝাটিময় ডাকাডাকির যে মধুর গুঞ্জন ধ্বনি -সে ধ্বনি তার হৃদয়ের ইথারে ইথারে আনন্দের আলোড়ন তোলে। প্রশান্তির ঢেউ উঠায়। কখনো কখনো একজন অসুস্থ হলে অন্যজন হালকা খাবার ঠোঁটের ডগায় করে তার সঙ্গীর জন্যে নিয়ে আসে।

তার ফুফাতো ভাই রাসেলকে নিয়ে তাই প্রতিদিন সকাল-সাঁজে আসে এখানটায়।

পাখিদ্বয়ের এমন মিষ্টি প্রেমের মাদকতায় নিজের অতীত স্মৃতি রোমন্থন করে বেড়ায় সোহান। আগে সে-ও এই হিজল বনে এসে হিজল গাছের ছায়ায় বসে হিজল ফুলের মালা তৈরি করে সেই মালা গেঁথে দিতো তার প্রিয়তমার চুলের খোঁপায়। নিয়তির নির্মমতায় সেই সুযোগ আর এখন সে পাচ্ছে না। তার বুক জুড়ে হারানোর যেই এক নিঠুর যন্ত্রণা আছে তা সে পাখিদের এই জুটিকে দেখে নির্বাপিত করার চেষ্টা করে। তাদের এমন মায়াবী বন্ধন তার মনে সৃষ্টি করে প্রশান্তির হিন্দোল। কিছু সময় হলেও সে ভুলে থাকতে পারে হারানোর বেদনা। নিজের প্রিয়তমাকে হারাবার পীড়নটা সে পাখিদের এই জুটিকে দেখে কিছুক্ষণ সময়ের জন্য হলেও ভুলে যায়। সে মনে মনে প্রশান্তি পায় এই ভেবে- সবাই হারায় না। কেউ কেউ পায়ও....

২. আজকে দিন গিয়ে সন্ধ্যা এলো। দিনের আলো ম্লান হয়ে রাতের আঁধারের আবরণ ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। সারাদিন, সারা বিকেল, সারা সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত এলেও একটা পাখি নীড়ে ফেরার কোনো নামগন্ধ নেই। সঙ্গী পাখিটা ভীষন চেঁচাচ্ছে। তার চিৎকার চেঁচামেচিতে আশপাশ একাকার করে ফেলছে।

রাতে কেটে সকাল হলো, ফিরলো না পাখিটি। তার সঙ্গীর চেঁচানো কান্নায় হিজল গাছের প্রতিটি ডাল-পাতা-ফুলও যেনো কান্না করছে। চারদিকে যেনো বেদনার বাতাস ওড়াউড়ি করছে।

সঙ্গীহারা পাখিটার অসহ্য যন্ত্রণার যে আহাজারি, সেই আহজারি সোহানের বুকে এসে যেনো শূলের মতো বিদ্ধ হচ্ছে। তারও কলিজাটা যেনো ছিঁড়ে একাকার হয়ে যাচ্ছে। সে বুঝতে পারে পাখিটার সঙ্গী হারানোর যন্ত্রণা। বুকে খঞ্জর দিয়ে আঘাতের পর আঘাত করলেও এতোটা কষ্ট হয় না যতোটা প্রিয়তম বা প্রিয়তমাকে হারানোর যন্ত্রণায় হয়। সঙ্গী হারানোর যন্ত্রণায় ছটফট করছে পাখিটি। সোহানও জীবনে সেই যে এক কঠিন যন্ত্রণা, নিঠুর বেদনা –সেই বেদনার বাতাসের ছোঁয়া পেয়েছে। তাই সে বুঝতে পারে সব। কেউ কিছু মুখ খুলে বলা লাগে না। পাখিরা তো আর মানুষের কাছে খুলে বলতে পারেনা। কিন্তু পাখিরা পাখিদের বাসা বুঝে। আর বুঝে যাদের সত্যিকারের হৃদয় আছে। কিন্তু হৃদয়হীন মানুষগুলো তা বুঝে না।পাষাণ পাথর দিলের অধিকারী কোনো বনী আদম এসব বুঝতে অক্ষম।


হিজল গাছটায় পাখিদের ঝাঁক। একে একে সব পাখিরা সঙ্গীহারা পাখিটিকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। তাদের এক বন্ধুর সঙ্গী খুঁজতে খুঁজতে অস্থির সকলেই। কোনো কোনো পাখি আবার তাকে আহার এনে দিচ্ছে। কিন্তু সে খাচ্ছে না। ক্রন্দন করেই যাচ্ছে অবিরত। কারো বুকে যদি শূন্যতার সৃষ্টি হয় তখন আর পেটের শূন্যতার দিকে খেয়াল থাকে না। কিছু খেতেও পারে না। সে-ও পারছে না। ইচ্ছে হয় না। একেবারে বেদনায় মুষড়ে পড়েছে পাখিটি। স্তব্ধ হয়ে রয়েছে সে। চারিদিকে তার বন্ধু-বান্ধবরা কতো কতো বুঝ যে দিচ্ছে। বুঝানোর চেষ্টা করছে -কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। কোনো বুঝই সে মানছে না। থোকায় থোকায় খাবার পড়ে আছে তার সামনে। সে খাচ্ছে না। বেদনা ভরা বুকে হিরে-মতি-পান্নাও কোনো মূল্য পায় না। প্রিয়জনের কাছে তাবৎ দুনিয়ার সব সম্পদই মূল্যহীন।


৩. অসহ্য বেদনায় দিনরাত পাখিটির ডাকাডাকি চলছেই। সোহানকে সেই ডাক একেবারে পাগল করে দিচ্ছে। রাত কেটে ভোর আসার সাথে সাথেই সোহান রাসেল কে সঙ্গে নিয়ে হারিয়ে যাওয়া পাখিটির খোঁজে নামলো। খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে যায় গাঁয়ের দুষ্ট ছেলেদের হাতে। তারা পাখিটিকে বন্দী করে খেলাধুলা করছে। সোহান আর রাসেল তাদের বুঝিয়ে শুনিয়ে তাদের থেকে পাখিটিকে মুক্তি করে নিয়ে এলো। একটু বেঁকে বসলে রাসেল বলে ওঠে -আজ যদি তোমার মায়ের কোল থেকে তোমাদের কেউ নিয়ে যায়? কিংবা তোমাদের বাবার কাছ থেকে তোমাদের মাকে কেউ এভাবে এমন করে ধরে নিয়ে যায় -তখন ক্যামন লাগবে বলো তো?

প্রশ্ন দুটো তাদের হৃদয়-কোণে এসেও আছড়ে পড়লো। বোধের দরোজা তাদের আলগা হলো। ফিরিয়ে দিলো তারা পাখিটিকে।

পাখিটিকে এনে হিজল গাছের ছায়ায় ছেড়ে দিলো সোহান।পাখিটি গগনবিদারী আনন্দ-উচ্ছ্বাস ভরা ডাক দিয়ে হাজির হলো তার নিজের বাসায়, সঙ্গীর কাছে। একে অপরকে পেয়ে যেনো শুকনো মরুভূমির বুকে একপশলা বৃষ্টি পেলো। বুকের শুকনো মরুভূমিটা ভিজে সতেজ হয়ে ওঠেছে তাদের উভয়ের ।

প্রাপ্তির আনন্দে উচ্ছল হয়ে যায় দুজনের চোখ। বনের পাখিরা কৌতূহল দৃষ্টি জুড়ে দিলো মাটির বুকে। সেখানে দুজন মানব সন্তান সোহান ও রাসেলকে দেখতে পায়। পাখিরা দল বেঁধে নেমে এসেছে তাদের কাছে। পাখা ঝাপটিয়ে অভিনন্দন আর কৃতজ্ঞতা জানান দিচ্ছে সকলেই। হারানো দুই সঙ্গী এসে সোহানের নাক, মুখ ও চুলে ঠোঁট দিয়ে আদর বুলিয়ে ভালোবাসা আর কৃতজ্ঞতার জানান দিচ্ছে। সেই আনন্দঘন দৃশ্য দেখে রাসেলেরও চোখের কোনে বিন্দু বিন্দু জল জমে যায়।

এদিকে সোহানের কাঁদে পাখিদ্বয়ের চোখের অঝোর অশ্রুপাতে তারও দু'গন্ড বেয়ে বেয়ে ঝরে পড়ছে আনন্দাশ্রু। সোহানের স্বপ্ন ভঙ্গের কান্নার সাথে পরিচয় থাকলেও প্রাপ্তির মাঝেও যে অশ্রু থাকে সেটা জানা ছিলো না। আজ তা সে স্বচক্ষে দেখছে, উপলব্ধি করতে পারছে। সে বুঝতে চেষ্টা করে ফিরে পাবার আনন্দ কতোটা গাঢ় হতে পারে।

আনন্দেও অশ্রু থাকে- আগে এই কথাটা লোকমুখে শুনলেও সোহান আর রাসেল আজ তার প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী। সোহানের চোখ বেয়ে বেয়ে ঝরে পড়া অশ্রুগুলো রাসেল পকেট থেকে একটা টিস্যু নিয়ে মুছে দিচ্ছে। পাখির দল তাদের চরণে কৃতজ্ঞতার সুমহান সম্ভার ঢেলে দিয়ে তাদের থেকে একে একে বিদেয় হচ্ছে.....


||আনন্দাশ্রু||
~রেদওয়ান রাওয়াহা

পঠিত : ৫৫৩ বার

মন্তব্য: ০