গল্প : বেদনার অশ্রু
তারিখঃ ২৮ নভেম্বর, ২০২০, ১৪:৫১
শেষ বারের মতো বাবার পাশে দাঁড়িয়ে দু'নয়ন ভরে প্রিয় বাবার মায়াভরা মুখখানি দেখছে ফারিহা। দরদর করে অশ্রুপাত হচ্ছে। সেই অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে দুগণ্ড বেয়ে। এই মানুষটাই ছিলো তাদের বিশ্বাস, আস্থা, ভরসা আর ভালোবাসার কেন্দ্রবিন্দু। আজ থেকে তিনি আর পাশে থাকবেন না। সন্ধ্যে বাড়ি ফেরার সময় ফুচকা বাদাম চকোলেট নিয়ে আসবেন না। ‘মামনি’ আমার! কোনো চিন্তা নেই বলে মাথায় হাত বুলিয়েও দেবে না।
ফারিহার পাশেই তার ছোটো ছোটো ভাই-বোনগুলো অশ্রুর নোনাজলে সিক্ত করছে তাদের আঁখিদ্বয়! হাউমাউ করে বাবা বাবা স্বরে চিৎকার করে কাঁদছে....
সেদিন থেকেই ফারিহার নতুন জীবনে পদার্পণ। নিজের কান্নাকে চেপে রেখে ছোটো ভাই-বোনদের সান্ত্বনা দিতে হচ্ছে। অথচ তাকেই প্রতিদিন তার বাবা কতো শতো বিষয়ের জন্য সান্ত্বনা দিতে হতো, অশ্রুও মুছে দিতেন। আজ তাকেই নিতে হচ্ছে অশ্রু মোছার দায়িত্ব....
নিজের পড়াশোনা, ছোটো ভাইবোনদের দেখাশোনা -সবই তো বাবা করতো। আজ বাবা নামক ছাতাটা নেই। জীবনের মানে হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যাচ্ছে আজ! যেকোনো মূল্যেই কিছু একটা করতে হবে। জীবনের তাগিদে জীবিকার সন্ধানে নামতে হবে। কিন্তু এসমাজে কি নারীদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা আছে? ভেবে কুল পাচ্ছে না ফারিহা! কী করবে, কোথায় যাবে!
২. নিজের যাই হোক, কিন্তু ভাইবোনদের পড়াশোনায় সে ব্যাঘাত ঘটাতে চাচ্ছে না। ফারিহা টুকটাক সেলাইয়ের কাজ পারে। গ্রামের হাসন আলী মাতুব্বর একটা সেলাই মেশিন কিনে দিয়েছেন। এখন টুকটাক এই সেলাইয়ের কাজই করে সে। যা উপার্জন হয় তা দিয়ে চলা খুবই মুশকিল। তাই বাধ্য হয়ে দুটো টিউশনি করতে হচ্ছে। প্রতিদিন আসা যাওয়ার মাঝে বখাটেদের নানাবিধ কটুকথায় হৃদয় রক্তাক্ত হয়। এই রক্তক্ষরণ কাউকে দেখাতে পারে না। বাবার কাছে তো সব বলা যেতো। আজ বাবাও নেই। আর বাবা থাকলে এমন পরিস্থিতিতে পড়তেও হতো না।
হাসন আলী তাকে টিউশনি বন্ধ করে দিতে বললো। টিউশনি করে যা আয় হয় সে-ই টাকা তিনি নিজেই দিবেন।
৩
এখন প্রায় দিনই হাসন আলী মাতুব্বর সন্ধ্যায় তাদের ঘরে আসে। দীর্ঘক্ষণ সময় কাটায়। আজো এসেছে। চোখজোড়ায় এক অদ্ভুত দৃষ্টি এলোমেলো হয়ে ঘুরে তার। পিতৃতুল্য একজন বয়স্ক ব্যক্তির এমন চাহনি ফারিহার কাছে বিব্রতকর লাগছে। কিন্তু কিছু বলাও যাচ্ছে না। নিজেকে যতোই সেইফে রাখতে চায়, লোকটা ততোই কেমন যেনো কাছে ঘেঁষতে চায়! ফারিহার মাথা এলোমেলো। মগজ ভনভন করছে। কিছু ভাবতে পারছে না! ভিন্ন রকমের একটা মুচকি হাসি দিয়ে লোকটা আজকের মতো চলে যায়। যাবার সময একটা খামে কিছু টাকাও দিয়ে যায়।
চোখ দুটো ছলছল করছে ফারিহার! ছোটো ভাইটা কাছে এসে জিজ্ঞেস করে ‘‘বুবু কী হইছে তোমার! তুমি হাসছো না ক্যান’’ ? প্রশ্নটা শুনেই ছলছল চোখে ফিক করে হেসে দেয় সে……
গভীর রজনী। নিস্তব্ধ চারদিক। নিস্তব্ধতার মাঝেও কিন্তু এক অনিন্দ্য সৌন্দর্য লুকানো থাকে। ফারিহা সেই সৌন্দর্য খুঁজে পায় না। চিন্তার মধ্যে ডুবে থাকে সারারাত। সিদ্ধান্ত নেয়; মাতুব্বরের থেকে আর কোনো টাকা নেবে না। সেলাই মেশিনটার টাকাও ফেরত দেবে। নিজের যোগ্যতা দিয়েই কিছু করতে হবে। তার কাছে এমনিতেই অনেক ঋণী হয়ে গেছে। আর এই দুর্বলতাটাকেই কাজে লাগিয়ে মাতুব্বর তার উদগ্র বাসনা চরিতার্থ করার চিন্তায় বিভোর!
৪. আনোয়ারুল কবির টিভি টকশোতে, পত্রিকার পাতায় নারীর প্রতি সম্মান, নারীকে যথাযথ মর্যদা আর নারী পুরুষের সমতা নিয়ে অনেক সুন্দর সুন্দর কথা বলেন। তার একটা এনজিও প্রতিষ্ঠানও আছে। অসহায় নারীদের সেখানে অগ্রাধিকার দেয়া হয়। ফারিহা ফাইলপত্র নিয়ে সেই অফিসে গিয়েছে। আনোয়ারুল কবির তাকে বৃহস্পতিবার বাসায় দেখা করতে বলে।
বৃহস্পতিবার যথারীতি ফারিহা তার বাসায় হাজির। খোঁজ-খবর নিয়ে একপর্যায়ে কবির সাহেব এক অদ্ভুত আবেদন করে বসে। ফারিহার চোখ দুটো যেনো আঁধারে ঢেকে যায়। পৃথিবীর মানুষের ওপর একরাশ ঘৃণা চলে আসে। এখানে কেউ সাধু না। সাধুবাদিতার ভান করে। নিজের খায়েশের গোলামীর জিঞ্জিরে আবদ্ধ সকলেই। পৃথিবীর মানুষের ভেতরের এতো নগ্নতা সে টের পায় নি আগে। এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। কী করবে ভেবে পায় না! লোভনীয় বেতন। আবার নিজের ইজ্জত, সংসারের দায়িত্বের চিন্তা তাকে দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছে ভেতর ভেতর। সে ভাবে - নিজের সন্তান সংসার সব থাকার পরেও নারীত্বই যাদের প্রথম এবং প্রধান খায়েশ - তা হলে মুখোশ পরে দৃষ্টি আকর্ষণ করে মানুষের দুর্বলতায় আঘাত হানবার কী প্রয়োজন!
ভাবনায় কিছু আসছে না,চুপচাপ ভাবে - নারীদের জন্য পৃথিবী এতোটা সংকীর্ণ ক্যান! বাবার বয়সী বৃদ্ধপ্রায় মানুষদের কাছেও কন্যাতূল্য একটা নারী সম্মান বজায় রেখে চাকুরী, কর্ম ও পড়াশোনা চালিয়ে সমাজে চলতে পারবে না ক্যান! ক্যান এতো অসহায় নারী? টুপ করে কয়েক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো মুখে। এই দুঃসহ যাতনার অশ্রু কেউ মুছে দিতে আসবে না। নিজেই নিজের অশ্রু মোছবার দায়িত্ব পালন করতে হবে। বেদনার অশ্রু মুছতে মুছতে চলে আসে আপন নীড়ে...
||গল্প : বেদনার অশ্রু||
~রেদওয়ান রাওয়াহা

মন্তব্য: ০