Alapon

ডাকার মতো ডাকলেন তিনি...




উদ্দেশ্য যদি সঠিক হয়।
মন যদি সুন্দর হয়।
নিয়্যাতের মাঝে যদি শুদ্ধতার ফুল থাকে

-তা হলে আমার আল্লাহ ফিরিয়ে দেয় না। তিনি তাঁর বান্দার বিচ্যুতিগুলো ক্ষমা করে দেন।

আল্লাহর কাছে সিজদাহ্'তে পড়ে, দীর্ঘ সিজদাহ্ দিয়ে মনের আকুতি তুলে ধরলে তিনি ফিরিয়ে দেয় না। দিতে পারেন না!


তিনিই তো আমাদের প্রাপ্তির জায়গা, আমাদের প্রশান্তির প্রণোদনা। আমার এবং আমাদের সাহসের প্রবর্তনা তো আমার প্রিয় রব্বুল আলামীনই!
সেই তিনি কীভাবে আমাদের ফিরিয়ে দিবেন......!!

তাঁর কাছে চাইলে তিনি ফিরিয়ে দেয় না!
পরিশুদ্ধ অন্তর নিয়ে তাঁর কাছে চাইলে তিনি তা গ্রহণ করেন। তিনি তা কবুল করেন। আমরা হয়তো তাঁর কাছে চাওয়ার মতো চাইতে পারি না! বলার মতো বলতে পারি না....

চাওয়ার মতো চাইতে পারলে আমাদের রব্ব আমাদের ফিরিয়ে দেয় না। তিনি তো দয়ার সাগর। মায়ার মহাসাগর! তিনি তাঁর মায়া থেকে আমাদের বঞ্চিত করবেন না! করেন না....

ডাকার মতো ডাকতে পারলে, চাওয়ার মতো চাইতে পারলে তিনি সাড়া দিবেনই! যেভাবে চেয়েছে চরম বার্ধ্যক্যের সময়ও যাকারিয়া আলাইহিস সালাম। তিনি আমার আল্লাহর কাছে হৃদয়ের সবটুকুন ভালোবাসা আর আবেগ মিশিয়ে বলেছেন -" হে আমার রব্ব! আমি তো তোমাকে ডেকে কখনোই ব্যর্থ হইনি!" (সুরা মারইয়াম : ০৪)


আচ্ছা যেহেতু যাকারিয়্যা আলাইহিসালাম সালামের কথা চলেই আসছে তাহলে তাঁর গল্পটা আমরা শুনেই আসি, নাকি? আল্লাহর কাছে চাওয়ার গল্প। আল্লাহকে ডাকার গল্প। সেই চাওয়া আর ডাকায় আল্লাহর সাড়া দেয়ার গল্প...

চলুন তা হলে গল্পটা শুরু করি,

আল্লাহর নবী যাকারিয়্যা আলাইহিসসালাম। তিনি কাঠ-মিস্ত্রির কাজ করতেন। নিজের জীবনের জীবিকা নিজেই নির্বাহ করতেন। সকল নবী-রাসুল-ই নিজের জীবিকা অর্জনের জন্য বিভিন্ন হালাল পেশা অবলম্বন করতেন। তারা কখনো অপরের জন্য বোঝা হতেন না। হন নি যাকারিয়্যা আলাইহিস সালামও। বার্ধ্যকে তার চুলগুলো ধবধবে সাদা হয়ে গিয়েছে। শরীর ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়েছে। মৃত্যু পদযাত্রী তিনি। অথচ একজন সন্তানও নেই। সন্তান হবার কোনো সুযোগও নেই। সম্ভাবনাও নেই...


কারণ, ওনার প্রিয়তমা জীবন সাথীও যৌবনকাল থেকেই বন্ধ্যা! আর এখন তো বার্ধক্যের করালগ্রাসে আগ্রাসিত । ভরাট যৌবনে পড়েছে ভাটা।
আবার তিনি নিজেও তো খুনখুনে বুড়ো। শরীরের মাঝে আর যৌবনের সতেজতা নেই। সজীবতা নেই। উদ্যোমী যৌবনের যে শক্তি, সেই শক্তির প্রকটতা নেই। প্রখরতা নেই...

তাঁর যে নিজস্ব কোনো উত্তরাধিকারী নেই। ওয়ারিশ নেই -বিষয়টা ওনাকে ভাবায়। ভীষণ ভাবায়। মাঝেমধ্যে সেই ভাবনার বিষন্নতার কালো মেঘে চেয়ে যায় তাঁর মনের বাগান। আল্লাহর কাছে উত্তারাধিকারী চান তিনি। বিনয়ী হয়ে। গোপনে গোপনে।[ সুরা মারিয়াম:০২]

এই যে উত্তরাধিকারী চাওয়াটা, এটা কোনো সম্পদের উত্তরাধিকারী নয়। নয় প্রাচুর্যের উত্তরাধিকারী। তাঁর উত্তরাধিকারিত্বের চাওয়ার মানে হলো নবুওয়াত-রিসালাতের তথা সত্যের পয়গাম পৌঁছে দিবার উত্তরাধিকার।


ওনার তো আর্থিক উত্তরাধিকারিত্ব চাওয়ার প্রশ্নই আসে না। কারণ তাঁর কাছে কোনো জাগতিক সম্পদ ছিলো না। তিনি তো ছিলেন কাঠমিস্ত্রী। একজন কাঠমিস্ত্রী কতোটুকুন সম্পদই বা আহরণ করতে পারেন! কী'বা জমা করতে পারেন! আর একজন নবি প্রাচুর্যের প্রখরতায় মজে থাকবেন, সীমাহীন সম্পদের সাগরে ডুবে থাকবেন- তা তো হতেই পারে না। এবং সে-সব কার কাছে দিয়ে যাবেন, কিংবা কে হবে সে-সবের উত্তারাধিকারী --একজন নবীর এমন চিন্তা করার তো প্রশ্নই আসে না!


আর আল্লাহর রাসুল সল্লাল্লাহু অা'লাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন পয়গম্বরগণ কোনো অর্থ-সম্পদ রেখে যান নি ; বরং তারা ইলম তথা জ্ঞান রেখে যান। যে ব্যক্তি সেই ইলম তথা জ্ঞান হাসিল করলো, সে ব্যক্তিই বিরাট সম্পদের উত্তরাধিকার হলো। সেই সম্পদ হাসিল করলো।”- [ ইবনে মাজাহ: ২২৩]


তিনি কী কারণে একজন সন্তানের জন্য হাহাকার করতেন সে বিষয়টা নিম্নের আয়াতের দিকে একটু খেয়াল করলেই বুঝা যায়,

"যে আমার উত্তরাধিকারী হবে এবং উত্তরাধিকারী হবে ইয়া’কুবের (আলাইহিস সালাম) বংশেরও এবং হে আমার রব! তাকে করবেন সন্তোষভাজন।"[সুরা মারইয়াম:০৬]

এই যে আয়াতটা এই আয়াতের মাঝে কিন্তু সুস্পষ্টরূপে বুঝা যায় যে, তিনি ওয়ারিশ চেয়েছিলেন, কিন্তু এখানে দুনিয়াবি সম্পদের উত্তরাধিকারিত্ব চান নি তিনি।

আরেকটা বিষয় খেয়াল করুন, তিনি শুধু নিজের উত্তরাধিকারি-ই চান নি আল্লাহর কাছে, বরং ইয়াকুব (আলাইহিস সালাম) বংশের যতো কল্যাণ আছে, সকল কল্যাণের তথা নবুয়্যাতি ইলম ও হিকমাহ্'র উত্তরাধিকারি-ই চেয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন তাঁর পিতৃপুরুষরা যেভাবে নবুয়্যাতের ধারক বাহক হয়েছেন তিনিও যেনো তা-ই হয়।। [তাফহিমুল কুরআন]


এই যে চাওয়াটা, এই যে আকুল আকাঙ্খাটা, তা তিনি ক্যানো করেছেন? কারণ হলো তিনি তাঁর গোত্রের, তাঁর বংশের মানুষের মধ্যে দেখতে পাননি আল্লাহর বিধানকে ধারণ করার মতো যথোপযুক্ত কোনো মানুষকে । তাঁর গোত্রীয় লোকজনের মাঝে ছিলো না উপযুক্ত কোনো সৎ লোক। এককথায় আল্লাহর বিধানানুযায়ী চলার এবং চালাবার মতো কেউই ছিলো না সেখানে। ধীরে ধীরে বিপথে চলে যাচ্ছিলো সকলেই.....

আল্লাহর কাছে তাঁর যে আকুল আকুতি সেখানে তথা সেই ফরিয়াদেই তার বিবরণ ফুটে ওঠে। তিনি এই বলেই ফরিয়াদ করেছেন আল্লাহর দরবারে,

''আর আমি আশংকা করি আমার পর আমার স্বগোত্রীয়দের (আল্লাহর বিধানের ব্যাপারে) অসদাচারণসম্পর্কে, আমার স্ত্রী তো বন্ধা। কাজেই আপনি আপনার কাছ থেকে (বিশেষ রহমতের মাধ্যমে) আমাকে দান করুন উত্তরাধিকারী। [সুরা মারইয়াম:০৫]


যাকারিয়্যা আলাইহিস সালামের আল্লাহর কাছে সন্তান চেয়ে এই যে এক অধীর আকাঙ্খাময় আবেদন, এই আবেদন-নিবেদনের পেছনে যে বিষয়টি অনেকটাই অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে তা হলো মারইয়াম বিনতে ইমরানকে বায়তুল মুকাদ্দাসে দেখাশুনার দায়িত্বভার। মারিয়াম বিনতে ইমরানকে দেখাশোনার দায়িত্ব ছিলো তাঁর ওপর-ই। তিনি সে দায়িত্ব পালন করেন সুন্দর করে। সুচারুরূপে। যথাযথভাবে...

মারইয়াম (আঃ) যেখানটায় থাকতেন, সেখানে তিনি যেতেন। গেলেই তখন দেখতে পেতেন মারইয়াম(আঃ)এর নিকট মওজুদ রয়েছে প্রচুর পরিমাণ ফল-ফলাদি।

তিনি বিস্মিত হতেন। অবাক হতেন। একদিন তিনি বিরাট বিস্ময় নিয়ে মারিয়ামকে (আঃ) জিজ্ঞেসাজুড়ে দিলেন- এসব কোথা থেকে আসে, কীভাবে আসে?

মারিয়াম আঃ শান্ত আর দৃঢ়চিত্তে জবাব দিলেন, “এই অফুরন্ত নিয়ামত সম্ভার প্রতিদিন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলা'র পক্ষ থেকেই আসে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা যাকে ইচ্ছা তাঁকে তাঁর নিয়ামত দিয়ে ধন্য করেন”।


মারিয়ামের (আঃ) জবাব যাকারিয়া আলাইহিস সালামের হৃদয়ে দারুণ রেখাপাত করলো। তাঁর মনের ভেতরও এই ভাবনা উদিত হলো- যে মহামহিম ও রহমানুর রহীম আল্লাহ মারইয়াম আলাইহিস সালামকে নানাবিধ ফল-ফলাদি দান করেন নিত্যদিন নিয়মিতভাবে- সেই তিনি তো আমার মতো বয়সের ভারে নূহ্য হয়ে যাওয়া ব্যক্তিকে, আমার বন্ধ্যা হয়ে থাকা স্ত্রীকেও সন্তানও দান করতে পারেন।

তিনি আল্লাহর কাছে ধর্ণা দিলেন। দুয়া করতে লাগলেন নিয়মিত। নিজের দুর্বলতা, নিজের অক্ষমতা আর অসহায়ত্বের পুরোটা উপস্থাপন করে তাঁর কাছে চাইতে লাগলেন। কাঁদতে লাগলেন। অঝোর ধারায় চোখের জল ঢেলে দিতে লাগলেন রব্বের দুয়ারে!


তিনি বলতে লাগলেন, ‘হে আমার রব! আমার অস্থি নরম হয়ে গেছে। দেহের খুটি যে হাড়গোড়; সে হাড়গুলো দুর্বল হয়ে গেছে , বার্ধক্যে আমার মাথার চুলগুলো শুভ্র হয়ে গেছে; কিন্তু এমন অবস্থায়, এমন অক্ষমতায়, এবং আমার এতো এতো দুর্দশার ভীড়ে, আমার এতো এতো দুর্বলতার দুর্বিপাকে কোনো সন্তান-সন্ততি না হওয়াটা-ই তো স্বাভাবিক। কিন্তু আমার সকল ক্ষুদ্রতা, সীমাবদ্ধতাকে উপেক্ষা করে তুমি আমার প্রতি করুণা করো। রহম করো। হে আমার রব! হে আমার আল্লাহ ! আমার প্রয়োজনে আমি তোমাকেই তো ডাকি, তোমার কাছেই তো আসি! আমি তোমার কাছে এসে, তোমাকে ডেকে কখনো ব্যর্থ হইনি [ সুরা মারিয়াম :০৪]


এমন করে তিনি তাঁর সবটুকুন আবেগ অনুভূতি ঢেলে দিয়ে, তাঁর আন্তরিকতার সবটুকুন উজাড় করে দিয়ে আল্লাহর কাছে চেয়েছেন। একেবারে প্রতিটি স্বলাতে। প্রতিটি মুনাজাতে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লাও তাঁর সে-ই কলিজা ভরা আকুল আবেদন কবুল করেছেন।


সেই কবুলিয়্যাতের সুসংবাদ পেয়েছেন তিনি
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলা'র দরবারে স্বলাতে দাঁড়ানো অবস্থায়-ই!

আল্লাহ তাঁকে শুভ সংবাদ পাঠিয়ে বললেন, ‘হে যাকারিয়্যা! আমি আপনাকে এক পুত্র সন্তানের সুসংবাদ দিচ্ছি, তার নাম হবে ইয়াহইয়া....[সুরা মারিয়াম:০৭]


হুট করেই তাঁর নিজের অবস্থার প্রতি নযর পড়ে গেলো। তিনি বিস্মিত হলেন। বিস্ময়ে একেবারে 'থ' বনে গেলেন তিনি।

তিনি রাব্বুল আলামিনের দরবারে প্রশ্ন করলেন আমার সন্তান কী করে হবে-- হে আল্লাহ! আমার স্ত্রী তো বন্ধ্যা। আমিও তো বার্ধক্যের গোধূলি লগ্নে উপস্থিত ? আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জাতের তরফ থেকে জবাব এলো “এমনটাই হবে! তোমার প্রতিপালক বলেছেন, এ কাজ আমার জন্যে সহজ একটা বিষয় । আমি তো পূর্বে তোমাকে সৃষ্টি করেছি, যখন তুমি কিচ্ছু ছিলে না। এমন অবস্থা থেকে সৃষ্টি করেছি, যখন তোমার বিন্দু-বিসর্গ কোনো অস্তিত্বই ছিলো না”।
.
এ সুসংবাদ পেয়ে তিনি প্রফুল্ল হলেন। উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠলো তাঁর বিষাদমাখা হৃদয়টা। আনন্দের উচ্ছলতাপূর্ণ মন নিয়ে তিনি বেরিয়ে পড়লেন নিজ সম্প্রদায়ের নিকট। তাদেরকে সকাল-সাঁঝে আল্লাহর পবিত্রতা, আল্লাহর বড়োত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব, আল্লাহর মহিমা ঘোষণা করতে ইঙ্গিত করলেন। মুখ দিয়ে কথা বললেন না। শরীর, মন ও মেজাজ সবই সুস্থ থাকার পরেও...

অতঃপর তাঁর বুকে চোখজুড়ানো এক সন্তান এলো। আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত ইয়াহিয়া নামে। ধীরে ধীরে তিনি বড়ো হলেন। তাঁর পিতার মতো তিনিও নবী হলেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা তাঁর প্রতি অবতীর্ণ করলেন ওহী'! ধরার বুকে মানুষের হিদায়াতের কান্ডারি হিশেবে আবির্ভূত হয়ে নেমে এলেন তিনিও....

এভাবেই একজন বয়োবৃদ্ধ মানুষ একেবারে ডাকার মতোই ডাকলেন আল্লাহকে! নিজের অতিশয় দুর্বলতা আর অক্ষমতাকে সামনে এনে আল্লাহর কাছে ধর্ণা দিয়েছেন, তাঁর দয়া ও রহমতের ওপর আস্থা রেখে দুয়া করে গেছেন। হতাশ হন নি। হন নি নিরাশ। ডেকে গেছেন তাঁকে। নিজের চাওয়াটা চেয়ে গেছেন তাঁর কাছে - অবলীলায়। অবিরাম।অন্তহীন।

দয়ার সাগর মহান রব্ব আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লাও তাঁর সে-ই আকুলতা উপেক্ষা করেন নি। তাঁকে ফিরিয়ে দেয় নি। তিনি তাঁর বান্দাকে কীভাবে ফেরায়! তিনি ফিরিয়ে দিলে তো তাঁর বান্দার আর যাওয়ার কোনো জায়গা নেই! তাই তিনি তাঁর বান্দার ডাকে সাড়া দিয়েছেন। কবুল করেছেন যাকারিয়্যা আলাইহিস সালামের দুয়া...


এভাবে যাকারিয়্যা আলাইহিস সালামের মতো চাইতে পারলে আমাকে এবং আমাদেরকেও তিনি দিবে না ফিরিয়ে! আমিও তাঁকে ডেকে ব্যর্থ হবো না আর! ইন শা আল্লাহ!


( আল্লাহর ওয়াস্তে লেখাটি কপি করবেন না। কপি করা নিষেধ। কেউ করলে দায়ি থাকবেন)
||ডাকার মতো ডাকলেন তিনি...||
রেদওয়ান রাওয়াহা
০১.১২.২০

পঠিত : ১৭১২ বার

মন্তব্য: ০