Alapon

ভারতীয় গুপ্তচরের চোখে মার্চের সেই দিনগুলি



কালিদাস বৈদ্য। জন্মগ্রহণ করেছিলেন বাংলাদেশের পিরোজপুরে। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময় তিনি উঠতি তরুণ। পড়াশোনায় বেশ ভালো ছিলেন। কিন্তু তার পরিবার দেশভাগের সময় সব ছেড়েছুড়ে কোলকাতায় চলে যায়। যে পাকিস্তান গঠনের কারণে তাকে দেশ ছাড়তে হলো সেই পাকিস্তানের প্রতি তার চরম ঘৃণা তৈরি হলো। আর মুসলিমদের প্রতি মুশরিকদের সহজাত ঘৃণা তো আছেই।

তিনবছর পর ভারত সরকার তাদের হয়ে ঢাকায় কাজ করার জন্য এমন কিছু লোক চাইলেন, যারা কোনো কিছুতেই ভারতের স্বার্থের বাইরে যাবে না। যারা বাংলা থেকে সম্পদ ছেড়ে চলে এসেছে এবং আবার বাংলায় ফেরত যেতে চায়। এমন অনেক লোককে খুঁজে গোয়েন্দারা বাংলাদেশে পাঠায়। যারা পাকিস্তানকে ভাঙ্গার কাজে নিয়োজিত হয়। পাকিস্তানকে ভাঙ্গার শপথ নিয়ে কলকাতা থেকে তিনজন একত্রে ঢাকায় আসলেন। তারা হলেন চিত্তরঞ্জন সূতার, নীরদ মজুমদার আর কালিদাস বৈদ্য। চিত্তরঞ্জন ও নীরদ রাজনীতি করতে থাকেন। চিত্তরঞ্জন আওয়ামীলীগের এমপিও হতে সক্ষম হয়েছিলো।

আর কালিদাস ভর্তি হন ঢাকা মেডিকেল কলেজে। তার কাজ ছিল আড়াল থেকে কাজ করা। ভাষা আন্দোলনের সময় ঢাকা মেডিকেল একটি ভালো ঘাঁটি ছিল ভাষা আন্দোলনকারীদের। এর পেছনে অবদান ছিল কালিদাসের। নিউক্লিয়াস প্রতিষ্ঠা ও নিউক্লিয়াসের সাথে ভারতের সেতু হিসেবে কাজ করেছেন কালিদাস বৈদ্য। কালিদাসরা বাংলাদেশকে একটি হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। এজন্য তিনি কাজ করেছেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ সেদিকে হাঁটে নি। অনেকটা সেক্যুলার ও কমিউনিজম টাইপের দেশ তৈরি হয়েছে তাতে খুব একটা খুশি ছিলেন না তারা।

শেখ মুজিবের মৃত্যুর পর বাংলাদেশ একটু একটু করে ইসলামপন্থীদের ছাড় দিতে শুরু করে। ইসলামপন্থীরা আবার প্রকাশ্যে রাজনীতি করার সুযোগ পায়। বাংলাদেশর তৎকালীন শাসক জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রকে মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত করতে থাকে। সংবিধান পরিবর্তন করে মূলনীতিতে 'আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাস' যোগ করে। এতে কালিদাসরা হিংস্র হয়ে ওঠে। খুলনাকে কেন্দ্র করে ছয়টি জেলা নিয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করে তারা। তাদের রাষ্ট্রের যৌক্তিকতা প্রমাণ করতে একের পর এক দাঙ্গা তৈরি করে। নিজেরাই ষড়যন্ত্র করে হিন্দুদের ওপর আক্রমণ করে।

বাংলাদেশকে হিন্দু রাষ্ট্র করতে না পেরে অবশেষে দু’টুকরো করে হিন্দুদের জন্য আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের জন্য জোর তৎপরতা চালিয়েছে। বাংলাদেশের এক তৃতীয়াংশ ২০,০০০ বর্গমাইল এলাকা নিয়ে স্বাধীন বঙ্গভূমি গঠনের উদ্যোগ আয়োজন চলছে অনেকদিন ইতিমধ্যেই ঘোষিত হয়েছে স্বাধীন বঙ্গভূমি সরকার।

বঙ্গভূমি আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক সংগঠক নিখিল বঙ্গ নাগরিক সংঘ। ১৯৭৭ সালের ১৫ আগস্ট কলকাতায় এই সংগঠনকির জন্ম হয়। উপস্থিত ছিলেন ডা. কালিদাস বৈদ্য, সুব্রত চট্টোপাধ্যয় (বিলাত ফেরত ইঞ্জিনিয়ার), নীহারেন্দ্র দত্ত মজুমদার (পশ্চিম বাংলার প্রাক্তন আইনমন্ত্রী) এবং শরৎ চন্দ্র মজুমদার (বাংলাদেশের প্রাক্তন মন্ত্রী)। অন্য সূত্রের খবর চিত্তরঞ্জন সূতারও ঐ সভায় হাজির ছিলেন। ১৭ সেপ্টেম্বর সংস্থা গোলপার্কে সভা করে প্রথম প্রকাশ্যে হোমল্যাণ্ড দাবী করে। এরপর মাঝে মধ্যে সভা-সমাবেশ হত।

১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর তাদের সাহস বেড়ে যায়। তারা বাংলাদেশ ভাঙার জোর প্রস্তুতি নিতে থাকে। সালে বঙ্গভূমি আন্দোলন একটা গুরুত্বপূর্ণ মোড় নেয়। ঐ বছরের ২৫শে মার্চ ঘোষিত হয় স্বাধীন বঙ্গভূমি রাষ্ট্র। তৈরী হয় সৈন্য বাহিনী “বঙ্গসেনা”। সৈনাধ্যক্ষ ডা. কালিদাস বৈদ্য। পরে বঙ্গদেশ মুক্তি পরিষদ তৈরী করে সৈন্যবাহিনী লিবারেশন টাইগার্স অব বেঙ্গল (বিএলটি)। এই সংগঠন মাঝে মাঝেই বঙ্গভূমি দখলের ডাক দেয়। সীমান্ত অভিযান করে। কিন্তু কখনই ব্যাপারটা এদেশের মানুষের কাছে বিশেষ গুরুত্ব পায়নি।

বঙ্গভূমির প্রস্তাবিত ঘোষণায় যা ছিল,
রাষ্ট্রপতি : পার্থ সামন্ত (চিত্তরঞ্জন সূতার)।
রাজধানী : সামন্তনগর, (মুক্তিভবন)।
পতাকা : সবুজ ও গৈরিক রঙের মাঝে সূর্যের ছবি।
জাতীয় সঙ্গীতঃ ধনধান্যে পুষ্পে ধরা, আমাদের এই বসুন্ধরা।
সীমানা : উত্তরে পদ্মা, পূর্বে মেঘনা, পশ্চিমে ভারত, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। প্রস্তাবিত সীমানার মধ্যে পড়েছে বাংলাদেশের দুইটি বিভাগ অর্থাৎ খুলনা ও বরিশাল বিভাগ পড়েছে।

এই অঞ্চল নিয়ে ২৫ মার্চ ১৯৮২ ঘোষিত হয়েছে তথাকথিত স্বাধীন বঙ্গভূমি রাষ্ট্র। স্বাধীন বঙ্গভূমিকে বাস্তব রূপ দেওয়ার সমস্ত উদ্যোগই চলছে কিন্তু পশ্চিম বঙ্গ থেকে। নেপথ্য নায়করা সবাই জানেন এই রাজ্যেই বাংলাদেশ সীমান্ত বরাবর বিভিন্ন জেলা - ২৪ পরগনা, নদীয়া এবং উত্তর বাংলায় চলছে ব্যাপক তৎপরতা। সেসময় ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকা কাদের সিদ্দিকী এবং চিত্তরঞ্জন সূতার মদদ দিচ্ছেন হিন্দু রাষ্ট্রের পক্ষে। প্রবক্তাদের যুক্তি বাংলাদেশে মুসলমানদের শাসন চলছে। হিন্দুদের জীবন ও সম্পত্তি তাদের হাতে নিরাপদ নয়। বিশেষত বাংলাদেশকে মুসলিম রাষ্ট্র ঘোষনার পর ঐ দেশের হিন্দুরা পরাধীন জীবন যাপন করছে। তাই প্রয়োজন হিন্দুদের জন্য স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র-বঙ্গভূমি।

৮৮ এর জুলাই থেকে অবস্থাটা ধীরে ধীরে পাল্টাতে শুরু করে। ঐ বছর ২২ জুলাই বঙ্গসেনা একটি সম্মেলন করে। এরপরই শুরু হয় একের পর এক কর্মসূচী। সীমান্ত জেলাগুলোতে চলতে থাকে একের পর এক সমাবেশ মিছিল মিটিং। ২৩ নভেম্বর বঙ্গভূমি দখলের জন্য বনগাঁ সীমান্ত অভিযানে ৮/১০ হাজার লোক হয়। ২২-২৩ জানুয়ারী বনগাঁ থেকে বঙ্গসেনার মহড়া হয়। ২৪ মার্চ ও ২৫ মার্চ হয় আবার বঙ্গভূমি অভিযান। ৭ এপ্রিল রাজীব গান্ধীর কলকাতা আগমন উপলক্ষে সিধু কান ডহরে বিএলও এক জমায়েতের ডাক দেয়। প্রত্যেকটা কর্মসূচীতে ভালো লোক জড়ো হয়। বাংলাদেশে গেল গেল রব উঠে। ঢাকার সংবাদ মাধ্যমগুলো এই প্রথম গুরুত্ব সহকারে মনোনিবেশ করে খবর প্রচার করে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মতো অভিযান চালায়। কোনো যুদ্ধ ছাড়াই জঙ্গীরা ভারতে পালিয়ে যায়।

যাই হোক ডা. কালিদাস বৈদ্য ও চিত্তরঞ্জন সূতার নিয়ে অনেক কথা বললাম তাদের চরিত্র উপলব্ধি করার জন্য। এবার মূল বক্তব্যে আসে। কালিদাস ১৯৭১ সালে অপারেশন সার্চলাইটের আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা প্রবাহ সম্পর্কে যা বলছিলেন, আমরা তা তার বয়ানেই পড়ি।

অবস্থা দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে চিত্তবাবুর কাছ থেকে নির্দেশ এলো এবং আমি মুজিবের সঙ্গে আলোচনায় বসলাম। স্বাভাবিকভাবেই, আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল, বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের কী করা উচিত। তার কথাবার্তার মধ্যে দিয়ে পরিষ্কার বুঝা গেল যে, বাংলাদেশকে স্বাধীন করার চেয়ে অখণ্ড পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়াকেই তিনি বেশি গুরুত্ব দিলেন। এই সময় আমি তার আত্মগোপনের কথা তুললাম। চিত্তবাবু আমাকে আগেই বলেছিলেন যে, তার আত্মগোপনের ব্যবস্থা তিনি ইতিমধ্যে করে ফেলেছেন। আমি মুজিবকে বললাম, “দেশের পরিস্থিতি যে দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তাতে শীঘ্রই আপনার আত্মগোপন করা উচিত।”

(চিত্তবাবু ও কালিদাসের চাওয়া শেখ মুজিব যাতে বিদ্রোহ করতে ভয় না পায়। এজন্য তাকে সাহস দিতে চাইলেন। তার নিরাপত্তার ব্যাপারে আশ্বস্ত করতে চাইলেন। শেখ মুজিব প্রধানমন্ত্রী হয়ে গেলে পাকিস্তানকে ভাগ করা কঠিন হবে এটা ভারত মনে করতো)

তার আত্মগোপনের জন্য তিনটি পথের কথা আমরা আলোচনা করেছিলাম যার মধ্যে প্রথম ও প্রধান পথ ছিল ভারতে পালিয়ে যাওয়া। তাই আমি তাকে বললাম, “বাংলাদেশে আত্মগোপন করে থাকা আপনার পক্ষে সম্ভব নয়, কারণ এখানকার সব লোকোই হয় আপনাকে দেখেছে নয়তো আপনার ছবি দেখেছে। তাই সব থেকে ভালো হয় যদি আপনি ভারতে চলে যান। ইতোমধ্যে চিত্তবাবু যে নিরাপদে, তার আত্মগোপন করে থাকার সমস্ত ব্যবস্থা করে এসেছেন তাও তাকে বললাম। আমি আরও বললাম যে, ইচ্ছা করলে তিনি তার সঙ্গীসাথীদের নিয়েও ভারতে যেতে পারেন এবং সেখানে সকলেরই থাকা খাওয়ার সুবন্দোবস্ত করা হবে। তাকে আমি আরও বলেছিলাম যে ভারতে গিয়ে রাষ্ট্রপ্রধানের মর্যাদা পাবেন ও সমস্ত সুযোগ তার থাকবে।

সব শুনে তিনি হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন মুজিব। বললেন, 'কবিরাজ! ভারতের মাটিতে থেকে আমি স্বাধীনতা সংগ্রাম চালাবো না।” আমিও প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তাকে বললাম, “দেশে থেকে স্বাধীনতা সংগ্রাম চালাতে পারলেই সব থেকে ভালো হয়। কিন্তু তা বড়ই কঠিন কাজ।” (এখানে একথা সহজে অনুমেয় মুজিব আগেই মুশরিকদের সাথে দেশ ভাগ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। কিন্তু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ তাকে দ্বিধায় ফেলে দিয়েছে। সে ভারতে যেতে চায়নি কারণ ভারতে গেলেই তার রাজনীতির ইতি হবে। এর মূল ব্যাপার ছিল বাংলার মানুষ মুশরিকদের সাথে নিয়ে সমঝোতা করবে এটা মেনে নিতে রাজি ছিল না। তদুপুরি শেখ মুজিবের রাজনৈতিক বিরোধীরা তাকে মুশরিকদের মদদপুষ্ট বলে অভিযোগ করতো। মুজিব সেটা দৃঢ়ভাবে নাকচ করতো। এখন ভারতে থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে তার বিরোধীদের অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হবে)

দ্বিতীয়টি তার নিজস্ব নির্ধারিত পথ। তা তিনিই বেছে নিবেন।

সব শেষে আমি তাকে তৃতীয় পথটির কথা বললাম। বিশেষ জরুরি অবস্থায় আত্মগোপনের সব রাস্তা যদি বন্ধ হয়ে যায় তখন এই তৃতীয় পথটিকেই গ্রহণ করতে হবে এবং নিকটবর্তী একটি বিশেষ দূতাবাসে তাকে আশ্রয় নিতে হবে। সেই পরিস্থিতিতে দেওয়াল টপকে সেই দূতাবাসে ঢুকবার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ও একটা হালকা মই আগে থেকেই তৈরি করে রাখার কথাও আমি তাকে জানিয়েছি। এভাবে তাকে নিরাপত্তার সব দিকগুলোর কথা বলে এবং সব রকম আশ্বাস দিয়ে আমি তার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। তাকে আমি বারবার বলছিলাম যে উক্ত দূতাবাসে পৌঁছতে পারলে তার জীবনের কোনো ভয় থাকবে না। সেই দূতাবাসের তথা যে দেশের দূতাবাস সে দেশের সরকারের দেওয়া আশাসের ভিত্তিতেই তাকে তা বলা হয়েছিল। তাও তাকে আমি জানিয়ে দিই। (আমরা ধারণা করি সেটা রুশ দূতাবাস)

মুজিবের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আমার মনে প্রশ্ন জাগল, কেন ভারতে যাবার কথা বলায় তিনি এত রেগে গেলেন? উপরন্তু, ইয়াহিয়ার সঙ্গে ঘন ঘন বৈঠক করে তিনি কি বিষয়ে আলোচনা করেছেন? আরো একটা প্রশ্নও আমার মনে উঁকি মারছিল। তার দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পর থেকেই কি তিনি অখণ্ড পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন? স্বাধীন বাংলাদেশের প্রশ্ন কি তিনি আপাতত স্থগিত রেখেছেন?

চিত্তবাবু কলকাতায় ছিলেন, তাই তার সঙ্গে এ ব্যাপারে আলোচনার সুযোগ ছিল না। তবে আমার একক চিন্তায় মনে হল যে, মুজিবের প্রতি আমাদের প্রাথমিক সন্দেই বাস্তব রূপ নিতে চলেছে। এত দিন ধরে ক্রমাগত বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা আমাদের গোপনে বললেও চরম মুহূর্তে তার পাকিস্তান ত্যাগ করা তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।

যাই হোক, ইতিমধ্যে ঢাকায় অবস্থা হয়ে উঠেছে অগ্নিগর্ভ। দেশের প্রশাসন যন্ত্রও কার্যত থমকে দাঁড়িয়েছে। মোটামুটিভাবে ছাত্ররাই (নিউক্লিয়াস) প্রশাসন চালিয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে ঘটে গেছে আর এক পরিবর্তন। এত দিন ধরে ন্যাপ.ও কমিউনিস্ট পার্টি সব দিক দিয়ে মুজিবের বিরোধিতা করে এসেছে। এমন কি বাংলাদেশের স্বাধীনতাকেও তারা এক হাস্যকর প্রচেষ্টা বলে বিদ্রুপ করে এসেছে। বলেছে স্বাধান বাংলাদেশ বাস্তবে কখনও সম্ভব নয়। তারা আরও বলে এসেছেন যে, পূর্ববঙ্গ স্বাধীন হলে তার স্বাধীনতা বলে কিছু থাকবে না। সে ভারতের একটি তাঁবেদার রাষ্ট্রে পরিনত হবে। আশ্চর্যের ব্যপার হল, তারাই আজ চিৎকার করে বেড়াচ্ছে, “আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ চাই। মুজিব তুমি স্বাধীনতা ঘোষণা করো।

ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির এই হঠাৎ পরিবর্তন কেন তা বুঝতে বেশি অসুবিধা হয়নি। দুই দিক দিয়ে লাভ তোলার জন্যই তারা এই পথ বেছে নিয়েছিল। প্রথমত মুজিব যদি স্বাধীনতা ঘোষণা করে তবে ভুট্টো-ইয়াহিয়া তাকে ছেড়ে দেবে না। তারা তাঁকে হয় মেরে ফেলবে অথবা কারারুদ্ধ করবে। সেই অবস্থায় বাঘহীন বনে তাদের পক্ষে শৃগালের রাজত্ব করা সম্ভব হবে। দ্বিতীয় এই জন-জাগরণেকে উপেক্ষা করে মুজিব যদি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয় তবে তাকে বিশ্বাসঘাতক বলে প্রচার করা যাবে। জনগণের কাছে তাকে বিচ্ছিন্ন করে জন-জাগরণকে নিজের পক্ষে নিয়ে আসা সম্ভব হবে।

তাদের এই হঠাৎ দিক পরিবর্তনের সম্ভবত আরও একটি কারণ ছিল। পরের দিকে এক অভূতপূর্ব জন-জাগরণ লক্ষ্য করে তারা বুঝতে পেরেছিল যে, মুজিব স্বাধীনতার ডাক দিলে বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই। কোনো শক্তিই তাকে প্রতিরোধ করতে পারবে না। তাই স্বাধীনতা সংগ্রামের অংশীদার হবার জন্যই তাদের এই প্রচেষ্টা। এর পিছনে হয়তো রাশিয়ার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিতও ছিল। স্বাধীনতা আন্দোলনে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ল। মুজিবের বাড়ির সামনে জমায়েত হয়ে চিৎকার করতে থাকল— “মুজিব তুমি স্বাধীন বাংলাদেশ ঘোষণা করো, জয় বাংলা।” “ঢাকার পথে পথে মানুষের তখন একই কথা—স্বাধীনতা।

রাশিয়া তখন বাংলাদেশের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখছিল। পরিস্থিতি লক্ষ্য করে সেই ন্যাপ কমিউনিস্ট জোটকে স্বাধীনতা আন্দোলনে সামিল হতে নির্দেশ দিয়েছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন না করলে তারা যে জনগণের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে সেটাও রাশিয়াই তাদের বুঝিয়েছিল। এই কারণেই তারা হঠাৎ করে স্বাধীনতার বড় সমর্থক বনে গেল এবং মুজিবের বাড়ির সামনে হাজার হাজার সমর্থকের জমায়েত করতে লাগল। সেদিনের ঢাকার সেই উত্তাল গণ-জাগরণ নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা সম্ভব নয় এবং ভাষায় তা বর্ণনা করাও সম্ভব নয়। অভূতপূর্ব সেই গণজাগরণ দেখে খুবই আনন্দ পেয়েছি। নতুন করে আশায় বুক বেঁধেছি। মনে মনে গভীর ইচ্ছা থাকলেও, সেই পরিবেশ মুজিবের পক্ষে অখণ্ড পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়া সম্ভব ছিল না।

আগেই বলা হয়েছে যে, পূর্ববাংলার প্রশাসন তখন একেবারেই ভেঙে পড়েছিল এবং এই সঙ্কট না কাটাতে পারলে পাকিস্তানের অখণ্ডতার পূজারি তিন নেতা, ভুট্টো, ইয়াহিয়া ও মুজিব প্রমাদ গুনলেন। পাকিস্তানকে সুরক্ষার জন্য এই তিন নেতাকে আবার আলোচনায় বসতে হলো। এই আলোচনার মধ্য দিয়ে ভুট্টো ও ইয়াহিয়া আবার মুজিবকে ভাল করে বোঝার ও চিনবার সুযোগ পেলেন। তারা দেখলেন যে পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্যে মুজিবের মধ্যে কোনো ভেজাল নেই।

তাই ভুট্টো-ইয়াহিয়া এক ঢিলে দুই পাখি মারার পরিকল্পনা করলেন। তারা মুজিবকে প্রধানমন্ত্রী হবার আমন্ত্রণ জানাবেন ঠিক করলেন। তারা বুঝতে পারলেন যে, প্রধানমন্ত্রী হলে মুজিব আর বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা বলবেন না বা তার পক্ষে বলা সম্ভব হবে না। ফলে তিনি বাংলা জাতীয়তাবাদীদের থেকে অনেক দূরে চলে যাবেন এবং তখন তাদের পক্ষে ইসলামী জাতীয়তাবাদ প্রচার জোরদার করা সম্ভব হবে। সেই পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মুজিবের পক্ষে স্বাধীন বাংলাদেশের ডাক দেওয়া আর সম্ভব হবে না।

অনাদিকে সেনাবাহিনীতেও বাঙালির সংখ্যা খুবই কম। তাই মুজিব সেনাবাহিনীকেও পুরোপুরি নিজের পক্ষে নিতে পারবেন না। সবার ওপরে থাকবে ইসলামি পাকিস্তানের প্রতি গভীর আনুগত্যসম্পন্ন একজন প্রেসিডেন্ট, যাকে অতিক্রম করে মুজিবের পক্ষে কিছুই করা সম্ভব হবে না। এই সব দিক বিবেচনা করে তারা মুজিবকে প্রধানমন্ত্রী করার আশ্বাস দিলেন।

মুজিব বুঝলেন যে, তিনিই অখণ্ড পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন। ফলে পাকিস্তানও অখণ্ড থাকবে এবং ইসলামি বিশ্বভ্রাতৃত্ব রক্ষা পাবে। উপরন্তু স্বাধীনতা সংগ্রামের ঝুঁকিও তাকে নিতে হবে না। মুজিবের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথা ইয়াহিয়া ২২শে মার্চের রেডিও ভাষণে দেশের জনগণকে জানিয়ে দিলেন। আর ওদিন মুজিবও সমঝোতার কথা বললেন এবং দেশের যোগাযোগ, পাট শিল্প ও পাটজাত দ্রব্যের রপ্তানীর ব্যাপারে অসহযোগ তুলে নিলেন।

তারপর সারা পৃথিবীতে ছাত্র-জনতার বিদ্রোহের প্রস্তুতির কথা জানিয়ে দেওয়া হলো। ইয়াহিয়ার সাথে মুজিবে বিশ্বাসে ফাটল ধরে। মুজিব স্বেচ্ছায় গ্রেপ্তারিবরণ করে। পাক বাহিনী হিংস্র মূর্তি ধারণ করে হিন্দুদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। যদি সময়মতো জিয়াউর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা না করতো তবে পাকিস্তান ভাগ হওয়া সম্ভব ছিল না।

পঠিত : ১৫১৪ বার

মন্তব্য: ০