Alapon

মুক্তিযুদ্ধে ইসলাম বা আলেম সমাজ সত্যিই কি অনুপস্থিত ?


শৈশব থেকে কৈশর পর্যন্ত বেড়ে ওঠা গ্রামে। গ্রামের মানুষ গুলো শহরের তুলনায় একটু বেশী ধর্মপরায়ন। নিজের বেড়ে ওঠার সাথে সাথে পড়াশোনার দায়িত্ব আসলো কাধে। ছোট বেলায় শীতের দিন কী গরমকাল! ভোর হলেই মায়ের ডাক! মক্তবে পাঠিয়ে দেবার জন্য তোড়জোর শুরু। কায়েদা থেকে আমপাড়া তারপর কোরআন হাতে নেওয়া মাত্রই সকলকে মিষ্ঠিমুখ করানোটা ঐতিহ্য ছিলো গ্রামগুলোতে। যান্ত্রিক শহরের রোবটের মতন হালচাল প্রান্তিক অঞ্চলেও প্রবেশ করেছে। ভোরবলোয় মসজিদের বারান্দায় আরবি হরফ শুদ্ধভাবে উচ্চারনের সেই কিচিরমিচিরি শব্দ কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে! গ্রাম গুলোতে সেই ভোর বেলায় মক্তব মুখী বাচ্চাদের পদচিহ্ন আর পাওয়া যায়না। সেসব এখন পরবর্তী প্রজন্মকে গল্প শোনানোর ইতহিাস হয়ে গেছে।

মসজিদ এর সাথে নিয়মিত সম্পর্ক ক্লাস সিক্স থেকেই। যেখানেই থাকিনা কেন আযানের শব্দ কর্নকুহুরে আসা মাত্রই মসজিদ পানে ছুটে যেতাম। মাঝে মাঝে বন্ধুদের সাথে রোমাঞ্চকর আড্ডা থেকে বিদায় নিতেও চাইতাম না। ওরা মসজিদে না গেলেও আমাকে তাগাদা দিত। সে দিক থেকেও ওদের প্রতি সম্মান, শ্রদ্ধা থাকতো।

শুক্রবাররে তুলনায় অন্যান্য ওয়াক্ত নামাযে মুসল্লিদের সংখ্যা নেয়াত যতসামান্য হতো। ইমাম সহ ৪/৫ জন হতো প্রতি ওয়াক্তে। তখনকার সময়ের যবুকদের নামাযের ধারে কাছেও পাওয়া যেতনা। তবে একটা জিনিস আমী গভীর ভাবে লক্ষ্য করতাম। জানুয়ারী থেকে শুরু করে জুন পর্যন্ত পর্যায় ক্রমে আমাদের বড়ড়া (এসএসসি পরীক্ষার্থী ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা) রেগুরার নামায পড়তো। সেটাও একটি নির্দিষ্ট দিন পর্যন্ত। তাদের পরীক্ষা আর রেজাল্ট সমাপ্ত হওয়া মাত্রই মসজিদ এর সাথে সম্পর্ক সমাপ্ত হতো। এরকম টা এডমিশন টেষ্ট এর সময় গুলো দেখেছি।

ধীরে ধীরে সকল কিছু বোধগম্য হার পর আরও বুঝরাম এরকম কিছুদিনের সম্পর্ক মোটামোটি জাতীয় রাজনীতিতে হরহামেশায় দেখা যায়। এই ধরেন, নির্বাচনের আগে বড় রাজনৈতিক দল গুলো আলেম ওলামাদের দরবারে যেত দোয়া নিতে। তাদেরকে আশ্বাস দেওয়া হতো ক্ষমতায় গেলে কোরআন সুন্নাহ বিরোধী কোন আইন পাশকরা হবে না। কিন্তু ক্ষমতা পাবার পর কোরআন সুন্নাহ বিরোধী কেনা কিছু বাস্তবায়নকালে আলেম সমাজ যখন প্রতিবাদ করে তখন তারা হয়ে ওঠে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি, সাম্প্রদায়িক, উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠী। বাংলাদেশের সেক্যুরার সমাজ খুব সুক্ষভাবে দাড়িটুপিওয়ালাদের সাথে মুক্তিযুদ্ধকে বিপরীত ‍মুখী অর্থাৎ ইসলামকে মুক্তিযুদ্ধের সাথে সাংঘার্ষিক অবস্থানে দাড় কররিয়েছে। আমাদেরকে দেখানো হয় মুক্তিযুদ্ধের বয়ানে ইসলাম অনপুস্থিত। আমাদেরকে শেখানো হয় মুক্তিযুদ্ধের বয়ানে ইসলাম অপ্রাসঙ্গিক ছিলো। আর এভাবেই তৈরী হয়েছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহ্য। ইসলাম শুধু মাত্র অনুপস্থিত তা নয়; কখনো আসামি, কখনো পরাজিত শক্তি! কিন্তু গল্পটা উল্টো! ১৮০ ডিগ্রি উল্টো।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দলটির নাম নিঃসন্দেহে আওয়ামী লীগ। ১৯৬৯ সালে প্রস্তাবিত খসড়া সংবিধান সংশোধনী বিলে ইসলামী আদর্শ বহাল রাখার বিষয়ে তারা সম্মতি জানিয়েছিলো। ১৯৭০ সালের নভেম্বরে সাধারণ নির্বাচনের আগে বেতারে ও টেলিভিশনে বঙ্গবন্ধু তার ভাষনে স্পষ্ট ভাবে ইসলামের পক্ষ নিয়ে বলেছিলেন লেবেলসর্বস্ব ইসলামে আমরা বিশ্বাসী নই। আমরা বিশ্বাসী, ইনসাফের ইসলামে।
তিনি আরো বলেছিলেন, যে দেশের শতকরা ৯৫ জন মুসলমান, সে দেশে ইসলামবিরোধী আইন পাশের ভাবনা কোন মুসলিম ভাবতে পারেনা।

২৫ মার্চের পাকিস্তানিদের বর্বর গনহত্যা চালানোর পর বঙ্গবন্ধু তার এক ভাষনে বলেছিলেন,
জনগনকে ইসলাম ও মুসলমানের নামে স্লোগান দিয়ে ধোকা দেয়া যায় না।ধর্মপ্রাণ মুসলমান তাদের ধর্মকে ভালবাসে ; কিন্তু নামে ধোকাকে নয়

আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা হয় যে সম্মেলনে, সে সম্মেলনে তাদের ঘোষণাপত্র ও গঠনতন্ত্রের ১ নং ধারায় দুনিয়ার মুসলমানদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববন্ধন শক্তিশালী করার কথা বলা হয়।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের (আওয়ামী লীগ নেজামে ইসলাম ও অন্যান্য) ২১ দফা কর্মসূচির মূলনীতি হিসেবে ঘোষণা করা হয় :

' কুরআন-সুন্নাহর মৌলিক নীতির খেলাফ কোন আইন প্রণয়ন করা হবে না।'

তাই যে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিয়েছে, তাদের গড়ে ওঠার সকল পর্যায়ে সব সময়েই ইসলাম প্রধান উপাদান ছিলো। এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধ নির্মাণের সকল বয়ান বক্তৃতায় ইসলাম পরিপূর্ণ ভাবে বিদ্যমান ছিলো। ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বলেছিলেন, রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি তার বক্তৃতা শেষে বলেছিলেন, একটি সুখী সমৃদ্ধশালী সমাজ গঠনে আল্লাহর সাহায্য ও নির্দেশ কামনা করার উদাত্ত আহবান জানাচ্ছি। তাই বলতে গেলে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল 'ইনশাআল্লাহ' বলে আর শেষ হয়েছিল 'আল্লাহর সাহায্য কামনা' করে।

এভাবে স্বাধীনতাযুদ্ধের সকল ক্ষেত্রে ইসলামী চিহ্ন ও পরিভাষা ব্যবহার হয়েছে।স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সমস্ত কার্যক্রম শুরু হতো ইসলামী ভাবে। ২৬ শে মার্চ কবি আব্দুস সালাম স্বাধীন বাংলা বেতারের দ্বিতীয় অধিবেশনে যেই ঘোষণা দিয়েছিলেন সেই ঘোষণার মূল প্রতিপাদ্য ছিলো ইসলাম। তিনি বলেছিলেন, স্বাধীনতাহীন জীবনকে ইসলাম ধিক্কার দিয়েছে। আমরা আমাদের স্বাধীনতা আদায়ের লক্ষে মুক্তিযুদ্ধে আমাদের জান মাল কোরবান করে দিচ্ছি। তিনি তার ভাষণের শেষে বলেছিলেন, ' নাসরুম মিনাল্লাহে ওয়া ফাতহুন কারিব'। আল্লাহর সাহায্য ও জয় নিকটবর্তী।

এছাড়া মুক্তিযুদ্ধকালে প্রত্যেক সরকারি ঘোষণা ও নির্দেশনাবলিতে ইসলাম ছিলো মূল উপাদান। রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের চিঠিপত্রাদিতে ইসলামের প্রভাব ছিলো পরিপূর্ণরুপে।
সে সময়ের আওয়ামী লীগের মুখপত্র 'জয়বাংলা' পত্রিকায় ইসলামী আলোচনা ছিলো উল্লেখযোগ্য। এসকল আলোচনার মূলকথা হলো ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে ইসলাম মুক্তিযুদ্ধের প্রতিকুলে ছিলোনা। বরং সম্পুর্ণভাবে ইসলাম মুক্তিযুদ্ধের অনুকূলে ছিলো।

মুক্তিযুদ্ধে আলেমদের ভূমিকা

তারেক মুহাম্মাদ তাওফিকুর রহমান তার গ্রন্থ 'বাংলাদেশের রাজনীতিতে আলিম সমাজের ভূমিকা ও প্রভাবে' বর্ণনা করেছেন,
মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশের আলেম সমাজ ছয় ধারায় বিভক্ত ছিলেন।

বিভিন্ন ইসলামী রাজনৈতিক দলের সাথে সংশ্লিষ্ট আলেম
বিভিন্ন সাধারণ রাজনৈতিক দলের সাথে সংশ্লিষ্ট আলেম
সরকারি-আধা সরকারি মাদ্রাসাসমূহের শিক্ষক আলেম
কওমী মাদ্রাসাসমূহের শিক্ষক আলেম
বিভিন্ন খানকাহ্, সিলসিলা ও পীর-মুরিদী সংশ্লিষ্ট আলেম
ইমাম, মুয়াজ্জিন ও ব্যক্তি পর্যায়ের আলেম

এই ধারাগুলোর মধ্যে ইসলামপন্থী দল জামাতে ইসলাম ও নেজামে ইসলাম ব্যতিত অন্যান্য আলেম সমাজের বড় এক অংশ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সক্রিয় অবস্থান নেন। এদের মধ্যে অনেকেই রণাঙ্গনের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন।এর মধ্যে কিছু উল্লেখ করা যেতে পারে-

- সেই সময়ের বাংলাদেশের শীর্ষ আলেম হাফেজ্জি হুজুর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে রাজনৈতিক ও নৈতিক অবস্থান নেন।তিনি পাকিস্তানিদের জালেম ও মুক্তিযুদ্ধকে 'জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের লড়াই বলে অভিহিত করেন।
-শায়খুল হাদিস মাওলানা আজিজুল হক মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্বে বঙ্গবন্ধুর সাথে ৩২ নম্বর ধানমন্ডিতে এক দীর্ঘ বৈঠক করেন।এই বৈঠকের পর মাওলানা আজিজুল হক সাহেবের প্রশংসা করে বঙ্গবন্ধু পত্রিকায় এক বিবৃতিও দেন।
-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৫ শে মার্চ গনহত্যা চলার পরে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ না হলেও সেই সময়ের বড় মাদ্রাসাগুলো যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং ছাত্রদের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করা হয়।

এছাড়াও আরো অনেক আলেম মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার কাহিনী নিয়ে শাকের হুসাইন শিবলী তার গ্রন্থ 'আলেম মুক্তিযোদ্ধার খোঁজে ' সুন্দর আলোচনা করেছেন।

এ মুক্তিযুদ্ধে কেবল বাংলার আলেমরাই অংশগ্রহণ করেননি বরং উপমহাদেশের আলেম সমাজের ভূমিকাও ছিলো উল্লেখযোগ্য। এদের মধ্যে মাওলানা মাহমুদ মাওলানা আসআদ মাদানী ও অনন্যা আলেমগন উল্লেখযোগ্য। এ সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে 'বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের ভূমিকা' গ্রন্থে। আর মুক্তিযুদ্ধে সবচে বড় নাম মাওলানা ভাসানী এর কথা না বললেও চলে। এমনকি মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বিশ্বমানের আলেমগনও বাংলাদেশের পক্ষে কথা বলেছেন। খোদ পাকিস্তানি আলেম মুফতী তাকী উসমানী দাঃবাঃ তার জাহানে দীদাহ গ্রন্থে পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচারের বর্ণনায় বলেছেন, 'বাংলাদেশের মাটিতে তারা কিয়ামত নামিয়ে ছিলো'।

এসকল বক্তব্য দ্বারা একথাই প্রমাণিত হয় যে ইসলাম ও ইসলামি ব্যক্তিবর্গ সর্বদাই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিলেন।তারা কখনোই পাকিস্তানকে নিজেদের মিত্র ভাবেন নি।
(বিস্তারিত জানতে ‘মুক্তিযুদ্ধের বয়ানে ইসলাম’ বইটি পড়েতে পারেন)

বঙ্গ সেকুলাররা স্বাধীনতার লক্ষ চারটি বলে প্রচার করে আদতে এটা সত্য নয় বরং ডাহা মিথ্যা। 'স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য ছিল তিনটি ; সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচ‌‌ার নিশ্চিত করা।'
(বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র তৃতীয় খন্ড গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার তথ্য মন্ত্রণালয় ২০১০, পৃষ্ঠা ৭৪৩)
এই তিন নীতি মুক্তিযুদ্ধের সারকথা বা সংক্ষেপে এটাই মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা। এই চেতনাকে নস্যাৎ করবার জন্যই যুদ্ধ শেষে সংবিধান প্রণয়নের সময় ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও বাঙালী জাতীয়তাবাদ নামের চার নীতি আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি বা শুরুতে ধর্মনিরপেক্ষতার কোন কথা ছিল না। এটা ভারতই আমাদের চাপিয়ে দিয়েছে। এক্ষেত্রে পরজীবী সেকুলারদের বিরাট ভূমিকা আছে।

পঠিত : ৯০৪ বার

মন্তব্য: ০