Alapon

আজারবাইজান-আর্মেনিয়া যুদ্ধ- লেখক : নুর মোহাম্মদ




পরাজিত প্রজন্মের একটা পরিচয় কী জানেন? তারা কেবল পরাজয়ের গল্প বলে নিজের ব্যর্থতা ও কর্তব্য ভুলে থাকার অজুহাত খুঁজে পায়। তারা চোখে কেবল সরষে ফুল দেখে। দৃশ্যমান বিজয়ও দেখেও তাদের হৃদয় তা উপলব্ধি করতে পারে না।

আজারবাইজান-আর্মেনিয়া যুদ্ধ হলো।

যুদ্ধে একদল জিতেছে, তাই না? কারা জিতেছে? কেন জিতেছে? আশেপাশে খোঁজ নিয়ে দেখুন, খুব কাছের মানুষও এই যুদ্ধের খবর জানে না। বিজয়ী সেনাপতির নামও জানে না। কিন্তু ঠিকই তারা কাশ্মীরের পরাজিতদের খবর জানে, আফগানিস্তান, ইরাকের খবর জানে।

কেন জানেন? পশ্চিমা মিডিয়া আজারবাইজা-আর্মেনিয়া যুদ্ধের এমন ফলাফল প্রত্যাশা করেনি। তারা ভেবে নিয়েছিল, যুগ যুগ ধরে চলমান আর্মেনীয় দখলদারিত্ব অব্যাহত থাকবে। সারা দুনিয়ায় মার খাওয়া মুসলিম সেনাবাহিনী আর্মেনিয়ার সেনাবাহিনীর কাছে টিকতেই পারবে না!

তার্কিস ড্রোন, সেন্সর, হেভি আর্টিলারি আর মিসাইলের কল্পনাতীত আক্রমণ হজম করতে পারেনি তারা। লেজ গুটিয়ে আর্মেনীয় দখলদারদের পলায়নের দৃশ্য ক্যামেরায় ধারণ করলেও তা প্রচারের হিম্মত দেখানো সত্যিই তাদের জন্য কঠিন। তারা মুসলমানদের পরাজয়ের খবর প্রচার করতে বড্ড তৃপ্তি পায়। আজারবাইনের স্পষ্ট বিজয়ের পর তারা একেবারে নিশ্চুপ।

আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ আর্মেনীয়দের যেভাবে খেলে দিয়েছে, তা সহ্যের বাহিরে ছিল। তুর্কিদের সফল চাল মেনে নিতে সত্যিই ওদের কষ্ট হচ্ছে। আজারবাইন ও তুরস্ক যেভাবে যুদ্ধ জিতেছে, তাতে না মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলা যাচ্ছে, না কোনো যুদ্ধপরাধের গান শোনানো যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক রীতিনীতি মেনেই খেলে দিয়েছে আর কি! ১৯৯৪ সালে আজারবাইজানের এই ভূমি নাগার্ণো-কারাবাখ জোর করে দখল করেছিল আর্মেনীয়রা। অসংখ্য মুসলমানকে হত্যা করেছে, ধর্ষণের উৎসব করেছে। পৈশাচিক নির্যাতন করেছে মুসলমানদের ওপর।

২৭ সেপ্টেম্বর আজারবাইজান ওফেনসিভ আক্রমণ শুরু করে দখলদারিত্বের অবসান ঘটাতে। এর আগে কয়েক বছর ধরে যুদ্ধ প্রস্তুতি নেয় তারা। শত শত কোটি ডলার খরচ করেছে তাদের সামরিক বাহিনীকে নতুন করে গড়ে তুলতে। গত কয়েক বছরে দেশটি বহু আধুনিক ট্যাংক, সমরাস্ত্র এবং আধুনিক প্রযুক্তি কিনেছে নিজের সামরিক বাহিনীর জন্য। তুরস্ক তাদের দ্ব্যর্থহীনভাবে সমর্থন দিয়েছে। সাবেক আজারবাইজানের সাবেক প্রেসিডেন্ট হায়দার আলিয়েভ টার্কি-আজারবাইজান সম্পর্কে বুঝাতে প্রায়শই বলতেন- "One nation with two states".

এমন নয় যে আজারবাইনের প্রেসিডেন্ট একেবারে ঈমানী জোশে জিহাদ পরিচালনা করেছেন। অনেকটা জাতীয়তাবাদী চেতনায় কেবল দখলদারিত্বের অবসান করতে চেয়েছিলেন প্রথমে। কিন্তু ধীরে ধীরে সেখানে ইসলামের স্পিরিচুয়ালিটি ঢুকে যায়। প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ তার সৈন্যদের মোটিভেট করার সময় কুরআনুল কারিমের আয়াত বলতেন, নবিজির জিহাদের গল্প বলেছেন এবং কুরআনুল কারিমে চুমো দিয়ে সৈন্যদের মাঝে বিতরণ করেছেন।

সবচেয়ে বড়ো কথা কারাবাখ উদ্ধারের পর তিনি এবং তার স্ত্রী কূটনৈতিকভাবে একটা বার্তা দিয়েছে বিশ্ববাসীকে। সেনা পোষাকে প্রেসিডেন্ট ও ফার্স্ট লেডি মসজিদে প্রবেশ করে কুরআনুল কারিমে মমতার চুমো খাওয়ার দৃশ্য স্পষ্ট একটা বার্তা। অবশ্য নৈরাশ্যবাদীরা এখানে কোনো বার্তা খুঁজে পাবে না, বরং প্রশ্ন উঠবে ফার্স্ট লেডি নিয়ে।

বহু বছর পর মুসলমানরা একটা স্পষ্ট বিজয় পেল; কিন্তু কোথাও কোনো আওয়াজ নেই। আফসোস! আমরা পরাজিত প্রজন্ম কিনা, তাই পরাজয়ের শোকগাথা বলতে-শুনতে পছন্দ করি। বিজয় আমাদের চৈতন্যকে স্পর্শ করে না। যুদ্ধে হারলে তার ব্যবচ্ছেদ হতো; মুসলমানদের ঐক্য নেয়, সাহাবিদের মতো সাহস নেই, প্রযুক্তি নেই, সেনাপতি নেই। এরপরে আসত নসিহা। সোস্যাল মিডিয়াতে পরামর্শ আর উপদেশের বন্যা বইয়ে যেত।

একুশ শতকের আজকের সময়ে এসে এমন একটা বিজয় নিয়ে আমি মুসলমানদের তেমন কোনো উচ্ছ্বাস দেখিনি। একুশ শতকে জাহেলিয়াতের উত্তাল তরঙ্গের মাঝে এক মুসলমান শাসক তীব্র মনোবল, নিখুত পরিকল্পনা, আল্লাহর ওপর তায়াক্কুল, বিপুল হিম্মত আর দুঃসাহসের মাধ্যমে একটা জনপদকে শিকলমুক্ত করলো, এটা কি মুসলিম দুনিয়ায় আসলে খুবই সামান্য ঘটনা? দখলদাররা আত্মসমর্পণ করে লেজ গুটিয়ে পালিয়ে গেল, কিচ্ছু মনে হয় না? প্রযুক্তির নিখুত ব্যবহারে আর্মেনীয় দখলদারদের নাভিশ্বাস তুলে ফেলল আজারবাইজানীয় সৈন্যরা, কোনো ভাবান্তর হচ্ছে না তাতে?

হয়তো একটা ভুল পারসেপসনের ভিত্তিতে একটা অযৌক্তিক উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছি, নয়তো আমাদের প্রজন্ম সত্যিই পরাজয় দেখে দেখে বিজয়ের সংজ্ঞা ভুলে গেছে। আমরা নৈরাশ্যবাদী।

আফসোস! আফসোস! খুব জানতে ইচ্ছে করে, বিজয় কাকে বলে?

পঠিত : ৩৪৫ বার

মন্তব্য: ০