Alapon

ঘুরে এলাম কাঁচের মসজিদ



শিরোনাম দেখে অবাক হতে পারেন। কাঁচ দিয়ে কী মসজিদ তৈরি হয়! আমিও অবাক হয়েছি। এই প্রথম কোনো মসজিদ দেখলাম যার চারপাশের দেয়ালই তৈরি হয়েছে কাঁচ দিয়ে। প্রায় ২২ ফুট লম্বা কাঁচের খণ্ড দিয়ে তৈরি করা হয়েছে কেরানীগঞ্জের দোলেশ্বর জামে মসজিদ। এরকম নান্দনিক মসজিদ খুব কমই দেখেছি।

মসজিদটি এমন ছিল না। ১৫২ বছরের পুরনো মসজিদ এটি। ১৮৬৮ সালে মসজিদটি স্থাপন করেন ঢাকার কেরানীগঞ্জের দোলেশ্বর গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ। সেসময় পাঁচজন দানশীল ব্যক্তি মসজিদের জন্য জমি দান করেন। দারোগা আমিনউদ্দীন আহম্মদের নেতৃত্বে এই মসজিদের কার্যক্রম শুরু হয়। তাই এটি পরিচিত ছিলো “দারোগা মসজিদ” নামে। তার ছেলে মইজ উদ্দিন আহম্মদ ছিলেন মসজিদের প্রথম মোতোয়ালি।

পাঁচজন দানশীল ব্যক্তির একজন হলেন খিদির বক্স। মইজউদ্দিনের পর খিদির বক্সের পরিবার এই মসজিদটির দেখাশোনা করেন। কয়েকজন মানুষের হাত বদল হয়ে পাকিস্তান আমলে এই মসজিদটির দায়িত্ব আসে অধ্যাপক হামিদুর রহমানের কাছে। অধ্যাপক হামিদুর রহমান মসজিদটির সংস্কার করেন। মিনার ও গম্বুজ তৈরি করেন। এটি দুই গম্বুজ বিশিষ্ট সুন্দর মসজিদ।

হামিদুর রহমান সাহেব আওয়ামী লীগ করতেন। ১৯৭০ এর নির্বাচনে তিনি প্রাদেশিক পরিষদে কেরানীগঞ্জের আসন থেকে নির্বাচিত হন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি পাকিস্তানের প্রতি অনুগত থাকেন। মোস্তফা মহসিন মন্টুর নেতৃত্বে এখানে সন্ত্রাসী কার্যক্রম শুরু হয়। মন্টু ও ঢাকা থেকে পালিয়ে আসা বেশিরভাগ বাম মুক্তিযোদ্ধা কেরানীগঞ্জে আশ্রয় নেয়। সেখানে তারা এদিক-সেদিক বোমা ফাটানো জনজীবন বিপর্যস্ত করে তোলে। এপ্রিলে সেনাবাহিনী কেরানীগঞ্জে অভিযান পরিচালনা করে। তারাও সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীদের হত্যা করে। এই ব্যাপক গন্ডগোলের সময় অধ্যাপক হামিদুর রহমান কেরানীগঞ্জের মানুষের পাশে দাঁড়ান ও দুই বাহিনী থেকেই গণমানুষকে রক্ষার চেষ্টা করেন।

অধ্যাপক হামিদুর রহমানের মৃত্যুর পর এই মসজিদ পরিচালনার দায়িত্ব আসে তার ছেলে নসরুল হামিদ বিপুর কাছে। নসরুল হামিদ বর্তমানে আওয়ামী এমপি ও জ্বলানী প্রতিমন্ত্রী। তিনি দায়িত্বে আসার পর মসজিদটি সংস্কারের প্রসঙ্গ আসে। মসজিদটির ছাদ বেয়ে পানি পড়ে ও মসজিদে মুসল্লিদের স্থান সংকুলান হয় না। নসরুল হামিদ আগের স্থাপনা রেখেই নতুন মসজিদ করার পরিকল্পনা করেন। কারণ তিনি ঐতিহ্য হারাতে চান নি। নতুন মসজিদ তৈরির জন্য তিনি দায়িত্ব দেন বাংলাদেশের নামকরা স্থপতি কাশেফ মাহবুব চৌধুরীকে।

কাশেফ মাহবুব চৌধুরী বাংলাদেশের সেরা আর্কিটেক্টদের একজন। ২০১৬ সালে তিনি ফ্রেন্ডশিপ সেন্টারের জন্য আর্কিটেক্টদের সর্বোচ্চ পুরস্কার 'Aga Khan Award for Architecture' লাভ করেন। চট্টগ্রামে থাকাকালে তার আরেকটি স্থাপনা চাঁদগাঁও আবাসিক মসজিদের নিয়মিত মুসল্লি ছিলাম।

যাই হোক কাশেফ মাহবুব দোলেশ্বর মসজিদকে পুরো একটি কমপ্লেক্সে পরিণত করে। আগের মসজিদের পূর্ব দিকে থাকা পুকুর ভরাট করে চার বিঘা জমির ওপর নতুন মসজিদ তৈরি করা হয়। নতুন মসজিদের চারদিক থেকে খোলা যায়। তাই বাতাস চলাচলের কারণে গরমকালে এটি বেশ আরামদায়ক হয়। মসজিদের তিনদিকে বিশাল চত্ত্বর ও বসার স্থান আছে। যাতে বাচ্চার দৌড়াদৌড়ি করে ও মুরুব্বিরা বসে নানান বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। ফলে মসজিদটি এখন একটি সামাজিক মেলবন্ধনের জায়গা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মসজিদটি ৩০ টি বৃক্ষাকৃতির কংক্রিটের পিলারের ওপর কংক্রিটের ছাদ। ছাদে একটি ডিম্বাকৃতির গম্বুজ রয়েছে। এটি আমার কাছে সুন্দর লাগেনি। আমার মনে হয় গোলাকার ও বড় গম্বুজ হলেই বেশ মানাতো। তিনি হয়তো ভিন্নতা তৈরি করতে এই পলিসি নিয়েছেন। ছাদটি এমনভাবে তৈরি তাতে মনে হচ্ছে ছাদকে ছয়ভাগে ভাগ করা হয়েছে। দুইটি কংক্রিটের বড় খন্ডের মাঝে গ্লাস দেওয়া হয়েছে যাতে ওপর থেকে আলো মসজিদে প্রবেশ করতে পারে। মসজিদে প্রচুর আলো ও বাতাস প্রবেশ করতে পারে।

মসজিদটির পুরো কমপ্লেক্স জুড়ে সর্বত্র লালের ছড়াছড়ি। লাল টাইলসে মুসল্লিদের সিজদাহ বেশ পবিত্র আবহ তৈরি করে। প্রায় ১৬০০ মানুষ একসাথে সেখানে নামাজ পড়তে পারে। লাল রং যারা অপছন্দ করেন তাদের জন্য এটি বাড়াবাড়ি মনে হতে পারে। তবে আমার কাছে বেশ মনোহর মনে হয়েছে। এর কারণ হিসেবে কাশেফ মাহবুব বলেছেন আগের মসজিদটি লাল রং-এর থাকায় তিনি ঐতিহ্য হিসেবে লালকে বেইস করেছেন। পুরাতন মসজিদ এখন ব্যবহার হচ্ছে না। তবে পরিকল্পনা রয়েছে এটিকে লাইব্রেরিতে পরিণত করা হবে।

মসজিদ তিনদিকে অর্থাৎ পূর্ব দিক বাদে বাকী সব দিকে কৃত্রিম লেক ও ফোয়ারা তৈরি করা আছে। তাই উত্তর ও দক্ষিণ দিকে দরজা খোলা গেলেও মুসল্লি প্রবেশ করতে পারে কেবল পূর্ব দিক থেকে। এই মসজিদে একটি দারুণ বিষয় ছিল এর সাউন্ড সিস্টেম। সাধারণত মসজিদের সাউন্ড সিস্টেম ভালো হয় না। ইমামের সুন্দর তিলওয়াত সাউন্ড সিস্টেমের বদৌলতে মন ছুঁয়ে গেছে। মসজিদের পশ্চিম-দক্ষিণ কোণে পারিবারিক কবরস্থান। সেটাও সুন্দর করে গোছানো হয়েছে। পশ্চিম-উত্তর দিকে রয়েছে সুন্দর ওয়াশরুম। মন ভালো করে দেওয়ার মতো একটি স্থাপনা দোলেশ্বর জামে মসজিদ। সময় থাকলে একটি বিকাল ঘুরে আসুন। শান্তি পাবেন।

রাত নামলে মসজিদ নতুন রূপ ধারণ করে। সেটা আরো মায়াবী। মসজিদের ভেতরে ও বাইরের চত্ত্বরের লাইটিং একটি স্বপ্নময় জগত তৈরি করে। এমন সুন্দরে আপনার ঘন্টা পর ঘন্টা কাটিয়ে দিতে একটুও বিরক্তি আসবে না।

মসজিদ থেকে বের হয়ে ঘাটের কাছে পাবেন প্রচুর স্ট্রিট ফুডের দোকান। আমার মতো ভোজন রসিক হলে খাবারের মতো হালাল বিনোদন থেকে বঞ্চিত হবেন না আশা করি।

যেভাবে যাবেন...
সাধারণত কোনো স্থানে যাওয়ার জন্য এখন লোকেশন বলার দরকার হয় না। এখন গুগল ম্যাপ সবার হাতে হাতে। তবে এই মসজিদের জন্য সাজেশন লাগবে। নইলে গুগল ম্যাপ আপনাকে পুরো কেরানীগঞ্জ ঘুরিয়ে মারবে। ঢাকার যে কোন স্থান থেকে পোস্তগোলা ব্রিজের গোড়ায় অর্থাৎ জুরাইন রেল গেইটে চলে আসবেন। যারা এই স্থানটি চিনছেন না তাদের জন্য বলছি, যাত্রাবাড়ি থেকে জুরাইন রেল গেইট মাত্র দুই কিলোমিটার দূরে। অর্থাৎ যাত্রাবাড়ি এসে রিকশায় ২০/৩০ টাকা দিয়ে জুরাইন রেল গেইটে আসতে পারেন।

জুরাইন রেল গেইট থেকে রিকশা করে দোলেশ্বর ঘাটে চলে আসবেন। ৩০/৪০ টাকা নিবে। দোলেশ্বর ঘাটে ২ টাকা ঘাট চার্জ দিবেন। তারপর ট্রলারে করে বুড়িগঙ্গার ওপারে অর্থাৎ কেরানীগঞ্জের দোলেশ্বরে যাবেন। ট্রলার ভাড়াও জনপ্রতি দুই টাকা। ট্রলার ছাড়া ডিঙ্গি নৌকা আছে যেখানে ৭/৮ জন বসা যায়। ডিঙ্গি নৌকা দিয়ে পার হতে চাইলে বিশ টাকা দিতে হবে। দোলেশ্বরে নেমে মাত্র ১৫০ মিটার হাঁটলেই মসজিদ।

আর কেউ যদি ব্যক্তিগত পরিবহনে আসেন তবে দোলেশ্বর ঘাটে আপনার যানবাহন রেখে তারপর নদী পার হতে পারেন।

পঠিত : ৩৯২ বার

মন্তব্য: ০