Alapon

সৌদি প্রিন্সের ইসরায়েল-বিরোধিতার নেপথ্যে === ==== ===


সৌদি প্রিন্স তুর্কি বিন ফয়সাল সম্প্রতি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কঠোর বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি ইসরায়েলকে সম্বোধন করেছেন অ্যাপার্টহায়েড "কলোনাইজিং পাওয়ার" হিসেবে, যারা ফিলিস্তিনিদেরকে কনসেন্ট্রশন ক্যাম্পে বন্দী করে রেখেছে। ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং তো বটেই, কিন্তু এতে খুব বেশি আশাবাদী হওয়ার কিছু নাই। সৌদি আরব হঠাৎ করে ইসরায়েল-বিরোধী হয়ে যায়নি। ব্যাখ্যা করছি, তার আগে কিছু পটভূমি বলে নিই।

সৌদি শাসক শ্রেণির কথা বলার সময় অধিকাংশ মানুষই গড়ে সব শাসককে গালি দেয়। কিন্তু বাস্তবে সব সৌদি শাসক একরকম খারাপ না। সৌদি বাদশাহদের মধ্যে সৌদের মতো বেহিসেবি, উচ্ছৃঙ্খল, আর ফাহাদের মতো জুয়াড়ি, মদ্যপ শাসকও ছিল, কিন্তু বিপরীতে ফয়সালের মতো ধার্মিক এবং প্র্যাগমাটিক শাসকও ছিল।

বর্তমান যে বাদশাহ, সালমান বিন আব্দুল আজিজ, আপনি জানেন কিনা জানি না, কিন্তু তিনিও পার্সোনালি অত্যন্ত ধার্মিক এবং সৎ। দেশের ভেতরে এবং বাইরে তার জনপ্রিয়তা, গ্রহণযোগ্যতা এবং সম্মানও অতীতের অনেক বাদশাহর তুলনায় অনেক বেশি।

কিন্তু সৌদি শাসকদের সততার এবং ভালোমানুষির একটা লিমিট থাকে। সেটা সালমানের জন্য যেমন সত্য, ফয়সালের জন্যও তেমনই সত্য ছিল। ফয়সালকে অনেকে লিজেন্ডের পর্যায়ে নিয়ে গেছে, কিন্তু সেই ফয়সালও আমেরিকার তাবেদারিই করে গেছেন। এটা সৌদি সিংহাসনেরই নেচার। লঙ্কায় যে যাবে, রাবণ তাকে হতেই হবে।

হ্যাঁ, সত্তরের দশকে ফয়সাল আমেরিকার বিরুদ্ধে তেল অবরোধ দিয়েছিল সত্য। কিন্তু সেটা এমনি এমনি না। তার পেছনে ইরাক-লিবিয়ার মতো সেক্যুলার, অ্যান্টি-আমেরিকান আরব রাষ্ট্রগুলোর চাপেরও একটা ভূমিকা ছিল। এবং সেই স্বল্পকালীন তেল অবরোধের পর ফয়সালের আমলেই সৌদি আরবের সাথে আমেরিকার এবং ইসরায়েলের যে সুসম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল, তা অতীতের সব রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল।

ব্যাক টু বাদশাহ সালমান। সালমানের সব সময়ই প্রো-প্যালেস্টিনিয়ান হিসেবে খ্যাতি ছিল। ৬৭ সালের যুদ্ধের সময় যখন ফিলিস্তিনিদেরকে সাহায্য করার জন্য ফান্ড সংগ্রহের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়, তখন ফয়সাল তার কয়েক ডজন সৎ ভাইয়ের মধ্যে সালমানের উপরেই সেই দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন। পরবর্তীতে আফগান যুদ্ধের সময়ও মুজাহেদিনদেরকে অর্থায়ন করার দায়িত্ব ছিল সালমানের উপর।

সালমানের সাথে একদিকে আমেরিকার এবং অন্যান্য পশ্চিমা রাষ্ট্রের সম্পর্ক বেশ ভালো। কিন্তু অন্য দিকে সালমান জেনুইনলি ইসরায়েলের নীতিকে অপছন্দ করেন। এবং তার এই অপছন্দের কথা বিভিন্ন সময় পশ্চিমা কূটনীতিকদের কাছেও প্রকাশিত হয়েছে। ৯/১১ এর পর সালমান এক মার্কিন কূটনীতিককে সরাসরিই বলেছিলেন, তিনি বিশ্বাস করেন, এটা মুসলমানদের কাজ না, ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের কাজ। পরবর্তীতে অবশ্য মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তার সামনে বিভিন্ন প্রমাণ হাজির করলে তিনি তার বিশ্বাস পরিবর্তন করেন।

অ্যানিওয়ে, ব্যাপারটা হচ্ছে, বাদশাহ সালমান প্রো-ইসরায়েলি না। বরং তাকে কিছুটা প্রো-প্যালেস্টিনিয়ানই বলা যায়। তিনি সত্যি সত্যিই ফিলিস্তিন সঙ্কটের একটা সুন্দর সমাধান চান। কেমন হবে সেই সমাধান? আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরায়েল "আরব পিস ইনিশিয়েটিভ" মেনে ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিলে, এবং ৬৭র বর্ডার মেনে নিলেই সেটা হওয়া সম্ভব। বাস্তবে অবশ্য ৬৭'র বর্ডার এখন আর মেনে নেওয়া সম্ভব না, কিন্তু ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিলেই অন্তত প্রক্রিয়াটা শুরু হতে পারে।

সমস্যা হচ্ছে, একদিকে ইসরায়েল এতে আগ্রহী না, অন্যদিকে সৌদি আরবের হাতেও সময় কম। সালমানের পুত্র, ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান যে ভিশন ২০৩০ হাতে নিয়েছেন, যার মূল লক্ষ্য হচ্ছে তেল-নির্ভর অর্থনীতি থেকে বেরিয়ে এসে সৌদি আরবকে পর্যটন এবং প্রযুক্তি নির্ভর আধুনিক একটা রাষ্ট্রে পরিণত করা, সেটা সফল হওয়ার পথে এই ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সঙ্কট একটা বড় বাধা।

ভিশন ২০৩০ সফল হওয়ার জন্য, বিশেষ করে লোহিত সাগরের পাড়ে পরিকল্পিত মেগাসিটি নিওম সফল হওয়ার জন্য সৌদি আরবের ইসরায়েলের সাহায্য প্রয়োজন। শুধু বিনিয়োগ এবং প্রযুক্তিগত সাহায্যের জন্য না, ভবিষ্যতে কোনো ধরনের রাজনৈতিক উত্তেজনা যেন নিওমের উপর নেতিবাচক প্রভাব না ফেলে, সেজন্যও।

সৌদি আরবের নিজের স্বার্থেই তাই ফিলিস্তিন সঙ্কটের একটা চিরস্থায়ী সমাধান দরকার। কিন্তু সমাধানের প্রক্রিয়াটা কেমন হবে, সেটা নিয়েই সালমান এবং তার পুত্র মোহাম্মদের মধ্যে এক ধরনের ঠান্ডা লড়াই চলছে বলে ধারণা করা হয়। মোহাম্মদ বিন সালমান অনেকটা আরব আমিরাতের মতোই প্রায় বিনা হিসাবে ইসরায়েলের সাথে শান্তিচুক্তি করতে আগ্রহী, কিন্তু সালমান তাতে আগ্রহী না। তিনি ইসরায়েলের সাথে শান্তিচুক্তি করার আগে ফিলিস্তিনের ব্যাপারে একটা সুরাহা করতে আগ্রহী।

অবশ্য বাদশাহ সালমান নিজেও জানেন যেহেতু আমেরিকা এবং ইসরায়েলই পাওয়ারফুল, তাই এই সমাধান হতে হবে তাদেরকে সন্তুষ্ট করেই - তাতে ফিলিস্তিনিরা অসন্তুষ্ট হলেও কিছু করার নাই। তাই গত কয়েক বছরে তিনি একাধিকবার ফিলিস্তিনি নেতাদের সাথে বৈঠক করেছেন, তাদেরকে চাপ দিয়ে বেশ খানিকটা ছাড় দিতে রাজি করাতে চেষ্টা করেছেন।

কিন্তু বরাবরের মতোই মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির পথে প্রধান অন্তরায় ইসরায়েল। অবিশ্বাস্য রকমের ছাড় দেওয়ার পরেও প্রতিবারই তারাই পিছিয়ে যায় - তাদের আরও বেশি দরকার। এখনও ঠিক সেটাই ঘটছে। যতটুকু আনুষ্ঠানিকতা করে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিলে তার বিনিময়ে ইসরায়েলের সাথে শান্তি স্থাপনের ক্ষেত্রে সৌদি আরবের মুখ রক্ষা হয়, ততটুকু করতেও ইসরায়েল রাজি না। তারা বিনা ছাড়েই সব পেতে আগ্রহী।

সুতরাং এখন প্রিন্স তুর্কি বিন ফয়সালের ইসরায়েল-বিরোধী যে বক্তব্য, সেটাও সম্ভবত এই টানাপোড়নের খেলারই অংশ। প্রিন্স তুর্কি, বাদশাহ ফয়সালের ছেলে হলেও যেহেতু বয়সে তিনি অনেক সিনিয়র, তাই ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদের চেয়ে বরং বাদশাহ সালমানের সাথেই তার সম্পর্ক ভালো। এবং সালমানের মতোই সম্ভবত তিনিও চান, ইসরায়েল যদি কিছুটা ছাড় দিয়ে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়, তাহলেই তারা ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিবেন।

এখন সম্প্রতি ইসরায়েল-বিরোধী বক্তব্য দিয়ে তিনি সম্ভবত ইসরায়েলের উপর চাপ সৃষ্টি করতে চাইছেন, ইসরায়েলকে ইঙ্গিত দিতে চাইছেন, তারা যদি তাদের অবস্থানে অনড় থাকে, তাহলে সৌদি আরবের পক্ষেও তাদেরকে সহজে স্বীকৃতি দেওয়া সম্ভব হবে না। এটাকে তাই সৌদি আরবের ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা হিসেবে না দেখে বরং ইসরায়েলকে আলোচনার টেবিলে আনার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে দেখলেই সঠিক হবে।

আরও বিস্তারিত লেখার ইচ্ছা ছিল, বাট থাক। এখনই সব লিখে ফেললে বইয়ে কী লিখব?

লিখেছেন Mozammel Hossain Toha

পঠিত : ৫২১ বার

মন্তব্য: ০