Alapon

সাংস্কৃতিক বস্তুবাদ এবং এ যুগের শিল্প সাহিত্য...



ঊনিশ শতকের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা দিক ছিল ছিল মার্কসিজসের উত্থান। কার্ল মার্কস এবং ফ্রেডরিক এঙ্গেলস তাদের তত্ত্ব কথা দিয়ে সারা দুনিয়ায় সাড়া পেলে দেন।এর অন্যতম কারণ ছিল সভ্যতার ইতিহাস বিশ্লেষণে তাদের ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি। মার্কসিজমের মতে, সভতার ইতিহাস হলো শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস।শ্রেণি সংগ্রামের উপর ভিত্তি করেই এগিয়ে চলে মানব ইতিহাস।

মার্কস-এঙ্গেলস পুরো মানবগোষ্ঠীকে দুই শ্রেণীতে ভাগ করেছেন ; বুর্জোয়া বা ধনিক শ্রেণী।যাদের হাতে থাকে উৎপাদনের উপাদানগুলোর নিয়ন্ত্রণ। আর প্রোলেটারিয়েট বা শ্রমিক শ্রেণী।যারা একই সাথে আবার উৎপাদিত পণ্যের ভোক্তা।

মার্কসিজমের মতে, সমাজের দুটো অংশ ; বেইস (ভিত্তি) এবং সুপার স্ট্রাকচার। বেইস হলো টাকাপয়সা, অর্থনৈতিক কর্মকান্ড, কলকারখানা ইত্যাদি।আর সুপার স্ট্রাকচার হলো সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান,শিল্প,সাহিত্য, সংস্কৃতি ইত্যাদি ইত্যাদি।

সমাজের যাবতীয় কর্মকান্ডে টাকাপয়সা বা অর্থনৈতিক বিষয়গুলো মৌলিক এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।একটা সমাজের অর্থনীতি নির্ধারণ করে দেয় সে সমাজের মানুষের জীবন ধারণ পদ্ধতি, তাদের আচার - ব্যবহার এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠান সমূহের গতিবিধি।

তো এক্ষেত্রে সমাজের উঁচু তলার ধনিক শ্রেণি সমাজের কর্তা ব্যক্তিতে পরিণত হয়।তাদের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ কার্যক্রমে সমাজ পরিচালিত হয় যেহেতু তারা উৎপাদনের উপাদানগুলো নিয়ন্ত্রন করে।।ফলে সমাজের শিল্প সাহিত্যও তাদের অভিরুচি অনুযায়ী হয়ে থাকে।

আর শ্রমিক শ্রেণি বা দরিদ্র ভোক্তা শ্রেণি ইচ্ছায় অনিচ্ছায় তাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।শিল্প সাহিত্যে তাদের খুব একটা ভূমিকা থাকেনা অথবা শিল্প সাহিত্য তাদের প্রতিনিধিত্ব করেনা।ফলে সমাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়েও তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

শিল্প সাহিত্যের বস্তুবাদিতার এই ধরণা কে আরও সম্প্রসারিত রৃপ দেন রেমন্ড উইলিয়ামস। তিনি দেখান কিভাবে শিল্প সাহিত্য পুরো সমাজের প্রতিনিধিত্ব না করে শুধু নির্দিষ্ট একটি শ্রণির রুচির অনুসরণ করে অন্যান্য ভোগ্য পণ্যের মতো উৎপাদিত হয়, সৃষ্টি নয়।এক্ষেত্রে বাজার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

বস্তুবাদী ধনতান্ত্রিক সমাজে শিল্প সাহিত্য হয় বাজার মূল্য সামনে রেখে।যে শিল্পের বাজার মূল্য ভালো তার শৈল্পিক মান বা সাহিত্য মূল্য খারাপ হলেও উৎপাদন হয় বেশি।আবার ভালো সাহিত্যের বাজার কাটতি কম হওয়ায় শিল্পী সাহিত্যিকরা তাতে খুব একটা আগ্রহ দেখান না।

এবার আসি বর্তমান শিল্প সাহিত্যের কথায়।

বর্তমানের অধিকাংশ শিল্প সাহিত্যের সৃষ্টি বাজার কে সামনে রেখে।বাজারে কি ধরণের বই বেশি চলে সেকথা মাথায় রেখেই লেখক লিখতে বসেন।(ব্যতিকক্রমও আছে।তবে সংখ্যায় তা খুবই কম)।আবার বাজার ধরার ক্ষেত্রে এক ধরণের প্রতিযোগিতা চলে।

যে লেখকের বই বেশি বিক্রি হয়,যার পাঠক বেশি, তিনি বেশি সফল বলে বিবেচিত হোন।আর এই অদৃশ্য প্রতিযোগিতায় জয়ী হতে শিল্পী সাহিত্যিকদের নানান ধরনের কলা কৌশল অবল্বন করতে দেখা যায়।এই অভিনব কলাকৌশলের আড়ালে ঢাকা পড়ে যায় শিল্প সাহিত্যের মান।

শিল্প সাহিত্যের বিকাশে মধ্য যুগের ইউরোপে শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠে।কারণ তখন ইউরোপ সামন্তবাদের থেকে বেরিয়ে শিল্প যুগে প্রবেশ করছে।ফলে গ্রাম থেকে লোকজন এসে শহরে ভিড় করছে।নির্দিষ্ট সময় তারা কারখানায় কাজ করে।বাকি সময় অবসর।আর এই অবসর সময়ে তারা টুকিটাকি বই পড়া শুরু করে।

ইউরোপীয় এনলাইটেন্টমেন্টের কারণে স্বাক্ষরতার হার বাড়ছে।ফলে বই পড়ার একটা ঝোক তৈরি হয় সাধারণজনগণের মাঝে।নারীরা আগে গৃহস্থালি কাজ করত।মাঝেমাঝে কৃষি কাজও।কিন্তু শহরে এসে তারা বেকার হয়ে পড়ে।আর এই বেকার সময়ে তারা বই পড়া শুরু করে।

আর এই নব্য পাঠক শ্রেণীর কথা মাথায় রেখেই লেখকরা লিখা শুরু করেন।গড়ে ওঠে ওপেরা হাউস,থিয়েটার।

বর্তমান যুগেও সেই একই ধারা চলমান।শিল্পীর তুলিতে আঁকা ছবিতে এখন গ্রামের চেয়ে শহর বেশি প্রাধান্য পায়।শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে আকর্ষন করার জন্য নতুন নতুন শিল্প আন্দোলন শুরু হয়।কবিতা উপন্যাসে এখন আর মৃত্যুক্ষুধা,পথের পাঁচালি, সূর্য দীঘল বাড়ি আর তিতাস একটি নদীর নামের মতো গ্রামীণ লোকায়ত সংস্কৃতি আর নিম্নবিত্ত মানুষের কথা উঠে আসেনা।আসে হুমায়ুন আহমেদের উপন্যাসের মতো শহুরে মধ্যবিত্ত জীবনের নানান জটিল সমীকরন, ঘাত প্রতিঘাত,সস্পর্কের টানাপোড়েন ইত্যাদি।

একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা আরও পরিষ্কার হবে।বর্তমান বাংলাদেশের মোটামুটি জনপ্রিয় একজন লেখকের একটা বই গত কিছুদিন আগে প্রকাশিত হয়েছে।তিনি সেই বইটাকে ভিন্ন চারটা রং এর প্রচ্ছদে বের করেছেন।এখন প্রশ্ন হলো, একটি বইয়ের চারটি ভিন্ন রং এর প্রচ্ছদের কি প্রয়োজন? যদি বইয়ের সাহিত্য মানই বিচার্য হয়, তবে প্রচ্ছদ এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে কি করে?

এই প্রশ্নের উত্তর উপরের কথাগুলোতেই আছে।সাহিত্য সৃষ্টির উদ্দেশ্যে এখন শিল্পচর্চা নয়, শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মনোরঞ্জন করে বাজার অর্থনীতির অংশীদার হওয়া।আর তার জন্যই এত ফন্দিফিকির।

প্রকৃত সাহিত্য আর সস্তা বাজারি সাহিত্যের মৌলিক পার্থক্য এখানে বুঝা যায়।এখনকার শিল্প সাহিত্য এর ঐতিহ্য কে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেয়ে বরং বাজার ধরার, বিখ্যাত হওয়ার এবং নির্দিষ্ট একটি শ্রেণির মনোরঞ্জনের জন্যই তৈরি হয়।তাই শিল্প সাহিত্যে মানুষের সত্যিকারের অনূভুতি আর বাস্তবতার বিপরীতে প্রতিফলিত হয় বাজার অর্থনীতি।যা অধিকাংশ পাঠকই বইয়ের কালো অক্ষরের মাঝে ধরতে পারেন না।

Cltd

পঠিত : ১৫২২ বার

মন্তব্য: ০