Alapon

পেশা হিসেবে শিক্ষকতা এবং কিছু কথা...



শিক্ষার মানোন্নয়ন নিয়ে আমাদের মাথা ব্যথার যেন শেষ নেই। অথচ যারা শিক্ষা নিয়ে কাজ করেন, তাদের জীবনমান নিয়ে ভাববার যেন কেউ নেই। ফি বছর কারিকুলাম আর পাঠ্য বই পরিবর্তন করে কখনোই শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব হবে বলে আমার মনে হয় না। একটা বৃক্ষকে শক্ত, সামর্থ্যবান এবং ফুল ও ফলবান করার জন্য যেমন গাছের উপরে নয় গোড়ার মাটিতে পানি ও সার দিতে হয় তেমনি জাতির মেরুদণ্ড শিক্ষাকে যথাযোগ্য করার জন্য জাতি গঠনের কারিগর শিক্ষকদের জীবনমান এবং তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।

শিক্ষার ভিত্তি রচিত হয় প্রাইমারী লেভেলে। অথচ আমাদের প্রাইমারী লেভেলের শিক্ষকদের মাইনে হচ্ছে রাষ্ট্রের ৩য় শ্রেণির চাকুরেদের সমান। তাহলে ভালো ছাত্র কখনোই ভালো রিজাল্ট নিয়ে স্বেচ্ছ্বায় রাষ্ট্রের ৩য় শ্রেণির নাগরিক হতে যাবেন না। সেখানে আরোও মজার ব্যাপার হলো গত বছর পর্যন্ত প্রাইমারী লেভেলের শিক্ষক নিয়োগে ইন্টারমিডিয়েট পাশ নারীদের জন্য বরাদ্দ ছিলো ৬০-৭০% কোটা।তাহলে ভেবে দেখুন আমাদের শিক্ষার ভিতটা কত শক্ত হয়ে গড়ে উঠছে?

এবার আসুন মাধ্যমিক লেভেলে। দেশের মোট শিক্ষার ৯৫-৯৭% মাধ্যমিক শিক্ষা বেসরকারি। 'এমপিওভূক্ত' নামক এক ধরনের আজব পদ্ধতিতে এইসব বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। এখানে প্রাথমিক লেভেল থেকে আরো বেশি অবহেলিত হয় শিক্ষকগণ। এন্ট্রি লেভেলের মাধ্যমিক শিক্ষক মাত্র ১২৫০০/ টাকায় তার কর্ম জীবন শুরু করেন। এখানে নেই কোন বাড়ীভাড়া, নেই কোন বদলি, নেই কাঙখিত পদোন্নতি। বদলিহীন পদোন্নতিহীন এই লেভেলের শিক্ষকরা তাদের জীবন নির্বাহের প্রয়োজনীয় রসদ যোগাতেই নানা ফন্দিফিকির করে টিউশন করে জীবন শেষ করে ফেলেন। অতি দূর্বল ভিত নিয়ে প্রাইমারী পাশ করা ছাত্র মাধ্যমিক স্তরেও অধিকাংশ জায়গায় প্রয়োজনীয় শিক্ষা থেকে বঞ্চিত অবস্থায় ফি বছর মাধ্যমিক স্তর অতিক্রম করছে।

এরপর আসুন উচ্চ মাধ্যমিক লেভেলে। এখানেও অধিকাংশ কলেজ এমপিওভূক্ত নামের গ্যাঁড়াকলে আটকে আছে। একই সিলেবাস, একই শিক্ষাক্রম, পাঠক্রম অনুসরণ করে পাঠদান করা সরকারি আর বেসরকারি শিক্ষকদের মাইনে আর জীবন মানের বিস্তর ফারাক। এখানে নেই কোন পদোন্নতি, নেই কোন বদলি। এন্ট্রি লেভেলে প্রভাষক হিসেবে জয়েন করে অধিকাংশ শিক্ষক প্রভাষক হিসেবেই অবসরে যাচ্ছেন। সম্ভবত পৃথিবীতে কেবলমাত্র বাংলাদেশেই এই অদ্ভুত নীতিমালা রয়েছে। যার নাম অনুপাত প্রথা। মানে প্রতি ৫ জন প্রভাষকে ২ জন সহ: অধ্যাপক হতে পারবেন। অদ্ভুত! একই যোগ্যতা এবং একই দিনে জয়েন করেও আপনার দুইজন সহকর্মী সহ অধ্যাপক আর আপনি বিনা দোষে প্রভাষক। কোন ধরনের বদলি আর পদোন্নতি না থাকায় এই লেভেলের শিক্ষকরা ভোগেন আরোও বেশি হতাশায়। তাদের স্টাটাস অনুযায়ী কাম্য বেতন ভাতা না থাকায় তারা সামাজিক ভাবে খাপ খাইয়ে নিতে পারেন না। আর এভাবেই ফি বছর আপনার আমার সন্তানকে দিয়ে যাচ্ছে গুণগত মানহীন উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা।

এরপর আসেন উচ্চ শিক্ষায়। স্বাধীনতার পর থেকে যে হারে আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার কথা ছিলো হয়েছে তার চেয়ে অনেক গুণ কম। যদিও ইদানিং জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ক্ষমতাশীল রাজনৈক দলের ক্যান্টনমেন্ট ছাড়া খুব বেশি কাজে আসছে বলে আমার মনে হয় না। এখানে নেই কোন গবেষণা, নেই কোন গবেষণা বাজেট, নেই কোন গবেষক। ফি বছর চাকুরীর বাজারে একদল অদক্ষ বেকার সাপ্লাই দেওয়াই যেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আহা কোথায় আজ গবেষনা? পৃথিবীর বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের গবেষণায় সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ দিয়ে থাকে।কারণ গবেষণার উপর ভিত্তি করেই বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যাংকিং করা হয়। আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকগণও কেবল তাদের প্রমোশনের জন্য নামকাওয়াস্তে কিছু গবেষণা করে থাকেন। তার উপর শিক্ষক নিয়োগে মেধাবীদের পরিবর্বতে রাজনৈতিক প্রভাবে পেছনের সারির শিক্ষার্থীরা শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাচ্ছেন। তাহলে এই বিশ্ববিদ্যায় হতে কিভাবে আমারা আমাদের জাতি বিনির্মাণের কারিগর আশা করি?

কর্তাব্যক্তিদের প্রতি আমার বিশেষ অনুরোধ:

* প্রাইমারী লেভেলে দেশের সবচেয়ে মেধাবীদের নিয়োগের ব্যবস্থা করুন। বেতন কাঠামো এবং পদমর্যাদায় প্রাইমারীর শিক্ষকদের জন্য সম্মানজনক সংস্কার করুন। যাতে মেধাবী তরুণ প্রজন্ম প্রাইমারী লেভেলে শিক্ষক হয়ে আমাদের ভবিষ্যৎ ভিত্তিটা।মজবুত করতে পারে।

* মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক লেভেলে এই 'এমপিওভূক্ত' সিস্টেম বাদ দিয়ে পুরো শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণ করুন। শিক্ষকদের জন্য মান সম্মাত বাস্তব সম্মত বেতন কাঠমো ঠিক করে সরকারি বেসরকারি ব্যবধান ঘুচিয়ে শিক্ষকদের পদোন্নতি এবং পুরষ্কার ও তিরষ্কারের বদলি চালু করুন।

* বিশ্ববিদ্যায়গুলোতে রাজনৈতিক বিবেচনা বাদ দিয়ে মেধার ভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগের নিশ্চয়তা দিন। শিক্ষা গবেষণায় প্রচুর বরাদ্দ দিন। বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যায়ের সংখ্যা বৃদ্ধি করে প্রডাক্টিভ গ্রাজুয়েট প্রভাইট করার পথ সুগম করুন।

আশা করি আমাদের জাতির মেরুদণ্ড শিক্ষা সোজা হয়ে দাঁড়াবেই। এবং ফুলে ফলে এই জাতিকে সমৃদ্ধ করবে ইনশাল্লাহ।

- মনজুর আহমাদ

পঠিত : ৪৮২ বার

মন্তব্য: ০