Alapon

||ইমাম আবু দাউদ রাহিমাহুল্লাহ-১ম পর্ব||




সকল আমলই নিয়্যাতের ওপর নির্ভরশীল"।

"ইসলামের সৌন্দর্য হলো অপ্রয়োজনীয় কথা ও কাজ পরিত্যাগ করা"।

"কোনো ব্যক্তি মু'মিন গতে পারবে না ততোক্ষণ, যতোক্ষণ সে নিজের জন্যে যা পছন্দ করে তা অপর মুসলিম ভাইয়ের জন্যে না করবে! "

"হালাল সুস্পষ্ট এবং হারামও সুস্পষ্ট!"


ওপরের দুর্দান্ত ও জীবনঘনিষ্ঠ চমৎকার হাদিস সমূহ তিনি তাঁর গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন। এই হাদিসগুলো হাদিসের মৌলিক ও প্রধান সকল গ্রন্থে মুহাদ্দিসরা উল্লেখ করলেও এই হাদিসগুলো নিয়ে তিনি করেছেন অসাধারণ হৃদয় আলোড়নকারী মন্তব্য। তিনি উক্ত হাদিস সমূহ সম্পর্কে বলেন –আমি রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু অা'লাইহি ওয়াসাল্লাম এর পাঁচ লক্ষাধিক হাদিস থেকে গ্রহণ বর্জনের মধ্যে ৪৮০০টি হাদিস নিয়ে এসেছি এই গ্রন্থে। যেগুলো সহীহ্ এবং হাসান হাদিস। এই বিশাল গ্রন্থের মধ্য থেকে মাত্র (এই) চারটি হাদিসই দ্বীনুল ইসলাম অর্জনের জন্য যথেষ্ঠ!


সত্যি কেউ যদি এই হাদিসগুলোকেই বুঝে, ধারণ করে হৃদয়ে, আর চেষ্টা করে উপলব্ধি করতে তাহলে তার জন্য ইসলামের বিধানকে হৃদয়ে চাষাবাদ করার জন্যে, মন-মগজে ধারণ করার জন্যে যথেষ্ঠ!


তিনি তাঁর হাদিসগ্রন্থে প্রায় সকল হাদিস সম্পর্কেই মন্তব্য করতেন। কোনটা সহীহ্, কোনটা দ্বয়ীফ, কোনটা নাসিখ কোনটা মানসুখ,একই জাতীয় হাদিসের দু'ধরণের বর্ণনা পেলে কোনটা সন্দেহযুক্ত কোনটা বিশুদ্ধ তা তিনি বলে দিতেন, সুস্পষ্টরূপে। তবে কোনো কোনো হাদিসের ক্ষেত্রে তিনি মন্তব্য না করে চুপ থেকেছেন।


এই যে চুপ থাকা, এটা নিয়ে আলিমদের মাঝে মতপার্থক্য তথা মতভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়! তারা অধিকাংশই মনে করেন যে, যেহেতু তিনি চুপ থেকেছেন তার মানে এই নয় যে হাদিসটি দ্বয়ীফ। বরং হাদিসটি হাসান। কেউ কেউ বলেন যে তা দ্বয়ীফই। কিন্তু বাস্তবে মোটের ওপর তেমনটি না।
কারণ, তিনি যখন হাদিস সংকলনের কাজে মনপ্রাণ দিয়ে নেমে পড়লেন, তখন কিন্তু মক্কার অধিবাসীদের পত্র প্রেরণ করেছেন। সেই পত্রে তিনি গ্রন্থটি ফিকহী পদ্ধতিতে সাজানো এবং সর্বোচ্চ সতর্কতার সাথে সহীহ্ পদ্ধতিতে তা সংকলিত করার কথা উল্লেখ করেছেন।

ইসলামের ইতিহাসের একেবারে প্রথম থেকেই মুহাদ্দিসরা বিধি-বিধান এবং উপদেশমূলক হাদিস সংগ্রহ ও সংকলনের ওপর অধিক গুরুত্ব প্রধান করেন। বাস্তব জীবন ও কর্মের জন্যে তো রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু অা'লাইহি ওয়াসাল্লামের দৈনন্দিন কর্মের বিষয়গুলো সবচে বেশি প্রয়োজন। যার পরিপ্রেক্ষিতে হিজরি তৃতীয় শতকের শেষার্ধ থেকে মুহাদ্দিসরা শরিয়তের বিধান সম্পর্কিত হাদিসগুলো সংকলনের ওপর একটু বেশি গুরুত্ব দিতে থাকেন। আর এই বিধান বা আহকাম জাতীয় হাদিস গ্রন্থসমূহকে বলা হয় সুনান।


আল্লাহর নবী মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু অা'লাইহি ওয়াসাল্লামের দৈনন্দিন জীবনের কর্ম তথা স্বলাত, সওম, হাজ্জ্ব, ব্যবসা-বাণিজ্য, ক্রয়-বিক্রয়, বিয়েশাদি, শাসনব্যবস্থা, সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা তথা বাস্তব জীবনের বিষয়গুলো অধিকতর জরুরি।


এই জিনিসটা উপলব্ধি করেন তিনিও। তাই নেমে পড়েন কর্মেও। ব্যবহারিক জিন্দেগীর আমলের যে হাদিস সমূহ –সেগুলো সংগ্রহের মতো মহৎ উদ্যোগ আর উদ্দেশ্য নিয়ে। শুরু করেন সংগ্রাম আর সাধনা। তিনি আল্লাহর রাসুলের মুখনিঃসৃত অমিয় বাণী সমূহের যে মহা সাগর,সে মহা সাগরে ডুবুরি হয়ে সাঁতার কেটে সেখান থেকে সিঞ্চন করতে শুরু করেন মানুষের সীমিত যে জিন্দেগি, সে জিন্দেগি যাপনের উপযোগী হাদিস সমূহ! পূর্বেই তো বলেছিলাম যে, এ-সব হাদিসগ্রন্থকেই বলা হয়ে থাকে সুনান। আর তিনিছিলেন সুনান গ্রন্থ সংকলকদের পথিকৃৎ। তিনি তাঁর সুনান গ্রন্থে সে-সকল হাদিস সন্নিবেশ করেছেন, যেগুলোকে ফিকহের ইমামরা তাঁদের মতামতের পক্ষে দলিল হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি নিজেই বলেছেন, 'আমার এ কিতাবের মধ্যে ইমাম মালিক, ইমাম সাওরি, ইমাম শাফিঈ (রহঃ)দের মাজহাবের ভিত্তি মজুদ রয়েছে।'


যতোটুকু জানা যায় -তিনি তাঁর যৌবনের সোনালি সকালেই 'সুনান গ্রন্থটির রচনা সম্পন্ন করেন। তিনি তাঁর স্মৃতির মলাটে আবদ্ধ হাদিসের সুবিশাল ভাণ্ডার থেকে যাচাই-বাছাই করে মোট চার হাজার ৮০০ হাদিস তাঁর সুনান গ্রন্থে সমবেত করেন। এ বিষয়ে তিনি নিজেই বলেন, 'আমি রাসুলে করিম (সা.)-এর পাঁচ লাখ হাদিস লিপিবদ্ধ করেছিলাম। তার মধ্য থেকে বাছাই করে মনোনীত হাদিসগুলো এ গ্রন্থে সমবেত করেছি।'


দিনের পর দিন যায়। একপর্যায়ে তাঁর গ্রন্থের রচনা-সংকলনেরও পরিসমাপ্তি ঘটে। এরপর প্রথম তা নিজের উস্তাদের নিকট উপস্থাপন করেন। যেই উস্তাদের কাছে তিনি তা উপস্থাপন করেছেন, তিনি আর কেউ নয়, তাঁর সেই উস্তাদ ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রহ.)! তাঁর উস্তাদ ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রাহিমাহুল্লাহ বিমুগ্ধ আর বিমোহিত হন। আনন্দে চোখের তারা যেনো চিকচিক করে ওঠে। কে না খুশি হয় তার হাতে গড়া মানুষের, সাগরেদের এমন অভাবনীয় মহৎকর্ম দেখে? হয়েছেন তিনিও।
তিনি তাঁর সেই গ্রন্থখানা খুবই পছন্দ করেন এবং একখানা উত্তম হাদিস গ্রন্থ বলে প্রশংসা করেন।প্রশংসার প্রেরণায় উদ্দীপ্ত করেন তাঁর প্রিয় ছাত্রকে! অতঃপর তিনি নিজের সেই গ্রন্থখানা সকলের জন্য সর্বসাধারণের জন্যে উন্মুক্ত করেন, উপস্থাপন করেন। তাঁর পরিশ্রম, মনোযোগিতা, একাগ্রতার আর সাধনার সাক্ষী তাঁর ছেলে ইমাম আবু বকর রাহিমাহুল্লাহ! তাঁর জীবনাচরণ সে সময়ের, সে যুগের মানুষদের মধ্যে একেবারে ব্যতিক্রমধর্মী ছিলো! ওনার ছেলে বলেন যে, তিনি ইলমুল হাদিসের সাগরে এমনভাবে ডুবে থাকতেন খাবারের সময়টা পর্যন্ত পেতেন না ঠিকমতো!


ইলমে হাদিসের এই উজ্জ্বল তারকা আল ইসলামের এই প্রজ্জ্বল বাতিটা আর কেউ নয়, তিনি ইমাম আবু দাউদ রাহিমাহুল্লাহ! সুনানে আবু দাউদ'-এর সংকলক তিনিই। তাঁর রচিত গ্রন্থের নাম সুনান হলেও পরবর্তীতে ওনার নামের সাথেই একে যুক্ত করে "সুনানে আবু দাউদ" নামে নামকরণ বা চিহ্নিত করা হয়। এই মহান ইমাম আবু দাউদ রাহিমাহুল্লাহ ইলমে হাদিস চর্চার স্বর্ণযুগ ২০২ হিজরি সনে, ৮১৭ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান আফগানিস্তানের কান্দাহার ও চিশতের কাছে সিস্তান নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মূল নাম সুলাইমান, উপনাম আবু দাউদ, বাবার নাম আশয়াস, দাদার নাম ইসহাক। জন্মস্থানের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে তাঁকে সিজিস্তানি বা সিস্তানি বলা হয়।
কারো কারো মতে তাঁর জন্ম ২০৩ হিজরিতে। যদিও সেটা দুর্বল মনে করেন অধিকাংশ ইতিহাসবিদ।

অনেক মানুষের জীবন একেক সময় একেক স্থানে কাটে। ইমাম আবু দাউদ রাহিমাহুল্লাহ'র জীবনী সম্পর্কে পড়াশোনা করে যতোটুকুন অনুমিত হয়, তা হলো ইমাম আবু দাউদ রাহিমাহুল্লাহ'র শৈশব সিস্তানেই কেটেছিল। পারিবারিক পরিমণ্ডলে অর্জন করেন প্রাথমিক শিক্ষা!


||ইমাম আবু দাউদ রাহিমাহুল্লাহ-০১ম পর্ব||
~রেদওয়ান রাওয়াহা


[কপি করা নিষেধ, সংকলকের পক্ষ থেকে অনুমতি নেই ]

পঠিত : ৪৬৭ বার

মন্তব্য: ০