Alapon

মারমাডিউক মোহাম্মদ পিকথল

মোহাম্মদ মারমাডিউক পিকথল। এ যুগের মানুষের কাছে যে নামটি অপরিচিত। তাকে নিয়ে কোনো আলোচনা বা লেখালিখি আমাদের চোখে পড়ে না বললেই চলে। চলুন আমরা আজকে এই পশ্চিমা মুসলিম পণ্ডিত ও কোরআনের অনুবাদককে নিয়ে একটু জানার চেষ্টা করি।

তার জন্ম লন্ডনে ১৮৭৫ সালের ৭ই এপ্রিল। পূর্ব পুরষ ছিলেন রাজা উইলিয়ামের সময়কার নাইট। এলজন এ্যাংলিকান ধর্মযাজকের ছেলে তিনি। পশ্চিমের জীবনধারার প্রতি সেই ছুটবেলা থেকেই এক ধরনের অনিহা কাজ করছিলো। সেই অনিহা থেকে এবং ফিলিস্তিনের কনসুলার অফিসে চাকরি উদ্দেশ্যে তিনি মধ্যপ্রাচ্যে উদ্দেশ্যে জাহাজে উঠে পড়েন। যে জীবনের প্রতি তার মাঝে একটা অন্যরকম আকর্ষণ কাজ করছিলো সেই জীবনের প্রতিই ছিলো তার এই রওয়ানা হওয়া। সেখানে গিয়ে তিনি সেখানকার জীবনাচরণের মাঝে এমন এক স্বাদ পান যেটা তার ভাষায় 'পাশ্চাত্যের কোন স্কুল ছাত্রের পক্ষে বোঝা অকল্পনীয়'।

ফিলিস্তিন সিরিয়ায় ঘোরাঘুরির ভেতর দিয়ে পিকথল এক ধরণের আধ্যাত্মিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পর্যটনও করেন। শেষ পর্যন্ত তার কাছে ইসলামকেই মনে হয় সংস্কার মুক্ত, যুক্তিধর্মী, ন্যায়ানুক ধর্মের বিলাতী স্বপ্নের পূর্ণ বাস্তবায়ন [১]।

কিন্তু এতদূর এগিয়ে গিয়ে তার ইসলামে আসতে অপেক্ষা করতে হয়েছিলো আরোও অনেকদিন। এর কারণ ছিলো পিকথলেত বৃদ্ধ মা। বৃদ্ধ মা তার এই কনভারসনটা হয়ত মেনে নিতে পারতেন না।

সেই সময় তিনি একই সাথে ইসলামী নীতি ও বিশ্বাসকে খ্রিষ্টীয় ধর্মতত্ত্বের ভেতর খুজে ফিরছিলেন। কিন্তু এই অবস্থান থেকে সরে আসতে পিকথলের আর বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি, ১৯১৭ সালে এসেই তিনি সস্ত্রীক ইসলাম গ্রহণ করেন এবং তখন নামের 'মোহাম্মদ' জায়গা করে নেয়।

এবার আমরা একটু ভিন্ন কিছু দেখার চেষ্টা করবো। যে পিকথলের এক সময় ইসলামের জাগতিক সমৃদ্ধি ও ঐশ্বর্যের প্রতি ঝুক ছিলো সেই তিনি এমন এক সময় ইসলাম গ্রহণ করলেন যখন ইসলাম ও মুসলিমরা ছিলো এক সংকটময় অবস্থায়। তখন একদিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারনে তুরস্কের ভেংগে যাওয়া অবস্থা আর অন্যদিকে শেষ খিলাফত 'উসমানি খিলাফাহর' ভবিষ্যৎ অন্ধকার। এরকম অবস্থায় পিকথলের কনভারসনটা মোটের উপর ইসলামের অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্যের উপর বিবেচনা করেই ছিলো।

ইসলামের খেদমতের জন্য তখন থেকেই মোহাম্মদ পিকথলের কাজ করে যাওয়া শুরু। বোম্বে ক্রনিকাল পত্রিকার সম্পাদনা দায়িত্ব গ্রহণের জন্য ১৯২০ সালে চলে আসেন ভারতে এবং পনেরো বছর এখানের মুসলমানদের সাথে থেকে তাদেরই একজন হয়ে যান।

এবার আমরা পিকথলের কাছ থেকে প্রাপ্ত সবচেয়ে বড় উপহারটা নিয়ে কথা বলবো। ‘The Meaning Of The Glorious Koran’ কোরআনের ইংরেজি তরজমা যেটা এই প্রথম এমন একজন মুসলমানের হাতের তরজমা যার মাতৃভাষা হলো ইংরেজি। চাকরিতে ১৯২৯ থেকে ১৯৩১ এই দুইবছর ছুটি নিয়ে তিনি কোরআনের তরজমার কাজ পুরোদমে এগিয়ে নেন। এ তরজমার অনুমোদনের জন্য তিনি মিশরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের উলামাদের সাথেও দেখা করেন। শায়খ-উল-আজহার আল মারাঘী পিকথলের কাজের সাফল্য কামনা করেন।

তার এই তরজমা পড়ে অসংখ্য ইংরেজি ভাষাভাষী মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেন। এরপর থেকেই মুলত মোহাম্মদ পিকথলের ধর্মীয় নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ আসে। তিনি হয়ে উঠেন একজন অক্লান্ত কর্মসাধক, ইসলামী জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তির জগতে এক সিপাহসালা। বিভিন্ন জটিল ও আইনি বিষয়ে তার মতামত নিতে চাইলে তিনি যথাযথ ফাতওয়া দেন।

মোহাম্মদ মারমাডিউক পিকথল যার সামনে খোলা ছিলো প্রাচ্যের চাকচিক্যময় জীবনের পথ যেখানে খুব সহজেই তিনি হারিয়ে যেতে পারতেন। সেই তিনি ইসলামের অভ্যন্তরীণ মর্ম ও সৌন্দর্যকে আকড়ে ধরে ফিরে আসলেন ইসলামের ছায়ায়। এবং তার হাত ধরে কোরআনের নন্দিত তরজমা দুনিয়া জুড়ে ইংরেজি ভাষাভাষী মানুষের কাছে বিপুলভাবে ছড়িয়ে পড়ে।

পিকথল ১৯৩৬ সালের ১৯ মে অসুস্থ অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। ব্রুকউড মুসলিম কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয় যে জায়গা বহুবছর পর কোরআন শরীফের আরোও এক অনবদ্য তরজমাকারী 'আব্দুল্লাহ ইউসুফ আলীর'ও শেষ শয্যা হয়।

“A soldier of faith! True servent of Islam”

————————————-
(১. উত্তর আধুনিক মুসলিম মন ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা ৪৯)

|| আল মুনিম||

পঠিত : ৫০১ বার

মন্তব্য: ০