Alapon

কাতার সংকটের মূল্য কত?




২০১৭ সালের জুন মাসে কট্টরপন্থায় মদদ দেয়া ও শিয়া মতাবলম্বী ইরানের সাথে ঘনিষ্ঠতার অভিযোগে সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন উপসাগরীয় আরো তিন মুসলিম রাষ্ট্র কাতারের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে জল-স্থল-আকাশ পথে অবরোধ আরোপ করে একঘরে করে ফেলে ১১,৫৮১ বর্গকিলোমিটারের ক্ষুদ্র রাষ্ট্র কাতারকে।
উদ্ভূত সংকটে অবস্থার পরিবর্তনের জন্য তের দফা সম্বলিত দাবি উত্থাপন করে সৌদি নেতৃত্বাধীন চারটি দেশের তথাকথিত সন্ত্রাসবাদবিরোধী জোট।
যেগুলোর মধ্যে রয়েছে আল-জাজিরার সম্প্রচার বন্ধ, মুসলিম ব্রাদারহুডকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া ও ইরান ও তুর্কী বলয় থেকে বেরিয়ে আসা।

বাহ্যত এসবগুলো শর্তই একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্য চরম অবমাননাকর। আধুনিক বিশ্বের কূটনৈতিক সভ্যতা-ভব্যতার মাথা খেয়ে ক্ষুদ্র রাষ্ট্র কাতারের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে চরম অবমাননাকর এসকল শর্ত চাপিয়ে দেয় সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন চার দেশের সন্ত্রাসবাদবিরোধী জোট।

তাৎক্ষণিকভাবে আরোপিত এই অবরোধের ফলে কাতার ও কাতারের জনগন বেশ বড়সড় একটা ধাক্কা খায়। অবরোধ আরোপের ঘোষণা দেয়ার ২৪ ঘন্টা অতিক্রান্ত হওয়ার আগেই কাতারের সবগুলো সুপারশপ খালি হয়ে যায়। অবরোধে খাদ্য-সংকট থেকে বাচতে কাতারের জনগন খাদ্যদ্রব্য মজুত করতে আরম্ভ করেন। এরই মধ্যে কিছু কিছু অসমর্থিত সুত্রে সংবাদ পাওয়া যায় যে,কাতারে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করতে যাচ্ছে সৌদি নেতৃত্বাধীন চার দেশের সন্ত্রাসবাদবিরোধী জোট। এ সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথেই বৈশ্বিক কূটনৈতিক পরিমন্ডলে জোড়ালো তৎপরতা শুরু হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরবের এই পদক্ষেপের কঠোর বিরোধীতা করে। কাতারের মিত্র ইরান ও তুরস্ক কাতারের এই দুঃসময়ে পাশে দাড়ানোর অঙ্গিকার ব্যক্ত করে। তুরস্ক কাতারে তাদের সৈন্য মোতায়েনের ঘোষণা দেয়। পরবর্তীতে চতুর্মুখী চাপে কোনঠাসা সৌদি জোট এই পদক্ষেপ নেয়া থেকে বিরত থাকে।

সৌদি আরবের এই পদক্ষেপ বৈশ্বিক পরিমন্ডলে কোন সমর্থন লাভ করেনি। অধিকাংশ রাষ্ট্রই এতে নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ করে। ইঙ্গ-মার্কিন বলয়ের বাইরের দেশগুলো এর জোড়ালো বিরোধিতা করে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সৌদি আরব নিজেদের পদক্ষেপের সমর্থন লাভের জন্য নিজেদের মিত্র রাষ্ট্রগুলোর উপর চাপ প্রয়োগ করে। পাকিস্তান, বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলংকা,মালদ্বীপ সহ আরো বিভিন্ন দেশকে নিজেদের পক্ষে টানতে ব্যাপক প্রস্তুতি শুরু করে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের মানবসম্পদ রপ্তানির আরেক উর্বর ক্ষেত্র কাতারকে হতাশ করে এ দেশগুলো সৌদি আরবের পক্ষাবলম্বন করতে অস্বীকৃতি জানায়।

সামরিক ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষকগন এই অবরোধকে ঔপনিবেশিক আমলের রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে অভিহিত করেন। তারা এই অবরোধকে অনভিজ্ঞ ও ক্ষমতালিপ্সু নতুন সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের রাজনৈতিক অপরিপক্কতার ফসল হিসেবে চিহ্নিত করেন। যার মূল ভোক্তা হবে ইসরায়েল।

কাতার সংকটে বিশ্বস্ত মিত্র হিসেবে পুরো সময়ই তুরস্ক পাশে ছিলো। কাতারকে তুর্কী বলয়ের বাইরে আনতে সৌদি যুবরাজ যে পন্থা অবলম্বন করেছিলেন, তা পুরোপুরি বুমেরাং হয়েছে। এই অবরোধের ফলে কাতার তুরস্ক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়নি তো বটেই, উল্টো তাদের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরো উশ্ন থেকে উশ্নতর হয়েছে। কাতার ও তুরস্কের মধ্যকার সামরিক সহযোগিতা পূর্বের চেয়ে শতগুন বেশী বৃদ্ধি পেয়েছে এই অবরোধের ফলে। কাতারে নিজেদের সামরিক শক্তি আরো সুসংহত করার পেছনে সৌদি আরবের এই অবরোধ বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। এই অবরোধের নিজেদের মধ্যকার বাণিজ্যিক সম্পর্কও আগের চেয়ে বেশি শাণিত হয়েছে।
সুতরাং এই অবরোধকে যদি কাতার-তুরস্ক দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের মাইলফলক হিসেবে অভিহিত করা হয় তাহলে একটুও বাড়িয়ে বলা হবেনা।

কাতার সংকটে আরেক অবরোধের ভুক্তভোগী ইরানও নিজেদের সাধ্যনুযায়ী নিজের মিত্রের পাশে থাকার চেষ্টা করেছে। অবরোধের পরপরই কাতারে বিমানের সাহায্যে খাদ্যসহায়তা প্রেরন করেছে ইরান। তবে আসল খেলাটা হয়েছে কাতার ও তুরস্কের মধ্যে। যেখানে ইসরায়েলের বদলে সুদে-আসলে অবরোধের পুরো ফসল ঘরে তুলেছে তুরস্ক।

তুরস্ক শুধু কাতারের রাষ্ট্রযন্ত্রেরই নিকটবর্তী হয়নি এ সুযোগে। বরং অবরোধের সময় তুরস্কের মানবিক সহায়তা কাতারী জনগনের মন জয় করে নিয়েছে। কাতার সংকটে তুরস্কের অবস্থান, তুরস্কের কাতারনীতি ও মানবিক সহায়তা তুর্কী ডিজির চেয়েও বেশি কার্যকরী ভূমিকা পালন করেছে।

অবরোধ নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সৌদির দিকে ইতিবাচক থাকলেও কাতারের বিরুদ্ধে সৌদির সামরিক শক্তি প্রয়োগের বিরুদ্ধে ছিলো। কেননা, কাতার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত মিত্র হওয়ার পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বড় সামরিক ঘাঁটিটির অবস্থানও কাতারে। সুতরাং সৌদি আরবের সামরিক শক্তি প্রয়োগ এক্ষেত্রে সৌদি জোটকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মুখোমুখি দাড় করাত। তাই যুক্তরাষ্ট্র এর শক্ত বিরোধিতা করে। কিন্তু অবরোধের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন অধিকাংশই সৌদির দিকে ঝুকে ছিলো। যদিও কাতার, সৌদি উভয় দেশই যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র। কিন্তু নিজেদের সত্যিকারের মিত্র ইসরায়েলের ঘরে অবরোধের মূল পুঁজি তুলতে হলে সৌদিকে সমর্থন দেয়া ছাড়া যে কোন গত্যন্তর নেই এটাও তাদের অজানা ছিলোনা। তাই পর্দার আড়ালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষত ট্রাম্পের পুরো সমর্থন সৌদি জোটের পক্ষেই ছিলো।

এই অবরোধে মুহাম্মাদ বিন সালমানের মূল পুঁজি ছিলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কট্টর ডানপন্থী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তার আনুকুল্যেই সৌদি আরব ও ইসরায়েল একে অপরের কাছে আসার সুযোগ পায়। ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্যই ইহুদী স্বার্থ রক্ষাকারী তের দফা দাবি উত্থাপন করেন সৌদি যুবরাজ।

কাতার সংকট এত দ্রুত সমাধান হবে এটা কেউ আশা করেনি। সুতরাং কাতার সংকটে সৌদি আরবের এই ডিগবাজি সাধারন মানুষকে বেশ আশ্চর্য করেছে। কিন্তু রাজনৈতিক বিষয়ে সচেতন যেকোনো মানুষই জানেন কাতার সংকট নিয়ে সৌদি আরবের সুর যুক্তরাষ্ট্রের প্রাইমারি নির্বাচনের পরপরই পাল্টাতে থাকে। ভাবী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যখন প্রাইমারীতে আত্মবিশ্বাসের সাথে একের পর এক স্তর অতিক্রম করছিলেন ডানপন্থাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে। তখনই বিন সালমান নিজের ভবিষ্যত নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়েছিলেন। নিজের নির্ভরতার জায়গাটুক ক্রমশ উদারপন্থী বাইডেনের ধাক্কায় নড়বড়ে হয়ে পড়ায় সৌদি যুবরাজ তার ভবিষ্যত নিয়ে ভাবনা শুরু করে দেন। যার ফলে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সির মেয়াদ যতই দ্রুত ফুরিয়ে আসছে, সৌদি যুবরাজ ঠিক তত দ্রুতই কাতার সংকট সমাধানে আগ্রহী হয়ে ওঠেছেন। যার ফল, শক্তিমান,যুদ্ধবাজ সৌদি জোটের ক্ষুদ্র কাতারের কাছে আজকের কূটনৈতিক পরাজয়।

কাতার সংকটে কাতারের সকল মিত্রই আশাতীত লাভের ফসল ঘরে তুলেছে। স্বয়ং কাতারের অর্জনের ডালিও একেবারে শূন্য নয়। যদিও অবরোধ তুলে নিলেই কাতার খুশি হবে। কিন্তু কাতার সংকটের মূল্য যদি আমরা হিসাব করি, তাহলে দেখতে পাবো এই অবরোধের ফলে কাতার নয়, উল্টো সৌদি আরবই একঘরে হয়ে যাচ্ছে। যেই শিয়া জুজু ও তুর্কী জুজুর ভয়ে কাতারকে ক্ষুধায় মারতে চেয়েছিলেন সৌদি যুবরাজ, সেই জুজুই এখন বাস্তবতায় রুপ নিয়ে তাকে অবরুদ্ধ করে ফেলছে। ইয়েমেন সংকটে ইরানের বিজয়, কাতার সংকটে তুরস্কের বিজয়, সাদ্দাম-পরবর্তী ইরাকে শিয়া মতবাদের উত্থান ও ইরানের প্রভাব বিস্তার, সৌদি আরবকে ভৌগোলিক দিক থেকে একঘরে করে ফেলতে যাচ্ছে। সেইসাথে সুন্নি মুসলমানদের নেতৃত্বের আসনও তারা এরদোয়ানের তুরস্কের হাতে খুইয়ে ফেলতে যাচ্ছে ভাবমূর্তির সংকটে।

কাতার অবরোধ ব্যরথ করে দেয়ার জন্য যদি কোন একক ব্যক্তিত্বকে কৃতিত্ব দেয়া হয় তাহলে তা যে কেবল এরদোয়ানই পাবেন এতে কোন সন্দেহ নেই। সৌদি যুবরাজের বেপরোয়া আচরণ বিশ্বের সুন্নি মুসলমানদের সৌদি নেতৃত্বের প্রতি আশাহত করে তুলেছে। নেতৃত্বের সেই শূন্যস্থান পূরণে মুসলমানরা যে ক্রমশ এরদোয়ানের ক্যারিশমাটিক নেতৃত্বের দিকে ঝুকবেন তা তো আজ দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট।

অবরোধ ব্যারথ হওয়ায় নিশ্চিতরুপেই ইসরায়েল মনক্ষুন্ন। সৌদি আরবের কাঁধে বন্দুক রেখে শিকার করার আশায় গুড়েবালি পড়ল যে! মুসলিম ব্রাদারহুডের অস্তিত্ব যে ইসরায়েলের সার্বভৌমত্বের উপর হুমকি এটাতো ইসরায়েলের দায়িত্বশীলগনই খুল্লামখুলা স্বীকার করেছেন। সেই ব্রাদারহুডের ব্যাপারে যদি সন্ত্রাসবাদীতার স্বীকৃতি আদায় করা যেতো আরবের সবচেয়ে ধনী ও প্রতিবেশি রাষ্ট্রটির থেকে তাহলে ঘরের শত্রু বিভীষণ হয়ে ওঠার আশংকা থেকে মুক্ত হয়ে খোলামনে গাজায় মানুষ শিকার করা যেতো!

আর ইসরায়েল যেহেতু এতে নাখোশ সেহেতু তার মনীব যুক্তরাষ্ট্রেরও এতে সন্তুষ্ট থাকার কথা নয়।
পাশাপাশি অবরোধ জুজুতে আক্রান্ত কাতারের কাছে অস্ত্র ব্যবসার সুসময়ও ফুরিয়ে আসায় স্বাভাবিকভাবেই যুক্তরাষ্ট্র তথা যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রশাসন ও অস্ত্রব্যবসায়ীরাও কিছুটা নাখোশ।

অনুষ্ঠিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সৌদি যুবরাজকে তার অনেক সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য করবে। যার শুরুটা সম্ভবত কাতার সংকটের সমাধানেই হচ্ছে।


সংগ্রহ

পঠিত : ৩৮৪ বার

মন্তব্য: ০