Alapon

নারী শিক্ষা এবং কিছু কথা...



নারীশিক্ষা কখনোই ইসলামে ব্রাত্য ছিলনা। মহিলা সাহাবীদের মধ্যে তালিবুল ইলম ও শিক্ষিকা দুই শ্রেনীর সাহাবিই ছিলেন। অনেক মহিলা সাহাবি যুদ্ধক্ষেত্রে সেবা প্রদানের দায়িত্বে ছিলেন। বেসিক মেডিকেল নলেজ ছাড়া সেটা সম্ভবপর ছিল না। খিলাফতের পরবর্তী জমানায় হেরেমের নারীদেরকে অস্ত্রবিদ্যা, ভূগোলশাস্ত্র, পররাষ্ট্রনীতি ইত্যাদি শিক্ষা দেয়া হতো। হেরেমের এই নারীরাই পরবর্তীতে যুবরাজদের মা হতেন এবং যুবরাজদের শিক্ষাদিক্ষা শুরু হতো তাদের মায়েদের হাত ধরেই।

ইসলাম জেন্ডার বেসিসে কে কি করবে তার একটা আইডিয়া দিয়ে রেখেছে। এখানে পরিবারের ভরণপোষণের মূল দায়িত্ব স্বামীর। স্বামী এই দায়িত্ব পালনে অপারগ হলে বা শর্টকামিংস থাকলে বহুকাল আগে থেকেই ঘরের নারীরা অর্থনৈতিক কাজে স্বামীদেরকে সহযোগিতা করেছেন। তবে সেটা কখনোই সংসারে নিজের ভূমিকাকে কম্প্রোমাইজ করে নয়। আরবে নারী ব্যাবসায়ী হিসেবে হজরত খাদিজা রাঃ এর উদাহারণ টানা হয় প্রায়ই। কিন্তু যারা এই উদাহারণ টানেন তারা ব্যবসায়ী হিসেবে খাদিজা রাঃ এর ভূমিকাকে জানতে চেয়েছেন কি কখনও? তিনি কি আজকের কর্পোরেট নারী লিডারদের মত ঘরের বাইরে গিয়ে বিজনেস লিড করেছেন? তিনি কি নিজের সংসার ত্যাগ করে ঘন্টার পর ঘন্টা বিজনেসে টাইম স্পেন্ড করেছেন?

এই প্রশ্নগুলো না ভেবেই খাদিজা রাঃকে টেনে আনা খুবই অবান্তর। খাদিজা রাঃ এর উদাহারণ যারা আনেন তারা কি রাসূলুল্লাহ সাঃকে বিয়ে করার পর খাদিজা রাঃ এর বিজনেস এক্টিভিটিকে রোল মডেল হিসেবে গ্রহন করবেন? রাসূলুল্লাহ সাঃকে বিয়ে করার পর খাদিজা রাঃ তার বিজনেসের সবটাই তার স্বামীকে সমর্পণ করেন। এবং এর পর খাদিজা রাঃ একজন পারফেক্ট হোম ম্যানেজারই ছিলেন যিনি কিনা হেরা গুহায় এতেকাফ করা স্বামীর কাছে খাবার নিয়ে যেতেন, নিজের সন্তানদের লালন করতেন, স্বামীকে তার দ্বীনি কাজে সাহায্য করতেন। বিয়ের আগেও তার বিজনেস এক্টিভিটি ছিল হাইলি ডেলিগেশনবেসড। কিন্তু এই ব্যাপারগুলো নিয়ে আলোচনা হয় না।

বলছিলাম ইসলামে নারীশিক্ষার অবস্থান কোথায়? ইতিহাস থেকেই দেখা যায় ইসলাম নারীকে মূলত একটা মেজর রোল দিয়ে রেখেছে। তা হচ্ছে মানবশিল্পীর ভূমিকা। স্রেফ জন্ম দিয়েই নয়; একজন নারী তার সন্তানকে তেমনভাবেই গড়ে তুলবেন যেমনটা একজন আর্টিস্ট তার আর্টকে গড়ে তুলেন। স্রেফ কিছু হাড়গোড় আর মাংসপিন্ডের দলা থেকে বুদ্ধি-নৈতিকতাসম্পন্ন একজন মানুষ বানানোর কাজটা করবেন নারী। একজন নারীকে শিক্ষিত করার মধ্য দিয়ে ইসলাম চায় নারীর বুদ্ধিভিত্তিক বিকাশ হোক, সে একজন সুবিবেচক হিসেবে গড়ে উঠুক, একজন পারফেক্ট টিচার হিসেবে গড়ে উঠুক যে সবার আগে তার সন্তানকে নৈতিকতা শেখাবে, স্রষ্টার সাথে পরিচয় করিয়ে দিবে, আগুন-পানির পার্থক্য চেনাবে, হারাম-হালাল থেকে বাচিয়ে রাখবে। এবার একটু ভেবে দেখেন কাজের বিচারে ইসলাম কি নারীকে পুরুষের চেয়ে কোন অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ কাজ এসাইন করেছে?
প্রশ্ন এসেছে, কেবল মা-ই কেন এইসব কাজ করবে? বাবাদের ভূমিকা কি? সন্তান পালনের বাবাদের কি কোন ভূমিকা নেই স্রেফ ফাইন্যান্সিয়াল সাপোর্ট দেয়া ছাড়া?

অবশ্যই আছে। সন্তানকে মানুষের মত মানুষ করার কাজ ২৪ ঘন্টার কাজ। তাই এই কাজেও বাবা-মার অংশগ্রহন আছে এবং তার বন্টন আছে। বাবার উপরে যেহেতু পারিবারিক ভরনপোষণের দায়িত্ব অর্পিত তাই বেশিরভাগ সময়ই সন্তান মার কাছেই থাকে। তাই মার দায়িত্বটা একটু বেশি। কিন্তু পিতার দায়িত্ব নেহায়েত কম না। একজন সন্তান পিতার কাছ থেকে পারসোনালিটি ডেভেলপমেন্ট করবে। বাবাকে দেখে দেখে সে শিখবে। নৈতিকতার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ সে বাবাকে দেখে শিখবে। বাবাকে দেখে সন্তান দায়িত্ববোধ শিখবে, ভার বহন করা শিখবে, লিডারশিপ শিখবে। সন্তানকে বাইরের দুনিয়ার সাথে পরিচয় করিয়ে দিবে একজন বাবা। একজন বাবা ছেলেকে মসজিদে নিয়ে যাবেন, বাজারে নিয়ে যাবেন, কর্মক্ষেত্রে নিয়ে যাবেন। এগুলোই সন্তান প্রতিপালনে বাবার মেজর কিন্তু সেকেন্ডারি রোল। এটাকেও অবজ্ঞা করার সুযোগ নেই।

তাহলে আজকালকার কর্মজীবি মহিলা সমাজের কোন মানসিকতাকে সমস্যা মনে করছি?
প্রথমত, ওমেন এমপাওয়ারমেন্টের যুগে নারীকে ফ্রিডমের সংজ্ঞা শেখাতে গিয়ে বেশ ভুলভাল পাঠ পড়ানো হয়েছে। একজন নারীর শিক্ষিত হওয়ার প্রয়োজন সে আদিকাল থেকেই ছিল। এবং শিক্ষিত হয়ে একজন নারী কিভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রে ভূমিকা রাখবেন তাও ডিফাইন্ড ছিল। কিন্তু ওমেন এমপাওয়ারমেন্টের ওয়েস্টার্ন কনসেপ্ট নারীদেরকে শিখিয়েছে যে যেকোন কন্ট্রিবিউশান মনেটারি ভ্যালুতে মাপতে হবে। সফলতাকে মনেটারি ভ্যালুতে মাপতে হবে। এই ওমেন এমপাওয়ারমেন্টের আত্মার প্রশান্তির জায়গা নেই। আর তাই এই সংজ্ঞামতে শিক্ষিত নারীর কন্ট্রিবিউশন মাপা হয় সে বাইরে গিয়ে কতটুকু কন্ট্রিবিউশন রাখতে পারছে তা দিয়ে। একজন শিক্ষিত নারীর শিক্ষা অর্জন করব আউটলুক বড় হওয়া, সুবিবেচক হওয়া, সমঝদার হওয়া ইত্যাদির চেয়েও কামাইতে পারাকে প্রায়োরিটাইজ করা হচ্ছে। "পড়াশোনা করে কি করবা? আল্টিমেটলি তো ড্যাগমাস্টারিই করবা।'," ইশ! কত ভালো রেজাল্ট তোমার। চাইলেই কত উচুঁ পজিশনে যেতে পারতা।',"পড়াশোনা করে চাকরি করবা না? তাহলে আর কি লাভ হলো?'-এই প্রশ্নগুলো কিন্তু আমাদের শিক্ষিত নারী সমাজ হরহামেশাই ফেস করছে। নারীকে স্রেফ প্রফেশনাল হওয়ার মধ্য দিয়ে সফলতা নিহিত থাকার ডক্ট্রিন এই মডার্নাইজেশন খাইয়ে দিয়েছে।

ফলাফল কি হয়েছে? কর্মক্ষেত্রে নারীর সংখ্যা বেড়েছে। নারী এখন ফাইন্যান্সিয়ালি প্রচুর কন্ট্রিবিউট করছি ঠিকই। কিন্তু নারী এখন আর আগের মত মানবশিল্পী হতে পারছে না। একজন ওয়ার্কিং মাদার খুব ইচ্ছে থাকলেও তার সন্তানকে সে পরিমান সময় দিতে পারছে না যা একজন হোমমেকার মা দিচ্ছেন। মাতৃত্বকালীন ছুটি এখনও সেভাবে নিশ্চিত হয়নি ফলে দুগ্ধপোষ্য শিশুও তার মায়ের সাহচার্য পাচ্ছে না। এই রোলগুলো এখন দিয়ে দেয়া হয়েছে বেবিসিটারদেরকে। বেবিসিটাররাও এই এমপাওয়ারমেন্টের অংশ। তারাও কর্মজীবি মহিলাই বটে। ব্যাপারটা এমন যে আমার সন্তান যাকে লালন করার মূল দায়িত্ব আমার হওয়ার কথা এখন তা পালন করছে আরেকজন মহিলা। আপনিই বলেন, একজন মায়ের লালনপালন আর একজন বেবিসিটারের লালনপালন একই পর্যায়ের হবে কি?

অপরচুনিটি কস্টের কথা আমরা সবাই জানি। একজন কর্মজীবি মায়ের অপরচুনিটি কস্টের কথা চিন্তা করেন। মনেটারি ভ্যালু দিয়ে মাপার প্রয়োজন নেই। আজকে সন্তানদের মধ্যে নিজের বাবা-মার প্রতি ভালবাসা, শ্রদ্ধা ইত্যাদি দিনকে দিন লোপ পাচ্ছে। পাবেই বা না কেন? যে সময়টাতে একটা শিশুর আত্মিক, নৈতিক ও মানসিক ডেভেলপমেন্ট হওয়ার কথা সে সময়টাতে সে পেয়েছে অশিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত বেবিসিটারকে যে তাকে তার জব ডেসক্রিপশনের টুলস হিসেবেই দেখবে- এটাই স্বাভাবিক। একজন সন্তানের তার মার কাছে থাকারও একটা চাহিদা আছে।

আরো একটা বড় ধরনের ক্ষতি এখানে হচ্ছে। আমরা হোমমেকারদের প্রতি সম্মান হারিয়ে ফেলছি। একজন মেয়ে যখন বাসার বাইরের ক্যারিয়ারকে বাদ দিয়ে হোমমেকার হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তখন তাকে বিভিন্নভাবে ফিল করানো হচ্ছে যে সে ভীষন ভুল কাজ করছে, তার পড়াশোনা কোন কাজেই আসবে না, তার কোন ভ্যালু থাকবে না। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে একজন হোমমেকার কি ফাইন্যান্সিয়াল কন্ট্রিবিউশন করেন না? তিনি কি সমাজ ও রাষ্ট্রগঠনে ভূমিকা রাখেন না? একজন হোমমেকার সমাজ ও রাষ্ট্রকে সে এলিমেন্ট প্রভাইড করেন যা সমাজ ও রাষ্ট্রের ভিত গঠনের মূল উপাদান হিসেবে কাজ করে- একজন সুনাগরিক। একজন চিন্তাশীল নাগরিক। একজন নৈতিক, বিবেকসম্পন্ন নাগরিক। এই এলিমেন্টগুলো গুরুত্ব ক্যান্ট বি ওভারস্টেটেড। ফাইন্যান্সিয়ালি কত উপায়ে একজন হোমমেকার কন্ট্রিবিউট করেন তা আলোচনা করতে গেলে আলাদা পোস্টেরই প্রয়োজন হবে।

নারীদের এই এমপাওয়ারমেন্টের নতুন সংজ্ঞায়নকে আমি বিরোধিতা করি। কর্মজীবি নারীদের প্রতি আমার শ্রদ্ধার অভাব নেই। আমার নিজের শ্বাশুড়ি একজন কর্মজীবি নারী এবং আমি তার কাছে ইটার্নালি গ্রেটফুল যে তিনি আমাকে এমন একজন জীবনসংগী উপহার দিয়েছেন যে সুবিবেচক ও নৈতিকতাসম্পন্ন। এমন অনেক কর্মজীবি মায়েরা আছেন যাদের জীবন একেকটা সংগ্রামের রুপ। কিন্তু তাদের সাথে আমি আজকের মনেটারি ভ্যালু দিয়েকে নিজের ভ্যালুয়েশন করা কর্পোরেট আপুদের মেলাতে পারি না। বরং এটা করলে সেসব মায়েদের প্রতি ডিসরেসপেক্টই করা হবে।

পরিশেষে একটা কথা বলে শেষ করব। আমাদের উচিত আমাদের নারীদেরকে শিক্ষিত করা। শুধু ট্র‍্যাডিশনাল শিক্ষাতেই নয়; জীবনমুখী শিক্ষাতেও। যে শিক্ষা একজন নারীর মানসিক বিকাশ করে একজন সুশিক্ষিত হোমমেকারে পরিনত করবে। এরকম নারীই জাতীর প্রয়োজন যারা একজন প্রকৃষ্ট শিক্ষক হবেন। যারা একজন সুবিবেচক নৈতিকতাসম্পন্ন সুনাগরিক উপহার দিতে পারবেন।

- আরেফিন ইশাত

পঠিত : ৪৬৭ বার

মন্তব্য: ০