Alapon

নিজামুল মুলক আত তুসী-এর অজানা ইতিহাস...


নিজামুল মুলক আত তুসী , যিনি কিনা পরপর দুজন সেলজুক সুলতান, আলপ আরসালান এবং তাঁর পুত্র মালিক শাহের অধীনে পূর্ণ ৩০ বছর মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর মতো রাষ্ট্রীয় দক্ষতা ও যোগ্যতার অধিকারী ব্যক্তি ইসলামি রাষ্ট্রপরিচালনার ইতিহাসে প্রায় বিরল। তাছাড়া তিনি তাঁর গুরুতর প্রশাসনিক দায়িত্বের বাইরে ছিলেন একজন বিদ্বান ও সংস্কৃতিমনা পুরুষ। তিনি ইসলামের মধ্যযুগীয় ইতিহাসে রাজনৈতিক ধারা ও রাষ্ট্রীয় নীতিমালার একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উৎসগ্রন্থ রচনা করতে সক্ষম হন। কে এই নিজামুল মুলক তুসী? কী সেই গুরুত্বপূর্ণ অবদান, যার জন্য তিনি আজও ইতিহাসের পাতায় একটি বিশেষ স্থানের অধিকারী? কীভাবে তার অসাধারণ সাফল্যগুলো শেষ পর্যন্ত একটি অভিনব উপসংহারে রূপ নিল?

দারিদ্র্য থেকে মন্ত্রিত্ব

আবু আলী আল-হাসান ইবনে আলী ইবনে ইসহাক আত-তুসি ৪০৮ হিজরি মুতাবেক ১০১৭ খ্রিস্টাব্দে তুর্কমেনিস্তানের সীমান্তের নিকটে, বর্তমান ইরানের পূর্ব দিকে, একেবারে শেষপ্রান্তে তুস বা মাশহাদ আল রেজা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। গজনী সম্রাটদের শাসনামলে তার বাবা ছিলেন তুস শহরের নেতা। অর্থাৎ তিনি ছিলেন গজনী প্রশাসনের মাঝারি পর্যায়ের দায়িত্বশীল। তবে এই পদ থেকে অর্জিত আয় এবং মাসিক বেতন তাঁর ও নিজামুল মুলক-সহ অন্যান্য পুত্রদের জন্য যথেষ্ট ছিল না।

দুধপানের বয়সে নিজামুল মুলকের মায়ের মৃত্যু ছিল তার জীবনে সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা। তার বাবা ছিলেন দরিদ্র। পারিশ্রমিকের বিনিময়ে ছেলেকে দুধ পান করানোর মত সামর্থ্য তাঁর ছিল না। যে নারীরা কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বাচ্চাদের দুধপান করাতো, নিজামুল মুলকের পিতা তাকে সে নারীদের কাছে দুধপানের জন্য নিয়ে যেতেন। ফলে তখন থেকেই অর্থসংকটের প্রতি নিজামুল মুলকের দৃষ্টি খুলে যায়। দারিদ্র‍্যের এই অনুভূতিই তাঁকে প্রচণ্ড আশাবাদী করে তুলেছিল এবং তাকে শিক্ষার হাতেখড়ি ও কুরআনুল কারীম মুখস্থ করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ইবনুল আসির তাঁর বর্ণণা দিতে গিয়ে বলেন, ‘তিনি দারিদ্র‍্য ও অর্থসংকটের মাঝে বেড়ে উঠেছিলেন। যা তাকে উদ্দীপ্ত করেছিল উচ্চ মনোবল ও জ্ঞানের স্রোতধারায় ডুবে থাকতে। ফলে তিনি দীনচর্চায় প্রভূত দক্ষতা হাসিল করেন এবং মহান ব্যক্তিত্বে পরিণত হন।’

তার জন্মশহর নওকানে তিনি ফারসির পাশাপাশি আরবী ভাষার শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং কুরআন, হাদিস, ভাষা ও ব্যাকরণের জ্ঞান লাভ করেন। তিনি শাফেয়ী মাযহাবের ফিকাহশাস্ত্র ও আশআরী মাসলাকের আকীদাশাস্ত্র অধ্যায়ন করেন। হাদীসে নববীর প্রতি তাঁর প্রবল আকর্ষণ থাকায় তিনি তাঁর অন্যান্য ইলমঅন্বেষী সহপাঠীদের মতোই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, প্রবীণ শায়েখদের কাছ থেকে জ্ঞান অন্বেষণ এবং হাদীস শ্রবণের জন্য ইরাক, খোরাসান, রাই, ইস্পাহান, নিশাপুর ইত্যাদি শহর সফর করবেন। অবশেষে তিনি এই শাস্ত্রে এমন উচ্চতর দক্ষতা অর্জন করেছিলেন, যা তাকে রাই (বর্তমান তেহরান) শহরের হাদীস-শিক্ষার্থীদের শিক্ষকের আসনে বসিয়েছিল।

তার বাবা যে প্রশাসনিক কাজে নিরত থাকতেন, সে কাজের প্রতি তুসী নিজে যথেষ্ট অনুরাগী ছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি লেখালেখি ও রচনার জ্ঞান লাভ করেন এবং হিসাববিজ্ঞান-সহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে গভীর পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। এগুলো তখনকার মুসলিম বিশ্বের সমস্ত অঞ্চলে স্থানীয় সরকারের কার্যালয়ে নিযুক্তির মূল বিষয় ছিল। অবশেষে তিনি আফগানিস্তানের রাজধানী গজনীতে গজনী সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক কাজকর্মে যুক্ত হন। এভাবেই ধীরে ধীরে তার অভিজ্ঞতা বৃদ্ধি পায় এবং তিনি সহকর্মীদের তুলনায় শ্রেষ্ঠত্বের স্থান দখল করে নেন। এ কারণেই হয়তোবা ইমাম যাহাবী তার সম্পর্কে বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, ‘গজনীতে যাওয়ার পর তিনি হয়ে ওঠেন একজন কীর্তিমান হিসাবরক্ষক। তার কাছেই চূড়ান্ত হিসাবের দায়িত্ব ছিল। তিনি রচনায়ও দক্ষতা অর্জন করেন। সাথে সাথে তিনি ছিলেন একজন মেধাবী, বুদ্ধিমান ও পূর্ণ নেতৃত্বের অধিকারী।’

সে-সময় সেলজুক শাসকদের রাজনৈতিক উত্থান ঘটছিল এবং তারা ইতোমধ্যে মাওরাআন নাহার অঞ্চলগুলোতেও নিজেদের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল। ধীরে ধীরে তারা গজনীদের হটিয়ে খোরাসানের অঞ্চলগুলোতে (যা বর্তমানের আফগানিস্তান, তুর্কমেনিস্তান ও ইরাকের পূর্বাঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত) নিজেদের ক্ষমতার প্রসার ঘটাতে থাকে। হাসান তুসী সেলজুকদের সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হন। তার দক্ষতা, জ্ঞান এবং বুদ্ধি বাদশাহ আলপ আরসালানের মন্ত্রী আবু আলী বিন শাযানকে আকৃষ্ট করেছিল। ফলে তুসী সেলজুক আমিরদের বিশ্বাসভাজনে পরিণত হন। ইবনে শাযানের মৃত্যু-পরবর্তী রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব লাভের পূর্বেই তিনি একজন মন্ত্রীর সহকারী পদ থেকে সেলজুকী বাদশাহ আলপ আরসালানের ‘কাতেবে’র পদে উন্নীত হন।

আলপ আরসালান যখন সবচেয়ে বিখ্যাত সেলজুক সুলতানরূপে আবির্ভূত হলেন এবং ঐতিহাসিক ‘মানযিকার্ট’-এর যুদ্ধে বিজয়ী হলেন, তখন ৪৫৫ হিজরিতে তিনি তাঁর কাতেব আবু আলী আত-তুসিকে সেলজুক রাজ্যের মন্ত্রী বানাবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। অর্থসংকটে বেড়ে ওঠা মন্ত্রীর জীবনে এটাই ছিল অন্যতম মুহূর্ত। তাঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষা, অধ্যবসায় এবং শিক্ষা উপরন্তু তার বুদ্ধিমত্তা তাকে মধ্যযুগীয় মুসলিম বিশ্বের সর্বাধিক ক্ষমতাশালী রাষ্ট্রের দ্বিতীয় ব্যক্তির স্থানে নিয়ে গিয়েছিল। এই পদটি তাকে সেই সময়ের সেরা রাজনীতিবিদ হিসাবে যোগ্য করে তোলে, যেমনটির স্বীকারোক্তি দিয়েছেন প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ হুসাইন গোলাম।

নিজামুল মুলকের রাষ্ট্রনীতি

আলপ আরসালান ও তার পুত্র মালিকশাহ, এই দুই সেলজুক শাসকের অধীনে নিজামুল মুলক দীর্ঘ তিরিশ বছর মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। দুই দুইজন সেলজুক শাসকের সময়ে মন্ত্রী থাকার কারণে তাকে তাজুল হাযরাতাইন লকব দেয়া হয়। নিজামুল মুলকই একমাত্র ব্যক্তি যিনি আব্বাসি ও সেলজুকদের পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখার জন্য তাকে আব্বাসি খলিফার পক্ষ থেকে ‘রাদিয়্যু আমিরিল মুমিনিন’ উপাধি দেয়া হয়। রাষ্ট্রীয় অন্যান্য কাজকর্মেও নিজামুল মুলক অংশ নিতেন। সৈন্যবাহিনীকে ঢেলে সাজানো ও অধিক শক্তিশালী করার ব্যাপারেও তিনি যথেষ্ট তৎপর ছিলেন। এমনকি তিনি যুদ্ধের ময়দানে সৈন্যদের অগ্রভাগে থেকে লড়াই করতেন।

নিজামুল মুলকের প্রকৃত নাম আবু আলি আল হাসান আত তুসী। সেলজুক সাম্রাজ্যকে উন্নত ও শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখার কারণে তাকে নিজামুল মুলক বলে ডাকা হতো। রাষ্ট্র পরিচালনায় তার অনুপম দক্ষতার মাধ্যমে তিনি ইসলামী ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনীতিবিদ হয়ে ওঠেন। তার রাজনৈতিক কৌশলের সাহায্যে তিনি একটি কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম করতে সক্ষম হন। এই শাসনব্যবস্থা খোরাসান, ইরান ও ইর অঞ্চলে বিস্তৃত সেলজুক সাম্রাজ্যকে নিয়ন্ত্রণ করত। ইসলামে নবদীক্ষিত সেলজুকদের ইসলামের দিকনির্দেশনার প্রতি মনোযোগী করে তোলেন নিজামুল মুলক। একইসাথে পারস্য বা অন্যান্য অঞ্চলের সফল শাসকদের রাষ্ট্র পরিচালনার নানান নীতি ও কৌশল সম্পর্কে অবহিত করেন।

সাধারণ মানুষের প্রতি নিজামুল মুলক খুবই আন্তরিক ছিলেন। তারা যাতে জুলুম বা অত্যাচারের শিকার না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতেন। ইনসাফ কায়েমের ব্যাপারে সচেষ্ট ছিলেন। আল্লামা সুবকি তার গ্রন্থে উল্লেখ করেন, নিজামুল মুলকের কাছে কোন অনিয়ম বা অত্যাচারের অভিযোগ আসলে তিনি কুরআন ও হাদিসের আলোকে বিচার করতেন। জালেম ও সীমালঙ্ঘনকারীদের আল্লাহর ভয় দেখাতেন। যার ফলে মানুষ তখন নিশ্চিন্তে বসবাস করতে পারত। সুলতানের আশেপাশের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের থেকেও তারা ইনসাফের আশা করত।

সাধারণ মানুষ, মজলুম ও অধিকারবঞ্চিত লোকদের আলাদা গুরুত্ব দিতেন নিজামুল মুলক। মানুষের অভিযোগ-অনুযোগ শোনার জন্য বিশেষ দিনগুলোতে মজলিস হতো। একবার এমন এক মজলিসে খোদ ইমামুল হারামাইন উপস্থিত ছিলেন৷ অভিযোগকারী একব্যক্তি এসে নিজামুল মুলকের দিকে একটা চিরকুট ছুঁড়ে মারল। নিজামুল মুলকের সামনে দোয়াত রাখা ছিল। চিরকুট গিয়ে পড়লো দোয়াতের কালিতে। প্রচুর পরিমাণে কালি থাকার কারণে কালি ছিটকে এসে নিজামুল মুলকের পোষাক কালো করে দিল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল, নিজামুল মুলক ছিলেন খুবই শান্ত। তিনি একটুও রাগান্বিত হন নি। তার চেহারাও মলিন হয় নি। অথচ তিনি ছিলেন চিন থেকে নিয়ে আনাতোলিয়া হয়ে শাম পর্যন্ত বিস্তৃত সাম্রাজ্যের সবচেয়ে প্রভাবশালী মন্ত্রী।

তিনি হাত বাড়িয়ে চিরকুটটি নিয়ে অভিযোগকারীর অভিযোগ পড়তে লাগলেন। কিভাবে সমাধান দেয়া যায় এই নিয়ে ভাবতে লাগলেন। উপস্থিত ব্যক্তিরা তাঁর মতো একজন প্রভাবশালীর ব্যক্তির এমন ধৈর্য আর সহনশীলতা দেখে অবাক হয়ে গেল। প্রজাদের উপর যাতে জুলুম না হয় এজন্য তিনি বিভিন্ন অঞ্চলে এ ধরনের মজলিস কায়েম করতেন। এরমধ্যে প্রধান অঞ্চল ছিল আব্বাসি খেলাফতের রাজধানী বাগদাদ। বাগদাদে তিনি মানুষের যাবতীয় প্রয়োজন মেটানোর চেষ্টা করতেন। যারা বাস্তবেই হকদার তাদেরকে বিপুল পরিমাণ সম্পদ দান করতেন।

রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গিয়ে নিজামুল মুলক দীর্ঘ অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন। একসময় তিনি চাইলেন, রাষ্ট্রসংক্রান্ত তার এই অভিজ্ঞতাগুলো নিয়ে একটা গ্রন্থ লিখবেন। যে গ্রন্থটি রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে মানুষকে সুস্পষ্ট ধারণা দিবে। এ কারণে রাষ্ট্রনীতি বিষয়ে লিখিত তাঁর ‘সিয়াসাতনামা’ গ্রন্থটি তার রাষ্ট্রপরিচালনার দীর্ঘ অভিজ্ঞতার বর্ণনা বলে গণ্য করা হয়৷ নিজামুল মুলক শেষ জীবনে সুলতান মালিক শাহর অধীনে মন্ত্রী থাকার সময় সুলতানের ইচ্ছায় সিয়াসাত নামা গ্রন্থটি লেখেন।

৪৭৯ হিজরীতে সুলতান মালিকশাহ রাজ্যের বিশিষ্ট ব্যক্তিদেরকে সেলজুক সাম্রাজ্যের নানা অসঙ্গতি ও তা থেকে উত্তরণের উপায় এবং রাষ্ট্র পরিচালনার সঠিক পদ্ধতি সুলতানকে অবহিত করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মতামতকে সামনে রেখে সুলতান রাজ্যের সংবিধান তৈরি করবেন। তখন রাজ্যের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা মেধা ও প্রজ্ঞার সাহায্যে নিজেদের মতামত সুলতানের সামনে পেশ করে৷ সম্রাট সেসব থেকে কেবল নিজামুল মুলকের লিখিত সিয়াসাতনামা গ্রন্থটিই সংবিধান হিসেবে বেছে নেন। তিনি সিয়াসাতনামার দিকনির্দেশনা অনুযায়ী রাজ্যপরিচালনার ঘোষণা দেন৷

সন্দেহ নেই, এর পরপরই নিজামুল মুলক মন্ত্রী থেকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ প্রভাবশালী ব্যক্তিতে পরিণত হন। রাষ্ট্রীয় নানা সমস্যার সমাধান, রাষ্ট্রীয় চুক্তি ও সমঝোতা, বিভিন্ন খাতে সম্পদ ব্যয় করা, যে কোনো বিধান জারী করার একচ্ছত্র অধিকার লাভ করেন৷ কোনো জবাবদিহিতা ছাড়াই এসব ক্ষেত্রে তিনি স্বাধীনভাবে হস্তক্ষেপ করতে পারতেন। রাষ্ট্রীয় নীতি ও নৈতিকতা, সাধারণ মানুষের সাথে রাষ্ট্রের সম্পর্ক নির্ণয়, যুদ্ধকৌশল ও তার মৌলিক উদ্দেশ্য–সব ক্ষেত্রেই নিজামুল মুলকের পরামর্শ সিদ্ধান্ত বলে বিবেচিত হতো।

সে সময় সংবাদ পৌঁছানোর জন্য একটা দক্ষ ও শক্তিশালী বাহিনী ছিল। যারা মানুষের মাঝে মিশে থেকে বিভিন্ন ধরনের তথ্য সংগ্রহ করত। জুলুম-নির্যাতন কিংবা কোনো ষড়যন্ত্র অথবা প্রাকৃতিক কোনো দুর্যোগের সংবাদ স্থানীয় প্রশাসকের কাছে খুব দ্রুতই পৌঁছিয়ে দিত। নিজামুল মুলক সংবাদ পৌঁছানোর ব্যবস্থাকে আরো উন্নত ও দ্রুততর করার জন্য বিভিন্ন স্থানে ডাককেন্দ্র স্থাপনের পরামর্শ দেন। যে ডাককেন্দ্রগুলো এশিয়ায় বিস্তৃত সেলজুক সাম্রাজ্যের অঞ্চলগুলোতে দীর্ঘ দূরত্ব থাকার পরও খুব দ্রুতই সংবাদ পৌঁছানোর ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।

সৈন্যবাহিনীকে বিভিন্ন ব্যাটালিয়নে ভাগ করার ক্ষেত্রে জাতিগত সম্পর্ক প্রধান না হওয়া গুরুত্বপূর্ণ। তুর্কি বাহিনী বা আরব বাহিনী কিংবা পারস্যবাহিনী এভাবে যাতে ব্যাটালিয়ন ভাগ না করা হয়, সে পরামর্শ নিজামুল মুলক তার সিয়াসাতনামা গ্রন্থে সুলতানকে দিয়েছিলেন। এটাই ছিল নিজামুল মুলকের সবচে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ। বিভিন্ন জাতির সৈন্য দিয়ে ব্যাটালিয়ন সাজানোর অন্যতম ফায়েদা হলো, শাসকশ্রেণী কোনো ধরনের সম্মিলিত বিদ্রোহ অথবা অবাধ্যতা ভয় থেকে মুক্ত থাকেন। নিজামুল মুলক খুবই সতর্ক মানুষ ছিলেন। গজনীরা জাতিগত সম্পর্কের ভিত্তিতে সৈন্যবাহিনীকে বিভিন্ন ব্যাটালিয়নে ভাগ করত। এই গজনীদের পরপরই সেলজুকদের শাসন শুরু হয়। এই শক্তিশালী কৌশলটি সেলজুকরা গ্রহণ করে৷ তাদের পরবর্তী যিনকি, আইয়ুবি, দাস ও রোমের সেলজুক এবং উসমানিরাও এই কৌশল অবলম্বন করে।

মাদরাসায়ে নেজামিয়া : উচ্চশিক্ষার প্রাণকেন্দ্র

আব্বাসি খেলাফতের অধীনে বেড়ে ওঠা তুর্কি সেলজুকদের ইসলামী সাম্রাজ্য শাসন করার আগে শিয়া বুহাইরিয়ারা ইরাক ও ইরানে তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছিল। এই সময়ে শিয়াদের ভ্রান্ত চিন্তাধারা মানুষের মাঝে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। এর পাশাপাশি মিশরের ফাতেমি সাম্রাজ্য শিয়া ইসমাঈলি মতবাদ প্রচারের ব্যাপক তৎপরতা চালাতে থাকে। বিপুল পরিমাণ অর্থসম্পদ ব্যয় ও শিয়া মতাবলম্বী লোকদের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে দেয়া হয়। আব্বাসি ও সেলজুকদের অধিকৃত অঞ্চলগুলোতে আহলুস সুন্নাহর শক্তিশালী ভিত্তি দুর্বল করার জন্য জোর প্রচেষ্টা শুরু করে৷ এই প্রচারণার ভয়াবহ প্রভাবের ব্যাপারটা নিজামুল মুলক উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। যার ফলে আমরা তাঁর সিয়াসাত নামা গ্রন্থে এই ভ্রান্ত ফেরকার চিন্তাধারা রদ করার ক্ষেত্রে তাঁকে তৎপর দেখতে পাই।

সুলতানকে তিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন, শিয়া মতাবলম্বীদের যাতে কোনো সাহায্য না করা হয়। সুলতান তাদেরকে গুরুত্ব দিবেন না। নির্ভরতা বা আস্থার সম্পর্ক রাখবেন না তাদের সাথে। সিয়াসাতনামায় নিজামুল মুলক বলেন, ‘আমি শিয়া মতাবলম্বীদের যেসব ভ্রান্তি ও মন্দকর্মের দিকে ইঙ্গিত করে থাকি, আশা করি খুব শীঘ্রই সুলতান সেসবের সত্যতা অনুভব করবেন। এবং এই বৃহৎ সাম্রাজ্যের প্রতি আমার আন্তরিকতা ও কল্যাণকামিতা সম্পর্কেও তিনি নিশ্চিত হবেন। খুব ভালোভাবেই আমি এই ভ্রান্ত দলের কাজকর্ম ও তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবগত আছি। বড় বড় শাসকদের কাছে আমি এই বিষয়গুলো পেশ করেছি। কিন্তু তারা এর প্রতি কোনো ধরনের গুরুত্বারোপ করেননি৷ ফলে একসময় আমি তা বলা থেকে বিরত হয়ে পড়ে।’

সে-সময় হাসান সাব্বাহর নেতৃত্বে ইসমাইলি হাশশাশীদের আত্মপ্রকাশ ছিল ইসলামি সাম্রাজ্যের জন্য সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ও বিপদজনক বিষয়। তাদের দুর্গগুলো ইরান ও শামের প্রায় সব জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। বড় বড় আলেম ও আমিরদেরকে এবং যাদেরকে তারা নিজেদের মতাদর্শ প্রচারের পথে বাধা মনে করতো, এদের সকলকে গুপ্তহত্যার মাধ্যমে হত্যা করতে লাগল৷ ফলে এই শক্তিশালী দলটিকে প্রতিরোধ করার জন্য প্রায়সময় সেলজুক সৈন্যবাহিনীকে পাঠানো হতো। দুর্ভেদ্য দুর্গ ও তৎপরকর্মীদের সাহায্যে তারা ইরানের দামেগান, আলমুতসহ বিভিন্ন অঞ্চলের বিপুল মানুষকে তাদের চিন্তাধারার প্রতি আকৃষ্ট করে তুলে। শামের অঞ্চলগুলোতে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল এই মতবাদ৷ এই ভ্রান্ত দলের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে নিজামুল মুলক প্রায় সময় সেলজুক শাসকদের সতর্ক করতেন৷
নিজামুল মুলক বিশ্বাস করতেন, শত্রুকে প্রতিহত করার জন্য কেবল সশস্ত্র আক্রমণই যথেষ্ট না। বরং সশস্ত্র যুদ্ধের পাশাপাশি রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে একটা চিন্তার যুদ্ধও চালিয়ে যেতে হয়। পরবর্তী সময়ে ইসলামী সাম্রাজ্যের বাগদাদ নিশাপুর মার্ভ রাইসহ বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাপকভাবে মাদরাসায়ে নিজামিয়া প্রতিষ্ঠার মধ্যে এই চিন্তা কার্যকর ছিল। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ছিল সরকারি ইউনিভার্সিটির মতো, যেগুলোর পেছনে রাষ্ট্র বিপুল পরিমাণ সম্পদ বরাদ্দ রাখত।

এটা সত্য, নিজামুল মুলকের মাদরাসা প্রতিষ্ঠার পূর্বে ইসলামি বিশ্বে মাদরাসা প্রতিষ্ঠার প্রচলন ছিল। কিন্তু শিক্ষাধারা ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে মাদরাসায়ে নিজামিয়া নতুন ধরনের তরিকার সূচনা করেছিল। মাদরাসা নিজামিয়াতে ছাত্রদের জন্য নির্ধারিত ভাতা ও থাকার ব্যবস্থা ছিল। শিক্ষকদের বেতন ও বাসস্থান দেয়া হতো। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে রাতদিনের সবসময় জ্ঞানচর্চার সুযোগ ছিল। ছাত্র-শিক্ষক সকলে নিশ্চিন্ত মনে একাগ্র হয়ে জ্ঞানচর্চা করতে পারতেন৷ নিজামুল মুলকের সৌভাগ্য, অনেক বড় বড় আলেম ও ফকিহগণ তার সমসাময়িক ছিলেন। এদের মধ্যে একজন হলেন, ইমামুল হারামাইন আবুল মায়ালি আল জুওয়াইনি (মৃত্যু : ৪৭৮হিজরী)। তিনি নিজামুল মুলকের মতো শাফেয়ী ছিলেন। তাঁর সাথে নিজামুল মুলকের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল।

ইমাম জুওয়াইনি তার রচিত রিসালায়ে নিজামিয়া গ্রন্থটি নিজামুল মুলককে হাদিয়া দেন। নিজামুল মুলক ইমাম জুওয়াইনির জন্য খোরাসানের রাজধানী নিশাপুরে নিজামিয়া ধারার একটা মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন৷ তার সমসাময়িকদের মধ্যে অন্যতম আরেকজন হলেন ইমাম আবু হামেদ আল গাযালি। তিনি নিজামুল মুলকের জন্মশহর তুসে জন্মগ্রহণ করেন। নিজামুল মুলক ইমাম গাযালিকে বাগদাদের মাদ্রাসা নিজামিয়ায় যোগদানের আমন্ত্রণ জানান৷ যে মাদরাসাটি তিনি সাধারণ মানুষ ও তালেবে ইলমদের মাঝে আহলুস সুন্নাহর সঠিক মতাদর্শ প্রচারের জন্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

নিশাপুরের মাদরাসায়ে নিজামিয়ায় প্রতিদিন ইমামুল হারামাইন জুওয়াইনির দরস শোনার জন্য তিনশো ছাত্র উপস্থিত হতো। এটা চলছিল দীর্ঘ তিরিশ বছর ধরে। আর বাগদাদের মাদরাসায়ে নিজামিয়া প্রতিষ্ঠিত হয় ৪৫৭ থেকে ৪৫৯ পর্যন্ত এই দুইবছরে৷ এই প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের ভাতা এবং শিক্ষক ও কর্মচারীদের বেতনের ব্যবস্থার জন্য ছিল বাজার, হাম্মাম দোকান ও ক্ষেতখামারসহ প্রচুর পরিমাণ ওয়াকফকৃত সম্পত্তি। বাগদাদের মাদরাসায়ে নিজামিয়াতে একটি সমৃদ্ধ পাঠাগারও ছিল। এর বাইরে শিক্ষক, সহকারী শিক্ষক, পাঠাগারের দায়িত্বশীল, পাহারাদার ও কর্মচারীদের উল্লেখযোগ্য একটা অংশ এই মাদরাসায় নিযুক্ত ছিল। শিক্ষক ও ছাত্রদের জন্য বছরে পনেরো হাজার দিনারের মত ব্যয় হত। ছাত্রসংখ্যা ছিল ছয় হাজারের মত। যারা ভাষা ব্যকরণ, সাহিত্যের নানান অনুষঙ্গ, ফেকাহ, তাফসির, হাদিসসহ ধর্মীয় শিক্ষার অন্যান্য বিষয়গুলোও অধ্যায়ন করত।
বসরা, ইস্পাহান, বলখ, হেরাত, মার্ভ ও মসুলেও নিজামিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। এই প্রতিষ্ঠানগুনগুলোর ছাত্র শিক্ষকদের অধিকাংশ ছিলেন হিজরী পঞ্চম ষষ্ঠ ও সপ্তম শতাব্দীর প্রসিদ্ধ আলেমগণ। অবশ্য শাফেয়ী মাযহাব ও আশআরী আকিদা অবলম্বনকারীদের প্রাধান্য ছিল। এই প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররাই পরবর্তীতে ইসলামি বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে৷ এবং নানা ধরনের দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করে। বাগদাদের মাদরাসায়ে নিজামিয়ার প্রথম শিক্ষক আবু ইসহাক আশ শিরাজি বলেন, আমি খলিফা মুকতাদির চিঠি পেয়ে খোরাসানের উদ্দেশে যখন সফর করি তখন যে শহর বা গ্রামে প্রবেশ করেছি, দেখেছি, সেখানকার খতিব-কাজী আমার ছাত্রদের মধ্য থেকেই কেউ একজন।

খুব সম্ভব এই বিপুল সাফল্য দেখতে পেয়ে শামের মুহাদ্দিস ও ইতিহাসবিদ আল্লামা হাফেজ ইবনে আসাকির মাদরাসায়ে নিজামিয়ার পাঠদান দেখার জন্য ছুটে আসেন। এখান থেকে ফিরে যাওয়ার পর তারিখে দামেশক নামে সত্তর খণ্ডের একটা দীর্ঘ ইতিহাসগ্রন্থ লিখেন৷ মাদরাসায়ে নিজামিয়ার সুনাম অনেক দূরদূরান্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। একেবারে পশ্চিমের দেশগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি এই সুখ্যাতি মুওয়াহহিদিন সালতানাতের প্রতিষ্ঠাতা ইবনে তুমারতের কানেও পৌঁছে গিয়েছিল। ফলে তিনি সুদূর মরক্কো থেকে মাদরাসায়ে নিজামিয়াতে ছুটে আসেন ইমাম আবু হামেদ আল গাযালী ও অন্যান্যদের কাছে দ্বীনের গভীর জ্ঞান অর্জনের জন্য। এরপর তিনি নিজদেশে ফিরে গিয়ে আলেমদের বিতর্ক করতে শুরু করেন। এবং মুরাবিতিনদের সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে মুওয়াহহিদিন সালতানাতকে শক্তিশালী করে তোলেন।

নিজামিয়া মাদরাসা ইসলামী সাম্রাজ্যের উল্লেখযোগ্য শহরগুলোতে বিস্তৃত জায়গাজুড়ে প্রতিষ্ঠিত হত। এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে অধ্যাপনা করা সে সময়ের শিক্ষক ও অধ্যাপকদের জন্য ছিল অনেক সৌভাগ্যের বিষয়। ফলে তারা মাদরাসায়ে নিজামিয়াতে অধ্যাপনার স্বপ্ন দেখতেন। কেউ কেউ এইজন্য প্রচুর পরিশ্রম ও অর্থসম্পদ ব্যয় করতে দ্বিধা করত না। আব্দুর রহমান আত তাবারি, আবু হামেদ আল বারদি এই প্রতিষ্ঠানে বেশ পরিশ্রম ও চেষ্টার পর অধ্যাপনার সুযোগ পেয়েছিলেন।

মাদরাসায়ে নিজামিয়ার শিক্ষক নির্বাচনের ধরন অনেকটা আজকের আধুনিক ইউনিভার্সিটিগুলোর অধ্যাপক নির্বাচনের মতো। মন্ত্রী নিজামুল মুলক আত তুসি নিজেই শিক্ষকদের যোগ্যতা যাচাই করতেন। সময়-পরিস্থিতি বিবেচনা করে তিনি বিভিন্ন বিষয়ে বিতর্কের আয়োজন করতেন৷ বেশকিছু প্রশ্ন তৈরি করে শিক্ষকতাপ্রত্যাশী দের সেগুলো জিজ্ঞেস করতেন। যাকে শিক্ষকতার যোগ্য বলে বিবেচনা করতেন তাকে তার উপযুক্ত পদে নিযুক্ত করতেন। জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা অনুযায়ী তাদেরকে বিভিন্ন শহরে প্রেরণ করতেন।

বিভিন্ন বাতিল ফেরকা ও ইসমাইলি মতবাদকে রদ করার জন্য নিজামুল মুলক মাদরাসায়ে নিজামিয়ার আলেমদেরকে লেখার প্রতি আগ্রহী করে তোলেন৷ যাতে করে এই লিখিত গ্রন্থসমূহ ভ্রান্ত আকিদার অসারতা প্রমাণ করে দেয়। এবং তাদের আকিদার মাঝে যে সুক্ষ্ণ ভ্রান্তিগুলো, যা সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে না সেগুলো স্পষ্ট করে দেয়। একই সাথে তাদের লিখিত পুস্তক সঠিক মাযহাব ও মতাদর্শের দিকে মানুষকে পথ দেখাবে। নিজামুল মুলকের এই মতাদর্শিক আন্দোলনকে সফল করে তোলার জন্য আব্বাসি খেলাফত তাকে নানাভাবেই সহায়তা করে৷

বাতিল ফেরকাগুলোর বিরুদ্ধে লিখিত সবচে প্রসিদ্ধ গ্রন্থ হলো ইমাম গাযালির বিখ্যাত রিসালা। যে রিসালায় তিনি ভ্রান্ত আকিদার অসারতা বর্ণনা করেছেন। এই রিসালা তিনি আব্বাসি খলিফা মুস্তাজহিরের অনুরোধে লিখেছিলেন। যার ফলে তিনি এর নাম দিয়েছিলেন, আল মুস্তাজহিরি। এরপর তিনি ইসমাইলিদের বিরুদ্ধে ছোট ছোট কিছু কাজ করেন। এই সময়ে তিনি উম্মাহর নেতৃত্বের বিষয়ে আব্বাসি খলিফার বিভিন্ন সিদ্ধান্তের পক্ষে অবস্থান করছিলেন।

ইসমাইলি মতবাদের মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে মাদরাসায়ে নিজামিয়া উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে৷ সেইসাথে এই প্রতিষ্ঠানগুলো জ্ঞান বিজ্ঞান ও সঠিক আকিদা চর্চার কেন্দ্রে পরিণত হয়। হিজরী পঞ্চম শতাব্দী জুড়ে নিজামুল মুলকের এইসব সংস্কার আন্দোলন গভীর প্রভাব বিস্তার করে। তার রাষ্ট্রীয় নীতিমালা অনুযায়ী সেলজুকরা রাজ্য শাসন করতো। পরবর্তী যেসব শাসক এসেছেন তারাও দীর্ঘকাল নিজামুল মুলকের রাষ্ট্রীয় নীতিমালার সাহায্যে দেশ পরিচালনা করেন। রাষ্ট্রীয় সংস্কারের পাশাপাশি শিক্ষাসংস্কারের আন্দোলনও ছিল খুবই ফলপ্রসূ ও কার্যকর৷ সে সময়ে জ্ঞানচর্চা জারী রাখার জন্য মাদরাসায়ে নিজামিয়ার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

খোরাসান, ইরান, ইরাকসহ সমগ্র রাজ্যে নিজামুল মুলক যেসকল মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেগুলো কেবল ধর্মীয় শিক্ষার কেন্দ্র ছিল না। জনসাধারণের ধর্মীয় প্রয়োজন মেটাতে ইসলামী আইন ও অন্যান্য শাস্ত্রে যোগ্য আলেম তৈরি করা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ কাজ। নিজামিয়া মাদরাসাগুলো দক্ষতার সাথেই তা আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছিল। তবে এর পাশাপাশি তিনি মাদরাসাগুলোয় বিজ্ঞান চর্চার সুযোগও রেখেছিলেন।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তিনি নিয়ে আসেন তৎকালে বিজ্ঞানের ফলিত শাখার স্বনামধন্য বিজ্ঞানীদের। তিনি বিখ্যাত জোত্যির্বিদ ও বহু প্রতিভার অধিকারী উমর খৈয়ামকে একটি মহাকাশ পর্যবেক্ষণকেন্দ্র নির্মাণ করে দেন। তার এই কেন্দ্রটি সমকালীন বিশ্বের সর্বাধুনিক কেন্দ্রগুলির একটি। এখানে বসেই উমর খৈয়াম প্রায় নির্ভুলভাবে তার সৌর ক্যালেন্ডারটি তৈরি করেছিলেন। যেটি সেলজুকি বা জালালী দিনপঞ্জি নামে পরিচিত। আজ থেকে প্রায় ১ হাজার বছর আগে , ৪৭২হিজরী মুতাবেক ১০৭৯ খ্রিষ্টাব্দে ক্যালেন্ডারটি তৈরি হয়।
নিজামুল মুলকের অসাধারণ সাফল্য, প্রবল বুদ্ধিমত্তা, রাষ্ট্র পরিচালনার দক্ষতা, বিস্তৃত জ্ঞান, প্রজাবাৎসল্য ও ন্যায়পরায়ণতা দেখে ইসমাইলি বাতেনিরা তার উপর প্রতিশোধ নিতে প্রস্তুত হতে থাকে। যেহেতু এই মন্ত্রী তাদের সমস্ত চেষ্টা প্রচেষ্টা, আশা ও স্বপ্নকে ধুলোয় মিশিয়ে দিচ্ছিল। ইসমাইলি একব্যক্তি দরিদ্র সেজে এসে নিজামুল মুলকের কাছে তার উপর অত্যাচারের অভিযোগ জানায়।

নিজামুল মুলক যখনই তার কাছাকাছি হলেন তখন অভিযোগকারী ব্যক্তিটি তার বুকে ছুরি চালিয়ে দেয়। নিজামুল মুলক ততক্ষণাৎ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছিল ১০৯২ খ্রিস্টাব্দ মুতাবেক ৪৮৫ হিজরীর দশম রমজানে নেহাওয়ান্দ শহরের কাছে। তার মৃতদেহ ইস্পাহানে নিয়ে আসা হয়৷ এই শহরে তার প্রতিষ্ঠিত মাদরাসায়ে নিজামিয়ায় তাকে দাফন করা হয়। মৃত্যুর সময় তার বয়স ছিল সাতাত্তর বছর৷

- সংগৃহিত

পঠিত : ১০২৫ বার

মন্তব্য: ০