Alapon

||ইমাম নাসা'ঈ রহিমাহুল্লাহ-০১||




শাহাদাতের অমিয় সুধা পানে ধন্য হয়ে শহীদি ঈদগাহে শামিল হয়েছেন তিনিও। কোনো ভয়-লোভ তাঁকে ছুঁয়ে দিতে পারেনি। সত্য প্রকাশ আর প্রচারে নিবেদিত প্রাণ একজন ইমামুল মুসলিমিন ছিলেন। নিজের জনপ্রিয়তা, প্রভাব ও ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে কারো থেকে নেন নি বিন্দুমাত্র প্রতিশোধও। অথচ নিতে পারতেন খুবই সহজে। কিন্তু নিজের অবস্থান আর জনপ্রিয়তাকে কেন্দ্র করে কোনো গণ্ডগোল সৃষ্টি করে পরিস্থিতিকে জটিল করতে চান নি। নিজেকে ঘুটিয়ে নিয়েই তিনি পরিস্থিতিকে ঠান্ডা রাখতে সহয়তা করেছেন। নিজের দীর্ঘদিনের আবাসন ছেড়ে দিতে করেন নি কুন্ঠাবোধ। জীবনের প্রতিটি পরতে পরতে ফুটে ওঠেছে ইনসাফ আর তাকওয়া, সাহস আর সততার প্রস্ফুটিত ফুল। সারাবছর জুড়ে নাফল সিয়াম আর স্বলাতে, গভীর রজনীর তাহাজ্জুদে সিক্ত করতেন আল্লাহ প্রেমের প্রলোভনে প্রলুব্ধ ও পিপাসিত হৃদয়কে।


জীবনের মাঝে ছিলো এক অতুলনীয় আভিজাত্য। চেহারায় চিকচিক করতো যেনো জান্নাতি নূরের ছটা।দামি সব কাপড়চোপড় পরতেন তিনি। কুতুবে সিত্তাহর ইমামদের মাঝে তিনি ছাড়া এমন সুদর্শন শক্তিমান কাউকে দেখা যায় না। স্বাস্থ্য সচেতনতার ছিলেন এক অনন্য নযীরও। প্রতিদিন খেতেন মুরগির মাংস, রোস্ট। কিসমিস ও কিসমিসের পানি। সুগঠিত শরীর আর ব্যক্তিত্বের পুরোটাই ছিলো তাঁর মাঝে। ছিলো তাঁর চারজন স্ত্রীও। এতো এতো ইবাদাত আর ব্যস্ততার ভীড়ের মাঝেও তাঁদের অধিকার নষ্ট করতেন না। কমতি করতেন না। সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যেতেন সকলের মাঝে সমতা প্রতিষ্ঠার। পালাক্রমে প্রতিজন সহধর্মিণীর সাথেই রাত যাপন করতেন। কাউকে অখুশি আর অসন্তোষের পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতেন না।


ছোটো বেলা থেকেই কৃর্তীমান একজন মানুষ হিসেবে তাঁর উস্তাদগণ তাঁকে দেখতে পেতেন। বাবা-মা দুজনই ছিলেন শিক্ষার আলোয় উজ্জীবিত। ইলমের আলোয় উদ্দীপ্ত। তাঁরাই তাঁকে আট বছর অবধি শিক্ষা দান করেছেন। হিফয করেছেন তখনই।

তাঁর শহর ছিলো 'আলিমদের শহর' নামে খ্যাত! জ্ঞানের প্রাথমিক স্তর, মাধ্যমিক স্তর সেখানটাতেই সমাপ্তি করলেন। ধীরে ধীরে বড়ো হতে লাগলেন। পনেরো বছর বয়সের সময় বাবা-মা এবং জন্মভূমির মায়া ছেড়ে উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশ্য নিয়ে উচ্চ শিক্ষার সকল কেন্দ্রে, জ্ঞানীদের সোহবতে বের হয়ে পড়লেন সুদীর্ঘ সফরে। নিজ শহরের বাহিরে সর্বপ্রথম যাঁর সোহবত লাভে ধন্য হন, তিনি হলেন কুতায়বা ইবনে সা'ঈদ (রহিমাহুল্লাহ)! তাঁর কাছে যাপন করেন জীবনের দুই বছর। এরপর গমন করেন মিশরে। সেখানকার বিদগ্ধ শিক্ষকদের নিকট থেকে ইলমুল হাদিসের জ্ঞান আহরণ করেন। শিক্ষক হিসেবে পান তৎকালীন মিশরের বিখ্যাত মুহাদ্দিস ইউনুস আবদুল আলী আল-মিশরী (রহ.)কেও। মিশরও ইলমুল হাদিসের মারকায ছিলো সেসময়।


সেখানেই অবস্থান করতে থাকেন তিনি। মানুষ তাঁর কাছে দলে দলে আসতে থাকেন আল্লাহর দ্বীন শিখতে। রাসুলে কারিম স্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী সমূহ জানতে। তিনিও দারাজদিলে ছড়িয়ে দিতে লাগলেন আল্লাহর দ্বীনের বাণীকে। জ্ঞানের আলোকে।

তিনি পরিকল্পিত দাওয়াতি কাজও করতেন। আসোলে এই বিষয়টা সকলেই করতেন। তবে এই পরিকল্পনাটা ওনার মাঝে একটু বেশি লক্ষণীয়। তিনি ইলমে দ্বীন নিয়ে, হাদিসের শিক্ষা নিয়ে ছুটে যেতেন একেক সময় একেক দিকে। যতোটুকু জানা যায়, তাঁকে রাজধানী বাগদাদ থেকেও সরকারি পদ-পদবী দিয়ে সরকারের পক্ষে কাজে লাগাতে চেয়েছে। তিনি যান নি। কর্ণপাত করেন নি সেই আহ্বানে। দরবারি আলিম হওয়া থেকে বিরত থেকেছেন।

মিশরে থাকা অবস্থায়ই তিনি অনেকগুলো গ্রন্থ রচনা করেছেন। যে গ্রন্থের কারণে তিনি সারা বিশ্বের কাছে আজ এতো এতো পরিচিত সেই গ্রন্থ হলো সুনানে নাসায়ী। মূলত সেই গ্রন্থকে আস সুনানুস সুগরা-ও বলা হয়ে থাকে। প্রথম তিনি সুনানে কুবরা নামে একখানা বড়োসড়ো গ্রন্থ রচনা করেছেন। এরপর একদিন সাক্ষাত ঘটে ফিলিস্তীনের শাসকের সঙ্গে। তাঁর সেই গ্রন্থ সম্পর্কে ফিলিস্তীনের রামাল্লা অঞ্চলের শাসক তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার সংকলিত 'আস-সুনানুল কুবরা'র সকল হাদিসই কি সহীহ? তিনি না-সূচক জবাব দিলেন। বললেন স্পষ্ট স্বরে- এতে সহীহ এবং দ্বঈফের মিশ্রণও আছে। তা শুনে আমীর তাঁকে বললেন, আপনি এ গ্রন্থ থেকে সহীহ হাদীসগুলো বাছাই করে আমাদের জন্য একটি বিশুদ্ধ হাদীসগ্রন্থ সংকলন করুন। কথাটা তাঁর মনে ধরেছে। তিনিও সীদ্ধান্তটা নিয়েই ফেললেন। নেমে পড়লেন কাজে। আস-সুনানুল কুবরার যে হাদিসগুলোর সনদে ত্রুটি ছিলো, সেগুলো বাদ দিয়ে ‘সুনানুল মুজতাবা’ সংকলন করেন’। মূলত তাঁর গ্রন্থের নাম এটাও। তবে ইমাম যাহাবী বলেন ভিন্ন কথা। তিনি বলেন সুনানে কুবরাকে সংক্ষেপ করে ‘মুজতাবা’ সংকলন করেছেন তাঁর সুযোগ্য ছাত্র ইবনুস সুন্নী (রহ.)। তিনি এই গ্রন্থ রচনার সময়ে দু’রাকাআত স্বলাত আদায় করতেন। ইস্তিখারা করতেন। যে হাদিস নিয়ে তাঁর মনে সংশয় সৃষ্টি হতো সেইসব হাদিস নিয়েই করতেন আরকি। যখন পজিটিভ হতো তাঁর মন, তখন তিনি তা সংকলন করতেন। নতুবা বাদ দিতেন। তিনি নিজেই তা বলেছেন। সহীহাইনের পরে তাঁর এই গ্রন্থেই কম সংখ্যক দ্বয়ীফ হাদিস রয়েছে। হাদিস গ্রন্থটার নাম তাঁর নামেই পরিচিত লাভ করেছে সারা বিশ্বে। সুনানে নাসা'ঈ হিসেবেই আমরা জানি। কিন্তু এর পকৃত নাম তো পূর্বেই বলা হয়েছে যে, আসসুনানুল মুজতবা। আসোলে তিনি নিজেও নাসাঈ হিসবে পুরো পৃথিবীতে পরিচিতি লাভ করলেও তাঁর মূল নাম তা কিন্তু নয়।


||ইমাম নাসা'ঈ রহিমাহুল্লাহ-০১||
~রেদওয়ান রাওয়াহা

পঠিত : ৪০৪ বার

মন্তব্য: ০