Alapon

আজ মাওলানা জালালউদ্দিন রুমির ওফাত দিবস!



আজ ৫ জমাদিউস সানি ফার্সি ভাষার কোরআন খ্যাত বিখ্যাত মসনভী শরীফ রচয়িতা মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি রহমাতুল্লাহি আলাইহি পবিত্র ওফাত দিবস!

১২০৭ খ্রিষ্টাব্দ ৩০ সেপ্টেম্বর ৬০৪ হিজরি ৬ই রবিউল আউয়াল মাসে জন্মগ্রহণ করেন।
মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি রহমাতুল্লাহি আলাইহি মওলানা জালালুদ্দিন বালখি নামেও পরিচিত (ফার্সি ভাষায়: ﻣﺤﻤﺪ ﺑﻠﺨﻰ ), কিন্তু বিশ্বে তাকে সংক্ষেপে রুমি নামে জানে। তিনি ত্রয়োদশ শতকের একজন ফার্সি কবি, ধর্মতাত্ত্বিক এবং সুফি দর্শনের শিক্ষক ছিলেন। রুমি খোরাসানের (বর্তমান আফগানিস্তান ) বলখ শহরে ১২০৭ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ সেপ্টেম্বর (৬০৪ হিজরি ৬ই রবিউল আউয়াল) জন্মগ্রহণ করেন । তাঁদের পরিবার ছিল বিশিষ্ট আইনজ্ঞ ও দর্মতত্ত্ববিদ পরিবার । তার পিতা বাহাউদ্দিন ওয়ালাদকে সমসাময়িক বিদ্বানরা "পণ্ডিতদের সুলতান" বলে আখ্যায়িত করেছিল।

রুমির পিতা ছিলেন একজন বিখ্যাত ধর্মতত্ত্ববিদ, সুফি এবং অতীন্দ্রিয়বাদী যার সাহস, সাধুতা , অন্তরের মহত্ত্ব এবং ঈশ্বরের প্রতি দার্শনিক বা মৌল অভিগমনের পরিবর্তে সরাসরি আধ্যাত্মিকভাবে সমীপবর্তী হওয়ার বাসনা রুমিকে ভীষণভাবে প্রভাবিত এবং অনুপ্রাণিত করেছিল। রুমি যে যুগে জন্মগ্রহণ করেন তখন ভয়াবহ এ আলোড়ন চলছিল। উসমানীয় সাম্রাজ্য ভিতরে এবং বাইরে থেকে আক্রান্ত ছিল; ভিতরে ছিল খ্রিষ্টান আক্রমণকারীরা এবং অপর দিক থেকে চেঙ্গিস খানের মোঙ্গল বাহিনী। এই সামাজিক-রাজনৈতিক আলোড়ন রুমিকে তরুণকাল থেকে আতঙ্ক ও বিশৃংখলা দ্বারা দহন করেছিল ।ধর্মীয় বিরুদ্ধবাদীদের বিরোধিতা এবং সম্ভাব্য মোঙ্গল আক্রমণের আশঙ্কায় ১২১৯ খ্রিষ্টাব্দে মাত্র বার বৎসর বয়সে রুমি তার পিতাসহ বলখ ত্যাগ করেন। বাহাউদ্দিনের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। এক বৎসর পরেই বলখ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। তার দশ বৎসর ধরে এশিয়া মাইনর ও আরবে পরিভ্রমণ করেন । মক্কার পথে রুমি এবং তার পরিবার নিশাপুরে অবস্থান করেন , সেখানে তাঁদের সাথে বিখ্যাত সুফি কবি আত্তারের সাক্ষাৎ হয় । আত্তার রুমি সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে , " এই বালকটি ভালবাসার অন্তরে একটি দ্বার উদ্ঘাটন করবে ।" রুমিও কখনও আত্তারকে ভুলতে পারেন নি , রুমি আত্তার সম্পর্কে বলেছেন " আত্তার ভালবাসার সাতটি নগরই ভ্রমণ করেছেন আর আমি এখনও একটি গলির প্রান্তে অবস্থান করছি।" তাঁর পিতার সঙ্গে ভ্রমণের আরেক পর্যায়ে রুমি দামাস্কাস যান । সেখানে সে যুগের শ্রেষ্ঠ দার্শনিক ইবনুল আরাবির সাথে দেখা হয় । শোনা যায় ইবনুল আরাবি যখন রুমিকে তার পিতার পিছনে হাঁটতে দেখেন তখন বলেছিলেন " ঈশ্বরের কী মহিমা , একটি হ্রদের পিছনে এক সমুদ্র যাচ্ছে।"

একদিন শাহ শামসুস তীবরিজ নামের এক ফকির এসে মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমীর সামনে দাঁড়ালেন। মাওলানা রুমী তখন ইসলামী ফিকাহ শাস্ত্র পড়াশোনা করছিলেন। তখন ফকির শামসুস তীবরিজ জিজ্ঞাসা করলেন ই চিস্ত? (এটা কি পড়ছো?) মাওলানা রুমী বললেন ইয়া ইলম মাসকে তু না দানা ( এটি এমন জ্ঞান যা তুমি বুঝবেনা) একথা শুনে ফকির তীবরিজ মাওলানার সমস্ত বই পাশের নদীতে ফেলে দিলেন। তারপর নদীর মাঝখানে পানির উপর দাঁড়িয়ে সব বই গুলোকে পানি ঝেরে ওঠাতে লাগলেন আর বললেন মাওলানা দেখো কোন বই আবার ভিজে গেলোনা তো? এবার মাওলানা রুমী শামসুস তীবরিজ কে জিজ্ঞাসা করলেন ই চিস্ত? (এটা কিভাবে করলে ?) উত্তরে শাহ শামসুস তীবরিজ বললেন ইয়া ইলম মাসকে তু না দানা ( এটি এমন জ্ঞান যা তুমি বুঝবেনা) মাওলানা রুমি তখনই শামসুর তীবরিজ এর কদম জড়িয়ে ধরলেন আর কান্না ভেজা গলা নিয়ে বললেন , ও মুরশিদ আপনার জানা মা'রিফাতের শিক্ষায় আমাকে সিক্ত করুন।

মাওলানা জালাল উদ্দীন রুমী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর আমিত্ব বিসর্জন ও হযরত শামসুত তিবরিজ রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর কাছে বায়াত গ্রহণঃ
মৌলানা জালালুদ্দীন রুমী রহমাতুল্লাহি আলাইহি যখন মাজ্জুব হযরত শামসুত তিবরিজ রহমাতুল্লাহি আলাইহি কে চিনতে পারলেন তখন বিনীত হয়ে হযরতের কাছে মুরিদ হতে গেলেন। তিবরিজ বললেন আমি মদ খাবো, আমার জজন্য এক বোতল মদ নিয়ে এসো। রুমীর মত এত বড় আলেম মদের দোকানে যাবেন ভাবতেই চমকে উঠলেন। কিন্তু আনতে তো হবে, না হলে মুরিদ হওয়া যাবেনা। অবশেষে রুমী মদের দোকানে গিয়ে বললেন, আমার ঘোড়ার সর্দি করেছে এক বোতল মদ দাও। সেই যুগে ঘোড়াকে সর্দির জন্য মদ খাওয়ানো হতো। রুমী মদ নিয়ে যখন ফিরে এলেন, তিবরিজ বললেন শেষে আমাকে ঘোড়া বানালে? এই মদ হবে না। যাও, এখন গিয়ে বলো আমি রুমী মদ খাবো। বিদ্যার বহরে ঠাসা, জ্ঞানের গরিমায় গরম রুমী নিজের কথা বলে মদ আনলেও, তা আস্তিনে লুকিয়ে আনলেন। তিবরিজ বললেন, এ মদও খাবো না। মদের বোতল সবার সামনে মাথায় করে আনতে হবে। রুমী অনিচ্ছা সত্ত্বেও কামেল পীরের দামান ধরার বাসনায় যখন মদের বোতল মাথায় করে নিয়ে আনতেছেন, তখন জনতা ছিঃ ছিঃ করতে লাগলো, সবাই ধিক্কার দিচ্ছিল। কিন্তু হযরত শামসুত তিবরিজ এ মদ খেলেন না। রুমীকে বললেন 'এই মদ দিয়ে তোমার যায়নামাজ রাঙ্গিয়ে দাও।

মূলত রুমীর মধ্যে থাকা সকল আমিত্ব চূর্ণ করে দিয়ে তাঁকে পরিশুদ্ধ করার জন্যই তিবরিজ প্রকাশ্য রাস্তায় মদ আনালেন এবং পরীক্ষা করলেন তিনি পীরের প্রতি কতটুকু আন্তরিক।
মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমী রহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁর বিখ্যাত মসনভী শরীফে ঘটনাটি বর্ণনা করেন। তিনি আরো বলেন,
"মওলবি আয খুদ না শুদ মাওলায়ে রুম
তা গোলামে শামস তাবরিযি নাশুদ"
অর্থাৎ, শামস তিবরেজের গোলাম হবার পূর্বে আমি রূমী প্রকৃত অর্থে কোন মাওলানাই ছিলাম না।

তিনি ২২ বছর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে রচনা করেন মসনবি শরিফ। যা সুবিশাল ৪০ হাজার লাইনের একটা মহাজ্ঞানের সমাহার। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক রিসার্স স্কলার এবং লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রিপ্রাপ্ত সামির আসাফ The Poet of the Poets- শীর্ষক এক নিবন্ধে লিখেছেন, গভীরতার মানদণ্ডে রুমির তুলনায় শেক্সপিয়রের মান হচ্ছে মাত্র ১০ ভাগের এক ভাগ। পশ্চিমা সাহিত্যিকদের মান প্রসেঙ্গ তিনি আরো লিখেছেন, ‘পাশ্চাত্যের গ্যাটে, চসার ও ইমারসন পর্যন্ত রুমির প্রভাব প্রতিপত্তি উপলব্ধি করতে পেরেছেন। এ কথা বলতে দ্বিধা নেই, রুমির সমকক্ষ যেমন গাজ্জালি, গালিব, জামি, সাদি, জিবরান, এমনকি কাজমি সাহিত্যকর্মের তুলনায় পশ্চিমা সাহিত্য বলতে গেলে হাস্যকর পর্যায়ের অগভীর।

এই মহান সূফি সম্রাট ৫ জমাদিউস সানি ৬৭২ হিজরি মোতাবেক ১২৭৩ খ্রিষ্টাব্দে ইহলোক ত্যাগ করেন।

- সংগৃহিত

পঠিত : ১২৫৪ বার

মন্তব্য: ০