Alapon

ইউভাল হারারি: পাঠ ও মূল্যায়ন



ইউভাল হারারি: পাঠ ও মূল্যায়ন
ভূমিকা
রাফান আহমেদ

আমরা অনেকেই ঐতিহাসিক ইউভাল নোয়াহ হারারি রচিত Sapiens: A Brief History of Humankind (Vintage books, 2014) বইটির নাম শুনেছি। বইটি ২০১১ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় হিব্রু ভাষায়, নাম ছিল קיצור תולדות האנושות (কিতসোর তোলদোথ হা-নুশুথ)। ইংরেজি অনুবাদ হয় ২০১৪ সালে। প্রকাশিত হবার কয়েক বছরের মাঝেই বইটি জনপ্রিয় হয়ে উঠে। এক পর্যায়ে বিল গেটস, মার্ক জাকারবার্গ, বারাক ওবামা, মুহাম্মদ জাফর ইকবালের মত নামিদামি মানুষেরাও বইটি পড়তে উৎসাহ দিতে থাকেন। বইয়ের নাম ছড়িয়ে পড়ে আরো। লেখককে বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে ডাকা হতে থাকে। সঞ্চালকের দায়িত্বের হলিউডের নামকরা নায়িকাকে দেখা যায় কোনো কোনো অনুষ্ঠানে। মিডিয়ার কল্যাণে এই বই ছড়িয়ে পরে ব্যাপক হারে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ইউটিউবে এই বই নিয়ে হুলুস্থুল কারবার চলেছে অনেক। লেখকের সাক্ষাৎকার আর লেকচারে জ্যাম হয়ে আছে। সেই হুজুগ বন্ধ হয় নি এখনো। সেলিব্রেটি কালচারের গড্ডালিকায় চলে হালফিলের তারুণ্য। দুনিয়াটা বইয়ের হোক বলেও ডুবে থাকে সেই তারকা-পূজোয়। মানের চেয়ে স্বাদ, আবেগ আর ঘ্রাণেই মজে থাকে রাতবিরেতের অনেক বইপোকা। এতটাই মজে যায় যে বড়সড় গর্তও চোখে পড়ে না। বিশ্বব্যাপী তুমুল জনপ্রিয় হয়েছে যে বই তাতে কি আর ভুল থাকতে পারে! বালাই ষাট! আমি যখন এই পাঠ-পর্যালোচনা লিখছি তখন দেখতে পাই বইটি নিয়ে দেশে নতুন করে জিগির উঠাচ্ছে একদল প্রগতিশীল। বইটি কেনা না বরং অর্জনের ছবক দিচ্ছে।

আমরা তাদের আকুলতা বুঝতে পারি। কেউ বস্তুবাদি বা নাস্তিক হিসেবে ঘোষণা করলেও সে জীবনের অর্থদোতন্যার সন্ধান বাদ দিতে পারে না। নাস্তিকতার পরিনতি ধ্বংসবাদ বা নায়েলিজম—অস্তিত্ব ও নৈতিকতা দুই দিকেই। কিন্তু বাঙালিরাসহ বিশ্বের অধিকাংশ নাস্তিকই সেটা মানতে পারে না। জীবনগাড়ি চালানোর জন্য তাদের স্টেশানের ঠিকানা লাগে, মনে স্থিরতা আনা লাগে। হয়তো হারারির বই থেকে তারা সরল ভাষায় সেই স্থিরতা পেয়েছে ভেবে বসে। অথচ হারারি নিজে বস্তুবাদি-সমকামি হওয়া সত্ত্বেও সেই স্থিরতা খুঁজার চেষ্টা করেন ধ্যানে!

কি অদ্ভূত স্ববিরোধীতা!

হারারির বই পাঠ-পর্যালোচনা করার যোগ্যতা আমার আছে কিনা সেই প্রশ্ন তুলতে পারেন কোনো কোনো প্রগতিশীল। তার আছে অক্সফোর্ডের ডিগ্রী এবং তুমুল জনপ্রিয়তা; অথচ আমি এক ছা-পোষা ডাক্তার মাত্র। লোকে যাদের কসাই বলে আনন্দ পায়। সাহস কত ছোকরার! সচেতন কেউ এই প্রশ্ন শুনে ভাবতে পারেন, আমাকে এমন অভিযোগ ছুড়ে দেয়া প্রগতিশীলরা ইসলাম নিয়ে কোনো রকম কাঠামোবদ্ধ পড়াশোনা না করেই মনে যা আসে সেভাবে ইসলামের উৎস ব্যাখ্যা করেন, মনগড়া অভিযোগ করেন, লাইভে লাইভে মিথ্যের আসর সাজান। এমন কেউ আমাকে ঐ প্রশ্ন করার নৈতিক অধিকার কী আদৌ রাখেন?

তবে আমি এই পালটা প্রশ্নের সাথে তাল না মিলিয়ে বলতে চাই, বক্ষ্যমাণ পাঠ-পর্যালোচনায় আমি নিজের কথা খুব কমই বলেছি। পশ্চিমা একাডেমিয়ার রথীমহারথীদের বরাতেই আসর সাজিয়েছি। বোঝার চেষ্টা করেছি বইটি বিশ্বব্যাপী যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে তা অ্যাকাডেমিক ভাবে কতটা গ্রহণযোগ্য। সচেতন পাঠক মাত্রই জানেন বিজ্ঞানের অনেক বিষয়েই সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচলিত ধারণার সাথে প্রকৃত ধারণার দূরত্ব রয়ে যায়। বিজ্ঞানের নাম করে স্বীয় বিশ্বাস গেলান তুমুল জনপ্রিয় সেলিব্রেটি বিজ্ঞানীরা, এমন অভিযোগ স্বয়ং পশ্চিমা পণ্ডিতদেরই!

একই সাথে সুস্থচিন্তার পাঠকেরা খুব ভালভাবেই বোঝেন কোনো বই তুমুল জনপ্রিয় হওয়া মানেই যে তা যে বৈজ্ঞানিক মহলের সঠিক প্রতিনিধিত্ব করবে বা ইতিহাসের সঠিক চিত্রায়ন থাকবে এমনটি নয়। বরং উল্টোটাই দেখা যায়। বহুল প্রচলিত ও জনপ্রিয় বইগুলোতে ভুলের আধিক্যের কারণে অ্যাকাডেমিকরা এসব বই পড়তে আগ্রহ কমই পান। বলা হয়ে থাকে জ্ঞানের স্ব-স্ব শাখার বিশেষায়ন নির্দিষ্ট মাত্রায় জলাঞ্জলি না দিলে পাঠকের মুখে সে-সব বিষয়ের বই রোচে কম। বিকোয় কম, হুজুগেও আসে কম।

মাতৃভাষায় এই বইটি গোছানোর পরিকল্পনা আমার ছিল না। শুভাকাঙ্খিদের একাংশ খুব তাড়া দিলেন, আবদার করলেন। তাই একটু অগোছালোভাবেই কলম ধরতে হলো, মানে কি-বোর্ড চাপতে হলো আরকি। আশা করি বোদ্ধা পাঠকেরা আমার ভাষাগত সীমাবদ্ধতা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। পাঠ-পর্যালোচনা বা বুক রিভিউ সচরাচর ১২০০ শব্দের কাছাকাছি হয়। অর্থাৎ মূল বইয়ের চেয়ে অনেক কম। এটাই পাঠ-পর্যালোচনার রীতি। এই বাস্তবতা না জেনে কেউ যদি বলেন—এহ! ৪৫০ পেইজের মূল বইকে ৭০-৮০ পেইজেই কাটাছেড়া করল! কি হাস্যকর!—তাদের জন্য সমবেদনা। যে নামকরা পশ্চিমা পণ্ডিত হারারির বইয়ের অ্যাকাডেমিক কবর রচনা করেছেন তার রিভিউ ছিল সর্বসাকূল্যে ২০-২২ পৃষ্ঠা। এর চেয়ে বড় রিভিউ আমি পাই নি।

আশা রাখি যারা গড্ডালিকায় হারিয়ে যান নি তারা এই আলোচনা থেকে উপকৃত হবেন। যারা হারিয়ে গেছেন তাদের জন্যও আশা রাখি। হয়তো তারা আবার ভাববেন নিজেদের আবেগ সম্পর্কে।

আশাই জীবনের শ্বাস।
শুভকামনা সবার জন্য।

রাফান আহমেদ
১৪ জানুয়ারি ২০২১, অপরাহ্ন

পঠিত : ৫৫৭ বার

মন্তব্য: ০