Alapon

মমতা আবার জিতবে তো?



পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার নির্বাচন হতে যাচ্ছে এপ্রিলে। বাঙালি হওয়ায় পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন নিয়ে আমরা একটু বেশিই কৌতুহলী।

ভারতের নির্বাচন সংস্কৃতি এখনো অনেকটা ভালো। আমদের দেশের মতো ওদের নির্বাচন কমিশন ধ্বসে যায়নি। সে দেশের জনগণ এখনো নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থা রাখে। তবে নির্বাচনে বলপ্রয়োগের সংস্কৃতি তাদের দেশেও আছে।

যাই হোক, এপ্রিলের এই নির্বাচন ঘিরে মঙ্গলবার একটি জরিপের ফলাফল ঘোষণা করেছে এবিপি আনন্দ এবং সি-ভোটার। জরিপটি বলছে, আবারও পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতার মসনদে বসতে যাচ্ছেন তৃণমূলের প্রাণ মমতা বন্দোপাধ্যায়। মমতা'র দল তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় গেলেও তার দলের বেশ কিছু আসন কমে যেতে পারে বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। পশ্চিমবঙ্গের ২৯৪টি বিধানসভা আসনের ১৮ হাজার ভোটারের মধ্যে এই সমীক্ষা চালিয়ে দেখা যায়, এবার ১৫৪ থেকে ১৬২টি আসনে জিততে পারে তৃণমূল। আর বিজেপি জিততে পারে ৯৮ থেকে ১০৬টি আসনে। বাম ও কংগ্রেস জোট জিততে পারে ২৬ থেকে ৩৪টি আসন। আর অন্যরা পেতে পারে ২ থেকে ৬টি আসন।

সমীক্ষার ফলাফলে আপাতদৃষ্টিতে যদিও অন্যান্য অনেক তথ্য দেখা যায়, তবুও এখানে উঠে এসেছে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে সবচেয়ে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের গ্রহণযোগ্যতা এখনো সর্বোচ্চ। এমনকি সাম্প্রতিককালের বহুল আলোচিত নাম ভারতীয় কিংবদন্তী ক্রিকেটার সৌরভ গাঙ্গুলীর চেয়েও জনমত জরিপে অনেক এগিয়ে আছেন মমতা। সৌরভের বিজেপিতে আসন্ন নির্বাচনে যোগদানের কথা ছিল কিন্তু হঠাৎ করেই হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ায় আপাতদৃষ্টিতে তার যোগদান না করার বিষয়টি সামনে আসছে।

পশ্চিম বাংলার নির্বাচন নিয়ে সমীক্ষার পাশাপাশি ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় দুই রাজ্য কেরালা ও তামিলনাড়ুর আসন্ন নির্বাচন নিয়েও সমীক্ষা প্রকাশ করেছ গবেষণা প্রতিষ্ঠান সি-ভোটার। কেরালায় জরিপে উঠে এসেছে, দীর্ঘকাল ধরে বাম শাসনের অধীনে থাকা রাজ্যটি আগামীতেও তাদের অধীনে থাকবে। ভারতীয় রাজ্যগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রায় শতভাগ শিক্ষার হারের রাজ্য কেরালা। সাম্প্রতিক একটি নির্বাচনে আরিয়া রাজেন্দ্র নামে একজন কলেজছাত্রী রাজ্যটির ত্রিভূবনথাপুরাম শহরের মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। এ ঘটনাটি সারা বিশ্বের কাছেই বিস্ময়কর, কারণ ও ওই ছাত্রীটির বয়স মাত্র ২১ বছর।

কেরালা এবং পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে পার্থক্যটা দীর্ঘকাল ধরেই লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। আর তা হলো- নেতৃত্ব সৃষ্টির ক্ষেত্রে কেরালা সবসময় তরুণদেরকে সামনে নিয়ে এসেছে যার ফলশ্রুতিতে হয়তো কেরালায় এখনো বামপন্থী ধারা আছে। আর পশ্চিমবাংলার ক্ষেত্রে ঘটেছিল উল্টোটি। দীর্ঘ ৩৪ বছরের শাসনকালে বয়স্করা ছিল শাসন ও নেতৃত্বের কেন্দ্রে। যে জন্য বুড়োদের রাজ্য হিসেবে খ্যাত ছিল পশ্চিমবাংলা। একসময় পশ্চিমবাংলার বিধানসভার নেতৃত্বে থেকে সাধারণ সভ্য সকলের বয়স প্রায় পঞ্চাশের উর্ধ্বে ছিল। তরুণ প্রজন্মকে মাঠ কর্মী হিসেবে বিবেচনা করা হতো, কখনো নেতৃত্বে নিয়ে আসার কোনো ব্যবস্থাই পশ্চিমবাংলার বামপন্থীদের ছিল না। যে কারণে পশ্চিমবাংলায় মাঠকর্মীদের দলে ধরে রাখতে পারেনি বামপন্থীরা। বামপন্থীদের পরাজয়ের এটি একটি অন্যতম কারণ। এছাড়াও আরও অনেক কারণ আছে। তবে জয়ের জন্য তরুণ নেতৃত্ব তৈরি করা যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সেটি কেরালা দেখিয়ে দিয়েছে।

তামিলনাড়ুর নির্বাচন নিয়ে ওই সমীক্ষায় ইঙ্গিত দেওয়া হয়, আগামীতে স্ট্যালিন-রাহুলের নেতৃত্বাধীন জোট ক্ষমতায় আসছে। স্ট্যালিন হচ্ছেন তামিলনাড়ুর এককালের সবচেয়ে জনপ্রিয় করুণানিধির ছোট সন্তান আর রাহুল হচ্ছেন রাজীব গান্ধীর ছোট সন্তান। এই দুই ছোট সন্তানের মিলিত জোট আগামী দিনে তামিলনাড়ুর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবে বলে অনুমান করেছে সি ভোটার। তামিলনাড়ুর বর্তমান ক্ষমতায় আছে জয়ললিতার রাজনৈতিক দল। জয়ললিতার অনুপস্থিতিতে দলের নিয়ন্ত্রণ আর কোন একক ব্যক্তির কাছে নেই।

ভারতীয় রাজনীতিতে দীর্ঘকালের পরিবর্তনের উদাহরণ হচ্ছে তামিলনাড়ুর রাজনীতি। এক্ষেত্রে পশ্চিমবাংলায় একই অবস্থানে আছে পরিবারতন্ত্রের রাজনীতি। পশ্চিমবাংলার রাজনীতিতে মমতা ব্যানার্জির সবচেয়ে বড় সমালোচনা হচ্ছে তার ভ্রাতুষ্পুত্র কে রাজনীতির মঞ্চে প্রতিষ্ঠা করা। আজকে তার দল থেকে চলে যাওয়া প্রায় সবাই 'ভাইপো ভাইপো' বলে চিৎকার করছেন। এ ব্যাপারে মমতা ব্যানার্জি কোনো প্রতি উত্তর দেননি। ভাইপো তার রাজনৈতিক যোগ্যতায় দলটির যুব তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃত্ব দিচ্ছেন নাকি ভাইপো হিসেবেই এই যোগ্যতা অর্জন করেছেন তা নিয়ে চলছে বিতর্ক।

ওপার বাংলার এই পারিবারিক উত্তরাধিকারিত্ব বাংলাদেশের মতোই। বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক পরিবারের সদস্যরাই সর্ জায়গায় তাদের অবস্থান নিশ্চিত করে। সংসদ থেকে শুরু করে পৌরসভার মেয়র, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান- মেম্বার পর্যন্ত পরিবারের মধ্যে ধরে রাখার প্রয়াস আমরা এখানে দেখি। এখান থেকে গণতন্ত্রের যাত্রা ক্ষতিগ্রস্ত হয় কিনা তা এদেশের সকল স্তরের মানুষেরই ভাবা উচিত।

মমতা ব্যানার্জির পুনরায় ক্ষমতা আসা বাংলাদেশের জন্য একদিকে একটি সুসংবাদ অন্যদিকে দুঃসংবাদও বটে। মমতা ব্যানার্জির পুনরায় ক্ষমতায় আসলে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি'র করা বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইনের সিএএ এবং এনআরসির বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হবে। মমতা থাকতে পশ্চিমবাংলায় এটি হবেনা বলেই ধরে নেওয়া যায়। এনআরসি বাস্তবায়ন হলে আসামের মতন পশ্চিমবাংলার বিশাল জনগোষ্ঠী সেখানে তাদের রাজনৈতিক পরিচয় হারাবে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে মতুয়া সম্প্রদায়। এই সম্প্রদায়ের আদিনিবাস বাংলাদেশের ফরিদপুর অঞ্চলে। খানিকটা আলাদা ধর্মীয় দর্শন ধারণ করা এই সম্প্রদায়ের মানুষের জাতীয়তা নিয়ে সংকট এখনও নিষ্পত্তি হয়নি।

বিজেপি'র কেন্দ্রীয় নেতা ও ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত সাহা কিছুদিন আগে ঘোষণা করেছিলেন, মতুয়াদের ভারতের রাজনৈতিক পরিচয় সিএ এর মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হবে। মতুয়া সম্প্রদায়ের ইতিহাস বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পৃক্ত দীর্ঘকাল যাবত। রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক কারণে বাংলাদেশ থেকে যারা ভারতে গমন করেছিলেন। তাদের অনেকেরই ভারতের জাতীয় পরিচয় নিষ্পত্তি হয়নি যদিও দেশটি তাদেরকে পরিচয় নিষ্পত্তির অঙ্গীকার করেছে। অমিত শাহ'র এই হচ্ছে বাংলাদেশের সঙ্গে পশ্চিমবাংলার সংকটের একটি দিক। বাংলাদেশের সঙ্গে পশ্চিমবাংলা সংকটের আরেকটি দিক হচ্ছে মমতা ব্যানার্জির তিস্তা চুক্তি মেনে নিতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন। তিস্তা চুক্তি মেনে না নেওয়ার ফলে বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ক একটি সংকটময় জায়গায় আছে। কেউ কেউ ধারণা করেন যে বিজেপি কৌশলে মমতা ব্যানার্জিকে দিয়ে তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়নের পথ রুদ্ধ করে দিয়েছে, কারণ বাংলাদেশের সঙ্গে যে যে বাণিজ্যিক এবং সামাজিক এবং অর্থনৈতিক চুক্তি সম্পাদন করেছে ভারত, তাতে বাংলাদেশের দিক থেকে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তিস্তা চুক্তি। ধারণা করা হয় যে মমতা ব্যানার্জি যদি পুনরায় ক্ষমতায় আসেন তাহলে বাংলাদেশের এই তিস্তা চুক্তি হয়তো আর সম্পন্ন হবেনা। তিস্তা চুক্তি সম্পন্ন না হওয়ার ফলেই বাংলাদেশকে চীনের প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে যেতে হচ্ছে, যা বাংলাদেশের জাতীয় ঋণ কয়েক বিলিয়ন ডলার বৃদ্ধি করবে। চীনের প্রস্তাবিত প্রকল্প এবং পানির প্রবাহ বৃদ্ধি উজানের দেশগুলোকেও সহায়তা করবে। ভাটিতে যদি পানি প্রবাহ বৃদ্ধি পায় উজানে তাহলে বন্যার আশঙ্কা কমে যায়।

ভারতীয় গণমাধ্যম দীর্ঘদিন যাবৎ পশ্চিমবাংলার নির্বাচনকে নিয়ে যে প্রচারণা চালাচ্ছিল, সি ভোটারের এই সমীক্ষা আপাতত তৃণমূল কংগ্রেসকে কিছুটা স্বস্তি দিচ্ছে। তৃণমূল কংগ্রেসের মমতা ব্যানার্জি তার পুরনো বিধানসভা আসন ও ভবানীপুর এর সঙ্গে তার উত্থানের স্থান নন্দীগ্রামে নির্বাচনের ঘোষণা করেছেন। এই নন্দীগ্রাম থেকেই বিধায়ক হয়েছিলেন মমতার সঙ্গী দীর্ঘ ২০ বছর রাজনীতি করে আসা শুভেন্দু অধিকারী। তৃণমূল থেকে বিজেপিতে যোগ দেওয়া শুভেন্দু মমতাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন, মমতা যদি নন্দীগ্রামে জিততে পারে তবে তিনি রাজনীতি ছেড়ে দেবেন। পার্শ্ববর্তী দেশের অতিচেনা এই রাজ্যের নির্বাচনে এখন আমাদের দেখার পালা কার রাজনীতি থাকে আর কার রাজনীতি শেষ হয়ে যায়।

পঠিত : ৪১৭ বার

মন্তব্য: ০