Alapon

একটি কুলখানির আত্মকথা...



যখন ক্লাস ফাইভে পড়ি, তখন আমার দাদি মারা যান। মারা যাওয়ার দিন কয়েক পরেই নাকি কুলখানি করার নিয়ম। আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশিরা সবাই এ কথা বলল। সবার কথা শুনে আব্বা ও চাচ্চুরা মিটিংয়ে বসল। সিদ্ধান্ত হল, দুই হাজার মানুষের আয়োজন করা হবে। দিনক্ষণ ঠিক করা হল এবং সেই দিন মোতাবেক আত্মিয়-স্বজনরা বাড়িতে আসতে শুরু করল।

আমরা একান্নবর্তি পরিবার। আব্বারা ৭ ভাই আর তিন বোন! স্বাভাবিক কারণেই বাড়িতে সর্বদা লোকজন ভরপুর থাকে। সেইসাথে প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো আত্মিয় তো আছেই। আর কুলখানি উপলক্ষ্যে কাছের-দূরের আত্মিয়-স্বজনরা যখন বাড়িতে আসতে শুরু করল, তখন বাড়িটাকে নিউমার্কেটের নুরজাহান মার্কেট মনে হচ্ছিল! যেখানে সারাদিন মানুষ গিজগিজ করে- তেমন অবস্থা!

গল্প-উপন্যাসের মত বলব না, এমন মানুষ ভর্তি বাড়ি দেখে আমার ভীষণ ভালো লাগছিল। বরং সত্যটা হল, যখন নিজের ঘুমানোর রুমটাও ছেড়ে দিতে হল, তখন বিরক্তির সপ্তম আসমানে উঠে গেলাম। কিন্তু আমি নিরুপায়!

যাইহোক, দেখতে দেখতে বাড়িটা আত্মিয়-স্বজনে ভরে গেল। বাড়িতে মহিলারা গল্প-গুজবে মেতে উঠল। কেউ কেউ গল্প করতে করতে গায়ে ঢলে পড়তেছিল, আর মুরুব্বিরা মুখে পান গুজতে গুজতে সাবধান করে দিয়ে বলছিল, ‘আস্তেরে...আস্তে! কুলখানিতে আসছিস, বিয়ে বাড়িতে না!’

কিন্তু সেই সাবধান বাণী ভুলে যেতে তাদের খুব বেশি সময় লাগে না। শুরু হয় নতুন গল্প, আর সেই গল্পের সাথে সাথে শুরু হয় হাসির রোল। আর তাদের সেই হাসি দেখে আমার দাদির ছোট দুই বোন হঠাৎ হঠাৎ দির্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, ‘বুবুজি...ও বুবুজি!’

রাতে শুরু হল রান্নার আয়োজন। তিনটা গরু, আর গোটা কয়েক খাসি নিয়ে রান্নার আয়োজন। বাবুর্চিরা রান্না নিয়ে বিরাট ব্যস্ত, গোটা বাড়ি মশলার ঘ্রাণে মৌ মৌ ঘরছে। বাবুর্চিরা একটু পরপরই তাদের সহকারীদের হাক দিচ্ছিল, ‘তাড়াতাড়ি কর! ফজরের আজানের আর বেশি দেরি নাই। আজানের আগেই রান্না শেষ করবার না পারলে, বিরাট বিপদ হয়ে যাবে!’ সেই বিপদ যেন না হয়, তাই রান্নার সমস্ত বিষয় বড়ো চাচ্চু দাঁড়িয়ে থেকে তদারকি করছিলেন।

ফজরের পর থেকে শুরু হলো খাওয়ানো। প্রথমের দিকে মানুষ একটু কম থাকলেও বেলা বাড়ার সাথে সাথে ঢল নামতে শুরু করল। বারান্দায় বসে মানুষের এই ঢল দেখে আমি ভড়কে গেলাম। সেইসাথে বাড়ির আর সবাই ভড়কে গেল। কেউ কেউ বলতে লাগল, ‘মানুষের যে পরিমাণ ঢল নামছে তাতে তিনটা গরু কেন, ত্রিশটা গরু জবাই করলেও কুলানো সম্ভব হবে না।’

এই কথা শুনে আব্বাজি নিজের রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লেন! আর বাদবাকি সবাই ‘ইন্নালিল্লাহ...ইন্নালিল্লাহ’ পড়তে লাগল! আর দাদু সাহেব মনে মনে কী কী যেন দুআ পড়তে লাগলেন! সেদিন আমি কতটা বুঝে ভয় পেয়েছি, আর কতটা দাদু ও চাচ্চুদের মুখের অবস্থা দেখে ভয় পেয়েছি, তা নিয়ে আজও সন্দিহান। কিন্তু সেদিন আব্বার অমন করে শষ্যাশায়ী হওয়া দেখে নাকি দাদু সাহেবের অনবরত দুআ-এর বদৌলতে আল্লাহপাকের দয়া হয়েছিল, তা পরিষ্কার নয়। যে ওসিলায় হোক ওই তিনটা গরু আর ৫ টা খাসি দিয়েই সমস্ত লোক সামলানো সম্ভব হয়েছিল।

লোকজন খাওয়া শেষে মুখ মুছতে মুছতে বাড়ি যাচ্ছিল আর বলছিল, ‘গোশতটা সেইরকম রান্না হইছে! আর দুইটা গোশত সাথে একহাতা ডাল যদি পাইতাম, তাহলে আরও এক প্লেট মেরে দেওয়া যাইত! কিন্তু শরমের জন্য চাইতে পারলাম না। যাকগে, যা খেয়েছি তাতে আলহামদুলিল্লাহ!’

আজ ১৫ বছর পর সেই কুলখানির কথা মনে পড়লে, আমার জিজ্ঞাসু মন জানতে চায়, লোকজনকে এমন পেটপুরে খাওয়ানোটা যে উদ্দেশ্যে, আমার মরহুমা সেই দাদীর জন্য লোকজন দুআ করেছিল কি? আর দুআ করলেও, সেই দুআ কি দাদীর পুলসিরাত পারাপারে কোনো সহায়ক ভূমিকা রাখবে?

মনে তো হয় না...!

পঠিত : ৩১৮ বার

মন্তব্য: ০