Alapon

যুব চিন্তায় আলেম ও ইলম বাংলাদেশী যুবকদের সাথে - প্রফেসর ড. মেহমেদ গরমেজ


আসসালামু আলাইকুম
প্রথমেই শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি আপনাদের সবার সাথে যুক্ত হতে পেরে। এই সুযোগ দেওয়ার জন্য আপনাদের সকলকে অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমাকে এই প্রোগামে আহ্বান জনানোর জন্য আপনাদের ধন্যবাদ জানাই। যদি বাংলা জানা থাকত তাহলে আপনাদের সাথে বাংলাতেই কথা বলতাম। অনুবাদক হওয়ার জন্য ভাই বুরহান উদ্দিনকেও ধন্যবাদ জানাই।
আমি প্রথম পনের থেকে বিশ মিনিট ইলম ও আলিম সম্পর্কে কথা বলব। তারপর আপনাদের প্রশ্নের উত্তর দিব।
আমি যতটুকু জানি আপনারা আলিম ও আলিমাহ হতে চান। শুরুতেই আমি আপনাদের জানাতে চাই কিভাবে আলিম হবেন।
প্রথমত, ইসলামী সভ্যতা জ্ঞানকে যে পরিমাণে গুরুত্ব দিয়েছে এবং যে উচ্চ মর্যাদার আসনে সমাসীন করেছে, অন্য কোন দ্বীন বা সভ্যতা এত গুরুত্ব কখনো দেয় নি এবং এত উচ্চ মর্যাদায় প্রদান করেনি । ইসলাম অন্যান্য সকল সভ্যতা থেকে নিজেকে একটি জ্ঞানভিত্তিক সভ্যতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং জ্ঞানের মাধ্যমে ইসলাম নিজেকে অন্যদের থেকে পার্থক্য করে থাকে । এজন্য ইসলাম তাঁর পূর্বের সমস্ত সময়কে আইয়্যামে জাহেলিয়াত (মূর্খতার যুগ) বলে উল্লেখ করেছে। রাসূলে আকরাম (সা) একটি হাদীসে ইরশাদ করেছেন ”যারা জ্ঞান অর্জন করে ফেরেশতারা তাদের জন্য নিজেদের পাখাকে বিছিয়ে দেয়। আসমান জমিনের মাঝে যা কিছু আছে সবকিছুই যারা জ্ঞানার্জন করে তাদের জন্য দোয়া করে। এমনকি সাগরের মাছ পর্যন্তও তাদের জন্য দোয়া ও ইস্তেগফার করে”।
আলেমরা হচ্ছেন নবীগণের উত্তরাধিকারী। মহাগ্রন্থ আল কুরআন আলিমদেরকে হাদীসের চাইতে বেশি উচ্চ মর্যাদায় আসীন করেছে।
شَهِدَ اللَّهُ أَنَّهُ لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ وَالْمَلَائِكَةُ وَأُولُو الْعِلْمِ قَائِمًا بِالْقِسْطِ ۚ لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ
আল্লাহ রব্বুল আলামীন ফেরেশতাদের সাথে সাথে আলিমদেরকেও তাঁর অস্তিত্বের সাক্ষী করেছেন। অন্য একটি আয়াতে বলা হয়েছে-
قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِينَ يَعْلَمُونَ وَالَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ ۗ إِنَّمَا يَتَذَكَّرُ أُولُو الْأَلْبَابِ
”যারা জানে আর যারা জানেনা তারা উভয়ে কি কখনো এক হতে পারে ?”অন্য একটি আয়াতে বলা হয়েছ।
انما يخشى الله من عباده العلماء
কেবলমাত্র যারা জ্ঞানী তারাই আল্লাহকে সবচেয়ে বেশি ভয় করে।”
তাহলে এখন প্রশ্ন হচ্ছে আলিম কে?
আল্লাহ এবং রাসূল (সাsmile যে আলিমের প্রশংসা করছেন সে আলিম কে ? কিভাবে আলিম হওয়া যায়? কোন জ্ঞান অর্জন করলে সত্যিকারের আলেম হওয়া যায়? শুধুমাত্র কিছু তথ্য উপাত্ত জানলেই কি আলিম হওয়া যায়! যেমন উইকিপিডিয়ায় সকল তথ্য আছে তার মানে কি উইকিপিডয়া আলেম?
যেমন গুগল, এমন কোন তথ্য নাই যা সে জানেনা, সে সকল তথ্যকে তার মাঝে সংরক্ষিত করে রেখেছে; তার মানে আমরা কি গুগলকে আলিম বলব?
ইলম কি শুধুমাত্র তাফসীর এবং হাদিস! শুধু কি কালাম এবং তাসাউফ! পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন সহ আরো যেসকল জ্ঞান আছে যা মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীনের সৃষ্টির সৃষ্টিতত্ত্বকে বুঝতে সহায়তা করে এগুলো কি জ্ঞান না? যারা এই জ্ঞান অর্জন করে তাদেরকে কি আলিম বলবো না? তাহলে আমরা কি বলবো ইমাম গাযালী আলেম আর ইবনে সিনা আলেম না! আমরা কি বলবো ইবনে তাইমিয়্যাহ আলেম কিন্তু আল ফারাবী আলেম নন!
অনেক জ্ঞানার্জন করার পরও যদি একজন মানুষ তার কর্মে জ্ঞানের প্রতিফলন না ঘটান তাহলে কি আমরা তাকে আলেম বলতে পারব? আমল কি আলেম হওয়ার জন্য শর্ত? কোন মানুষের ভিতরে যদি ইখলাস না থাকে তাহলে তাকে কি আলেম বলা যাবে? আমরা যদি এই সকল প্রশ্নের সঠিক জবাব দিতে পারি, তাহলেই একজন মানুষ সত্যিকারার্থে কিভাবে আলেম হতে পারেন এবং আলেম কাকে বলে এই প্রশ্নের উত্তর আমরা পেতে পারি।
প্রথমত, আমাদেরকে ইলম শব্দকে বুঝতে হবে। ইলমের উদ্দেশ্য কি, ইলম কি শুধু কুরআনের আয়াতসমূহকে বুঝানোর ক্ষেত্রে গঠিত ইলমুত তাফসীরই কি ইলম? নাকি সমগ্র সৃষ্টিতত্ত্বকে বুঝানোর ক্ষেত্রে যে জ্ঞান রয়েছে সেগুলোও ইলম?
এই বিষয়কে আমরা কিভাবে বুঝব? ইসলামী সভ্যতার সবচেয়ে টার্নিং পয়েন্ট তথা ভঙ্গুর পয়েন্ট হলো জ্ঞান কে দ্বীনি এবং দ্বীনি নয় (দুনিয়াবী) এভাবে বিভাজন করা। এটিই হচ্ছে সবচেয়ে বিপজ্জনক পয়েন্ট। কারণ তা হচ্ছে একটা সেক্যুলার বিভাজন। মহান রব্বুল আলামীনের আয়াতসমূহকে ব্যাখ্যাকারী তাফসীর সমূহ যেরকম ইলম, তেমনি মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীনের এই পৃথিবীকে ব্যাখ্যাকারী যত জ্ঞান রয়েছে সেগুলোও ইলম।
তাকবীনি আয়াতসমূহ তথা এই পৃথিবী সৃষ্টিজগতের সাথে সম্পর্কিত আয়াতসমূহ এবং তানজিলি তথা কুরআনের আয়াতসমূহকে একটা আরেকটার থেকে পৃথক করতে পারবো না। কারণ আমরা যখন কুরআন পড়ি তখন কুরআন আমাদেরকে তাকবিনি আয়াতসমূহ তথা সৃষ্টির দিকে আমাদেরকে নিয়ে যায়-
الذين يتفكرون في خلق السموات والأرض
এই আয়াতে বলা হয়েছে সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে আকাশ ও জমিনের সৃষ্টি নিয়ে গবেষণা করতে বলা হয়েছে।
إِنَّ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ لَآيَاتٍ لِّأُولِي الْأَلْبَابِ
وَمِنْ آيَاتِهِ خَلْقُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافُ أَلْسِنَتِكُمْ وَأَلْوَانِكُمْ ۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَاتٍ لِّلْعَالِمِينَ
وَمِنْ آيَاتِهِ خَلْقُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافُ أَلْسِنَتِكُمْ وَأَلْوَانِكُمْ ۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَاتٍ لِّلْعَالِمِينَ
এখানের যে আয়াতগুলো তিলাওয়াত করা হয়েছে সেখানে বলা হয়েছে এখানে শুধুমাত্র কুরআনের আয়াতসমূহ নয় একই সাথে সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়েও বলা হয়েছে। পৃথিবীতে যে আয়াতসমূহ রয়েছে এগুলোর কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। এজন্য আমাদেরকে কখনোই এই আয়াতসমূহের মাঝে বিভাজন সৃষ্টি করা যাবেনা। তাওহীদুল উলুম তথা জ্ঞানের মধ্যকার তাওহীদ, তাওহীদুর রবুবিয়্যাত তথা স্রষ্টার তাওহীদের মতই গুরুত্বপূর্ণ।
আমরা জ্ঞানকে দ্বীনি - অদ্বীনি, ইসলামিক- অনৈসলামিক, শরয়ী - গয়রে শরয়ী এভাবে পার্থক্য করতে পারবোনা। কেননা আমরা জ্ঞানকে শুধু উপকারী এবং অপকারী হিসেবেই পার্থক্য করতে পারি। এজন্য রাসূল (সাঃ) এরশাদ করেছেন “আমি সেই জ্ঞান থেকে পানাহ চাই যেই জ্ঞান কোন ধরণের উপকার করে না।”
এগুলো হচ্ছে প্রথম বিষয়। দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে ইসলামী সভ্যতায় ইলম বলতে শুধু তথ্য বুঝায় না বরং ইলম, হিকমত, মারিফাত এই তিনটি বিষয়কে বুঝায়। আমার পিছনে একটা দেয়ালিকা আছে। এই দেয়ালিকাটি তুর্কির সবচেয়ে বিখ্যাত চিত্রশিল্পী অংকন করেছেন। কানুনী সুলতানের সময়ে এই কথাগুলো একটি মসজিদে নকশা করে রাখা হয়েছিল। আপনারা দেখতে পাচ্ছেন না হয়তো। তাই আমি নিজেই পড়ে শুনাচ্ছি, 'ক্বলবের আকাশের যে বিষয়টি প্রথম উদিত হয়, সেটি হচ্ছে হিকমতের তারকা, এরপর উদিত হয় জ্ঞানের চন্দ্র, এরপর উদিত হয় মারিফাতের সূর্য'।
হিকমতের তারকার মাধ্যমে সৃষ্টিতত্বের যে হাকিকত রয়েছে এটাকে দেখা সম্ভব। জ্ঞানের চন্দ্রেরের সাহায্যে অর্থের / রহস্যের জগতকে তথা ইলমুল মা’য়ানাকে দেখা সম্ভব। এরপর মারিফাতের সূর্যের সাহায্যে আমরা মহান রবকে তথা রবের কুদরতকে দেখতে পারি, তাঁর সৃষ্টিকে পর্যবেক্ষণ করতে পারি। ফলশ্রুতিতে ইলম, হিকমত, মারিফাত এদের একটাকে আমরা আরেকটা থেকে কখনোই পৃথক করতে পারবো না। যে জ্ঞানার্জন করে তথা জ্ঞানী তাকে আলেম বলা হয়। যে হিকমতের অধিকারী তাকে হাকিম বলা হয়। আর যে মারিফাতের অধিকারি তাকে আরিফ বলা হয়। ইসলামী সভ্যতায় আলিম বলতে শুধু আলিম নয়, আলিম একই সাথে হাকিম তথা প্রজ্ঞাবান এবং একই সাথে আরিফ তথা ইরফানের অধিকারী। এগুলো একটি আরেকটির সাথে সম্পর্কিত। এগুলোকে কখনোই পরস্পর থেকে পৃথক করা যাবে না। মারিফাতুল্লাহ ছাড়া কখনো হিকমাহ অর্জন করা সম্ভব নয়। হিকমতবিহীন ইলম সম্ভব নয়। যদি আমরা পৃথক করি, তবে ইলম শুধু তথ্য উপাত্তে পরিণত হবে। আমাদের সময়ের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আমরা প্রচুর তথ্য উপাত্ত জানি। ইন্টারনেটের আবিষ্কারের কারণে বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত জানা হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে সহজ বিষয়। অথচ শুধুমাত্র কিছু তথ্য উপাত্ত জানলেই একজন মানুষ কখনোই আলিম হতে পারে না।
প্রিয় যুবক ভাইয়েরা দুনিয়াতে একটা নতুন ধরণের ইঞ্জিনিয়ারিং আছে। এটাকে বলে জাহেলিয়্যাতের ইঞ্জিনিয়ারিং তথা মূর্খতার ইঞ্জিনিয়ারিং (হান্দাসাতুল জাহিলিয়্যাহ)। এই মূর্খতার ইঞ্জিনিয়ারিং মানুষকে তথ্য উপাত্ত দিয়ে মূর্খ বানায়। এজন্য যারা শুধুমাত্র তথ্য উপাত্ত জানে তারা কখনোই আলিম হতে পারে না। ইলমের সাথে সাথে হিকমতের অধিকারী হতে হবে , মারিফাতের অধিকারী হতে হবে।
এমনি কি ইলমের সাথে অবশ্যই সালেহ আমলের সংযোগ থাকতে হবে। সালেহ আমল ছাড়া সে যদি আল্লামাও হয়, তাকে আলেম বলা যাবে না।
মানুষ ধ্বংস হলো শুধুমাত্র আলেমগণ ছাড়া,
আলেমগণ ধ্বংস হলো আমলে সালেহ ছাড়া
আর আমলে সালেহ ধ্বংস হলো ইখলাস ছাড়া।
আলিম হওয়ার জন্য উসূলের অধিকারী হতে হয়। শুধুমাত্র দ্বীন সম্পর্কেই জানলেই হবে না। দ্বীনের সাথে সাথে মানুষ এবং মানুষের জীবনকে জানতে হবে। এমনকি এই তিনটির মধ্যে কিভাবে সমন্বয় সাধন করা যায় তাও জানতে হবে। শুধুমাত্র কুরআনকে জানলেই হবে না, বরং এর সাথে আয়াতে তাকবিন ও আয়াতে তানজিলকে বুঝার জন্য উসূলকে বুঝতে হবে, উসূলকেও জানতে হবে। আছল তথা মূল এবং শাখা-প্রশাখার মধ্যে পার্থক্য করার জ্ঞান থাকতে হবে। জুয'ইয়্যাত কাকে বলে কু্ল্লিয়্যাত কাকে বলে তথা শাখা-প্রশাখা কাকে ,মূল বা সামগ্রিক বিষয় কাকে বলে তা জানতে হবে এবং এর মাঝে পার্থক্য নিরূপণ করার যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। কোনটি পরিবর্তনীয় আর কোনটি অপরিবর্তনীয়, কোনটি স্থানীয় আর কোন বিশ্বজনীন এগুলোর মাঝে পার্থক্য নিরূপণ করার মতো যোগ্যতা থাকতে হবে এবং এগুলোকে খুব ভালোভাবে বুঝতে হবে। শুধুমাত্র কিতাব জানলেই হবে না এর সাথে সুন্নাহকে তথা হাদীস জানতে হবে। কিতাব ও সুন্নাহর মাঝে যে সম্পর্ক রয়েছে সে সম্পর্কিত উসূলও জানতে হবে। কিতাব এবং সুন্নাহকে কিভাবে বুঝব এই সম্পর্কে ইস্তিম্বাতের উসূলকে জানতে হবে। ফলশ্রুতিতে যারা এই সকল বিষয়কে জানবে তাদেরকেই আমরা আলিম বলব। আর তাদের দ্বারাই আলিম হওয়া সম্ভব। এজন্য একজন যুবক যদি এই ফ্রেমকে খুব ভালো ভাবে বুঝতে পারে এবং এই ফ্রেমকে ভালোভাবে জানতে পারে এবং নিজের সময় কে ভালোভাবে ব্যবহার করতে পারে তাহলে মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীন খুব অল্প সময়ের মাঝে তাকে জ্ঞানী হওয়ার যোগ্যতা দান করবেন।
এই প্রেক্ষাপটের আলোকে আপনাদের প্রতি আমার উপদেশ হলো সময়কে খুব ভালোভাবে ব্যবহার করতে হবে। কারণ আমাদের জীবন খুবই স্বল্প সময়ের, কিন্তু জানার বিষয় অনেক। আপনারা হচ্ছেন অনেক বড়, অনেক বৃহৎ একটি সভ্যতার সন্তান। মহান আল্লাহ রব্বুল সমগ্র মানবতার জন্য আদালতকে প্রতিষ্ঠা করার দায়িত্ব আপনাদেরকে দিয়েছেন। মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীন মুসলমানদেরকে ইসতিখলাফের দায়িত্ব তথা আদালত ও ন্যায়কে প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব দিয়েছেন। যে সভ্যতায় আলিম নেই, সে সভ্যতা কখনো উপমা হতে পারে না। আমাদেরকে তাওহীদুল উলুম তথা জ্ঞানকে বিভাজন না করে উসূলের আলোকে জ্ঞানের পথ বের করে নিতে হবে, জ্ঞানী হতে হবে। বাঁচার জন্য পানি এবং অক্সিজেনের যেমন প্রয়োজন, তেমনি আমাদের তথা ইসলামী সভ্যতার জন্য বড় বড় আলেমের প্রয়োজন। যারা তাওহীদুল উলুমের আলোকে ,উসূলের আলোকে নিজেদেরকে গড়ে তুলবে। আলেমগণ যদি সত্যিকার অর্থেই মানুষকে পথ প্রদর্শন করতে পারেন, তাহলে আমাদের উপর আমাদের দায়িত্বকে সঠিকভাবে পালন করতে পারব।
এজন্য আমি আবারও পুনুরাবৃত্তি করতে চাই, যারা শুধু কুরআন এবং হাদীসকে জানেন তারা আলেম হতে পারবেন না বরং এর সাথে তাকবিন এবং তানজিলকে যারা একত্রিত করে পাঠ করতে পারবেন, যারা অতীত ও বর্তামানের মাঝে সমন্বয় সাধন করে জ্ঞানার্জন করতে পারবেন, তাদের দ্বারাই আলেম হওয়া সম্ভব। একবার ইমাম গাজালীকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আপনি এত অল্পসময়ের মাঝে এত বিশাল কীর্তি কিভাবে সাধন করলেন ? তিনি বলেন, “আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করেছি তিনি যেন আমাকে সময়ের মাঝে সময় দান করেন”। এজন্য আমরা যারা যুবক আছি তাদেরকে সময়ের মাঝে সময় সৃষ্টি করে সমগ্র বিশ্ব মানবতাকে আলোর পথ দেখাবে এমন আলেম হতে হবে।
জ্ঞান, চিন্তা ,মূল্যবোধ এই তিনটি বিষয়ের উপর আমাদেরকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বারোপ করতে হবে এবং এই তিনটি বিষয়কে খুব দ্রুত গঠন করতে হবে। আজ সমগ্র উম্মাহর মধ্যে ই'তিকাদি সমস্যা আছে, আমলী সমস্যা আছে, আছে আখলাকী সমস্যাও। এই তিন সমস্যাকে দূরীভূত করার জন্য প্রচেষ্টা চালাতে হবে। এই তিনটি বিষয়কে নিয়ন্ত্রণ করে রাজনীতি। একই সাথে বিশ্বরাজনীতি এবং মুসলমানদের মাঝে যে রাজনীতি হচ্ছে আমাদের যুবকদেরকে তা ভালোভাবে জানতে হবে, বুঝতে হবে। এজন্য সমাজবিজ্ঞানকে খুব ভালোভাবে জানতে হবে। সেই সাথে ফিলোসফি, পলিটিক্যাল সায়েন্স, সোশিওলজি, সাইকোলজি, আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে খুব ভালোভাবে জানতে হবে।
জ্ঞানের তিনটি মৌলিক বিষয় আছে এই তিনটির একটিকে আরেকটি থেকে কখনো আলাদা করা যাবে না। যথা:
১/ওহী
২/মানুষ
৩/ সৃষ্টিজগত।
ওহীকে বুঝানোর জন্য যেসকল জ্ঞান রয়েছে যেমন- তাফসীর, হাদিস, কালাম এগুলো নির্দিষ্ট। শুধুমাত্র এসকল বিষয়ের উসূলকে ভালোভাবে জানতে হবে। উসূলে দ্বীন ও উসূলে ফিকাহকে গুরুত্ব দিতে হবে। আরেকটি হচ্ছে, মানুষকে বুঝানোর ক্ষেত্রে যেসকল জ্ঞান আছে আমাদেরকে সেসবও জানতে হবে। এজন্য ইতিহাস, সোশিওলজি, সাইকোলজি ভালোভাবে জানতে হবে কেননা এসকল জ্ঞান মানুষের সাথে সম্পৃক্ত। তৃতীয়টি হচ্ছে বিশ্বসৃষ্টি। এই বিশ্বসৃষ্টিকে ব্যাখ্যা করে যেসকল জ্ঞান সেসকল জ্ঞানসমূহও আমাদেরকে জানতে হবে। কারণ সৃষ্টিজগত হচ্ছে আল্লাহ রব্বুল আলামীনের সৃষ্টি সম্পর্কিত বিষয় সমূহ। মহান আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর সৃষ্টি জগতে যেসকল নিয়ম কানুনসমূহকে প্রতিষ্ঠা করেছেন সেগুলোকে ব্যাখ্যা করে পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন, গণিত। এসকল বিষয় আমাদেরকে আল্লাহর সৃষ্টিজগতের নিয়ম-কানুন সম্পর্কে শিক্ষা দেয়। আমরা যদি এই সকল বিষয়কে একটি সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে পারি, তাহলে তাওহীদুল উলুমের অধিকারী হতে পারব।
বর্তমান মুসলিম বিশ্বে যারা মুনাওওয়ার তথা আলোকিত মানুষ এবং যারা মুতাফাক্কির তারা একে অপরের বিরোধিতা করে থাকেন। কারণ প্রত্যেকে তাঁর নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে সবকিছুকে বিশ্লেষণ করে থাকেন। যে ওহী সম্পর্কে জানে সে ওহীকে ঐভাবে দেখে, যে ইনসান তথা মানুষকে জানে সে ইনসানকে দেখে বিশ্লেষণ করে। এভাবে প্রত্যেকে জ্ঞানের তিনটি শাখার যেকোন একটি দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে ,সামগ্রিক ভাবে না দেখার ফলে বিরোধ সৃষ্টি হয়। এজন্য আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে নতুন করে প্রণয়ন করতে হবে। খানকা এবং মাদরাসার মধ্যকার পার্থক্য মিটাতে হবে। আমাদের ইতিহাসে খানকা তথা পীর মুরিদী এবং মাদরাসার মধ্যে একটা পার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে। যারা দরগায় যায় তারা মাদরাসার শিক্ষার্থীদেরকে এই বলে বিদ্রুপ করে যে- মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা শুধু আকার আকৃতি নিয়ে পড়ে থাকে। আবার যারা মাদরাসার লোকজন তারা খানকার লোকজনকে জাহেল বা মূর্খ বলে থাকে। মাদরাসা আর বিশ্ববিদ্যালয় একে অপরের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে থাকে। অথচ এই সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আলাদা আলাদা ভাবে যে জ্ঞান অর্জন করে থাকে আমরা যদি সেগুলো একত্রিত করি তাহলে বিদ্যমান ইখলিতাফসমূহ আপনা আপনিই দূরীভুত হয়ে যাবে। আমি আপনাদের সকলের জন্য জ্ঞানের জগতের এই কঠিন পথে চলার সফলতা কামনা করি।
আরেকটি বিষয় বিশেষ করে বলতে চাই, মুসলমানদের জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে কখনোই পুরুষ এবং মহিলাদের মধ্যে কোন বিভাজন করা যাবে না। রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “জ্ঞানার্জন করা প্রত্যেক মুমিন নর নারীর জন্য ফরজ”। এখানে মহিলা এবং পুরুষের মাঝে কোন পার্থক্য করা হয়নি। একটি সভ্যতা বা একটি উম্মত কখনোই এক ডানায় উড়তে পারে না। রাসূলে আকরাম (সাঃ) মদিনাকে একটি উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করেছিলেন। মহিলা এবং পুরুষ উভয়ই এইখানে একসাথে জ্ঞানার্জন করেছেন। হযরত আয়েশা (রাঃ) উম্মতের সবচেয়ে বড় আলিমাদের একজন। এমনকি সকল ফকিহ সাহাবীগণ জ্ঞানার্জনের জন্য আয়েশা (রাঃ) কাছে আসতেন।
ইসলামী সভ্যতায় বড় বড় কয়েকটি জ্ঞানের কেন্দ্র রয়েছে। প্রত্যেকটি কেন্দ্র থেকে জ্ঞান অর্জনের জন্য অনেক সুন্দর ও গুরুত্বপূর্ণ উপমা রয়েছে। এক্ষেত্রে সবার প্রথমেই যেসকল অঞ্চল আসতে পারে সেগুলো হচ্ছে শাম, হিজাজ এবং ইরাক। মাওয়ারাউন নাহার তথা মধ্য এশিয়াতে তৈরি হয়েছিল বৃহৎ একটি ইসলামী সভ্যতা। এখান থেকে একই সাথে ইমাম বুখারী এবং ইবনে সিনা বের হয়েছেন। ইমাম সারাখসি এবং ইমাম ফারাবিও এখানে থেকেই বের হয়েছেন। শাহে নকশাবন্দ এবং আহমেদ ইয়েসিবির ধারাও এখান থেকেই বের হয়েছে। আন্দালুসিয়াকেও আমাদেরকে গুরুত্ব দিতে হবে। আন্দালুসিয়া থেকে আমরা অনেক কিছু শেখার আছে। উত্তর আফ্রিকার ইসলামী সভ্যতাকেও গুরুত্ব সহকারে দেখতে হবে। এক্ষেত্রে মিশর খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গা। এখান থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ আলেম বের হয়েছেন। একই সাথে ভারতীয় উপমহাদেশ তথা ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তানের মুসলমানগণ অনেক বড় একটি সভ্যতা প্রতিষ্ঠা করেছেন।
আমরা মুসলিম সন্তান হিসেবে মুসলমান প্রজন্ম হিসেবে আমাদের সভ্যতার ইতিহাসকে খুব ভালোভাবে জানি না। এইজন্য আমরা নির্দিষ্ট ব্যাক্তি কেন্দ্রিক হয়ে পড়ি। আমরা কেউ কেউ শুধু ইবনে তাইমিয়াকে পড়ে থাকি, তাই আমরা ইবনে তাইমিয়াপন্থী হয়ে পড়ি। আবার কেউ কেউ আব্দুল ওয়াহাবকে পড়ে থাকি তাই আব্দুল ওয়াহাবপন্থি হয়ে যাই। কেউ কেউ আবার শুধুমাত্র আল্লামা মওদূদীকে পড়ে থাকি ফলশ্রুতিতে আল্লামা মওদূদীপন্থি হয়ে পড়ি। এজন্য আমরা আমাদের পৃথিবীকে কোন ব্যাক্তির উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠা করতে পারি না। তাঁরা প্রত্যেকে আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হতে পারেন কিন্তু আমাদেরকে কুরআন এবং সুন্নাহর উপর চলতে হবে। চিরস্থায়ী হাকিকতকে কখনো ক্ষণস্থায়ী হাকিকতের উপর ছেড়ে দিতে পারি না। হযরত আলী (রাঃ) বলেছেন, “তোমরা হক্বকে ব্যাক্তির আলোকে চিনবে না বরং তোমরা ব্যাক্তিকে হক্বের আলোকে চিনবে”। ব্যাক্তিগণ কখনোই হাকিকতের উৎস নয়। হাকিকত কখনোই কারোর মনোপলি হতে পারে না। হাকিকত হচ্ছে সেই মূল্যবোধ যে মূল্যবোধের পথে আমাদের সকলকে থাকতে হবে।
আমাকে আপনাদের সামনে কথা বলা বলার সুযোগ দেওয়ার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ। আপনাদেরকে পুনরায় ধন্যবাদ জানাচ্ছি আমাকে আপনাদের নিজেদের ঘরে মুসাফির করার জন্য।
"প্রশ্নোত্তর পর্ব"
_______________
১/ প্রফেঃ ড সাইদুল ইসলাম প্রশ্ন করেছেন যে, বর্তমান যুবসমাজ অশ্লীলতা বেহায়াপনায় ডুবে আছে। আমরা কিভাবে যুবকদেরকে উদ্ধার করে ইসলামের পথে নিয়ে আসব ??
প্রথমেই আমি উস্তাদ সাইদুল ইসলাম সাহেবের নিকট দুঃখ প্রকাশ করছি যে, সকল যুবকদের এভাবে জেনারেলাইজেশন করে এই কথা বলা আমি সঠিক বলে মনে করিনা। আমরা যারা মুরুব্বি আছি, আমাদের অপরাধ আমাদের যুবকদের অপরাধের চাইতে কম নয় বরং অনেক ক্ষেত্রে বেশি। প্রত্যেকটা প্রজন্ম তার পরবর্তী প্রজন্মকে সবসময় এভাবে দেখে থাকে যে- যুবসমাজ তা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমরা যখন আজকের যুবকদের মত যুবক ছিলাম, তখন আমাদের গুনাহ থেকে দূরে থাকা খুব সহজ ছিল। কিন্তু এখন অনেক কঠিন। আজকের যেসকল যুবক গুনাহ থেকে মুক্ত বা দূরে থাকে তারা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান। আজকের যুবকগণ বর্তমান ডিজিটাল দুনিয়ার সকল ধরনের অস্থিরতা, বেহায়াপনার মুখোমুখি। এক্ষেত্রে কোন সন্দেহ নেই যে আজকের যুবকদেরকে অনেক মজবুত ঈমানের অধিকারী হতে হবে। কারণ আরো অনেক বড় বড় খারাপ বিষয় সমূহ রয়েছে।
এজন্য এ ক্ষেত্রে প্রথমত আমাদেরকে হিকমতের ভাষাকে রপ্ত করতে হবে যুবকদের হৃদয়ে প্রবেশ করতে হবে। আমাদের উচিৎ হচ্ছে তাদের ভিতরকে বুঝতে পারা। আমি নিজে সহ আমাদের প্রজন্মের যারা আছি, যারা নিজেদেরকে উস্তাদ বলে দাবি করে থাকি তাদেরকে যুবকদের চাইতে বেশি পড়াশোনা করা উচিত, নয়তো আমরা কিভাবে তাদেরকে ইসলাম বুঝাব! ভোগ এবং গতির এর যুগে যে সকল যুবক তাদের নিজেদেরকে রক্ষা করতে পারছে সেসকল প্রত্যেক তরুন-তরুণীই এক একজন বীর যোদ্ধা।
এজন্য আমাদেরকে আকাইদ এবং ফিকহার গ্রন্থসহ অন্যান্য গ্রন্থসমূহ কে আবার নতুন করে পুনর্বিন্যাস' করার মাধ্যমে যুবকদের বর্তমান এই দুনিয়ায় আমরা কিভাবে নতুন করে নামতে পারি এটা নিয়ে আমাদের চিন্তা করতে হবে। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সকল নবীদের নির্বাচিত করেছেন যুবকদের মধ্য থেকে। এমনকি নবীগণও তাদের সকল সাহাবীদেরকে যুবকদের মধ্য থেকে নির্বাচিত করেছিলেন। যুবকদের জন্য সবচেয়ে বড় উপমা হচ্ছে নবীগণ । হযরত ইব্রাহিম (আঃ) যখন ঐ সকল মূর্তিগুলোকে ভেঙেছিলেন তখন তিনি একজন যুবক ছিলেন। যখন তাঁকে আগুনে নিক্ষেপ করা হয়েছিল তখন তিনি একজন যুবক ছিলেন। কিন্তু তিনি একাই একজন উম্মতে পরিণত হয়েছিলেন। হযরত ইউসুফ(আঃ) যখন কারাগারে ছিলেন তখন তিনি একজন যুবক ছিলেন। এজন্য প্রত্যেক নবীর জীবনের মধ্যে আমাদের যুবকদের জন্য অনেক বড় বড় শিক্ষা রয়েছে। রাসূল আকরাম (সাঃ) এর প্রত্যেক সাহাবীর জীবনের মধ্যে আমাদের জন্য অনেক বড় বড়ে উপমা রয়েছে। আমাদের সব থেকে বড় সমস্যা হচ্ছে আমরা যুবকদের উপমা হতে পারিনি । যুবকদের অনেক প্রশ্ন আছে। তারা যখন এসব প্রশ্ন আমাদেরকে করে তখন তার উত্তর না দিয়ে আমরা তাদের প্রতি রাগ করি। অথচ তাদের যে প্রশ্ন আছে, তাদের যেসকল জিজ্ঞাসা রয়েছে সেগুলো সম্পর্কে তাদেরকে এমনভাবে জবাব দিতে হবে যেন তারা মুতমাইন হয়।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, আমাদের নিজেদের জীবন দিয়ে আমাদেরকে তাদের উপমা হওয়ার প্রচেষ্টা করতে হবে এবং উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে। এজন্য সর্বপ্রথম আমাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব হচ্ছে, আমরা যেন আমাদের যুবকদের জন্য সুন্দর একটি দুনিয়া রেখে যেতে পারি। তারাও যেন তাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সুন্দর একটি দুনিয়া রেখে যেতে পারে। আমি আইডিয়াল যুবকদেরকে এইভাবে সংজ্ঞায়িত করে থাকি, “যুবক হচ্ছে সে, যে নিজের চিন্তা, সুখ এবং সবকিছুকে আল্লাহর মধ্যে খুঁজে পায় ”। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সকল যুবককে এমন আইডিয়াল যুবক হওয়ার তৌফিক দান করুন । আমরা উস্তাদকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি এই প্রশ্ন করার জন্য ।
২/ আমাদের ডিপার্টমেন্টের হেড, যিনি আকীদার উপর পিএইচডি করেছেন তিনি আমাদের ভাইদেরকে ইসলামী জ্ঞানে উসূলের ধারা বইটি পড়ার সময় দেখেছেন এবং আমাকে বলেছেন যে, উস্তাদ গরমেজ আক্বীদার ব্যাপারটি গুরুত্বহীনভাবে উপস্থাপন করেছেন। এ বিষয়ে আমার প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা আক্বীদার বিষয়টি কিভাবে দেখব এবং আকাইদকে কিভাবে প্রাধান্য দিব?
আমিনুল ইসলাম, কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
প্রথমত উসূলের ধারা যে বইটি আছে সেটি হচ্ছে আমার কয়েকটি বক্তব্যের আলোকে তৈরি করা একটি গ্রন্থ। সকল বিষয়কে ওখানে সেইভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়নি। দ্বিতীয় সংস্করণে আকাইদের একটা অধ্যায় যোগ করা হবে ইনশাল্লাহ। আমি আপনার উস্তাদকে সমর্থন করেই বলছি যে আকাইদ ছাড়া না উসূলু্দ দ্বীন হবে না আর না উসূলে ফিকহ হবে। কিন্তু আকাইদ তথা উসূলুদ্ দ্বীন সুফি যুগে এসে তার একটি মাত্রাকে হারিয়ে ফেলেছে। কারণ ইমুল কালাম যা কিনা উসূলুদ্দীনের মূল, সেটা হচ্ছে একটা ইস্তিদলালী তথা দলিল এর উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত একটি জ্ঞান। অর্থাৎএই জ্ঞান দলিলের উপর নির্ভর করে। আর এই সকল দলিলসমূহ শুধুমাত্র কুরআন এবং হাদিসে উল্লেখিত দলিল সমূহের দ্বারা নয় । এর সাথে কায়িনাত তথা সৃষ্টিজগতের দলিলসমূহও আছে।
কিন্তু আজকের আকাইদের যে গ্রন্থসমূহ আছে এগুলো শুধুমাত্র আল্লাহর সৃষ্টিকে এবং সিফাত সমূহকে বর্ণনা করে থাকে, তার উদ্দেশ্য বর্ণনা করে না। আজকের যুবকদেরকে রুবুবিয়াত, উলুহিয়াত, নবুয়্যাত, মাওত তথা আখিরাত এই সকল বিষয়কে সামগ্রিক ভাবে বুঝাতে হবে, খন্ডিতভাবে নয়। এমন কিছু বুঝানোর ক্ষেত্রে কায়িনাত তথা সৃষ্টিজগতের আইনসমূহকে বিবেচনায় নিতে হবে। আজকে আমরা আমাদের যুবকদেরকে যে আকাইদ পড়িয়ে থাকি এটা অনেক দিক থেকেই অসম্পূর্ণ, এতে অনেক ঘাটতি রয়েছে। কেউ কেউ আমাদেরকে তাওহীদ বুঝানোর পরিবর্তে তাকফিরকে বুঝিয়ে থাকে। অথচ আমাদের শেখা দরকার হচ্ছে তাওহীদ। আল্লাহর আসমাউল হুসনা বা গুনবাচক নাম এবং নির্বাচনকে খুব ভালোভাবে জানতে হবে। আল্লাহকে চিনবো আসমা সমূহের মাধ্যমে। শুধুমাত্র এটা জানার মধ্যে আমাদেরকে সীমাবদ্ধ থাকলে হবেনা বরং সেই সকল আসমাসমূহ থেকে আখলাক সৃষ্টি করে আমাদের নিজেদের জীবনকে সজ্জিত করে তার আলোকে গঠন করতে হবে। একই সাথে আল্লাহ এবং মানুষের মধ্যকার সম্পর্ককে আজকের যুবকদেরকে বুঝানোর জন্য নতুন করে সংজ্ঞায়িত করতে হবে। নতুন করে বোঝাতে হবে।
প্রথম যুগের মুসলমানগণ যেমন হাসান বসরী (রঃ)- মানুষ এবং আল্লাহ মধ্যকার সম্পর্কের বোঝানোর ক্ষেত্রে মারহামাতের উপর ভিত্তি করে এটাকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এবং সেই অনুযায়ী বই-পুস্তক রচনা করেছেন।
এরপর আসেন মুতাজিলাগন। তারা আল্লাহ এবং মানুষের মধ্যকার সম্পর্ককে আদালতের উপরে ভিত্তি করে নির্ধারণ করার চেষ্টা করেন।
এরপর ইমাম আশয়ারি আসেন। তিনি মানুষ এবং আল্লাহর মধ্যকার সম্পর্ককে ইরাদা এবং কুদরতের উপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করার চেষ্টা করেন।
এরপর ইমাম মাতুরিদি আসেন তিনি মানুষ এবং আল্লাহ মধ্যকার সম্পর্ককে হিকমার উপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করার চেষ্টা করেন।
আহলে তাসাউফ তথা সুফীগণ আল্লাহ এবং মানুষের মধ্যকার সম্পর্ককে ইশক এবং মুহাব্বতের উপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করার চেষ্টা করে ।
বর্তমান সময়ে এসে কিছু কিছু আইডিওলজি বা কিছু কিছু ধারা মানুষ এবং আল্লাহর মধ্যকার সম্পর্ককে হাকিম এবং মাহকুম এর উপর ভিত্তি করে ডিফাইন করার চেষ্টা করেছেন।
এগুলো প্রত্যেকটিই হচ্ছে এক একটি তাবিল তথা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। এই প্রত্যেকটি থেকে আজকে আমাদের উপকৃত হতে হবে। প্রথমত আকাইদ তথা আল্লাহ সাথে মানুষের মধ্যকার সম্পর্ককে দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। দৃঢ় ভিত্তি ছাড়া কখনোই আকাইদকে সত্যিকার অর্থে উন্নত করা যাবে না। আল্লাহ এবং মানুষের মধ্যকার সম্পর্ক একটি মিছাক তথা একটি চুক্তি উপর নির্ভর করে। আর সেই মিছাক হচ্ছে-মানুষের উপর আল্লাহর দেওয়া ফিতরাত।
আর এই মিছাককে দুই ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। একটি হচ্ছে মিছাকুল আমানাহ আরেকটি হচ্ছে মিছাকুশ শাহাদাহ।
মিছাকুশ শাহাদাহ হচ্ছে- মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সবসময় আমাদেরকে দেখেন, আমাদেরকে পর্যবেক্ষণ করেন আর আমরাও সব সময় আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সৃষ্টিতত্ত্ব তাঁর নিয়ামত, তাঁর আসমা সমূহকে দেখে থাকি এবং আমরা সব সময় এগুলো পর্যবেক্ষণ করে থাকি। আমনতু বিল্লাহ এবং আশাদুল্লাহ ইলাহা ইল্লাল্লাহ এর মধ্যে এখানেই পার্থক্য।
আরেকটা হচ্ছে মিছাকুল আমানাহ। সেটা কি? এটি হচ্ছে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সমস্ত সৃষ্টিকে মানুষের নিকট আমানত হিসেবে দিয়েছেন। মানুষের দায়িত্ব হচ্ছে এই আমানতের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা না করা। এই দৃষ্টিকোণ থেকে এক্ষেত্রে কোনো সন্দেহ নেই যে, আকাইদ কে আমাদের সবকিছুর কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে। তাছাড়া আল্লাহ কি আকাশে নাকি মাটিতে? আল্লাহ কোথায়? এগুলো নিয়ে আবার চৌদ্দশ বছর পরে এসে তর্ক-বিতর্ক করার নাম আকাইদ নয়। (নাউজুবিল্লাহ) আল্লাহর হাত আছে কিনা? আল্লাহ কোথায় বসেন কি বসেন না এই সকল বিষয় নিয়ে চৌদ্দশ বছর পর আবার তর্ক বিতর্ক করার প্রয়োজন নেই। এসব বিষয় নিয়ে চৌদ্দশ বছর আগে বিতর্ক হয়ে গেছে এবং এর সমাধানও হয়ে গিয়েছে। নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি করার প্রয়োজন নেই।
৩/ আমরা জানি আন্তঃ ধর্মীয় সংলাপ এবং আন্তঃ সভ্যতা সংলাপের ব্যাপারে নানামুখী মতভেদ রয়েছে। আমি আন্তঃধর্মীয় সংলাপের ব্যাপারে বিশ্বাস করি যে এটা মানবো না। কিন্তু আন্তঃ সভ্যতার সংলাপের ব্যাপারে স্কলার তারিক রামাদান সাপোর্ট করেছেন। এটাকে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন এক্ষেত্রে আমাদের কি ধরনের চিন্তা করা উচিত?
মেহেদি হাসান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
প্রথমত ইন্টারফেইথ ডায়ালগ বা আন্তধর্মীয় সংলাপ এই শব্দটিই আমরা গ্রহণ করি না। বিশ্বাস করি আপনার কাছে একটাই দ্বীন, সেটা হলো ইসলাম। ফলশ্রুতিতে সকল দ্বীনকে এক জায়গায় নিয়ে এসে, তাদের থিওলজির সথে এক করে একটা আলাদা থিওলজি সৃষ্টি করাকে আমরা কখনোই গ্রহণ করি না। আমি যখন দায়িত্বে ছিলাম তখন পোপ ফ্রান্সিস আমাকে দাওয়াত দিয়েছিলেন। আমার কাছে তিনি এসম্পর্কে জানতে চাইলে, আমি তাকে বলেছিলাম আলোচনা তো দূরে থাক আমি এই শব্দটিই আমি শুনতে চাই না। তবে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা একসাথে এসে মানুষের কল্যাণের জন্য , মুক্তির জন্য একসাথে আলোচনা করতে পারেন। এতে কোন সমস্যা নেই ।
পবিত্র কুরআনে বর্নিত, যদি কোন গোষ্ঠী বা দল বা দ্বীনের অধিকারী যদি তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ না করে, তোমাদের সাথে শত্রুতা পোষণ না করে, তাহলে তাদের প্রতি ভালো ব্যবহার করা, তাদের প্রতি আদালত প্রতিষ্ঠা করায় কোন সমস্যা নেই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম যখন মদীনায় হিজরত করেন তখন সেখানে ইহুদীগণ বসবাস করত। তিনি যখন মদিনার সনদ স্বাক্ষর করেন তখন সেখানে তারাও স্বাক্ষর করে। তিনি তাদেরকে আইনের অধিকার দেন। এমনকি তাদের যে অধিকার সেটাতে তিনি তাদেরকে স্বাধীন রাখেন। নাজরানের ইহুদীদের সাথে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম শান্তিচুক্তি করেন। হযরত উমর (রাঃ) যখন কুদুস বিজয় করেন তখন তিনি একটি চুক্তি করেন এবং সেই চুক্তিতে যারা যেই ধর্মের তারা সেই ধর্ম পালন করার ক্ষেত্রে স্বাধীনতা পায়। সুলতান ফাতিহ মুহাম্মদ যখন ইস্তাম্বুল বিজয় করেন তখন তিনি সেখানে বসবাসকারী সকল মানুষকে তাদের অধিকার প্রদান করেন, তাদেরকে নিজ ধর্ম পালনের স্বাধীনতা দান করেন। এজন্য ইসলামী সভ্যতা তার রাষ্ট্রে বসবাসকারী অন্যান্য সকল ধর্মের, সকল মতের নাগরিকদেরকে স্বাধীনতা দান করে। এমনকি তাদের জন্য আলাদা একটি ন্যায়ভিত্তিক আইন রয়েছে ইসলামে। এটা একটা বিষয় আর ইন্টারফেইথ ডায়ালগ বা ধর্মীয় সংলাপ সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। তবে ভিন্ন ভিন্ন সভ্যতার যারা অধিকারী তারা একসাথে এসে মানুষের সমস্যা নিয়ে মানুষের ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলা সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়।
৪/ আমি মেডিকেল কলেজের ছাত্র। ছোট বেলা থেকেই স্বপ্ন দেখে আসছি ইবনে সিনা হবো। কিন্তু অনেক আলেমদের দেখে থাকি বিশেষ করে সৌদি আরবের মদিনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেছেন তারা বলেন ইবনে সিনা কাফের! এ সম্পর্কে তাঁরা ইমাম গাজালী থেকে শুরু করে বড় বড় ইমামদের রেফারেন্স দিয়ে থাকেন। এখন উস্তাদের কাছে অনুরোধ হচ্ছে, ইবনে সিনা ও ফারাবীর ব্যাপারে যদি আমাদের সঠিক ধারণা দিতেন।
মাজহারুল ইসলাম, গাজীপুর মেডিকেল কলেজ ।
প্রথমেই একজন উস্তাদ হিসেবে নয় একজন ভাই হিসেবে আপনাদের মাধ্যমে সমগ্র বাংলাদেশের মানুষকে আমি একটি অনুরোধ করতে চাই আধুনিক সময়ে মুসলমানদের অনেক বড় একটি অসুস্থতা রয়েছে। সেই অসুস্থতা হচ্ছে তাকফীরের অসুস্থতা। মানুষকে তাকফীর করা। কোন মুসলমানকে একটি জ্ঞানগত কারণে, একটি আয়াতকে ব্যাখ্যা করার কারণে, কয়েকটি ভিন্ন মতের কারণে তাকফীর করার কোনো সুযোগ নেই। রাসূল (সাঃ) তাকফীরকে নিষিদ্ধ করেছেন।
ইমাম আবু হানিফা (রঃ) তাঁর ফিকহুল আকবরে একটা কথা বলেছেন- মান আমানা বিত তানযীল, লান ইউকাফফারু বিত ত'উয়ীল।
যে ব্যক্তি, যে মুমিন আল্লাহর অবতীর্ণ গ্রন্থের প্রতি ঈমান এনেছে সেই গ্রন্থের কোন আয়াতকে বা কোন বিষয়কে ব্যাখ্যা করার কারণে তাকে কখনোই তাকফীর করা যাবে না।
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের সবচেয়ে বড় মূলনীতি হচ্ছে আহলে কিবলা কে তাকফীর করা যাবেনা। এটা হচ্ছে প্রথম বিষয়।
দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে ইতিহাসে ঘটে যাওয়া বড় বড় আলেমদের মধ্যকার বিতর্ককে আজকের যুগে নিয়ে এসে যুগে সেই বিতর্কের উপর ভিত্তি করে যেন আমরা নিজেদের মধ্যে ইখতিলাফ না করি।
ইমাম গাজ্জালী এবং ইবনে সিনার মধ্যকার বিভিন্ন বিতর্ক আছে এটা আমরা জানি। কিছু কিছু চিন্তা মানুষকে কুফরের দিকে নিয়ে যায় এটা বলেছেন এটা আমরা জানি। তবে ইসলামী সভ্যতার সবচাইতে বড় নক্ষত্রদের একজন, বিখ্যাত দার্শনিক, সবচেয়ে বড় চিকিৎসাবিদ ইবনে সিনা এবং মাদিনাতুল ফাদ্বিলার অধিকারী আল ফারাবীকে কাফের বলা তো দূরে থাক, এইসব বিষয়ে কথা বলাকেও আমি কখনো সমর্থন করি না।
যেমন ইমাম গাজ্জালী এবং ইবনে রুশদের মধ্যে মতভেদ আছে। প্রথমে ইমাম গাজ্জালী তাহাফাতুল ফালাসিফা লেখেন ইবনে রুশদ তার জবাব দেন এবং এমনকি নতুন একটা বই রচনা করেন। কিন্তু দেখুন, ইবনে রুশদ কি করেছেন। তিনি ইমাম গাজ্জালীরি আল মুস্তাসফাহকে সংক্ষিপ্ত করে আদ দ্বারুরি ফি উসূল ফিকহ নামে আরবিতে একটি নতুন বই লেখে তাঁর নিজের ছাত্রদেরকে পড়িয়েছেন (এভাবেই একজন অন্যজনকে সম্মানিত করেছেন)। এজন্য আলেমদের ইখতিলাফ হচ্ছে একটি রহমত। আমরা এই রহমতকে যেন অসুবিধায় বা মুসিবতে পরিণত না করি ।
৫/ আমাদের একবোন প্রশ্ন করেছেন। আমি বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। আমি আপনার বক্তৃতামালা, উসুলের ধারা বই পড়েছি। আপনার বই পড়ে উৎসাহিত হয়েছি এবং কাজে মনোনিবেশ করেছি। সেই সাথে জ্ঞানার্জন করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমার বাবা একজন বড় আলেম তিনি আমাকে সবসময় বলে থাকেন মেয়েদের জিহাদ করার প্রয়োজন নেই । অধিকাংশ মহিলা সাহাবীরা জিহাদ করেননি। ইসলামের ইতিহাসে তেমন কোন নজির নেই এবং বলে থাকেন যে ৪ ধরনের কাজ করলেই মহিলারা জান্নাতে যাবে! এক্ষেত্রে আমাদের করণীয় কি ??
আমি আমার বক্তব্যের শুরুতেও বলেছি নারী এবং পুরুষকে জ্ঞানের ক্ষেত্রে কখনোই বিভাজন করা যাবে না, কাউকে জ্ঞান থেকে বঞ্চিত করা যাবে। আমাদের পুরুষ আলেমদের যতটুকু প্রয়োজন আমাদের মহিলা আলেমদেরও ততটুকুই প্রয়োজন। যে জাতি তার নারীদেরকে মূর্খ রাখে সেই জাতির দ্বারা কখনোই কোনো ভালো কাজ করা সম্ভব নয়। তাদের পক্ষে সফলতা অর্জন করা সম্ভব নয়। কারণ মানুষকে গঠনকারী, প্রজন্মকে গঠনকারী সত্ত্বা হচ্ছেন নারীগণ। যে জাতি তার মহিলাদের মূর্খ রাখবে তাদের প্রজন্মও মূর্খ হবে এটাই স্বাভাবিক ।
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন নারী এবং পুরুষকে একই মূল থেকে সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টিগত দিক থেকে নারী এবং পুরুষ সমান। সৃষ্টিগত দিক থেকে তাদের মধ্যে কোন ধরনের পার্থক্য নেই। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেনঃ আমি পৃথিবীতে খলিফা সৃষ্টি করব। এই খলিফা সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে তিনি কখনই বলেন নি যে শুধুমাত্র পুরুষরা খলিফা হবে নারীরা খলিফা হবে না। একথা তিনি কখনই বলেননি। পুরুষরা যতটুকু আল্লাহর খলিফার নারীরাও ততটুকুই আল্লাহর খলিফা। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যখন ওহী পাঠিয়েছেন সেটা শুধুমাত্র পুরুষদের জন্য পাঠাননি। একই সাথে তিনি নারীদের জন্য ওহী পাঠিয়েছেন। ইলাহী ওহীর উদ্দেশ্যগত দিক থেকে নারীরাও আল্লাহর উদ্দেশ্য পুরুষরাও আল্লাহর উদ্দেশ্য। পৃথিবীতে আমর বিল মা'রূফ ও নাহি আনিল মুনকারের যে দায়িত্ব মানুষের উপর অর্পিত হয়েছে, সেই দায়িত্ব তিনি নারী-পুরুষ উভয়ের উপরই দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনে, ‘মুমিন নারী এবং মুমিন পুরুষ একজন আরেকজনের বন্ধু একজন আরেকজনের সহকর্মী তারা একসাথে সত্যের আদেশ এবং অপকর্মের বিরোধিতা করবে’ এ কথাই আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চারটি আইডিওলজি বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন।
১/ শিরক
২/দাসত্ব
৩/ জাতীয়তাবাদীতা বা বর্ণবাদ
৪/জেন্ডারইজম তথা নারীকে ছোট করে দেখা। শুধুমাত্র নারী হওয়ার কারনে তাকে ছোট করে দেখা একটি চরম জাহিলি চিন্তা।
এমনকি তিনি এমন একটি সময়ে এইসকল আইডিওলোজির মোকাবেলা করেছেন যখন তারা নারী-শিশুদেরকে জীবন্ত কবর দিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ সকল কিছুর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেন। সপ্তাহের একদিন তিনি মসজিদে নববীকে শুধুমাত্র নারীদের জন্য আলাদা করে রাখেন এবং সেই দিন তিনি তাদেরকে ইসলাম শিক্ষা দেন। তিনি তাদেরকে লেখাপড়ার ব্যাপারে উৎসাহিত করেছেন। হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহা সাহাবীদের মধ্যে সবচাইতে বড় আলিম ছিলেন। তিনি ২২২০ হাদিস বর্ণনা করেছেন। পুনুরাবৃত্তিসহ যদি বিবেচনা করা হলে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহা পাঁচ হাজারের অধিক হাদীস বর্ণনা করেছেন। তিনি কুরআনের কিছু কিছু আয়াত নাযিল হওয়ার সময় সাক্ষী হিসেবে ছিলেন। তিনি কিছু কিছু আয়াতের শানে নুযুল। তিনি কিছু কিছু আয়াতের তাফসীর করেন এবং এ বিষয়ে পরবর্তীতে মুসলমানরা অনেক অগ্রগামী হন।
কিন্তু পরবর্তীতে জেন্ডারইজম তথা জিনছি চিন্তা মাঝেমধ্যে মুসলমানদের উপর আপতিত হয়েছে। এমনকি এই উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়ন করার জন্য তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি মিথ্যা রেওয়ায়েত সম্পৃক্ত করে দেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু সাল্লাম এর উপর তারা অপবাদ দেয়।রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারীদেরকে জ্ঞান অর্জনের ব্যাপারে এত গুরুত্ব দেওয়ার পরেও তারা এরকম বানোয়াট হাদিস সৃষ্টি করেছে “তোমরা তাদেরকে লেখা পড়ার শিক্ষা দিও না” এটা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর অপবাদ। যেই গ্রন্থের শুরুই হচ্ছে ইকরা দ্বারা, সেই গ্রন্থ কিভাবে মুমিনদের অর্ধেক কে বলতে পারে যে, তোমরা পড়তে পারবে না এবং লিখতে পারবে না এটা কিভাবে সম্ভব হতে পারে? ইমাম বুখারীর উস্তাদদের মধ্যে নয় জন নারী উস্তাদ ছিলেন। এই নয় জন নারী থেকে তিনি রেওয়ায়েত গ্রহণ করেছেন। ইমুল হাদিসে অনেক নারী রাবী রয়েছেন।
প্রথমে এ বিষয়টি বলতে চাই, নারী হওয়ার কারণে তাদেরকে নিচু করে দেখা, খাটো করে দেখা এ ধরনের যত কথা আছে এগুলো রাসুলুল্লাহ কথা হতে পারে না।
নারীদের আকলে কমতি আছে, নারীদের আকলে ঘাটতি আছে এরকম কোন রেওয়ায়েতই আল্লাহর রাসুলের সাথে সম্পৃক্ত করা যাবেনা। আল্লাহর রাসুলের নামে এরকম কোন রেওয়ায়েত নেই। মহিলারা দ্বীনের ক্ষেত্রে অর্ধেক- এ ধরনের কোনো রেওয়ায়েকে আল্লাহর রাসুলের সাথে সম্পৃক্ত করা যাবে না। এই বিষয়ে হাদিস সমূহকে তারা ভুল বুঝে, ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে নিজেদের স্বার্থের জন্য। এই সকল রেওয়ায়েতসমূহ কুল্লি আসাস তথা সামগ্রিকতার মূলনীতির ভিত্তিতে বোঝা সম্ভব ।
আমি একজন মুহাদ্দিস। এই হাদিসের উপর ভিত্তি করে কেউ কখনই কোনো নারীদের ক্ষেত্রে ঘাটতি রয়েছে, দ্বীনের ক্ষেত্রে ঘাটতি রয়েছে এটা কখনোই বলতে পারবেন না। যদি সে বলে তাহলে সে ঐ হাদিসকে বুঝতে পারেনি। আমাদের নারীদেরকে, আমাদের মেয়েদেরকে সকল ধরনের খারাপ বিষয় থেকে রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব। কিন্তু একটি খারাপ থেকে রক্ষা করতে গিয়ে যেন তাদেরকে আমরা দশটি খারাপের মধ্যে নিপতিত না করি। সবচাইতে বড় খারাপ বিষয় হচ্ছে মূর্খতা। আমার জাহালাত কে কখনোই আমাদের নারীদের উপর দিতে পারিনা। আবার নারীদেরকে জাহালাত দ্বারা সজ্জিত পারে না।
৬/ আমাদের দেশে সব থেকে বেশি প্রচারিত দু্ইজন ইমাম হচ্ছেন ইমাম ইবনে তাইমিয়াহ এবং সাইয়্যেদ কুতুব। আমরা প্রতিনিয়ত লক্ষ্য করি মদিনা বিশ্ববিদ্যালয় সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বড় বড় আলেমগণ ইমাম তাইমিয়া কে নিয়ে গবেষণা করেছে এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে যাচ্ছেন। আপনিও আপনার উসূলের ধারা বইয়ে ইবনে তাইমিয়াহকে একটি বিশেষ ধারা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু ইমাম ইবনে তাইমিয়া এবং সাইয়্যেদ কুতুবকে সামনে রেখে তারা অধিকাংশ বলেন ইসলামে এ ধরণের রাজনীতি হারাম, ইসলামে এধরণের নির্বাচন পদ্ধতি হারাম, এ ধরণের রাজনৈতিক কর্মসূচি দেওয়া হারাম আমরা এগুলোকে কিভাবে দেখব ??
নুরুদ্দিন মাহমুদ ,ঢাকা কলেজ।
আমি আমার বক্তব্যের সময় বলেছি, আমরা যেন আমাদের দুনিয়াকে কখনো ব্যক্তির উপর নির্ভর করে প্রতিষ্ঠা না করি। রাসূল (সাঃ) ছাড়া কোন ব্যক্তি হাকিকতের উৎস হতে পারবেন না। প্রত্যেক আলেমের ভুল হতে পারে, ঘাটতি হতে পারে, বিভিন্ন ধরনের সমস্যা থাকতে পারে। আমরা না কাউকে তাকফির করতে পারি, আর না কাউকে ঘৃণা করতে পারি। আমরা যখন কোন আলিমকে মুল্যায়ন করবো তখন আমাদেরকে আদিল হতে হবে, ন্যায়পরায়ণ হতে হবে।
কিন্তু এটা আমি গ্রহণ করি যে, এই দুজন ব্যক্তির বিভিন্ন বিষয়ে কিছু কিছু চিন্তা খুবই এক্সট্রিম। কারণ এই দুজনই তাদের চিন্তাকে প্রকাশ করেছেন খুব কঠিন সময়ে। জুলুম-নির্যাতনের মধ্যে। ইবনে তাইমিয়াহ জীবনের বড় একটি সময়ই জেলের মধ্যে অতিবাহিত করেছেন। তিনি মোঙ্গলদের সাথে যুদ্ধ করেছেন। ফলশ্রুতিতে বিভিন্ন বিষয়ে তিনি একটু কঠিন হতেই পারেন, একটু কঠিন কথা বলতে পারেন এটাই স্বাভাবিক। আমার ওস্তাদ আমাকে বলতেন- ইমাম ইবনে তাইমিয়া এবং মহিউদ্দীন আরাবীর মতো আলিমগণ বিশাল এক মহাসাগরের মত। যদি সাঁতার কাটতে পারো তাহলে ঐ মহাসাগরে সাঁতার কাটো সমস্যা নাই। তবে যদি সাঁতার কাটতে না জানো তো এইসব ক্ষেত্রে খুব বেশি যাওয়ার দরকার নাই। মণি মুক্তা হচ্ছে সাগরের একদম তলদেশের সম্পদ। আমি নিজে ইবনে তাইমিয়াকে খুব ভালোভাবে পড়েছি। আমার তাঁর সকল ফতোয়াকে পড়ার সুযোগ হয়েছে। আধুনিক সময়ে এসে আইডিওলজিক্যাল সালাফিজম, দায়েশ এবং আরও যেসকল চরমপন্থি গোষ্ঠীগুলো আছে তারা তাদের উৎস হিসেবে ইমাম ইবনে তাইমিয়াহকে নেয়, যা সম্পূর্ণ তাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ।
আপনারা যদি ইমাম ইবনে তাইমিয়ার “তায়রিদুল আক্বলি ওয়ান নাকলি” বইটি আব্দুল ওহহাবের বর্তমান সময়ের যেকোনো একজন ছাত্রকে দেন, তাহলে তারা কেউ এটাকে গ্রহণও করবে না পড়া তো দূরে থাক। একই সাথে সাঈদ কুতুব একজন মুতাফাক্কির তিনি একজন আলেম নয়। তিনি একজন শহীদ। আল্লাহ তার উপর রহম করুন। তিনি উম্মাহর একজন শহীদ। কিন্তু তিনি যখন ফি যিলালিল কুরআন লিখেন তখন তিনি রিমান্ডে ছিলেন। এখানে আর্ত-চিৎকার আছে, ফরিয়াদ আছে। এখানে তিনি জালিমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন। প্রত্যেক আলেমকে তাঁর অবস্থার আলোকে পড়তে হবে। ইসলামকে কখনোই ব্যাক্তির উপর নির্ভর করে প্রতিষ্ঠা করা যাবে না।
৭/ বর্তমান সময়ে কিছু কিছু আলেম বের হয়েছেন যারা বলেছেন আজকে বর্তমান সময়ে যে রাজনীতি আছে এই সকল রাজনীতি সাহাবীরা করেননি এমনকি বড় বড় আলেমগণ এই রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন না । এখন আমার প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশে ইসলামী আন্দোলন আছে। এই সকল ব্যাপারে আমরা কিভাবে কি করব?? একজন ছাত্র হিসেবে আমাদের অবস্থান কি হবে ??
জাহিদ বিন সিরাজ - আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।
আমি মুসলমানকে এভাবে ডিফাইন করে থাকি একজন মুসলমান সমগ্র মানবতার সমগ্র পৃথিবীর দায়িত্বশীল। যদি আপনি সমগ্র দুনিয়ার ব্যাপারে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে থাকেন, তাহলে দুনিয়াকে পরিচালনা করে যে রাজনীতি, তা থেকে আপনি কিভাবে দূরে থাকতে পারেন? শুধুমাত্র রাজনীতির উপর ভিত্তি করে মুসলমানদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করা, পার্থক্য করা একজন আরেকজনকে তাকফির করা কখনোই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সিয়াসাতের অপর নাম হচ্ছে আখলাক। একজন মুসলমান যখন রাজনীতি করবেন তখন তিনি কখনও সিয়াসাতকে আখলাক থেকে পৃথক করতে পারেন না। আদালত কে প্রতিষ্ঠা করার জন্য রাজনীতির প্রয়োজন অপরিসীম। কারণ আদালত হচ্ছে আসাসুল মূলক তথা আদালত হচ্ছে রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের মতো একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের একজন মুমিনের জন্য এরকম একটি ধারণা আবশ্যক। একই সাথে যদি সম্ভব হয় তাহলে অবশ্যই তাকে হক এবং আদালত প্রতিষ্ঠা করার আন্দোলনে এবং যারা এ ধরণের রাজনীতি করেন তাদের সাথে যোগদান করা উচিৎ।
৭/ আমার বাড়ি আরাকানের কাছেই । এখানে আমি আরাকানের মুসলমানদের কে খুব কাছে থেকে দেখে থাকি। তবে এই ক্ষেত্রে আমার প্রশ্ন হচ্ছে ভারতীয় উপমহাদেশের অনেক জায়গায় অনেক জুলুম-নির্যাতন রয়েছে। তাহলে আমি কেন এই গুলার চেয়ে কুদুসকে বেশি প্রাধান্য দেই কুদুসের মুক্তিকে কেন আমরা সর্বাগ্রে নিয়ে আসি?
কক্সবাজার থেকে প্রশ্ন করেছেন তাসনিম জুনায়েদ।
এরকম একটা প্রশ্ন করার জন্য তাসনিম জুনায়েদ ভাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। এই প্রশ্নের মাধ্যমে তিনি উম্মাহর একটি ভুলকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। এর মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে যে উম্মাহ মজলুম মানুষদের মধ্যে ভিন্নতা সৃষ্টি করে রেখেছে। আমি OIC একটি প্রোগ্রামের বক্তব্য দিয়েছিলাম ২০০৯ সালে। আমার বক্তব্যের বিষয় ছিল মানে মুসলিম সংখ্যালঘু অঞ্চলে ভাইয়েরা যেসকল সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন সেই সংক্রান্ত। কিন্তু আমরা তিনদিন শুধুমাত্র ফিলিস্তিন নিয়ে কথা বলছি। আমি সেখানে বলেছিলাম- আপনারা কি জানেন দুনিয়াতে কয়টা ফিলিস্তিন আছে? হয়তো কুদুসের কারণে ফিলিস্তিনকে প্রাধান্য দেওয়া যেতে পারে কারণ কুুদুস হচ্ছে আমাদের জন্য শাহীদ বা নিদর্শন। এটার মুক্তির সাথে আমাদের মুক্তি সম্পৃক্ত। তবে মাজলুমদের মাঝে মধ্যে কোন ধরনের পার্থক্য করা যাবেনা, সকল মাজলুম মাজলুমই।
৮/ আমি মেডিকেলে পড়ি। এখানে আমাদের মেডিকেল কলেজের পাশে একটি দেওবন্দী মাদরাসা আছে। আমার তাদের সাথে যোগাযোগ আছে। কিন্তু এক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে যে তারা আমার দাড়ি নিয়ে বা পোশাক নিয়ে বিভিন্ন ধরনের কথা বলে থাকেন। এই ব্যাপারে আপনি কি বলেন? আরেকটা হচ্ছে আপনি তো হানাফী এবং তারাও হানাফি তাহলে আপনাদের মধ্যকার এতবড় তফাৎ থাকার কারণ কি?
প্রথমত, দেওবন্দী এবং বেরলভীসহ সকল ধারার আলেমদের প্রতি আমার সালাম। এই সমস্যার মূল কারণ হচ্ছে মুসলমানদের মধ্যে উসূলগত সমস্যা। এর কারণ আমরা মূল শাখা এবং প্রশাখাকে একীভূত করে ফেলছি এবং এর মধ্যে পার্থক্য করতে জানিনা। কুল্লিয়াত এবং জুজ'ইয়্যাতকে একত্রিত করে ফেলি। উসিলা তথা মাধ্যম এবং মাকাসিদ তথা উদ্দেশ্যকে আমরা এক করে ফেলি। মাঝে মধ্যে আমরা উসিলা তথা পন্থাকে মাকাসিদে রূপান্তরিত করে ফেলি। জুজ'ইয়্যাতকে কুল্লিয়্যাতে রূপান্তর করে ফেলি। যেটা আকাইদ নয় আমরা সেটাকেও আকাইদে রূপান্তর করে ফেলি। দুঃখজনক হলেও সত্য, এটা সমগ্র উম্মাহর মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে এবং এটা সব জায়গায়ই আছে। আসলে এটা একটা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে ।
সবচাইতে বড় সমস্যা হচ্ছে, কোনটি দ্বীনি এবং কোনটি সাংস্কৃতিক এ দুয়ের মধ্যে পার্থক্য করতে না পেরে গুলিয়ে ফেলা। কোন নবী তার নিজের কওমের সংস্কৃতিকে বিশ্বজনীন একটি সংস্কতিতে রূপান্তরিত করেননি। একটি দ্বীনের মধ্যে সবচাইতে বড় যে বিদায়াতটি প্রবেশ করতে পারে, সেটি হচ্ছে ওই নবী যে কওমে বা গোত্রে এসেছেন সেই গোত্রের কোন কৃষ্টি-কালচারকে দ্বীনে রুপান্তরিত করা। আর এটাই হচ্ছে সবচাইতে বড় বিদায়াত। তবে আমি এটা বলার সময় পোশাক আশাকের ব্যাপারে ইসলাম যে অনুমতি দিয়েছে সেটাকে আমি অবজ্ঞা করছি না, হেয় বা ছোট করছি না। পোশাক আশাকের ব্যাপারে ইসলাম যে মূলনীতি দিয়েছে সেটা হচ্ছে পোশাক আশাকের মাধ্যমে যাতে করে কোন হারাম প্রকাশিত না হয়। পোশাকের ক্ষেত্রে নারীদের পোশাক ভিন্ন পুরুষদের পোশাক ভিন্ন। নারীদের পোশাকের ক্ষেত্রে তাদের অঙ্গকে সঠিকভাবে ঢাকতে হবে এবং পবিত্রতা রক্ষা করতে হবে। অমুসলিমদেরকে অনুকরণ করার জন্য কোন পোশাক পরিধান করা যাবে না। এই সকল মূলনীতির বাহিরে একজন মুসলমান হিসেবে সে তার পছন্দমত পোশাক পরতে পারে। এ ক্ষেত্রে ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে কোন সমস্যা নেই ।
উহুদ এবং বদরের যুদ্ধের কথা চিন্তা করেন। একপাশে মুসলমানরা, আরেক পাশে মুশরিকরা। উভয়ের মাঝে পোশাক-আশাকে খুব বেশি পার্থক্য ছিল না। মুসলমানদের মাথায়ও পাগড়ি ছিল তাদের মাথায়ও ছিল। মুশরিকদেরও দাড়ি ছিল, মুসলমানদেরও দাড়ি ছিল। বাহ্যিক দিক থেকে তাদের মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য ছিল না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিপ্লব শুধুমাত্র বাহ্যিক দিক থেকে ছিল না রাসূলের বিপ্লব ছিল মূল নীতিগত দিক থেকে। বাহ্যিকতা আনুষ্ঠানিকতার গুরুত্ব অবশ্যই আছে অস্বীকার করা যাবেনা। কিন্তু রূহবিহীন বাহ্যিকতা এবং রূহবিহীন আনুষ্ঠানিকতার কোন মূল্য নেই।
৯/ আমার প্রশ্ন হচ্ছে যে, আপনি নাজমুদ্দিন এরবাকান হোজার সাথে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন এবং উনাকে আপনি অনেক ভালবাসেন আমরা এটা জানি আপনি তার কাছ থেকে অনেক উপকৃত হয়েছেন। বিশেষ করে ইসলামী সভ্যতার পুনর্জাগরণ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক কাজগুলো কি ছিল যদি আমাদেরকে বলতেন!
তামিরুল মিল্লাত মাদ্রাসা থেকে সা’দ মুসান্না।
প্রথমেই দোয়া করি যেন, আমাদের সাবেক প্রধানমন্ত্রী উস্তাদ নাজমুদ্দিন এরবাকানের উপর আল্লাহ রহমত বর্ষিত হোক। শুধুমাত্র তুরস্ক নয় সমগ্র উম্মাহর মধ্যে অনেক কঠিন সময়ে তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। আমরা সবাই মুসলমান হিসেবে তুর্কিতে খুব কঠিন সময় অতিক্রম করছি। আমি সাত বছর যে প্রতিষ্ঠানের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি সেই প্রতিষ্ঠান ২৫ বছর পর্যন্ত আজান দিতে পারেনি। উস্তাদ নাজমুদ্দিন এরবাকান যখন তুরস্কে রাজনীতি শুরু করেন তখন ইসলাম সম্পর্কে একটা কথা বলা পর্যন্ত অপরাধ ছিল এমন কি এটা ছিল সংবিধানের বিরুদ্ধে। এরকম একটি মুহূর্তে তিনি রাজনীতি করেছেন। তুরুস্কের সাথে মুসলিম উম্মাহর কোন সম্পর্ক ছিল না। সকল সম্পর্ককে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল। ওই সময় তিনি ইসলামে ঐক্যের আহবান করেছেন এবং ঘোষণা করেছেন এমনকি সবচেয়ে উচ্চস্বরে, দৃঢ়ভাষায় ঘোষণা করেছিলেন। বিশেষ করে কাদিম এবং জাদিদ তথা নতুন এবং পুরাতন সকল প্রকার সম্পর্কের মধ্যকার সমন্বয় সাধনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। ইসলামী রাজনীতিকে আখলাকের সাথে সম্পৃক্ত করার ক্ষেত্রে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন। এক্ষেত্রে সবচাইতে বড় ভূমিকা পালন করেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে তিনি নতুন একটি প্রজন্ম তৈরি করেছেন। আজকের তুরস্কে, যদি আমাদের কোনো ছোটখাটো অর্জন থেকে থাকে, তবে সেটা তাঁর কারণেই, তাঁর ওসিলায়-ই এটা হয়েছে। আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করি যেন তোমাদের মধ্য থেকে এরকম অনেক বড় বড় নেতৃত্ব উঠে আসে এবং তারা যেন মুসলমানদেরকে নেতৃত্ব দান করতে পারে। আমাকে ধৈর্য ধরে দুই ঘন্টা যাবৎ শোনার জন্য সবাইকে অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। সবাইকে আমার সালাম।
আমার চিন্তাকে, আমাকে আপনাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য প্রিয় বুরহান উদ্দিনকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। আমাদের অতীতের বড় বড় আলেমগণ যখন কোন বিষয়ে কথা বলতেন তখন একটি কথা বলতেন- এই বিষয়ে আল্লাহ তায়ালাই সবচাইতে ভালো জানেন। আপনাদের প্রতি আমার একটা অনুরোধ হচ্ছে- আমিসহ যেকোন আলেমকে যখন আপনারা শুনবেন, পড়বেন তখন অবশ্যই গবেষণা করবেন। দয়া করে নিজেদেরকে খুব যোগ্য করে গড়ে তোলেন। কুরআনকে খুব ভালোভাবে জানুন। সুন্নাত ও সিরাতকে সবসময় পড়ুন খুব ভালো ভাবে জানার ও বুঝার চেষ্টা করুন। ইসলামী সভ্যতার ইতিহাস কে খুব ভালোভাবে শেখার চেষ্টা করুন। কারণ আপনাদের খুব প্রয়োজন রয়েছে এই উম্মাহর।
ওয়া আখেরি দাওয়ানা আনিলহামদুলিল্লাহি রব্বিল আলামীন।
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুলল্লাহি ওয়া বারকাতুহ।

সংকলক- মুহাম্মদ সায়েম মুহাইমিন

পঠিত : ১১১১ বার

মন্তব্য: ০