Alapon

সাহাবী উসমান ইবনে মাজউন রা.-এর জীবন ও ইতিহাস...



উসমান ইবনে মাজউন রা.—আল্লাহর রাসূলের প্রিয় সাহাবীদের একজন। উসমান ইবনে মাজউন রা. ছিলেন প্রাপ্ত বয়স ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে পুরুষদের মধ্যে ১৪ তম। ইসলামের আহব্বান পাওয়া মাত্রই তিনি মহান আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়ন করেন। অবশ্য, ইসলাম আগমনের পূর্ব থেকে উসমান ইবনে মাজউন ছিলেন উত্তম চরিত্রের অধিকারী। তিনি ছিলেন সেই অল্প কয়েকজন ব্যক্তি—যারা জাহেলি যুগে বসবাস করেও কখনো মদ পান করেননি। যারা মদ পান করতো তাদের উদ্দেশ্যে উসমান ইবনে মাজউন বলতেন—এমন জিনিস পান করে কী লাভ—যাতে মানুষের বুদ্ধি লোপ পায়, নীচ শ্রেণীর লোকের হাসির পাত্রে পরিণত হয় এবং নেশা অবস্থায় মা-বোনের কোনো বাছ-বিচার থাকে না?

ইসলামের প্রচার শুরু হওয়ার পর মুসলিমদের উপর নেমে আসে কাফিরদের নির্যাতন। তখন আল্লাহর রাসূল মুসলিমদের হাবশা তথা আবিসিনিয়ায় হিজরত করার কথা বলেন। আবিসিনিয়ায় হিজরতকারী প্রথম দলটির নেতা ছিলেন উসমান ইবনে মাজউন রা.।

আবিসিনিয়ায় থাকা অবস্থায় একদিন উসমান ইবনে মাজউন রা. জানতে পারলেন, কুরাইশ গোত্রের সবাই ইসলাম গ্রহণ করেছে। এই সংবাদ পাওয়া মাত্র আবিসিনিয়ায় হিজরত করা সকল মুসলিম মক্কার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। কিন্তু মক্কার কাছাকাছি পৌঁছানোর পর জানতে পারলেন, এই সংবাদটি সত্য নয়! কিন্তু যে পর্যন্ত চলে এসেছেন, তাতে আবিসিনিয়ায় ফিরে যাওয়া বেশ কষ্টসাদ্ধ! আর মক্কায় ফিরে গেলে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে কাফিরদের নির্যাতন। এমতাবস্থায় তারা সেখানেই তাঁবু গেড়ে বসবাসের সিদ্ধান্ত নিলেন। এভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর দেখা গেল, মুসলিমদের অনেকেই মক্কায় অবস্থানরত তাদের আত্মিয়-স্বজনদের নিরাপত্তা নিয়ে মক্কায় ফিরে গেছে। তাদের দেখাদেখি উসমান ইবনে মাজউনও রা. ওয়ালিদ ইবনে মুগীরার নিরাপত্তায় মক্কায় ফিরে গেলেন।

এভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর উসমান ইবনে মাজউন রা. অপরাধ বোধে ভুগতে লাগলেন। তিনি ভাবলেন, ‘এভাবে ওয়ালিদ ইবনে মুগীরার নিরাপত্তায় থাকার চেয়ে, তার জন্য আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের নিরাপত্তাই যথেষ্ট।’ যে ভাবনা সেই কাজ। তিনি ওয়ালিদ ইবনে মুগীরার কাছে গিয়ে বললেন, ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আপনি আপনার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছেন। এখন আমাকে আপনার নিরাপত্তাবন্ধন থেকে ‍মুক্ত করে দিন। কারণ, আমার জন্য আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলই যথেষ্ট।’
তারপর ওয়ালিদ ইবনে মুগীরা কাবা চত্বরে লোক সমবেত করে উসমান ইবনে মাজউন রা.-কে তার নিরাপত্তাবন্ধন থেকে মুক্ত করে দেন।

এরপর উসমান ইবনে মাজউন রা. লাবীব ইন রাবিয়ার সাথে কুরাইশদের একটি মজলিসে যান। সেই মজলিসে গিয়ে লাবীব একটি কবিতা আবৃত্তি করেন। লাবীব বলেন, ‘ওহে, আল্লাহ ছাড়া সবই বাতিল ও অসার’। তখন উসমান ইবনে মাজউন রা. বলেন, তুমি সত্য বলেছে। তার পরের চরনে লাবীব বলেন, ‘সকল সম্পদই নিশ্চিত ধ্বংষ হবে।’ এবার উসমান ইবনে মাজউন রা. প্রতিবাদি কন্ঠে বলেন, ‘তুমি মিথ্যা বলছো। জান্নাতের নিয়ামত কখনো ধ্বংস হবে না।’ তখন লাবীব বিরক্ত হয়ে বলে, ‘হে কুরাইশ গোত্রের লোকেরা! তোমাদের মাজলিসের অবস্থা তো পূর্বে এমন ছিলো না!’ এরপর মজলিসে উপস্থিত এক কম বয়সি কুরাইশ তরুণ ঘুসি মেরে উসমান ইবনে মাজউন রা.-এর একটি চোখ প্রায় অন্ধ করে দেন। তখন মজলিসে উপস্থিত লোকেরা বলল, ‘আজ যদি তুমি ওয়ালিদ ইবনে মুগীরার নিরাপত্তায় থাকতে তাহলে এই চোখ হারাতে হতো না।’ তখন উসমান ইবনে মাজউন রা. বলেন, ‘আমার একটি চোখ এখনো অবশিষ্ট আছে। মহান আল্লাহর বাণী পৌঁছে দেওয়ার জন্য যদি আমার এই চোখ কুরবান করতে হয়, তাতেও আমার কোনা আফসোস থাকবে না। ‘

এরপর আল্লাহর রাসূল যখন মুসলিমদের মদীনায় হিজরত করতে বলেন, তখন উসমান ইবনে মাজউন রা. পরিবারের সকলকে সাথে নিয়ে মদীনায় হিজরত করেন। তিনি নিজ পরিবারের একজনকেও মক্কায় ছেড়ে যাননি। সকলকে সাথে নিয়ে মদীনায় হিজরত করেন। মদীনায় পৌঁছানোর পর আল্লাহর রাসূল উসমান ইবনে মাজউন রা. এবং তার পরিবারের জন্য একখন্ড জমি দিলে তিনি এবং তার পরিবার সেখানেই বসবাস করতে থাকেন।

এরপর বদরের যুদ্ধের ডাক এলে উসমান ইবনে মাজউন রা. স্বানন্দে সেই ডাকে সাড়া দেন এবং যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধ শেষে মদীনায় ফেরার পথে উসমান ইবনে মাজউন রা. ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তারপর তাঁর পরিবারের সদস্যরা তাকে সুস্থ করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করার পরও ব্যর্থ হন। তিনি মহান আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে পরপারে পাড়ি জমান। আল্লাহর রাসূল সা. যখন উসমান ইবনে মাজউন রা.-এর জানাজায় উপস্থিত হন, তখন কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। তারপর তিনি উসমান ইবনে মাজউন রা.-এর কপালে তিনবার চুমু খান। এসময় আল্লাহর রাসূলের চোখের পানি উসমান ইবনে মাজউন রা. এর মুখে ছড়িয়ে পড়ে। তারপর আল্লাহর রাসূল কান্না ভেজা কণ্ঠে বলেন, ‘ আবু সায়িব! আমি তোমার থেকে পৃথক হয়ে যাচ্ছি। আল্লাহ তোমার উপর রহম করুন। দুনিয়া থেকে তুমি এমনভাবে বিদায় নিলে যে, তার থেকে তুমি কিছু নিলে না এবং দুনিয়াও তোমার থেকে কিছু নিতে পারেনি।’

উসমান ইবনে মাজউন রা.-ই মুহাজিরদের মধ্যে প্রথম ব্যক্তি—যিনি মদীনায় মৃত্যুবরণ করেন। তারপর তাঁকে মদীনার বাকী গোরস্তানে দাফন করা হয়।

পঠিত : ১৫৩৯ বার

মন্তব্য: ০