Alapon

আটপৌরে!

একদৃষ্টিতে বিশাল বিলবোর্ডের দিকে তাকিয়ে আছেন ফারুক সাহেব। আঁটসাঁট কাপড়ের এক তরুণীর অদ্ভুত ভঙ্গিমায় ছবি জুড়ে আছে বিলবোর্ডে। এককোণে ছোট্ট করে ইংরেজীতে লেখা পণ্যের নাম।


ফারুক সাহেব নাকের গোড়া থেকে মোটা ফ্রেমটা নামিয়ে পাঞ্জাবির কাচায় মুছে নিলেন। তারপর লাগিয়ে আবার তাকালেন বিলবোর্ডের দিকে। ছোট করে নিঃশ্বাস ছাড়লেন তিনি। সময় দ্রুত বদলে যাচ্ছে। বদলে যাওয়া সময়ের সাথে তাল মিলাতে গিয়ে পিছিয়ে পড়ছেন কেউ কেউ। আর যারা এগিয়ে যাচ্ছে তারা হয়তো হারিয়ে ফেলছে নিজের স্বকীয়তা।


এসব ভাবতে ভাবতে হাঁটছিলেন তিনি। হঠাৎ ঝুপ করে একটা ট্যাক্সি এসে দাঁড়ালো তার গা ঘেষে। অল্পের জন্য তিনি রক্ষা পেলেও হাতের ব্যাগটা ছিটকে গেল। ট্যাক্সি থেকে গলা বের করে ড্রাইভার খেঁকিয়ে উঠলো, 'অই মিয়া। বাড়িত কি বউয়ের লগে ঝগড়া কইরা আইছেন নি? রাস্তায় নামলে হুশ গিয়ান কই থাহে? সাইডে চাপেন।' বলেই যেভাবে এসেছিল ঠিক সেভাবে শা করে বেরিয়ে গেল।


ফারুক সাহেব মনে মনে নিজেকে তিরস্কার করতে লাগলেন। এটাতো তার চিরচেনা গ্রাম নয়। এটা ঢাকা শহর। এখানে পা ফেলতে হয় হিসাব করে। তিনি নিচে ঝুকে ব্যাগ থেকে ছড়িয়ে পড়া কাগজপত্র তুলতে লাগলেন। কাগজ গুলো আসলে ডাক্তারি রিপোর্ট। দীর্ঘদিন ধরে কিডনীর সমস্যায় ভুগছেন তিনি। রঞ্জুর মায়েরও এই রোগ ছিল। 
মরার সময় যে ক'টা জিনিস তাকে দিয়ে গিয়েছে তার মধ্যে এই রোগও একটি।


হাঁটতে হাঁটতে তিনি ভাবেন একজীবন একসঙ্গে থাকার পর কি পেয়েছেন রঞ্জুর মায়ের কাছ থেকে। দীর্ঘ তিরিশ বছরের স্মৃতি, যা এখন একাই বয়ে বেড়াচ্ছেন। এই কিডনীর রোগ। আর দু'টো ছেলে।


ছেলে দু'টোকে কি তিনি আসলেই পেয়েছেন? রঞ্জু চাকরির জন্য ঢাকায় ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকে। ছোট্ট সেই ফ্ল্যাটে দু'টো মাত্র বেড রুম। এক রুমে রঞ্জু আর বউমা থাকে। অন্য রুমে তাদের মেয়ে কুসুম। তিনি যতবার রঞ্জুর বাসায় গিয়েছেন ছোট্ট কুসুমকে শুতে হয়েছে মা বাবার মাঝখানে। এ নিয়ে অস্বস্তিতে ভুগেন তিনি। ওদের ফ্ল্যাটে যেতে ইচ্ছে করে না। নিজেকে অপাংক্তেয় মনে হয়। তবুও মাঝেমধ্যে যাওয়াই লাগে, রোগটা বেশ ভোগাচ্ছে তাকে।


ছোট ছেলে সঞ্জু থাকে হোস্টেলে। সঞ্জুর ভালো নাম সফিক। ফারুক সাহেব সফিক নাম ধরে ডাকলে রঞ্জুর মা প্রতিবাদ করে উঠতো, 'এ কেমন নামে ডাকতেছেন। ছেলের নাম ফিক হয় নাকি। সারাক্ষণ মেয়েদের মত ফিক ফিক করে হাসবে। ছেলেরা মেয়েলি হাসি দিলে আমার অসহ্য লাগে। আমার ছেলের নাম সঞ্জু। রঞ্জুর ভাই সঞ্জু।'


ফারুক সাহেব বলতেন, 'তোমার বড় ছেলের নামওতো রফিক। তখনতো এসব কিছু বলোনি।'
রঞ্জুর মা জবাব দিতেন, 'তখন তো আমি নতুন ছিলাম। আপনেরে ভয় পাইতাম। কিছু বলার সাহস পেতাম না।'


'এখন আমারে ভয় পাও না? '


' নাহ। ভয় কেটে গেছে। সংসার চালাতে গেলে ভয় থাকেনা। '


ভাবতে ভাবতে ফারুক সাহেবের চোখের কোনা ভিজে উঠে। আবার চশমা খুলে তা পরিষ্কার করে নেন। এক ফাঁকে পকেট থেকে ছেড়া বেল্টের হাতঘড়ি বের করে সময় দেখেন তিনি। রাত পৌনে দশটা। এখান থেকে হেঁটে হেঁটে রঞ্জুর বাসায় যেতে আরো ঘন্টা খানেক লাগবে।


°°°°°


ফারুক সাহেব যখন রঞ্জুর ফ্ল্যাটের কলিংবেলে চাপ দেন তখন কাটায় কাটায় ঠিক এগারোটা। ওরা হয়তো ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। রঞ্জু গায়ে একটা তোয়ালে জড়িয়ে নিয়ে দরজা খুলে দেখে ফারুক সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। রঞ্জু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো, 'আপনি এত দেরী করলেন কিভাবে আব্বা? আমি খবর নিয়ে জানলাম ট্রেন ঠিক সময়ে এসেছিল। এদিকে আপনার মোবাইলও বন্ধ।'


তিনি ভিতরে ঢুকে ড্রইং রুমের একটা চেয়ারে নিজেকে ছেড়ে দিলেন। তারপর ছেলের উৎসুক মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, 'ট্রেনে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। জেগে দেখি মানিব্যাগ নেই। হেঁটে হেঁটে আসতে হলো। চোর মোবাইল নেয়নি। সস্তা বলে নেয়নি হয়তো। কিন্তু চার্জ ছিল না। তাই তোদের জানাতে পারিনি। আমি ঠিক আছি।'


আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল রঞ্জু। এমন সময় শায়লা এসে থামিয়ে দিলো ওকে। কিছুটা রাগত স্বরে বললো, 'তুমি যে কি না। দেখছোনা আব্বা কত ক্লান্ত।'


শায়লার কথা শুনে রঞ্জু নিজেকে সামলে নিল। শায়লাই আবার বলে উঠলো, 'আব্বা আপনি হাত মুখ ধুয়ে নিন। আমি খাবার দিচ্ছি।'


ফারুক সাহেব বললেন, 'তোমার এত তাড়াহুড়ো করতে হবেনা মা। আমার নাতনীটা কোথায়? দেখছিনা যে?'


'কুসুম ঘুমিয়ে পড়েছে আব্বা।' বলল শায়লা। তারপর রঞ্জুর দিকে ফিরে বলল, তুমি আব্বাকে নিয়ে বসো। আমি রান্নাঘরে গেলাম।'


****
খাবার টেবিলে ফারুক সাহেবের ঠিক সামনে বসেছে রঞ্জু। বসে বসে পা নাচাচ্ছে সে। ফারুক সাহেব একবার দেখলেন সেদিকে। তারপর খাবারের দিকে মন দিলেন। ছোট বেলায় এই পা নাচানোর জন্য কত বকা দিয়েছেন তিনি। কাজ হয়নি। মুদ্রা দোষ রয়েই গেছে।
আজ সময়ের উল্টোপিটে বসে আছেন তিনি। রঞ্জু পা নাচাচ্ছে ঠিকই। কিন্তু তাকে বকা দেবার মতো সাহসটুকু হারিয়ে ফেলেছেন।


রঞ্জু এক টুকরা মুরগীর মাংস ফারুক সাহেবের প্লেটে তুলে দিয়ে বলল, 'আপনার খেতে কষ্ট হচ্ছে নাতো বাবা?'


তিনি বললেন, 'নাহ। কিসের কষ্ট! নিজের ঘরে খাচ্ছি।'


'শায়লা বলছিল ভাত কড়কড়া হয়ে গেছে। নতুন চাল চড়িয়ে দেবে। আমি মানা করলাম। বললাম, তরকারি গরম করে দাও। ভাত রান্না হতে অনেক সময় লাগবে। ততক্ষণে আব্বার ক্ষিদে মরে যাবে।'


'ভালো করেছিস। তোর চাকরি কেমন চলছে। প্রমোশন টমোশন পাবি নাকি কিছু।'


'না বাবা। এমন চাকরি করি। প্রমোশনের কোন সিস্টেম নাই। সারা জীবন গাধার মতো খেটে যেতে হবে।'


কথা বলার এক ফাঁকে ফারুক সাহেব লক্ষ করলেন ঘুমন্ত কুসুমকে শায়লা কোলে করে নিজের ঘরে নিয়ে যাচ্ছে। কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেলেন তিনি। মাঝে মাঝে এমনও সময় আসে যখন মুখের সব ভাষা হারিয়ে যায়। অথচ মনটা আকুলিবিকুলি করতে থাকে কিছু একটা বলার জন্য।


খাওয়া দাওয়া শেষ করে ফারুক সাহেব রঞ্জুকে ঘরে ডাকলেন। কাছে বসিয়ে এটা ওটা জিজ্ঞ্যেস করলেন। এক সময় বললেন, 'গ্রামের বাড়িটা বিক্রি করে দেই। কি বলিস? তোদেরও একটা বড় ফ্ল্যাট দরকার। কুসুম বড় হচ্ছে। আর সঞ্জুটাও তো মনে হয়না গ্রামে ফিরে যাবে।'


রঞ্জু ইতস্তত করে বলল, 'থাক না ওসব কথা বাবা। এখনো তো তেমন প্রয়োজন দেখছি না।'


রফিক সাহেব বললেন, 'আমি আর ক'দিন বাঁচব? যাবার আগে তোদের সুখী দেখতে চাই। সঞ্জুর পরীক্ষাটা শেষ হলে একটা বিয়ে করিয়ে দেব। ব্যসস আমার কাজ শেষ। চাকরি ও কিছু একটা যোগাড় করে ফেলবে। ও নিয়ে ভাবিনা।'


রঞ্জু কি একটা বলতে যাবে এমন সময় হঠাৎ ডোর বেল বেজে উঠলো। 'এমন সময় কে এলো আবার' বলে উঠতে যাচ্ছি সে। শায়লা রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলল, 'তোমরা কথা বলো। আমি দেখছি।'


°°°°°


শায়লা দরজা খুলে চমকে উঠলো। তার ছোট বোন ফারজানা আর তার স্বামী বাইরে দাঁড়িয়ে। সাথে ওদের ছেলে দু'টো। দুজনেরই কেতাদুরস্ত পোষাক, একবারে ফিটফাট। শায়লা ওদের এভাবে দেখে খুশিতে গদগদ হয়ে উঠলো যে বাকি সব মুহূর্তের জন্য ভুলে গেল। বাইরে দাড় করিয়েই প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতে লাগলো সে।


ফারজানা বললো, 'আপা ভিতরে আসতে দিবি? নাকি এখানে দাড় করিয়েই পাগলামি করবি?'


ড্রইং রুমে এসে বসতেই ফারজানা বললো, 'আপা আগে এক কাপ চা খাওয়া। তারপর বলছি।'


শায়লা বললো, 'চা খাবি কিরে। এত রাতে এসেছিস। তাও এতদিন পর। ভাত না খাইয়ে আমি ছাড়ছিনা।'


ফারজানা বলল, 'তোকে ছাড়তে হবেনা। আমরা তোর কাছে থাকতেই এসেছি। আচ্ছা শোন, বলছি। আমরা আসলে সন্ধ্যায় একটা ফাংশানের জন্য বেরিয়েছিলাম। সব ঠিক মতোই হলো। বাসায় ফেরার সময় তোদের বাড়ির অল্প দুরে এসে গাড়িটা নষ্ট হয়ে গেল। ও তো বলছিল ট্যাক্সি নিয়ে বাসায় চলে যেতে। আমি বেঁকে বসলাম। বললাম, সাথে দু'টো বেবী নিয়ে এত রাতে দৌড়াদৌড়ি করতে পারব না। আপার বাড়ির এতো কাছে এসে থেমেছি যখন ওর কাছেই গিয়ে থাকব। তাই চলে এলাম। তোদের আবার ঝামেলায় ফেললাম নাতো?'


শায়লা মনে মনে শংকিত হলেও মুখে স্বাভাবিক ভাবে বললো, আরে কি বলিস। ঝামেলা কিসের। তোকে অন্তত দুই তিন দিন থাকা লাগবে। এই বলে দিলাম। তোরা বোস। আমি তোর দুলাভাইকে ডেকে দিচ্ছি। এদিকে চুলায় পানি উঠিয়ে দেই।'


°°°°°
সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। শায়লার সাথে কুসুম আর ফারজানার বাচ্চারা শুয়েছে। ফারজানা আর তার স্বামীর জন্য অন্য ঘরটা ছেড়ে দেয়া হয়েছে। ড্রইং রুমে আসবাব গুলো একপাশে সরিয়ে রেখে ফ্লোরে শোবার জায়গা করা হয়েছে। সেখানটায় আছে ফারুক সাহেব আর রঞ্জু।


ফারুক সাহেব শোবার সাথে সাথে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলেন। ট্রেনের জার্নির পর দীর্ঘপথ হেঁটে আসার কারনে হয়তো নিজেকে ছেড়ে দিয়েছেন ঘুমের রাজ্যে। অল্পক্ষণ পরেই নাক ডাকতে শুরু করলেন তিনি।


পাশে শোয়া রঞ্জুর দু'চোখে ঘুম নেই। সে ভাবনার অতলে নিজেকে হারিয়ে ফেলছে বারবার। ছোট বেলায় যখন আব্বা ঘুমানোর সময় নাক ডাকতেন, সে কান্নাকাটি শুরু করে দিত। তার কান্না শুনে আম্মা জেগে উঠতো। জাগতো না শুধু বাবা। তিনি তখন যেন অন্য জগতের মানুষ। দুনিয়ার সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই। বাধ্য হয়ে আম্মা আব্বার গায়ে আলতো করে ধাক্কা দিতেন। এতে নাক ডাকা থেমে যেতো তার।


আজ কতো বছর পর বাবার সাথে ঘুমোচ্ছে সে। মনে নেই। সে অবাক হয়ে গেল এই ভেবে যে, আজ কেন আব্বার কোন গুরুত্ব নেই তার জীবনে। অথচ এই মানুষটা সারাটা জীবন শেষ করে দিয়েছেন সংসারটার পিছনে। তাদের দুই ভাইকে মানুষ করার পিছনে। তার বদলে কি পেলেন তিনি। এই বুড়ো বয়সে চিকিৎসার জন্য গ্রাম থেকে শহরে ছুটে বেড়াতে হচ্ছে তাকে।


রঞ্জু উঠে বেলকনিতে চলে এলো। ছোট্ট বেলকনি, কোন রকম দুজন মানুষ দাঁড়ানো যায়। সে একবার নিজের রুমে গিয়ে সিগারেটের প্যাকেটটা নিয়ে এসে আগের জায়গায় দাঁড়ালো আবার। একটা সিগারেট ধরিয়ে উদাস হয়ে টানছে সে। মনে হচ্ছে বাকি রাত আর ঘুম হবে না তার। পাশের বিল্ডিং গুলোতে কয়েকটা ফ্ল্যাটে জানালার পর্দায় আলো দেখা যাচ্ছে শুধু। বাকি সব শান্ত অন্ধকার। একবার মোবাইল বের করে সময় দেখলো সে। মাত্র আড়াইটা বাজে। মনে হচ্ছে এই রাত আর কখনো শেষ হবেনা। কখনো ভোর আসবে না। সে অনন্তকাল ধরে বেলকনির লোহার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে থাকবে। শুধু দাঁড়িয়ে থাকবে।

পঠিত : ১২৭৭ বার

মন্তব্য: ০