Alapon

-| তিনি অসম্ভবকে সম্ভব করেন|-০১




তাঁকে দেখে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়লেন তিনি। প্রবল অসহায়ের মতো আর্জি পেশ করে বললেন ; আল্লাহকে ভয় করো! আমি তোমার থেকে বাঁচতে চাই। আমার সম্রম-সম্মানের নিরাপত্তা চাই! তুমিও নিশ্চয়ই আল্লাহর বান্দা। তুমি সেই আল্লাহকে ভয় করো। এমন অন্যায় করতে পারো না তুমি! স্ফুট-অস্ফুট স্বরে এমন আরো কী কী যেনো বলে যাচ্ছেন তিনি!

আল্লাহর নামের সম্মানার্থে জিব্রাইল আলাইহিসসালাম কিছুটা পিছু সরে গিয়ে বললেন – না না! এমন কিচ্ছু হবে না তোমার! আমি আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমার জন্যে শুভসংবাদ নিয়ে এসেছি। তোমাকে একজন পূত্র সন্তান দান করবো। এই সংবাদটি নিয়েই আমি এসেছি আজ তোমার কাছে।

জীব্রাইল আলাইহিস সালাম থেকে সংবাদটা শুনেই হতচকিত হয়ে ওঠলেন তিনি। কীভাবে সম্ভব তা! কীভাবে...!! বুকটা তাঁর কেঁপে কেঁপে ওঠলো যেনো!! তাঁর মগজের ভাঁজে ভাঁজে যেনো এ-ই জিজ্ঞাসা – কীভাবে আমার ছেলে হবে? কীভাবে? আমাকে তো কস্মিণকালেও কোনো পুরুষ স্পর্শ পর্যন্ত করে নি। না হয়েছে আমার বিয়ে! না আমি ব্যভিচারিণী! কীভাবে হবে আমার সন্তান? কীভাবে?

জিবরাঈল আলাইহিসসালাম শান্ত অথচ দৃঢ়তার সাথেই মজবুতভাবে জবাব দিলেন– হ্যাঁ, এটাই হবে! এভাবেই হবে। তাঁর জন্যে সবই সহজ। তিনি সবই পারেন। স-অ-ব! তিনি পিতা ব্যতীত তোমাকে সন্তানের মা বানাতে চান এই জন্যে যে– তিনি তাঁকে সৃষ্টি জগতের জন্যে, সকল মানুষের জন্যে এক নিদর্শন হিসেবে উপস্থাপন করতে চান। এরমাধ্যমে তোমার প্রতিও অনুগ্রহ করতে চান।

যেহেতু সীদ্ধান্তটা আল্লাহর। সেহেতু আর কোনো কথা চলে না এখানে। তিনি যা-ই চান তা-ই করেন। তা-ই হয়! চুপচাপ হয়ে গেলেন তিনি। কিচ্ছু বললেন না আর। কিচ্ছু না! জিবরাঈল (আঃ) তাঁর বুকে ফুঁকে দিলেন রূহ। আল্লাহর নবি ঈসা আলাইহিস সালামের রূহ।
যাঁর কথা এতোক্ষণ বললাম, তিনি আর কেউ না। ঈসা আলাইহিসসালামের মাতা মারইয়াম আলাইহিস সালাম। তিনি ছিলেন বাইতুল মাকদিসের তৎকালীন একজন সম্মানিত ইমাম ইমরান ইবনে লাখাম এবং হান্না বিনতে ফাকুদের বহুল আকাঙ্খিত সন্তান। সাধনার ধন। তাঁরা নিঃসন্তান। বয়স হয়ে গেছে যথেষ্ট পরিমাণ। বৃদ্ধ প্রায় তাঁরা। কিন্তু কোনো সন্তান নেই বিধায় আল্লাহর কাছে তাঁরা একজন সন্তান চাইতে লাগলেন।

একদিনের ঘটনা। ইমরানের স্ত্রী হান্না বিনতে ফাকুদ একটি গাছের তলায় বসে আছেন। হঠাৎ তাঁর দৃষ্টি পড়লো একটা পাখির দিকে। গাছের ডালে পাখিটির ডিম হতে একটা বাচ্চা ফুটলো। ফোটবার সাথে সাথে সে কিচিরমিচির শব্দ করা শুরু করলো। মা পাখিটি বাচ্চাটিকে বুকের মাঝে আগলে নিলেন। খাবার নিয়ে তাকে খাবার খাওয়াতে লাগলেন। এই দৃশ্য দেখেই হান্না বিনতে ফাকুদের মায়াবী-মাতৃত্বপূর্ণ মন হাহাকার করে ওঠলো। শুধু একটা সন্তানের জন্যে!

তিনি আল্লাহর কাছে কাঁদতে লাগলেন খুব করে। বললেন –হে আল্লাহ! আমাকে একটা সন্তান দান করুন। আমি সেই সন্তানটাকে তোমার রাস্তায় চালাবো। বাইতুল মাকদিসের খিদমাহ্'য় তাঁকে নিবেদিত করবো।
আল্লাহ তাঁর ডাক শুনলেন। কিন্তু বাঁধলো বিপত্তি। ছেলে হলেই তো তাঁর কৃত নিয়তের পূর্ণতা পেতো।হয়েছে মেয়ে। তাঁর নাম রেখেছেন মারইয়াম। কিন্তু নিয়ত যে তাঁরা করেছেন, তার কী হবে! অবশেষে তাঁরা ঠিক করলেন মারইয়ামকেই বাইতুল মাকদিসের খিদমাতে নিবেদিত করবেন। করেছেনও।

বাইতুল মাকদিসে তাঁকে দেয়ার পরে তিনি নিবিষ্ট মনে ইবাদতের মধ্যে ডুবে থাকতেন। সারাক্ষণ আল্লাহর স্মরণে মশগুল হয়ে থাকতেন। নির্দিষ্ট একটি কক্ষে। একদিন তিনি সেই কক্ষ থেকে পূর্ব দিকে একটু আড়ালে চলে গেলেন। ইবাদতের জন্যে। কিংবা গোসল করার জন্যে। কারো কারো মতে তাঁর একটি ক্ষেত ছিলো, সে ক্ষেতে পানি দেবার জন্যে।
পূব দিকে যাওয়ার সাথে সাথেই জিবরাঈল আলাইহিস সালামকে দেখতে পেলেন। দেখেই তো তো ভড়কে গেলেন। ভাবলেন হয়তো কোনো মানুষ কোনো বদ ইচ্ছে নিয়ে এসেছে ওনার কাছে। কাহিনিটা তো শুরুতেই বলা হয়েছে।

তিনি এখন আল্লাহর ইচ্ছায় গর্ববতী। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ভীষণ বিচলিত হয়ে পড়লেন! মানুষকে কী জবাব দেবে! মানুষ কী বলবে! অপবাদকারীরা অব্যাহত অপবাদ আরোপ করে তাঁর পবিত্র জীবনকে কলুষিত করবার ফন্দি আঁটবে। করে তুলবে তাঁর জীবঙ্কে দুর্বিষহ। আসোলে মানুষ তো কখনো দেখেও নি পিতৃ ছাড়া সন্তান হতে! মানুষের কাছে বিষয়টা বললে তারা তো বিশ্বাস করবেন না! কিন্তু....! কিন্তু এখন কী করবেন তিনি -ভেবে কুল-কিনারা পাচ্ছেন না কোনো!

চলে গেলেন তিনি আল্লাহর নবি এবং তাঁর খালু জাকারিয়া আলাইহিস সালামের স্ত্রীর কাছে (কারো কারো মতে তিনি তঁর খালাতো ভাই)। সব তাঁকে খুলে বললেন। একেবারে সব। তিনিও তো আল্লাহর নবির স্ত্রী। তাঁর সুমহান কুদরাতে তিনিও এখন গর্ববতী। অথচ তিনি বন্ধ্যা। তাই তিনি সহজেই ওনাকে বিশ্বাস করলেন । পরম মমতায় বুকে টেনে নিলেন। সাহস দিলেন। অনুপ্রেরণা দিলেন। যেনো আল্লাহর ওপর দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে অটল - অনড় ও অবিচল হয়ে পরীক্ষাটা সামাল দিতে পারেন। যেনো তাঁকে বুঝাতে লাগলেন- ভয় পেয়ো না, ভেঙ্গে পড়ো না, আল্লাহর ওপর আস্থা রাখো, বিশ্বাস রাখো, ধৈর্য ধারণ করো; আল্লাহর সাহায্য-সহযোগিতা অবশ্যই পাবে, আল্লাহ তোমাকে একা ছেড়ে দেবেন না। সাহায্য না করে থাকবেন না। তিনি যেনো প্রাণ পেলেন। ধূসর মরুভূমিতে এক ফোটা বৃষ্টি পেলে যেমনটা হয়; তেমন-ই।

মাঝেমধ্যেই এখন তাঁরা দুজন মিলিত হয়। কিন্তু যাকারিয়া আঃ এর স্ত্রীর অনুভবে এক অদ্ভুত বিষয় ফুটে ওঠে। তিনি তাঁর নিজ গর্ভের সন্তানটি মারইয়াম আঃএর গর্বভের সন্তানের দিকে যেনো মাথাটা নুইয়ে দেয়। বুঝতে পারলেন তিনি- মারইয়ামের বড়ো আর মহৎ কেউ হতে যাচ্ছে !

কিন্তু তিনি এখানে থাকা আর নিরাপদবোধ করলেন না। সত্যিই এই স্থানে বসে থাকা, থেকে ইবাদাত করা তাঁর জন্যে মটেও নিরাপদ হবে না। এখানের মানুষগুলো বিষয়টা জানতে পারলে তাঁর জীবনকে বিষিয়ে তোলার সব আয়োজন করবে। তিনি মনে মনে চিন্তা করলেন, সিদ্ধান্ত নিলেন — আর থাকবো না এখানে, বসবো না এই আংগিনায়, আল্লাহর ইচ্ছের কাছেই যেহেতু সমর্পিত হয়েছি; তাই তাঁর ইচ্ছে বাস্তবায়নের আগ অবধি কোনো তিরস্কারের তীরে বিদ্ধ হতে চাই না। চাই না হতে দুর্নামের দুর্বিপাকে বিপর্যস্ত হতে । ব্যথাভরা অন্তর নিয়ে, বেদনায় ভারাক্রান্ত দেহো-মন নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। ধীরে ধীরে গিয়ে পৌঁছলেন বাইতুললাহ্মে।

হাঁটতে হাঁটতে হাঁপিয়ে ওঠেন তিনি। একা একা। সাথে নেই কেউ। নিঃসঙ্গ। শুরু হলো প্রসব বেদনা। ভীষণ বেদনায় অস্থির তিনি। তাঁর চোখ-মুখে যেনো প্রবল যন্ত্রণার কাতরানি ফুটে ওঠেছে। নিজেই যেনো নিজেকে জিজ্ঞেস করছছেন—কই যাবো? কোথায় যাবো? আমার আশ্রয় কোথায়? কার কাছে গেলে আমি এখন একটুখানি আশ্রয় পাবো? কার কাছে! পিপাসিতও তিনি। পিপাসায়ও বুকের ছাতি ফেটে যাবার জোগাড় যেনো! আর চলে না কদম তাঁর। আশ্রয় নিলেন একটা খেজুর বাগানে। বসে পড়লেন সেই গাছের তলায়। সেখানেই। কিন্তু ব্যথা-যন্ত্রণা তো কমছে না। কাতরাচ্ছেন তিনি!

কেউ কি সহায় নেই ! তাঁর মন ঠেলে প্রশ্নগুলো যেনো উঁকি দেয় —আমি মানুষ ক্যান ! মানুষ এমন ক্যান! ক্যান পৃথিবীতে এলাম! আমি যদি এই ভীষণ একটা কঠিন পরীক্ষা থেকে উত্তীর্ণ হতে পারতাম! আমি কি পারবো? নাকি ভুল করে ফেলবো! তাঁর মনে শুধুই জিজ্ঞেসা! ভাবেন —হায়, আমি যদি নিফাসের একটি নেকড়াও হতাম, মানুষের স্মৃতি থেকে যদি আমি মুছে যেতাম। মানুষ যদি আমাকে ভুলে যেতো। এই দিন, এইক্ষণ আসার পূর্বেই যদি আমি মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছে যেতাম....!!

আমার সাহায্যকারী এখানে কে! কীভাবে আমি একটু মুক্তি পাবো! এমন নির্জনতায় সাহায্য পাবো? কীভাবে তা সম্ভব হবে? কীভাবে? কেউ কি আসবে?

দূর থেকে কেউ একজন যেনো বলে ওঠলো, হতাশ হবেন না। মন ভাঙবেন না! অসম্ভবের কিছু নেই! আপনি পুরুষ ছাড়া, স্বামী ছাড়া গর্ভবতী হয়েছেন—আল্লাহ সেই অসম্ভবকে যেহেতু সম্ভব করেছেন ; এটাও করবেন।


-| তিনি অসম্ভবকে সম্ভব করেন|-০১
~রেদওয়ান রাওয়াহা

পঠিত : ১০৪১ বার

মন্তব্য: ০