Alapon

জরাথুস্ত্রবাদ এবং কিছু কথা...



ক্লাসিক্যাল মুসলিম পণ্ডিতদের বড় অংশ জরাথুস্ত্রবাদীদের অগ্নিউপাসক বলে চিহ্নিত করেছেন। কোন সংস্কৃতিকে বাইরে থেকে সংজ্ঞায়ন করতে গেলে এমন ভুল হয়। ইউরোপ বহুবার ইহুদি, ইসলাম এবং হিন্দুধর্মকে বুঝতে ভুল করেছে এই কারণেই।

যাহোক, জরাথুস্ত্রবাদ পরবর্তী ধর্মবিশ্বাসগুলো আশ্চর্যজনক ভাবে তার চিহ্ন বহন করছে। বিশ্বাসটা জরাথুস্ত্রবাদ বলে পরিচিত হলেও বিশ্বাসীগণ নিজেদের মাজদায়াসনা বলতে চান। দারিয়ুসের বেহিস্তুন লিপিতে এই শব্দই উদ্ধৃত হয়েছে। পৃথিবীর সবচেয়ে প্রভাবশালী আর সাহসী পথিকৃৎদের একজন জরাথুস্ত্র। নামের অর্থ উটের মালিক। আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ থেকে ১০০০ অব্দের দিকে বসবাস করেছেন উত্তর ইরান, আফগানিস্তান এবং তুর্কমেনিস্তান অঞ্চলে। মাত্র পনেরো বছর বয়স থেকেই জরাথুস্ত্র যেনো মরুব্বি হয়ে উঠেন। সমাজের বিশৃঙ্খলা আর সমস্যাগুলো বড় হয়ে দেখা দিতে থাকে চোখে। ভালো আর মন্দের সংঘাত এবং সৎ পথ অবলম্বন নিয়ে নানা প্রশ্ন মাথায় উঁকি দিতে থাকলো। বিশ বছর বয়সে বাড়ি ত্যাগ করে বিস্তীর্ণ পৃথিবীর পথে বেরিয়ে পড়লেন উত্তর খোঁজার জন্য। দীর্ঘ দশ বছর পাহাড়ে নিঃসঙ্গ কাটিয়েছেন ধ্যানে। তার প্রত্যুত্তর পেয়েছেন এক সৃষ্টিকর্তা আহুরা মাজদার থেকে। আবেস্তার ‘আহুরা’ শব্দটি সংস্কৃত ‘অসুর’ –এর সাথে তুলনীয়। পারসিক ধর্মের ঠিক উল্টোটা ঘটেছে ভারতীয় হিন্দুধর্মে। অর্থাৎ এখানে দেব হয়েছে নায়ক এবং অসুরেরা খল।

মানুষ জরাথুস্ত্রের কথা সহ্য করতে পারেনি। বিশেষ করে ধর্মযাজকেরা তার উপর ক্ষেপে গিয়েছিলো। নির্যাতনের তোপে বাধ্য হলো পলায়ন করতে। প্রত্যেক নবির জন্যই এই চিত্রটা খুব সাধারণ। প্রচলিত ধর্মতত্ত্বের বাইরে কথা বলার কারণে তাদেরকে কোপদৃষ্টিতে পড়তে হয়েছে বারবার। তারপরও প্রায় ৭৭ বছর বয়স পর্যন্ত নিজের বাণী প্রচার করেছেন জরাথুস্ত্র। পুরাতন ধর্মবিশ্বাসীরা তার পিছু ছাড়েনি। গুপ্তঘাতক লেলিয়ে দিয়ে হত্যা করে মানুষটাকে। জরাথুস্ত্র মারা যান। কিন্তু মানুষের মনে যে আগুন তিনি জ্বালিয়ে গিয়েছিলেন; তা নিভে যায়নি আজতক।

আহুরা মাজদা হলেন সত্য, সুন্দর, সততা এবং ভালোবাসার আধার। সর্বজ্ঞাতা, সর্বশক্তিমান এবং সর্বদ্রষ্টা। তাকে কোন ত্রুটি স্পর্শ করতে পারে না। অবশ্যই আসমান, জমিন, গ্রহ-নক্ষত্র তিনিই সৃষ্টি করেছেন। আহুরা মাজদা এক এবং নিরাকার। অবশ্য সুন্দরের প্রতিপক্ষ হিসাবে অসুন্দরের হোতা আঙরা মাইনু বা দুষ্ট আত্মাকে চিত্রিত করা হয়েছে।আধুনিক পারসিক ভাষায় বলা হয় আহরিমান। দুনিয়ায় শুভ আর অশুভের দ্বন্দ্ব চলছে হাজার বছর ধরে। এর পতন ঘটবে সাওশিয়ান্তের আগমনের মাধ্যমে। সাওশিয়ান্ত অনেকটা হিব্রু মেসায়াহ, বৌদ্ধ মৈত্রেয়ী এবং ইসলামের ইমাম মাহদির মতো। তিনি পৃথিবীতে আগমন করে সমস্ত কুৎসিতকে বিদূরিত করবেন। সম্পূর্ণভাবে পরাজিত হবে আঙরা মাইনু। সৎ লোকেরা পরিত্রাণ পাবে এবং অসৎ লোকেরা পাবে শাস্তি। জরা, মৃত্যু, অশান্তি এবং অসুস্থতার সমাপ্তি ঘটবে চিরকালের জন্য।

একটা বিচার দিবসের চিত্রও অঙ্কন করা হয়েছে। শেষ বিচারের দিন গোটা মানবজাতিকে পুনরুত্থিত করা হবে। জরাথুস্ত্র নিজে সকল আত্মাকে চিনবাত সাঁকো (পুলসিরাত!) পার করিয়ে বেহেশতের দিকে নিয়ে যাবেন। পূন্যবান আত্মার জন্য সাঁকো আহুরা মাজদার দয়ায় প্রশস্ত হয়ে উঠবে। তারা সহজেই সেতু পার হয়ে বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে। চিরন্তন সুখের জায়গা বেহেশত। অন্যদিকে পাপী আত্মার জন্য সেঁতু হবে মিহি এবং ধাঁরালো। তারা সেখান থেকে পতিত হবে দোজখে। অনন্তকালের জন্য আঙরা মাইনুর অনুসারীরা থাকবে সেখানেই।

জরাথুস্ত্রবাদ প্রাকৃতিক শক্তিগুলোকে শুদ্ধ হিশাবে গ্রহণ করেছে। আগুনকে শ্রদ্ধা করা হয়। আগুন চন্দ্র আর সূর্যের মতোই আলোকদানকারী। মানুষ আর আহুরা মাজদার মধ্যে সংযোগকারী সিম্বল। উপাসনার সময় সামনে আগুন রাখার নিয়ম তাই। বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় আগুনের উপসনা করা হচ্ছে। এইজন্য জরাথুস্ত্রবাদীদের ভুলভাবে অগ্নিউপাসক তকমা দেয়া হয়। আসলে আগুন কেবল জরাথুস্ত্রবাদীদের মধ্যে না। ইন্দো-ইউরোপীয় ধর্মগুলোতেই বিশেষ স্থান দখল করে আছে। হিন্দুধর্মে সকল দেবতার কাছে আহুতি পৌঁছে দেবার জন্য দূতের কাজ করে আগুন।

জরাথুস্ত্রবাদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ আবেস্তা। এর মধ্য দিয়ে বিশ্বাসীগণ দুনিয়ায় অশুভের মধ্যেও টিকে থাকার শক্তি খুঁজে পান। তবে আবেস্তার ইতিহাস খুব একটা সুখের না। গোড়ায় তেমন লেখার প্রচলন ছিলো না; একদল পুরোহিত থাকতো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বাণী প্রচারের জন্য। আলেকজান্ডার পারস্য বিধ্বস্ত করলে লিখিত অনেক অংশই হারিয়ে যায়। পুরোহিতদের মৃত্যুর পর উদ্ধারেরও উপায় থাকতো না। ফলে খ্রিষ্ট পরবর্তী কয়েক শতাব্দী ধরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাণী সংগ্রহ করা হয়। কেবল আবেস্তার বাণী না, টীকা টিপ্পনী সহকারে বিশাল আকার ধারণ করে গ্রন্থ। সূত্র ধরে পুনরুদ্ধার করা আবেস্তাকে বলা হয় জেন্দ-আবেস্তা বা জেন্দাবেস্তা। কিন্তু সেখানেই ইতিহাস থেমে থাকে নি। মুসলমানদের পারস্য বিজয়ের পরে জরাথুস্ত্রবাদীরা কোনঠাসা হয়ে পড়ে। অবদমিত হতে থাকে ধর্মজীবন থেকে। তারপর আসে মোঙ্গল এবং তাতারদের যুগ। মন্দির বিধ্বস্ত হয়, গ্রন্থ পুড়িয়ে ফেলা হয়, পারসিকরা বাধ্য হয় পারস্য ছেড়ে ভারতে চলে আসতে। যারা এখনো টিকে আছে পারসি সম্প্রদায় আখ্যা নিয়ে।

জরাথুস্ত্রবাদী বিশ্বাসের কয়েকটা বৈশিষ্ট্য পরবর্তী একেশ্বরবাদী ধর্মগুলোতেও দেখা যায়। বিশেষ করে শিশুর নিষ্পাপ হয়ে জন্মলাভ করা, মানুষের জীবনে কর্মের স্বাধীনতা, পৃথিবীর ধ্বংস, ধ্বংসের আগে সত্য ও সুন্দরের বিজয়ের জন্য কোন প্রতিশ্রুত চরিত্রের আগমন এবং মৃত্যু পরবর্তী শেষ বিচার ইত্যাদি ইত্যাদি। একদিকে ইন্দো-ইউরোপীয় ধর্ম হবার কারণে ভারতীয় হিন্দুধর্মের সাথে জরাথুস্ত্রবাদের সম্পর্ক গভীর। বেদের ভাষা এবং আবেস্তার ভাষাকে পাশাপাশি রাখলেই সেই প্রমাণ পাওয়া যায়। অন্যদিকে একত্ববাদী ধর্ম হবার কারণে ইবরাহিমি ধর্মগুলোর সাথে সম্পর্ক বিস্ময়করভাবে ঘনিষ্ঠ। সাইরাসের মাধ্যমে ব্যাবিলনের বন্দীদশার সমাপ্তি ঘটার পরে ইহুদিরা পারসিকদের সাথে ঘনিষ্টভাবে মেশার সুযোগ পায়। পরবর্তী ইহুদি জীবনে তার প্রভাব থাকা অসম্ভব না।

পঠিত : ৬৫৪ বার

মন্তব্য: ০