Alapon

ভিন্ন চোখে, ভিন্ন কিছু

ভিন্ন চোখে, ভিন্ন কিছু

লেখা হারাবার মতো কষ্ট পৃথিবীতে দ্বীতিয়টি নেই। একটা লেখার পেছনে কী পরিমাণ মেধা ব্যয় হয়, তা কেবল একজন লেখকই অনুধাবন করতে পারেন। আমি উঁচু স্তরের কোন লেখক নই। খুবই ছোট- খাটো একজন মানুষ। মেধার দিক থেকেও যথেষ্ঠ দুর্বল। তাই আমার কষ্টের পরিমাণটাও বেশি। একজন প্রতিষ্ঠিত লেখকের মতো এক বসাতেই পাঠোপযোগী একটি লেখা তৈরি করে ফেলতে পারি না। আমাকে অনেক খাটতে হয়। হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রম করতে হয়। দীর্ঘ খাটুনি খেটে একটি লেখা কোনরকম দাঁড় করানোর পর যদি সেই লেখাটি হারিয়ে যায়, তখন পুনারায় সেই বিষয় নিয়ে লিখতে বসতে একদমই ইচ্ছা করে না। স্বপ্নধনুর সম্মানেই মূলত পূনরায় লেপটপের কী বোর্ডে হাত বসালাম।

প্রযুক্তির ব্যবহারে সুবিধা যেমন আছে, আছে নানাবিধ অসুবিধাও। আসলে সবকিছুরই ভালো-মন্দ দু’টি দিক থাকে। দীর্ঘ সাধনার পর একটি লেখার পূর্ণতা দেয়ার পর, একটি ভুল ক্লিকে সেই লেখাটি হারিয়ে ফেলা প্রযুক্তির অসুবিধাগুলোর একটি। ডায়েরিতে লিখলে অবশ্য এই ভোগান্তিতে পড়ার তেমন সম্ভাবনা থাকে না। হাতের লেখারও একটু-আধটু চর্চা থাকে। অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করে। অন্তরে প্রশান্তি মেলে।

একটা সময় ডায়েরি-ই ছিলো আমার লেখালেখির প্রধান ভরসা। ডায়েরি বলতে খাতা, প্যাড, কাগজের টুকরাÑÑ এসব উদ্দেশ্য। কিন্তু স্মার্ট ফোন, লেপটপ এসবের উপর নির্ভরশীল হবার পর থেকে ডায়েরী থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছি। এখন খাতা-কলম নিয়ে লিখতে বসাকে সময়ের অপচয় বলে মনে হয়। এভাবেই হয়তো প্রাচীন ঐতীহ্যগুলো একদিন বিল্প্তু হয়ে যাবে।

ডায়েরির পাতায়, মোবাইলের নোটে কিংবা কম্পিউটরের স্ক্রীনে-- কে কোথায় লিখে তৃপ্তি পায়, সেটা বড় কথা নয়। লেখালেখির ধরায় সবচেয়ে বড় কথা হলো, নিয়মিত লেখালেখির সঙ্গে লেগে থাকা। চর্চা অব্যাহত রাখা। আমাদের প্রধান সমস্যা এখানেই। নানান অজুহাতে নিজেকে মূল কাজ থেকে দূরে সরিয়ে রাখি। অজুহাতের মায়াজালে আমরা মূল গন্তব্য থেকেই পথচ্যুত হচ্ছি, সেই অনুভূতিটুকুও আমাদের নেই।

অজুহাতের ক্ষতিকারক দিকগুলো নিয়ে না হয় অন্য দিন বলবো। একজন লেখক হিসেবে এখানে আমার কিছু আশা ও হতাশার কথা বলি-- একজন লেখক হিসেবে যখন আমি মফস্বল মানুষদের সঙ্গে মিশি, তখন আমাকে এক রাশ হতাশা নিয়ে ঘরে ফিরতে হয়। তাদের বই বিমুখতা আমাকে যারপরনাই ভাবিয়ে তুলে। আপামর জনসাধারণ নয়, শিক্ষিত মানুষদের কথা বলছি। নিয়মিত বিদ্যালয়ে যাতায়াত করা, খেলাধূলায় সময় কাটানো, পরিণত বয়সে ভালো একটা চাকুরি-- এটাই তাদের কাছে জীবন। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনার বাইরে নিজের জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করতে যে আরো কিছু পড়াশুনা করা প্রয়োজন, সেই প্রয়োজনীয়তা তাদের কাছে অনুপলব্ধ। দেশ, জাতি, সমাজকে এগিয়ে নিতে জ্ঞানচর্চার বিকল্প নাই। আর সেই জ্ঞান সমৃদ্ধশালী ঠিক তখনই হবে, যখন আমরা বইয়ের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলতে সক্ষম হবো। কিন্তু...।

খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা অর্থাৎ মানুষের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিতদের কথা আর কী বলবো! খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানের পেছনে ছুটে ছুটেই তো তাদের বেলা শেষ, কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে বিদ্যালয়ে যাবার সময় কই তাদের? আর চিকিৎসা! তাদের রোগ-বালাইয়েরই তো ভয় নেই, চিকিৎসার মর্ম বুঝবে কোত্থেকে? ডাস্টবিন যাদের খাবার টেবিল, জিবাণু তাদের খেলার সাথী। গণসচেতনার বাহারি আলাপে তারা বিনোদনের খোরাক পায়। অথচ গভীর অনুসন্ধান চালালে তাদের মাঝে হাজারো প্রতিভার সন্ধান পাওয়া যাবে।

আমি বিশ্বাস করি, আমাদের লেখক ও প্রকাশক মহোদয়গণ যৌথভাবে কিছু ব্যতীক্রমধর্মী উদ্যোগের মাধ্যমে দেশ ও সমাজকে এই অবক্ষয়ের তলানি থেকে টেনে তুলতে অনেকটা সক্ষম হবেন। হ্যাঁ, তার জন্য অবশ্য যথেষ্ঠ কাটখড় পোড়াতে হবে, তা আমি অস্বীকার করছি না। তারপরও বলবো, আমাদের লেখক সমাজের পক্ষ থেকে দেশের মানুষদের জন্য আরো ভালো কিছু হওয়া উচিৎ।

তাই মহান বইমেলাকে সামনে রেখে বলতে চাই, আসুন! বইবিমুখ মানুষদের বইমুখি করতে এবং বঞ্চিতদের হৃত অধিকার ফিরিয়ে দিতে আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই। খাঁটি মনে চাইলে সবই সম্ভব। শুধু যথাযথ উদ্যোগের অভাব। এ ব্যাপারে আমার ক্ষুদ্র ভাবনা থেকে ছোট্ট একটি খসড়া উপস্থাপন করছি:-
১.প্রতি জেলায় জেলায় পথশিশুদের প্রতিভা যাঁচাইয়ের লক্ষ্যে একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করা। প্রতিযোগীতায় যারা উত্তীর্ণ হবে, তারা পূর্ণ প্রতিষ্ঠিত হওয়া পর্যন্ত তাদের যাবতীয় ব্যায়ভারের দায়িত্ব গ্রহণ করা।

২.বিশ্বসাহিত্যকেন্দ্রের অনুকরণে বাংলার প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় বই নিয়ে মহড়া দেয়া। জানি, পাঠকদের সাড়া না পেলে কাজটি যথেষ্ঠ কষ্টসাধ্য হবে। তবে যেন সবাই বইপাঠে আগ্রহী হয় সে ব্যাপারে তাদেরকে মোটিভেট করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা।

৩.কন্টেনধর্মী যে সকল বই লেখা হয়, সে বইগুলো বিনামূল্যে হলেও ভুক্তভোগিদের হাত পর্যন্ত পৌছানোর চেষ্টা করা। মাদক, ধর্ষণ, সুদ, ঘুষ, পর্দা, নাস্তিক্যবাদ-- কত বিষয় নিয়েই তো বই লেখা হয়। কিন্তু লেখাটা যাদেরকে পূঁজি করে তৈরি করা হয়, তাদের পর্যন্ত পৌঁছানোর কি কোন ব্যবস্থা করা হয়? হয় না। তাহলে আমার লেখার সার্থকতা কোথায়? এই জন্য বলি, বিনামূল্যে হলেও নির্দিষ্ট কিছু কপি তাদের পর্যন্ত পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা উচিৎ।

৪.পাঠক বৃদ্ধির জন্য মাসব্যাপী বইপাঠের প্রতিযোগিতার আয়োজন করা।

৫.প্রকাশকদের যৌথ উদ্যোগে দেশের প্রতিটি ইউনিয়নে একটি করে পাঠাগার নির্মাণ করা। সবচেয়ে ভালো হয়, বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে শক্তিশালী পদক্ষেপ গ্রহণ করলে। তাহলে কাজটিতে সফল হওয়া যথেষ্ঠ সহজ হবে।

বইকে কেন্দ্র করে দেশে এমন কিছু হোক, আমি সবসময়ই কামনা করি। তাই ভেতরের চাওয়াগুলোকে প্রস্তাব আকারে উপস্থাপন করলাম। আমার প্রস্তাবের সঙ্গে সবার একমত হওয়া জরুরি না। তবে আমার বিশ্বাস, অবজ্ঞা করার মতো এখানে একটি কথাও বলিনি। আপন আপন জায়গা থেকে বিষয়গুলো ভেবে দেখা যেতে পারে।

পঠিত : ৪৩১ বার

মন্তব্য: ২

২০২১-০১-২৭ ১৮:০৫

User
ওয়ালী উল্লাহ নোমানী

প্রস্তাবগুলোর ব্যাপারে কার কি মতামত? মন্তব্য করে জানাবেন

submit

২০২১-০১-২৮ ১৫:১৪

User
তেপান্তর :

ভালো ব্লেছেন, কিন্তু, সকলে ত মতামত দিতে পারবেনা, কারন সকলে ত আর ব্লগে আইডি নেই। মন্তব্য সবাই করতে পারেনা ব্লগে,

submit