Alapon

বাংলায় প্রথম খিলাফত প্রতিষ্ঠার আন্দোলন



আজ ২৮ জানুয়ারি। বাংলার প্রথম খিলাফত প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের রূপকারের আজ মৃত্যদিবস। আজ থেকে প্রায় ১৮১ বছর আগে হাজী শরিয়তুল্লাহ ইন্তেকাল করেন। কুরআনের নির্দেশ অনুসারে নিজস্ব সংগ্রামের ফল ব্যতীত মানুষের আর কিছুই নেই, তাই আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে ঘোষণা করা হয় যে, যিনি জমি চাষ করেন তার উৎপাদিত ফসলের ওপর চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অধীনে সৃষ্ট জমিদারদের কোন অধিকার নেই। হাজী শরীয়তুল্লাহ তার অনুসারীদেরকে নির্দেশ দেন যে, হিন্দু প্রতিবেশীদের বহু ঈশ্বরবাদী পূজা উৎসবে অংশ নেওয়া যাবে না। জমিদার কর্তৃক তাদের ওপর আরোপিত কোন ধরনের ফসলী-করও প্রদান করা যাবে না। সরকার কর্তৃক নির্ধারিত আইনানুগ রাজস্বই কেবল প্রদান করা যাবে। এই নীতি সদ্য সৃষ্ট হিন্দু ভূ-স্বামিগণকে শরীয়তুল্লাহর আন্দোলনের বিরোধিপক্ষ হিসেবে প্রকাশ ঘটায়। হিন্দু ভূ-স্বামিগণ কৌশলে রক্ষণশীল মুসলিম কৃষকসহ তাদের পৃষ্ঠপোষক শক্তিসমূহকে একত্রিত করেন এবং নীলকরদেরকেও তাদের অন্তর্ভুক্ত করেন। এভাবে ১৮৪০ সালের দিকে উভয় পক্ষ ক্রমশ সংঘর্ষের দিকে এগিয়ে যায়।

ইংরেজরা বাংলা দখলের পর বাংলার মুসলিমরা ব্যাপক অত্যাচার ও নির্যাতনের মুখোমুখি হয়। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় মুসলিমদের শিক্ষাব্যবস্থা। মুসলিমদের সবক'টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়। মুসলিম পণ্ডিত ও বিদ্বান ব্যাক্তিদের হত্যা করা হয়। সেসময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যা মাদরাসা নামে পরিচিত ছিলো সেখানে ধর্মীয় জ্ঞানের পাশাপাশি জাগতিক জ্ঞান চর্চাও সমানতালে হতো। কিন্তু ইংরেজরা বুঝতে পেরেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু থাকলে মুসলিমদের জাতিসত্তা টিকে থাকবে। তাই তারা মুসলিমদের শিক্ষাগ্রহণ বন্ধ করে দেয়। এভাবে দুই দশকের মধ্যেই বাঙালি শিক্ষার আলো থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একটি অন্ধকারচ্ছন্ন ও পশ্চাতপদ গোষ্ঠীতে পরিণত হয়।

এছাড়াও তারা মুসলমানদের হাত থেকে খাজনা আদায়ের তারা প্রজাদের উপরে শুরু করলো নির্মম শোষণ-পীড়ন। ব্রিটিশ নিম্নমানের বস্ত্রের বাজার সৃষ্টির জন্যে বাঙালি তাঁতীদের নির্মূল করার কাজ শুরু হলো। তাদের আঙ্গুল কেটে দেওয়া হয় যাতে তারা তাঁত চালাতে না পারে। ১৭৬৬ সালে প্রতিমণ লবণের উপর দু’টাকা হারে কর ধার্য করে লবণ ব্যবসা ইউরোপীয়দের একচেটিয়া অধিকারে নেয়া হলো। এভাবে মুসলমানরা সকল অর্থনৈতিক ক্ষেত্র থেকে বিতাড়িত হয়ে দারিদ্র্যে নিষ্পেষিত হতে লাগলো। আমাদের শিক্ষা, শিল্প ও অর্থনীতি পুরোপুরি পঙ্গু হয়ে যায়।

শুধু তাই নয়, ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালনেও মুসলমানরা বাধাগ্রস্ত হতে লাগলো। অত্যাচারী হিন্দু জমিদারদের এলাকায় গো-কুরবানী এবং আজান দেয়া নিষিদ্ধ হলো। হিন্দু জমিদারগণ মুসলমান প্রজাদের দাড়ির উপরে ট্যাক্স ধার্য করলো। তাদের পূজা-পার্বণে মুসলমানদেরকে চাঁদা দিতে, পূজার যোগন ও বেগার দিতে বাধ্য করা হলো। মুসলমানদেরকে ধূতি পরতে ও দাড়ি কামিয়ে গোঁফ রাখতে বাধ্য করা হলো। মুসলমানদের ধর্ম, তাহজিব-তমদ্দুনকে ধ্বংস করে হিন্দুজাতির মধ্যে একাকার করে ফেলার এক সর্বনাশা পরিকল্পনা শুরু হলো। ধর্মপ্রাণ মুসলমান হয়ে উঠলো দিশেহারা। এর মধ্যে পর্যাপ্ত ধর্মীয় জ্ঞান না থাকায় মুসলিমরা হিন্দুদের অনুকরন করতে শুরু করে। মুসলিমদের মধ্যে প্রচুর শিরকি ও বিদআতি কর্মকাণ্ড পরিলক্ষিত হয়।

বাংলার মুসলমানদের এ চরম দুর্দিনের সময় ১৮২০ সালে ফরায়েজি আন্দোলনের সূচনা করে হাজী মুহাম্মদ শরিয়তুল্লাহ। তিনি ১৭৮৪ সালে ফরিদপুর জেলার বন্দর পরগণায় জন্মগ্রহণ করেন হাজী শরীয়তুল্লাহ। হাজি শরীয়তউল্লাহ ইসলামের পাঁচটি মৌল আদর্শের উপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করেন। তাওহীদে পরিপূর্ণ বিশ্বাস ও পূর্ণ অনুশীলনের উপর তিনি জোর দেন এবং মূল বিশ্বাস বা মতবাদ থেকে যে কোন বিচ্যুতিকে তিনি ‘শির্ক’ ও ‘বিদাত’ বলে ঘোষণা করেন। জন্ম, বিবাহ ও মৃত্যুর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বহুসংখ্যক আচার অনুষ্ঠান যেমন ছটি, পট্টি, চিল্লা, শাবগাস্ত মিছিল, ফাতিহা, মিলাদ ও ওরস নিষিদ্ধ করেন। পীরপূজা, পীরের প্রতি অতিশ্রদ্ধা প্রদর্শন, মহরমে তাজিয়া নির্মাণকেও শির্ক বলে ঘোষণা করেন। তিনি ন্যায়বিচার, সামাজিক সাম্য এবং মুসলমানদের সার্বজনীন ভ্রাতৃত্বের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন এবং সর্বপ্রকার সামাজিক বৈষম্য ও বর্ণগত কুসংস্কার বিলোপ সাধনের তত্ত্ব প্রচার করেন।

হাজী শরীয়তউল্লাহ বাংলায় ব্রিটিশ শাসনকে মুসলমানদের আধ্যাত্মিক জীবনের জন্য ক্ষতিকর বলে বিবেচনা করতেন। হানাফি আইনের অনুসরণে তিনি মত প্রকাশ করেন যে, বাংলায় বৈধভাবে নিযুক্ত একজন মুসলিম শাসকের অনুপস্থিতি মুসলমানদের জুমআর নামাজের জামায়াত অনুষ্ঠানের সুযোগ হতে বঞ্চিত করেছে। এ মত ছিল ফরায়েজী আন্দোলনের একটি ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য যা একে ওই সময়ের অপরাপর পুনর্জাগরণবাদী আন্দোলন থেকে আলাদা করে তুলেছে।

দিল্লীতে শাহ্ আবদুল আযীয দেহলভীর নেতৃত্বে ভারতভূমিতেও আবদুল ওহাব নজদীর অনুকরণে ইসলামী সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়, যা ‘ওহাবী আন্দোলন’ নামে পরিচিত ছিলো। তিনি ভারতবর্ষকে ‘দারুল হরব’ বলে ঘোষণা করেন এবং ‘দারুল হরব’কে ‘দারুল ইসলাম’ তথা একটি ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করার সক্রিয় আন্দোনে আত্মনিয়োগ করেন। সাইয়্যেদ আহমদ বেরেলভী, শাহ্ আবদুল আযীযের ভ্রাতুষ্পুত্র শাহ ইসমাইল ও জামাতা মাওলানা আবদুল হাই। হাজী শরীয়তুল্লাহও এ দেশকে ‘দারুল হরব’ ঘোষণা করেন এবং যতোদিন এ দেশ ‘দারুল ইসলাম’ না হয়েছে ততোদিন এখানে ‘জুমা’ ও ঈদের নামাজ সংগত নয় বলে ঘোষণা করেন। হিন্দুর পূজা-পার্বণে কোন প্রকার আর্থিক অথবা দৈহিক সাহায্য-সহযোগিতা ইসলাম-বিরুদ্ধ (শিরক ও হারাম) বলে অভিহিত করেন। তিনি আরও বলেন, মুসলমানদেরকে ধূতি ছেড়ে তহবন্দ-পায়জামা পরিধান করতে হবে, দাড়ি রাখতে হবে এবং সকল প্রকার কুসংস্কার থেকে তওবা করতে হবে। মোটকথা যাবতীয় পাপকাজ পরিত্যাগ করে নতুনভাবে ইসলামী জীবন যাপন করতে হবে।

শোষিত-বঞ্চিত ও নিষ্পেষিত মুসলমান জনসাধারণ হাজী শরীয়তুল্লাহর আহবাদে নতুন প্রাণসঞ্চারণ অনুভব করলো এবং দলে দলে তাঁর কাছে দীক্ষা গ্রহণ করতে লাগলো। অল্প সময়ের মধ্যে দশ হাজার মুসলমান তাঁর দলভুক্ত হলো। এটা হলো হিন্দু জমিদারদের পক্ষে এক মহাআতংকের ব্যাপার। এখন মুসলমান নিগ্রহ ও নিষ্পেষণ বন্ধ হয়ে যাবে এবং যেসব নিম্নশ্রেণীর দরিদ্র মুসলমানদেরকে তারা তাদের দাসানুদাসে পরিণত করে ইসলাম ধর্ম থেকেও দূরে নিক্ষেপ করেছে, তারাও তাদের হাতছাড়া হয়ে যাবে। অতএব, তাদের উদ্বিগ্ন ও আতংকিত হয়ে উঠারই কথা।

হাজী শরীয়তুল্লাহ্কে দমন করার জন্যে ঐক্যবদ্ধ ও বদ্ধপরিকর হলো হিন্দু জমিদারগণ। তাঁদের দলে যোগদান করলো কিছু সংখ্যক স্বার্থান্বেষী আধা-মুসলমান যারা ছিল হিন্দু জমিদারদের দাসানুদাস। অদূরদর্শী মোল্লা-মৌলভী ও পীর, যারা মুসলমানদের মধ্যে শিরক বিদয়াত প্রভৃতি কুসংস্কারের নামে দু’পয়সা কামাই করছিল, তারাও ফরায়েজী আন্দোলনের বিরুদ্ধে দাঁড়ালো। একদিকে ব্রিটিশ এবং অপরদিকে অত্যাচারী হিন্দু জমিদার মহাজনদের উপর্যুপরি অত্যাচার-নিষ্পেষণে মুসলমানরা অনন্যোপায় হয়ে মাথানত করে সবকিছু সহ্য করে যাচ্ছিল। শরীয়হতুল্লাহর আহ্বানে নিপীড়িত মুসলমানগণ দলে দলে তাঁর কাছে এসে জমায়েত হতে লাগলো এবং ব্রিটিশ ও হিন্দুদের বিরুদ্ধে এক দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলার শপথ গ্রহণ করলো।

হাজী শরিয়ত উল্লাহ ফরজের উপর বেশি গুরুত্বারোপ করেছিলেন বলেই ওনার ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন ফরায়েজি নাম লাভ করে। তিনি যাবতীয় ইসলাম বিরোধী রীতিনীতি পরিত্যাগ করে নবী মুহাম্মদ সা. প্রতিষ্ঠিত ইসলামের বিরোধী রীতিনীতি পরিত্যাগ করে নবী মুহম্মদের সা.-এর প্রতিষ্ঠিত ইসলামের পুনঃপ্রতিষ্ঠাই ছিল আরবের মুহাম্মদ বিন আবদুল ওহাব নজদী, সাইয়্যেদ আহমদ শহীদ, হাজী শরীয়তুল্লাহ, সৈয়দ নিসার আলী ওরফে তীতুমীর প্রমুখ মনীষীদের আন্দোলনের মুখ্য উদ্দেশ্য। এটিই ছিলো বাংলায় প্রথম ইসলামী আন্দোলন তথা খিলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। এই আন্দোলন মুখ্যত ইংরেজবিরোধী না হলেও এর ফলে মুসলিমরা আত্মসচেতন হয়ে উঠেছে যা শাসকরা ভালো চোখে দেখেনি। মুসলিমদের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সচেতনতাই পরবর্তীতে ইংরেজবিরোধীতায় রূপ নেয়।

ঢাকা জেলার নয়াবাড়ী নাম স্থানে প্রথমে শরীয়তুল্লাহর নতুন কর্মক্ষেত্র স্থাপিত হয়। কিন্তু হিন্দু জমিদারদের চরম বিরোধিতার ফলে তাঁকে আপন গ্রামে ফিরে গিয়ে তাঁর প্রচারকার্য শুরু করতে হয়। তাঁর আন্দোলন ঢাকা, বরিশাল, নদীয়া, পাবনা, ময়মনসিংহ প্রভৃতি জেলায় বিস্তার লাভ করে। নিরক্ষর, চাষী, তাঁতী ও অন্যান্য সাধারণ মুসলমানদের নামাজ-রোজার প্রচলন, ধুতির পরিবর্তে তহবন্দ-টুপির ব্যবহার, মসজিদগুলির সংস্কার প্রভৃতি কাজ পূর্ণ উদ্যমে চলতে থাকে। হাজী শরীয়তুল্লাহ্ নিজে মাথায় প্রকাণ্ড পাগড়ী ও গায়ে জামার উপরে হুদরিয়া পরতেন যে পোশাক সাধারণত: কোন মুসলমান ব্যবহার করতো না। ১৮৪০ সালের ২৮ জানুয়ারি তিনি পরলোক গমন করার পর তাঁর যোগ্য পুত্র দুদু মিয়া তাঁর আন্দোলন অব্যাহত রাখেন।

পঠিত : ৪১৫ বার

মন্তব্য: ০