Alapon

চীন ও ভারতের কাছে মিয়ানমার এত গুরুত্বপূর্ণ কেন!

চীন ও ভারতের কাছে মিয়ানমার এত গুরুত্বপূর্ণ কেন!

সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে,রোহিঙ্গা ইস্যু সহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের আরো নানাবিধ বিতর্কিত ইস্যুতে ভারত ও চীনের একতরফা সমর্থন পেয়ে এসেছে মায়ানমার। অথচ মায়ানমারের এমন বেপরোয়া কর্মকান্ডে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ দেশ বাংলাদেশ কিন্তু ভারত ও চীনের কৌশলগত মিত্র হিসেবেই পরিচিত।

আবার ভারত ও চীনের বর্তমান সম্পর্ক দা - কুমড়া সম্পর্কের মতো। এই সমীকরণে এসে বলা যায়,রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীন ও ভারতের মধ্যে একটি দেশ বাংলাদেশকে আর আরেকটি দেশ মায়ানমারকে সমর্থন দিলে একটা ব্যালেন্স হতো।

কিন্তু কোনো প্রকার ব্যালেন্সের তোয়াক্কা না করে ভারত ও চীন দুইটি দেশই মিয়ানমারকে সবসময় সমর্থন দিয়ে আসছে। মায়ানমারের প্রতি চীন ও ভারতের এমন ঝুঁকে পড়া কি এমনি এমনি নাকি কৌশলগত স্বার্থ রয়েছে দেশ দু'টির?

দক্ষিণ এশিয়া ও পূর্ব এশিয়ার মিলনস্থলের দেশ বলা যায় মায়ানমারকে। মায়ানমার তার ভৌগোলিক অবস্থানের জন্য ভারত ও চীন দুইটি দেশের কাছেই সম গুরুত্বপূর্ণ।


→ ভারতের কাছে মায়ানমারের গুরুত্বঃ

১…

ভারতের ভৌগোলিক অস্থিরতাঃ

বৈচিত্র্যময় দেশ ভারত। ভারতের বাদবাকি অংশের সাথে 'সেভেন সিস্টার্স ' নামে খ্যাত পূর্বাঞ্চলীয় ৭ টি রাজ্যের ভাষা, ধর্ম, সংষ্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্যের কোনোরকম মিল নাই। এমনকি ব্রিটিশ আমলের আগে কোনোদিন পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো দিল্লীর অধীনে ছিলো না। ব্রিটিশরা সর্বপ্রথম ১৮২৬ সালে আসাম'কে ভারতবর্ষের সাথে সংযুক্ত করতে সক্ষম হয়।

১৯৪৭ সালের পর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার হিসেবে পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর নিয়ন্ত্রণ পায় ভারত। 'সেভেন সিস্টার্স ' এর অন্তর্গত রাজ্যগুলো হলোঃ

*আসাম;
*মেঘালয়;
*ত্রিপুরা;
*অরুণাচল;
*নাগাল্যন্ড;
*মণিপুর ;
*মিজোরাম।

এই সাতটি রাজ্যের সাথে ভারতের অন্যান্য অংশের যোগাযোগ রক্ষা হয় শিলিগুড়ি করিডোর দিয়ে। প্রস্থে ২১ থেকে ৪০ কিলোমিটারের মতো এই করিডোরটি পরিচিত 'চিকেন'স নেক ' নামে। অর্থাৎ এই বরাবর শক্ত করে বাইরের শক্তি আঘাত হানলে ভারতের প্রাণবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হবে পুরোপুরি।

আবার,সমগ্র ভারত হিন্দু মেজরিটি হলেও 'সেভেন সিস্টার্স ' এর রাজ্যগুলো মূলত খ্রিস্টান মেজরিটি সম্পন্ন। মিশনারীদের মাধ্যমে মণিপুর,মিজোরাম, নাগাল্যান্ড,মেঘালয়ের বেশিরভাগ উপজাতি-ই বর্তমানে খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত। আবার আসামে মুসলিম জনসংখ্যা এখন অর্ধেকের সন্নিকটে। ফলে ধর্মের দিক দিয়ে এই অঞ্চলটি ভারতের জন্য চ্যালেঞ্জিং বটে।

এছাড়াও সেভেন সিস্টার্স এর রাজ্যগুলোতে সবসময়-ই বিচ্ছিন্নতাবাদের আতংক রয়েছে দিল্লির কাছে। আসামভিত্তিক স্বাধীনতাকামী সংগঠন উলফা'কে নিষ্ক্রিয় করতে বহু সময় এবং শক্তি খরচ হয়েছে দিল্লির। এছাড়াও মিজোরাম, নাগাল্যান্ড,মণিপুর ঘিরে তৎপর রয়েছে বেশ কিছু স্বাধীনতাকামী সংগঠন।

অর্থাৎ বলা যায়, ভৌগোলিক অবস্থান, ধর্ম, বিচ্ছিন্নতাবাদের ইতিহাস সব মিলিয়ে পূর্ব ভারতীয় রাজ্যগুলো সবসময়ই ভারতীয় জাতীয় নিরাপত্তার জন্য চ্যালেঞ্জিং হিসেবে রয়ে গেছে।

পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি রাজ্যের উপর দিল্লির একক আধিপত্য বজায় রাখা এবং সমস্ত স্বাধীনতাকামী আন্দোলনকে স্তব্ধ করতে হলে ' সেভেন সিস্টার্স ' -এর সাথে দিল্লির নির্বিঘ্ন ও সহজতম রুটে যোগাযোগের কোনো বিকল্প নাই। কিন্তু শুধুমাত্র ৪০ কিলোমিটার প্রস্থের সরু এবং পাহাড়ী শিলিগুড়ি করিডোর এর উপর নির্ভর করে বসে থাকাটা দিল্লিকে পূর্ণ স্বস্তি এনে দিতে সক্ষম হবে না।

২…

** সেভেন সিস্টার্সের সাথে দিল্লীর সহজতম যোগাযোগের রুট হলো বাংলাদেশ অথবা মায়ানমার। এই দুই দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অপেক্ষা মায়ানমার কেনো ভারতের পছন্দের তালিকায়?

ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য গুলোর সাথে বাংলাদেশের মাধ্যমে সহজে যোগাযোগ স্থাপন করা যায়। কলকাতা থেকে বাংলাদেশের বেনাপোল হয়ে ঢাকা এবং সিলেটের উপর দিয়ে সহজেই ভারতের আসাম সহ অন্যান্য পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে যাতায়াত করা যায়।

কিন্তু ভারতের সাথে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক কিছু অবস্থানে এসে ভারতীয় স্বার্থের প্রতিকূলে চলে গেছে। যেমনঃ

★ পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য গুলোর সাথে ভারতকে করিডোর দিলে বাংলাদেশ তখন ভারতের থেকে চাইবে ভুটান এবং নেপালের সাথে বাংলাদেশের নিরবিচ্ছিন্ন যোগাযোগ স্থাপনের জন্য করিডর। আর ভারত যদি বাংলাদেশ কে এই করিডর দেয় বাংলাদেশ সহজে স্বল্প দূরত্বের ভুটান এবং নেপালের সাথে সড়ক এবং রেলপথে সংযোগ স্থাপন করতে পারবে। আর উদীয়মান অর্থনীতির দেশ বাংলাদেশ তখন নেপাল এবং ভুটানে থাকা ভারতীয় বাণিজ্যে ভাগ বসাতে পারবে। ভারত কি এত সহজে নিজ বাণিজ্যে অন্য কাউকে প্রবেশ করতে দিবে!

★ ভারত সরকার এনআরসি এবং সিএএ - এর মাধ্যমে আসাম এবং পশ্চিমবঙ্গের বেশকিছু জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশি হিসেবে আখ্যায়িত করে বাংলাদেশে পাঠানোর একটি পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। ভারতের এমন পরিকল্পনায় স্বাভাবিকভাবেই ক্ষুব্ধ ঢাকা। আর তাই ২০১৯ সালের শেষদিকে ভারতে মন্ত্রী পর্যায়ের বেশকিছু সফর বাতিল করা হয় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে। তাই ভারত মনে করে বাংলাদেশের


মধ্য দিয়ে যদি তারা একটি যোগাযোগের রুট তৈরি করে তবে যেকোনো উত্তেজনাকর মুহূর্তে বাংলাদেশে এর সুযোগ গ্রহণ করলেও করতে পারে।

৩…

ঝঞ্জাটমুক্ত রুট মায়ানমার!

পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি রাজ্যের সাথে যোগাযোগের জন্য দিল্লির কাছে বাংলাদেশ ব্যতীত অন্য আরেকটি সহজ মাধ্যম হলো মায়ানমার। কলকাতা থেকে সমুদ্রপথে মায়ানমারের সিওটা বন্দর হয়ে সহজে ভারতীয় ভূখণ্ড মিজোরামে প্রবেশ করা যাবে। … (ইমেজঃ ১)

আর মায়ানমারের অর্থনীতি যেহেতু এত উদীয়মান নয় তাই তারা ভারতের কাছে নেপাল-ভুটানে যাওয়ার জন্য কোন রুট চাইবে না। এছাড়াও ভারত মায়নামারের সাথে যে রুট তৈরি করছে তা পরবর্তীতে বৃদ্ধি পেয়ে থাইল্যান্ড হয়ে দক্ষিণ চীন সাগর পর্যন্ত পৌঁছাবে। ( কিন্তু বাংলাদেশের সাথে পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য গুলোর রুট তৈরি করলে ভারত থাইল্যান্ড এবং দক্ষিণ চীন সাগর পর্যন্ত পৌঁছাবার সুযোগ পেত না।)

ভারত - মায়ানমার - থাইল্যান্ড কেন্দ্রীক এই প্রস্তাবিত নতুন বাণিজ্যিক রুটের নাম হলো ' দি এমআইটি হাইওয়ে '।
এই এমআইটি হাইওয়ে টি বাস্তবায়ন করা গেলে ভারতের একসাথে দুইটি লক্ষ্য অর্জিত হবে।

* ভারত তার পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য গুলোর সাথে সহজে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারবে ;

* ভারত থাইল্যান্ডের মাধ্যমে দক্ষিণ চীন সাগরে ও সহজে পৌঁছাতে পারবে।

৪…

ভারতের এমন মহাপরিকল্পনায় নেই বাংলাদেশ! ঢাকার ভাবনা কি?

ভারত মায়ানমার থাইল্যান্ড কেন্দ্রিক প্রস্তাবিত এমআইটি হাইওয়ে আরো গুরুত্বপূর্ণ হতো যদি এতে বাংলাদেশ সংযুক্ত হতো। কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবে ঢাকাকে এড়িয়ে এই বাণিজ্যিক রুটি নকশা প্রস্তাব করা হয়েছে।

তবে ঢাকা বারবারই দিল্লির কাছে আবেদন জানিয়েছে তারা এ রুটিতে যুক্ত হতে চায়। ঢাকার মতে, রুটটি ঢাকার মধ্য হয়ে গেলে পথ আরো সহজতর হবে এবং পরিবহন খরচ অনেক কম হবে। এ লক্ষ্যে ঢাকা " বিসিআইএম ইকোনমিক করিডোর" এর প্রস্তাব করে। বাংলাদেশের প্রস্তাবিত রুটে অবশ্য চীন ও সংযুক্ত আছে।
গত সপ্তাহে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের প্রথম ভারত সফরের সময়ও তিনি ভারত - মায়ানমার - থাইল্যান্ড ইকোনমিক করিডোরে বাংলাদেশকে যুক্ত করার জন্য ভারতের নিকট দাবী জানান। তবে ভারত বরাবরই বাংলাদেশের এই দাবির প্রতি নির্লিপ্ততা দেখিয়ে আসছে।

অতএব বলা যায় নিজ ভূখণ্ডের সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে এবং পূর্ব এশিয়ায় নিজের রাজনৈতিক প্রভাব বাড়াতে ভারতের কাছে মায়ানমারের গুরুত্ব অপরিসীম!

★★★★★

→ চীনের কাছে মায়ানমারের গুরুত্বঃ

1…

দক্ষিণ চীন সাগরে রেষারেষিঃ

চীনের প্রায় সব বাণিজ্যিক শহর এবং বন্দর দেশটির পূর্ব অঞ্চলে অবস্থিত। আর এই বরাবরই রয়েছে দক্ষিণ চীন সাগর। বহি বিশ্বের যেকোন প্রান্তে পৌঁছার জন্য চীনের কাছে একমাত্র মাধ্যম হলো দক্ষিণ চীন সাগর।

দক্ষিণ চীন সাগরের পার্শ্ববর্তী চীন ছাড়া অন্যান্য দেশঃ

*মালেশিয়া ;
*ব্রুনাই;
*থাইল্যান্ড ;
*ভিয়েতনাম ;
*ফিলিপাইন ;
*তাইওয়ান ;
*হংকং।

দক্ষিণ চীন সাগরের সীমানা নিয়ে উপরোক্ত সবগুলো দেশের সাথে চীনের চরম বিরোধ রয়েছে। চীন এবং উপরিক্ত দেশগুলোর এই সমুদ্রসীমা বিরোধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীন বিরোধী অবস্থান নিয়ে চীনকে চাপে রেখেছে। আর তাই দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের অবস্থান এখন চ্যালেঞ্জের মুখে।

গত দু দশক ধরে চীনের ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ বাণিজ্য সমুদ্রপথে হচ্ছে। সেই বাণিজ্য মালাক্কা প্রণালী দিয়ে হয় এবং চীন জানে যে তার সাথে শত্রুভাবাপন্ন দেশ যুক্তরাষ্ট্র এবং তার আঞ্চলিক মিত্ররা চাইলেই চীনের বাণিজ্য বন্ধ করে দিতে পারে। এটাকেই বলে চীনের মালাক্কা সংকট। আর তাই চীন চাচ্ছে দক্ষিণ চীন সাগরের উপর নির্ভরতা কমাতে এবং বিকল্প কিছু বাণিজ্যিক রুট তৈরি করতে।

2…

চীনের ভাবনায় রয়েছে দুটি বাণিজ্যিক রুট।

★ পশ্চিমাঞ্চলীয় রুট। যা চীনের কাশগড় থেকে পাকিস্তানের গোয়াদর বন্দর হয়ে আরব সাগরে পৌঁছবে।

★ পূর্বাঞ্চলীয় রুট। যা চীনের কুনমিং হতে মায়ানমারের আরাকান (রাখাইন) হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিলিত হবে।

বিকল্প এই দুইটি রুট এর মধ্যে পূর্বাঞ্চলীয় রুটের গুরুত্ব চীনের জন্য সর্বাধিক। কেননা চীনের গুরুত্বপূর্ণ সব শহর এবং বন্দর চীনের পূর্ব সীমান্তে অবস্থিত। চিনের এই পূর্বাঞ্চলীয় রুটটি বাস্তবায়ন করতে গেলে মায়ানমারের কোনো বিকল্প চীনের কাছে নাই।
আর চীনের সাথে যেহেতু বাংলাদেশের কোনো সীমান্ত সংযোগ নাই,সেহেতু মায়ানমারের তুলনায় চীনের কাছে বাংলাদেশের প্রায়োরিটি খানিকটা হলেও কম হবে।

মালাক্কা প্রণালী এবং দক্ষিণ চীন সাগরের বিতর্কিত সমুদ্রসীমা এড়িয়ে নির্বিঘ্নে বাণিজ্য করতে হলে চীনের কাছে মায়ানমারের কোনো বিকল্প নাই!


একদিকে ভারত অপরদিকে চীন, রয়েছে সাথে বিশাল সমুদ্র সীমা মায়ানমারের। ভৌগোলিক এমন চাকচিক্যময় অবস্থান - ই মায়ানমারকে করে তুলেছে ভারত এবং চীনের কাছে ব্যাপক গুরুত্বপূর্ণ। বোনাস হিসেবে মায়ানমার তাই পেয়েছে বেপরোয়া আচরণের সুযোগ!


-সাইফুদ্দিন আহমাদ

পঠিত : ৪১০ বার

মন্তব্য: ০