Alapon

|| হাসান আল বান্না (রাহিমাহুল্লাহ)||

'জাতীয়তাবাদ যদি দেশপ্রেম হয় তাহলে ইসলামি নীতির দিক দিয়ে কোন আপত্তি নেই। কিন্ত জাতীয়তাবাদের উদ্দেশ্য যদি হয় প্রাক ইসলামী মূল্যবোধের পুনর্জীবন তাহলে সেটা কোন ভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়'- হাসান আল বান্না।

মিসর তথা পুরো মুসলিম দুনিয়াকে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদ থেকে রেহাই দিতে তিনি মুসলিম সমাজকে নিয়ে ঘুরে দাড়াবার স্বপ্ন দেখেছিলেন। আধুনিক মুসলিম চিন্তার জগতে তখন অনেকেই প্রভাব ফেলেছিলেন। কিন্তু হাসান আল বান্নার প্রভাবটা ছিলো ভিন্নরকমের। তিনি সব বিশিষ্ট চিন্তাভাবনাকে একটি রাজনৈতিক রুপ দিতে পেরেছিলেন। মুসলিম ভাব জগতে যারা প্রভাব ফেলেছিলেন হাসান আল বান্না তাদের সেই বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তাভাবনাকে চমৎকার নেতৃত্ব গুনে একটি জনপ্রিয় আন্দোলনে পরিণত করেন। যে আন্দোলন সারা দুনিয়ায় রাজনীতিতে ইসলামের ভূমিকাকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলে।


সেই সময় যখন পশ্চিমাদের সেকুলার সংস্কৃতি মিসরের ইসলামী সংস্কৃতিকে প্রান্তিক অবস্থানে ঠেলে দিচ্ছিলো তখনই শুরু হয়েছিলো হাসান আল বান্নার কাজ। এই বিরূপ আবহাওয়ায় হাসান আল বান্না গড়ে তুলেন এমনই এক সংগঠন যেটা তখন মিসরকে নিয়ে ঘুরে দাড়াবার স্বপ্ন দেখেছিলো।

মিসরের মাহমুদিয়া নামক গ্রামে ১৯০৬ সালের ১৪ অক্টোবর জন্ম গ্রহণ করেন হাসান আল বান্না। ছোটবেলায় মুফতি আবদুহুর কাছে বেশ কয়েকদিন লেখাপড়া চালিয়ে যান বান্না। সংস্কারমুখী ধর্মীয় পরিবেশে বেড়ে উঠা বান্না তের বছর বয়সে সুফী ধারার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে যান ফলে এই সুফী ধারা তার পরবর্তী জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখে।

বান্নার কর্মজীবনের শুরু হয় 'ইয়ং ম্যানস মুসলিম এসোসিয়েশন' (YMMA) নামক সংগঠনটি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। এই সংগঠনের কাজ ছিলো মুসলিমদের মাঝে জাগরণ সৃষ্টি করা, ইসলামী নৈতিকতার উপর জোর দেওয়া, আধুনিক প্রযুক্তি আয়ত্ত করার উপর বিশেষ নজর দেওয়া। এই সংগঠন দিয়েই হাসান আল বান্না মিসরের সমাজকে পশ্চিমীকরণ প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে প্রথম আওয়াজ তুলেন। YMMA প্রতিষ্ঠার পর বৃহত্তর স্বার্থে কয়েকমাস পরেই হাসান আল বান্না ইখওয়ানুল মুসলেমুন প্রতিষ্ঠা করেন।

মিসরের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য হাসান আল বান্না মনে করতেন জনগণকে কোরআন ও সুন্নাহর নীতির দিকে ফিরে আসতে হবে। সেই লক্ষে তিনি প্রচুর দাওয়াহ কাজ চালিয়ে যেতেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলো কফি শপে গিয়ে ইসলাম প্রচার। কফি শপে মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকার প্রস্তাব দিলে বন্ধুরা বান্নার কথা হেসেই উড়িয়ে দিলেন। তারা বললেন, এটা একটা অসম্ভব কথা। কফি শপে কে ধর্মের কথা শুনবে? সেখানে তো মানুষ অবসর কাটাতে আসে। কেউবা চিত্ত বিনোদনের জন্যে আসে। বান্না তাদের অনেক যুক্তি দেখালেন। তিনি বললেন, যারা মসজিদে যায় তাদের চেয়ে কফিশপে গমনকারী লোকেরা বেশি উপদেশ আর নসিহত শুনতে ভালবাসে। তবে এজন্য ভালো আলোচ্য বিষয় বেছে নিতে হবে আর এমনভাবে কথা বলতে হবে যাতে তাদের আবেগ অনুভূতির উপর আঘাত না হানে। এছাড়া সুন্দর ভাবে তাদের কাছে দাওয়াত তুলে ধরতে হবে। তাছাড়া কম সময়ের মধ্যে কথা শেষ করতে হবে। পরিকল্পনা মাফিক দাওয়াত দেওয়ার কাজ শুরু হয় এবং সেই রাতেই ২০ টি কফি শপে যান বান্না এবং ইসলামের দাওয়াত দেন। শ্রোতারা আগ্রহ সহকারে বান্নার কথা শোনে। বান্না এসব কথার বদলে কোন কিছু উপহার হিসেবে নিতেন না বা কফি শপ থেকে কিছু পান করতেন না। বান্নার এসব কথার পর কোন কিছু পান করা বা কোন উপহার না নেয়াতে তার কথা শ্রোতাদের অন্তরে ভাল ক্রিয়া করে। বান্না তার পরিকল্পনায় একশ ভাগই সফল হলেন।

ধীরেধীরে বান্নার কার্যপরিধি বড় হতে থাকে এবং এরই ধারাবাহিকতায় ১৯২৮ সালের মার্চ মাসে বান্নার নেতৃত্বে গঠিত হয় 'ইখওয়ানুল মুসলেমুন' বা মুসলিম ব্রাদারহুড। ইখওয়ানের প্রধান লক্ষ ছিলো ইসলামের প্রকৃত শিক্ষার প্রচার করা। মিসরে তখনকার সময়ে পাশ্চাত্যের সেকুলারিজমের আঘাতে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা থেকে সাধারণ মানুষ অনেক দূরে ছিলো। অল্প দিনের মাঝেই ইখওয়ানের সাথে মিসরের সর্বস্তরের মানুষের পরিচয় হয়ে যায়। প্রথম দিকে ইখওয়ান ইসলামের নৈতিক শিক্ষা নিয়ে কাজ শুরু করলেও তখনকার সময়ে ব্রিটিশ আধিপত্য মোকাবেলায় ইখওয়ান হয়ে উঠে একটি পরিণত রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। ইখওয়ান মিসরের সমস্যা হিসেবে বৃটেনকে চিহ্নিত করে এবং ব্রিটিশ বিরোধী লড়াই শুরু করে। ইখওয়ান তখন তথাকথিত জাতীয়তাবাদী সরকারগুলোর ব্যর্থতাকে জনগণের সামনে উন্মুক্ত করে দেয়। ব্রিটিশবিরোধী লড়াইয়ের সময় বান্নার অজান্তেই ইখওয়ানের মাঝে সৃষ্টি হয়ে যায় ক্ষুদ্র একটি সশস্ত্র দল। যাদের স্বল্পদৈর্ঘ্য চিন্তার ফলে ইখওয়ানের কার্যকলাপ তখন কলঙ্কিত হয়ে যায় এবং বিপর্যয়ের কারন হয়ে দাড়ায়।

ইখওয়ানুল মুসলেমুন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বান্নার সবচেয়ে বড় অবদান হচ্ছে তিনি সময় উপযোগী ও কাজের মাধ্যমে অবদান রাখার মতো একটা মডেল তুলে ধরতে পেরেছেন। সেই সময় তিনি মিসর জুড়ে ২০০০+ শাখা গড়ে তুলতে পেরেছিলেন। ইখওয়ানকে নিয়ে গিয়েছিলেন মিসরীয় সমাজের সর্বস্তরের প্রতিনিধিত্বশালী সংগঠন হিসেবে। তিনি ইসলামকে একটি বৈপ্লবিক শক্তিতে রূপান্তর করতে পেরেছিলেন। ক্ষমতা বা অভ্যুত্থানের কোনো ইচ্ছে বান্নার ছিলো না।


একজন জনপ্রিয় বাস্তববাদী রাজনৈতিক নেতা হিসেবে বান্নার কাজ করা শুরু হয়েছিলো। তিনি তখনকার সময়ের মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের চিন্তাভাবনাকে গণআন্দোলনে রুপ দিতে পেরেছিলেন এবং মিসরীয় মুসলিমদের জাগ্রত করতে পেরেছিলেন এটাই তার সার্থকতা। তার এইসব কর্মকান্ড মিশরের তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীকে ভীত করে তোলে। মাত্র ৪৩ বছর বয়সে ১৯৪৯ সালে শাসকশ্রেণীর লেলিয়ে দেওয়া গুন্ডার গুলিতে তিনি নিহত হন।


||হাসান আল বান্না; মুসলিম দুনিয়ার একজন মডেল||
- আল মুনিম

পঠিত : ২৮৯ বার

মন্তব্য: ০