Alapon

দুআ কীভাবে কাজ করে?

দুআ কীভাবে কাজ করে?



আজকের খুৎবাহ কুরআনে বার বার উল্লেখ করা হয়েছে এমন বিশেষ এক জনের জন্য নিবেদিত। আর তিনি হলেন - মারিয়াম সালামুন আলাইহা।

আমি তাঁর জীবনের কিছু বিষয় নিয়ে আলোকপাত করতে চাই যা আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা কুরআনে তুলে ধরেছেন। আজকের আলোচনাটি এই সপ্তাহে করা এক জনের প্রশ্ন দ্বারা অনুপ্রাণিত। এক জন আমার কাছে এসে বলল, বাল্যকাল থেকে আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লার সাথে তার গভীর সম্পর্ক ছিল। খুব অল্প বয়স থেকে সে আল্লাহর নিকট দোয়া করত, তাহাজ্জুদ পড়তো, এমনকি কিশোরী বয়সেও। যখনই সে আল্লাহর নিকট কিছু চাইত, আল্লাহ তাকে তা দিত। এই ব্যক্তির আসলে খুব কঠিন এক জীবন ছিল। অল্প বয়সে বাবাকে হারান। কোন ভাই নেই। এই বোন খুবই একাকীত্বের জীবন কাটিয়েছেন এবং সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সত্যিকার অর্থে আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করে থাকবেন।

যখন সে এভাবে বড় হতে শুরু করল, সে দেখত আল্লাহ অলৌকিকভাবে তার সকল প্রার্থনার জবাব দিতেন। যখনি সে আল্লাহর কাছে কিছু চাইত আল্লাহ কখনো তার দোয়ার জবাব না দিয়ে থাকেননি। এভাবে সে আল্লাহর উপর নির্ভরতা এবং নৈকট্য বাড়িয়ে তোলে। যখনি তার কিছুর দরকার হত সে দুই রাকাত নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে তা চাইত। তো, তার আসলেই আল্লাহর সাথে খুব সুন্দর একটি কানেকশন ছিল।

তাহলে, এখানে প্রশ্ন কোথায়? প্রশ্ন আসে এই ব্যাপারটা থেকে যে সম্প্রতি তার জীবনে সে অপ্রত্যাশিত কিছু কঠিন সমস্যার মুখোমুখি হয়। তাই, সে আল্লাহর প্রতি ইবাদাতের পরিমাণ আরও বাড়িয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। দোয়ার পরিমাণও বাড়িয়ে দিল। কারণ, তার সমস্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে। সে ভাবল, সমস্যা যেহেতু বেড়েছে তাই আল্লাহর কাছে সমাধানের জন্য দোয়ার পরিমাণও বাড়াতে হবে। তাই, সে এমনটি করল। সে এতো বেশি নামাজ পড়লো যে জীবনে কখনো এতো নামাজ পড়েনি। এতো বেশি পরিমাণে রোজা রাখলো যে জীবনে কখনো এতো রোজা রাখেনি।

আল্লাহর কাছে কাকুতি-মিনতি করত, আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করত, অশ্রু ঝরাত, যেভাবে পূর্বে কখনো করেনি। কিন্তু, সমস্যা আরও খারাপ হতে থাকলো। পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হচ্ছে না। তখন সে মনে মনে ভাবতে লাগল, মনে হয় আল্লাহ আমার উপর খুশি নন। কারণ, আগে আমি দোয়া করতাম, আর সব দোয়ার উত্তর পেতাম। আমার আগে তো এই সমস্যা ছিল না। যখনই আমার কিছু দরকার হত, আল্লাহর দিকে ফিরতাম আর আল্লাহ আমার সমস্যার সমাধান করে দিতেন।

কিন্তু, এখন আমি দোয়ার পর দোয়া করে যাচ্ছি, আল্লাহর কাছে ভিক্ষা চেয়ে যাচ্ছি আমার সমস্যার কোনো সমাধান হচ্ছে না। শুধু আরও খারাপ হচ্ছে। এর কারণ কী হতে পারে? তার মাথায় এই ধারণা ঘুরতে থাকলো - নিশ্চয়ই আমি ভুল কিছু করেছি। আল্লাহ আর আমার দোয়ার জবাব দিচ্ছেন না কারণ কোনো কারণে আমি অযোগ্য হয়ে পড়েছি। আল্লাহর ভালো মানুষের তালিকায় আমি আর নেই।

আমি এই খুৎবা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি কারণ, সমাজে এই ধরণের চিন্তা খুবই কমন যা একজন মানুষের মাথা নষ্ট করে দিতে পারে। আমরা দোয়া করি। প্রতিটি মানুষ দোয়া করে। আর আমরা আশা করতে থাকি আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা আমাদের একটা উত্তর দিবেন। আমাদের প্রত্যাশা থাকে আল্লাহ আমাদের সমস্যা সমাধান করে দিবেন।

মূলত, দুই ধরণের দোয়া আছে, আমাদের অধিকাংশের ক্ষেত্রে। আমি এমন দোয়া সম্পর্কে কথা বলছি যা আমরা নিজেদের জন্য করি। এক প্রকার দোয়া হল, আমরা আমাদের বর্তমান সমস্যা সমাধানের জন্য দোয়া করি। আমাদের সমস্যা আছে, কিছু পরিস্থিতিতে আটকা পড়ে গেছি, আমরা চাই আল্লাহ আমাদের আরও খারাপ কোনো সমস্যায় পড়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করুন। আমাদের ভালো যা আছে তা যেন তিনি রক্ষা করেন, ইত্যাদি, ইত্যাদি। আর অবশ্যই আমরা আমাদের ভবিষ্যতের জন্যেও দোয়া করি। আমরা নিজেদের জন্য দোয়া করি, সন্তানদের জন্য দোয়া করি এবং ভবিষ্যতের ব্যাপারগুলোর যত্ন নেওয়ার জন্য দোয়া করি। "এখন সবকিছু ভাল আছে, ইয়া আল্লাহ! এভাবেই যেন থাকে। আমাদের এখন যা আছে তার সংরক্ষণ করুন।"

এই ধরণের দোয়াগুলো আমরা নিজেদের জন্য করে থাকি। যে বিষয়টির উপর আজ গুরুত্তারোপ করতে চাই - আগের একটা খুৎবায় এটা নিয়ে কথা বলেছিলাম - কিন্তু আজকের খুৎবাটি কিছুটা ব্যতিক্রম। এই জন্যই আমি মারিয়াম সালামুন আলাইহা কে বাছাই করেছি। শুরুতে সবাইকে একটা ব্যাপার স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। আপনার দোয়ার উত্তর তাৎক্ষনিকভাবে পাওয়া যাক বা না যাক - এর সাথে আল্লাহ আপনার উপর সন্তুষ্ট আছেন কিনা, তার কোন সম্পর্ক নেই। এটার সাথে সে বিষয়ের কোন সম্পর্ক নেই। এই দুইটার মাঝে কোন সংযোগ নেই। আর যদি কোনো সংযোগ থাকতো তাও আপনি জানতেন না। আপনার পক্ষে অনুমান করা সম্ভব নয় যে কারণটা কী।

আমরা নূহ (আ) এর কথা জানি। যিনি খুবই স্নেহময়ী পিতা ছিলেন। তিনি দাওয়াত দিয়েছেন, স্বজাতিকে ইসলামের দিকে ডেকেছেন ৯৫০ বছর যাবত। কল্পনা করতে পারেন? আপনাদের কি মনে হয় তিনি তাঁর সন্তানের জন্য দোয়া করেছেন? আপনাদের কি মনে হয় তিনি তাঁর স্ত্রীর জন্য দোয়া করেছেন? এতশত বছর ধরে। নাকি তিনি তাদের ব্যাপারে কোনো পরোয়া করেননি? যিনি তাঁর জাতির জন্য এতোটা যত্নশীল হতে পারেন...তারা তাঁকে থুতু নিক্ষেপ করেছে, অপমান করেছে, তারপরেও তিনি আবারো তাদের কাছে গিয়েছেন, তাদের জন্য দোয়া করেছেন এভাবে ৯৫০ বছর যাবত। আপনাদের কি মনে হয় তিনি নিজ ছেলেকে উপেক্ষা করেছেন? নিজ স্ত্রীর কথা ভুলে গেছেন? তিনি তাদের জন্য বছরের পর বছর দোয়া করে গেছেন কিন্তু তারা নিজেদের পরিবর্তন করেনি। ব্যাপারটা কি এমনি নয়? তিনি কি এভাবে নিজেকে দোষ দিয়েছেন যে মনে হয় আমার দাওয়াতটা ঠিকমত হয়নি? অথবা আল্লাহ হয়তো আর আমার দোয়ার প্রতি আর কোন গুরুত্ব দিচ্ছেন না?

আলোচনাটা এভাবে শুরু করার কারণ হল, ঐ মানুষগুলো আমাদের চেয়ে অনেক অনেক উত্তম ছিলেন। অনেক অনেক বেশি উত্তম ছিলেন। তাঁদেরও একই রকম সমস্যা ছিল। এখানে এমন অনেক পিতামাতা আছেন যারা সন্তানদের জন্য প্রতিনিয়ত দোয়া করে যান। কিন্তু, তাঁরা দেখেন সন্তানরা ধর্ম ছেড়ে চলে যাচ্ছে। তারা অন্ধকার পথে হারিয়ে যাচ্ছে।

এখানে এমন অনেক পিতামাতা আছেন যারা সন্তানদের জন্য প্রতিনিয়ত দুআ করে যান। কিন্তু, তাঁরা দেখেন সন্তানেরা ধর্ম ছেড়ে চলে যাচ্ছে। তারা অন্ধকার পথে হারিয়ে যাচ্ছে। আর তাঁরা এটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। নিয়মিত দুআ করে যাচ্ছেন। কিন্তু দুআর কোন উত্তর দেখা যাচ্ছে না। ফলে, তাঁরা হতাশ হয়ে পড়ছেন। আমি কি ভুল কিছু করেছি? আল্লাহ কেন উত্তর দিচ্ছেন না? আরে! আপনি একা তো আর এমন পরিস্থিতিতে পড়েননি। আমাদের রাসূল (স) প্রচুর দুআ করেছেন। আপনার কি মনে হয় না যে তিনি তাঁর চাচার জন্য দুআ করেছেন? তাঁর পরিবারের জন্য? আপনার কি মনে হয় না তিনি আবু লাহাবের কথা বিবেচনায় নেননি যখন তিনি মানুষের হেদায়েতের জন্য দুআ করতেন? যদি তিনি দুআ করে থাকেন... তাঁর সকল আবেগপ্রবণ দুআ সত্ত্বেও আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা তাঁকে বলেছেন - إِنَّكَ لَا تَهْدِي مَنْ أَحْبَبْتَ وَلَٰكِنَّ اللَّهَ يَهْدِي مَن يَشَاءُ ۚ وَهُوَ أَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِينَ- “আপনি যাকে পছন্দ করেন, তাকে সৎপথে আনতে পারবেন না, তবে আল্লাহ তাআলাই যাকে ইচ্ছা সৎপথে আনয়ন করেন। কে সৎপথে আসবে, সে সম্পর্কে তিনিই ভাল জানেন।” (28:56)
আপনি যাকে ভালবাসেন, ইচ্ছা করলেই তাকে সৎ পথে আনতে পারবেন না। আমাদের মাঝে এমন অনেকই আছেন, এমন অনেক সন্তানেরা আছেন যারা আশা করেন তাদের পিতামাতা বা বড়রা যদি আরেকটু ভালভাবে আল্লাহর পথে চলতো! এমন বহু তরুণ-তরুণীর সাথে আমার কথা হয়েছে যাদের পিতামাতা ভয়ংকর রকম পরিষ্কার হারাম ব্যবসায় জড়িত। তাদের ছেলেমেয়েরা তাদের বলছে, "প্লিজ এই ব্যবসা থেকে বের হয়ে আসেন। আমি আপনাদের উপর নির্ভরশীল। আপনারা আমার কলেজের ফি পরিশোধ করছেন। আপনারা আমাদের খচর বহন করছেন কিন্তু আপনারা হারাম আয় থেকে আমাদের ব্যয় নির্বাহ করছেন। আর আমি তো আর এই মুহূর্তে পরিবারের জন্য আয় করার অবস্থানে নেই। কিন্তু আপনারা যা করছেন তা ভুল।" তখন সন্তানদের বলা হয় - "তোমরা পিতামাতাকে অসম্মান করছ। তোমাদের তো পিতামাতার সাথে তর্ক করা উচিত নয়..." ইত্যাদি ইত্যাদি। এই ক্ষেত্রে ব্যাপারটা সম্পূর্ণ উল্টো, এই ক্ষেত্রে সন্তানেরা পিতামাতার হেদায়েতের জন্য দুআ করছেন। কিন্তু পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হচ্ছে না। যেমন আছে তেমনই। এই ধরণের হতাশাজনক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়।

এর বাহিরেও কারো হয়তো ভয়ংকর রকম অসুস্থতা দেখা দিতে পারে। শুধু পারিবারিক সমস্যা নয়, স্বাস্থ্যসংক্রান্ত চরম দুর্দশাও আসতে পারে। অথবা, চাকরি খুঁজে পাচ্ছেন না। অর্থনৈতিক সমস্যায় আক্রান্ত। আর আপনি আল্লাহর কাছে দুআ করে যাচ্ছেন। মনে মনে বলছেন, আমি তো গত বছর ই'তিকাফও করেছি। আমি দুআ করেই গেছি। সারা রাত সিজদায় পড়ে ছিলাম। এরপরেও আমার সমস্যা রয়ে গেছে। এরপরেও কোন সমাধান আসেনি। সবার আগে আমি আপনাদের সবাইকে এবং আমার নিজেকে মনে করিয়ে দিতে চাই যে নবীরা...সকল নবীরা আলাইহিমুস সালাতু ওয়াস সালাম... তাঁদের সকলেই দুআ করতেন। আমাদের বহুকাল পূর্বে যারা এসেছিলেন। আল্লাহ অনবরত তাঁদের দুআর কথা কুরআনে উল্লেখ করেছেন। একইসাথে আল্লাহ তাঁদের সমস্যাগুলোর কথাও কুরআনে বার বার উল্লেখ করেছেন। আপনাদের কি মনে হয় না ইয়াকুব (আ) যিনি বার জন সন্তানের পিতা ছিলেন, তিনি তাঁর সব সন্তানের জন্য দুআ করেছেন? বিশেষ করে ইউসুফ (আ) এর জন্য যখন তিনি ইউসুফকে হারিয়ে ফেলেন? আপনাদের কি মনে হয় না তিনি ইউসুফ (আ) এর নিরাপত্তার জন্য দুআ করেছেন যেন সে নিরাপদে বাসায় ফিরে আসে, তিনি যেন তাঁর সুন্দর সন্তানকে আবার দেখতে পান? আমরা জানি তিনি এত বেশি কেঁদেছিলেন যে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন। وَابْيَضَّتْ عَيْنَاهُ - “এবং দুঃখে তাঁর চক্ষুদ্বয় সাদা হয়ে গেল।” (12:84) তিনি ছেলের জন্য কাঁদতে কাঁদতে দৃষ্টি হারিয়ে ফেলেন।

তাঁর এত বছরের দুআর কোন উত্তর পাওয়া গেল না, কিন্তু শেষে একসময় উত্তর পাওয়া গেল। আপনাদের কি মনে হয় না যখন মূসা (আ) এর মা নিজ ছেলেকে পানিতে ভাসিয়ে দেন, আর দেখতে পাচ্ছেন যে স্রোতের টানে বাক্সটি হারিয়ে যাচ্ছে, বাক্সটি যে কোন সময় উল্টে যেতে পারত, আর কীভাবে জানেন যে বাক্সটি ওয়াটারপ্রুফ? কীভাবে জানেন যে এতে পানি প্রবেশ করবে না? কীভাবে জানেন যে এটি পাথরের আঘাতে ভেঙ্গে যাবে না? আপনি নদীতে ফেলে দিচ্ছেন... একটি বাচ্চাকে!! নদীতে!! আপনাদের কি মনে হয় না যে মূসার মা আল্লাহর কাছে দুআ করেছেন?

এই দুই ক্ষেত্রে পার্থক্যটা লক্ষ্য করুন। মূসা (আ) এর মায়ের ক্ষেত্রে তিনি আল্লাহর কাছে দুআ করেন আর ঠিক কয়েক ঘণ্টা পর তিনি তার ছেলের সাথে আবার একত্রিত হন। ঠিক কয়েক ঘণ্টা পর। বাচ্চার পরবর্তী খাবারের সময় হওয়ার মধ্যেই সে আবার তার মায়ের দেখা পায়। আর অন্যদিকে, ইউসুফ (আ) এর ক্ষেত্রে, তিনি তাঁর পিতার নিকট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। কিন্তু, বহু বছর যাবত তিনি তাঁর পিতার দেখা পাননি। অনেক অনেক বছর যাবত।

আমরা জীবনে সমস্যার মুখোমুখি হব। আর আল্লাহর কাছে দুআ করার সাথে সাথেই আমাদের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে না। দুআর বাস্তবতা বোঝার চেষ্টা করুন। দুআর উদ্দেশ্য কী? আমরা প্রায় দুআ কে 'তলাবের' সঙ্গে গুলিয়ে ফেলি। আরবিতে 'তলাব' মানে কোনো কিছু তালাশ করা, কোনো কিছু দাবি করা। আর দুআর আক্ষরিক অর্থ হল - ডাকা, আহ্বান করা। এটাই এর অর্থ। 'দাআওতুকুম' মানে আমি তোমাকে ডেকেছি, আমন্ত্রণ জানিয়েছি। আমি তোমাকে জোরে ডেকেছি। এটা হল দুআ। আমরা যখন আল্লাহর কাছে দুআ করি, মাঝে মাঝে আমরা ঐ দুআর মাধ্যমে আল্লাহর কাছে দাবি জানাচ্ছি - এটা সত্য - আমরা অনুরোধ জানাচ্ছি। কিন্তু, আমাদের এই ব্যাপারটা ভুলে গেলে চলবে না যে দিনশেষ আমাদের সব অনুরোধ...কী সেগুলো? সেগুলো হল, আল্লাহর একজন বিনম্র দাস আল্লাহর দিকে ফিরে নিজের সমস্যার সমাধান ভিক্ষা চাচ্ছে।

আপনার সমস্যার সমাধান হওয়ার চেয়েও আপনি যে আল্লাহর সাথে যোগাযোগ করছেন এটাই এখানে সবচেয়ে মূল্যবান বিষয়। আপনি যে আল্লাহর সাথে কথাবার্তায় যুক্ত হয়েছেন এটাই দিনশেষে মূল লক্ষ্য। আল্লাহ আপনার সমস্যা তাৎক্ষণিকভাবে সমাধান করে দিবেন কিনা সেটা ভিন্ন বিষয়। আমি এ সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু কথা শেয়ার করতে চাই, পরে মারিয়াম সালামুন আলাইহা নিয়ে কথা বলবো।

কখনো কখনো আপনি এমন কিছু সমস্যার মুখোমুখি হন যে মনের মাঝে প্রশ্ন আসে এখানে আমার দোষ কোথায়? আমাকে কেন এই সমস্যার মোকাবেলা করতে হবে? আমি কী অন্যায় করেছি যে আমার প্রতিই এটা আরোপিত হল? আপনাদের একটি কথা জিজ্ঞেস করি, ইউসুফ (আ) তো আট-নয় বছরের এক বালক ছিলেন মাত্র। শিশু মানেই তো নিষ্পাপ। একজন শিশু এমন কী করতে পারে যার জন্য সে কিডন্যাপ হতে পারে? একজন শিশু এমন কী অন্যায় করতে পারে যার কারণে সে বনের মাঝখানে কুয়ার মধ্যে নিক্ষিপ্ত হবে? একজন শিশু কী করতে পারে যার কারণে সে শিশু দাস হিসেবে বিক্রিত হবে? ভিন্ন একটি দেশে? আর তিনি প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পর কী অন্যায় করেছেন যার কারণে তাঁকে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হতে হবে? মিথ্যা একটি অভিযোগে..তিনি বহু বছর জেলে কাটিয়েছেন। তিনি তো নিজের অন্যায়ের কারণে জেল খাটেননি। তিনি নির্দোষ ছিলেন। আর তাঁকে এতগুলো বছর জেলে কাটাতে হয়। তাঁকে জীবনে এমনসব পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যেতে হয় অন্য কারো এমন হলে বলত - ভাই জীবন অন্যায্য, কি-বা করার আছে। জীবন অন্যায্য। কিন্তু, একজন বিশ্বাসীর ক্ষেত্রে কী হয়? সে শুধু বলে না যে জীবন অন্যায্য, সে বলে আল্লাহ অন্যায্য। নাউ'জুবিল্লাহ। আল্লাহ তাঁকে এমন পরিস্থিতিতে ফেলেছেন। আর আল্লাহ সূরা ইউসুফে বলেছেন - আল্লাহ তার সকল কাজের তত্ত্বাবধান করেছিলেন। তার সকল সিদ্ধান্তের অভিভাবকত্ব করেছিলেন। ইউসুফের জন্য যত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল আল্লাহ তার সবগুলোতে প্রভাব রেখেছিলেন। অভিভাবকত্ব করেছিলেন। কীভাবে?

কখনো কখনো আমি আপনি এমন কিছু সমস্যার মুখোমুখি হব .....কারণ, আল্লাহ জানেন ভালো কিছু সামনে আসছে। কখনো কখনো ভালো যা কিছু আসছে তা আপনার নিজের জন্য, আবার কখনো-বা অন্য কারো জন্য। কখনো কখনো আপনি জীবিত থাকতেই এর উপকার পাবেন আর কখনো কখনো এই উপকার আসবে আপনি আল্লাহর কাছে ফিরে যাওয়ার পর। কখনো কখনো আমি আপনি এমন কিছু সমস্যার মুখোমুখি হব ...কারণ, আল্লাহ জানেন ভালো কিছু সামনে আসছে। কখনো কখনো ভালো যা কিছু আসছে তা আপনার নিজের জন্য, আবার কখনো-বা অন্য কারো জন্য। কখনো কখনো আপনি জীবিত থাকতেই এর উপকার পাবেন আর কখনো কখনো এই উপকার আসবে আপনি আল্লাহর কাছে ফিরে যাওয়ার পর।

ইউসুফ (আ) এর ক্ষেত্রে কী হয়েছিল? একজন পিতা তার সন্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। এটা একটা ট্রাজেডি। ঠিক কিনা? কিন্তু চিন্তা করে দেখুন, তাঁকে যদি কিডন্যাপ করা না হত তাহলে তিনি কুয়ায় নিক্ষিপ্ত হতেন না, আর তিনি যদি কুয়ায় না পড়তেন তাহলে কোনোদিন মিশরে গিয়ে পৌঁছতেন না। আর মিশরে কোনোদিন না গেলে তিনি জেলে নিক্ষিপ্ত হতেন না। আর যদি জেলে না যেতেন তাহলে জেলের ঐ দুই লোকের সাথে তাঁর কোনোদিন সাক্ষাৎ হত না। যাদের স্বপ্নের তিনি ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। ঐ দুই ব্যক্তির সাথে যদি কোনোদিন তাঁর দেখা না হত... তাদের একজন বেঁচে যায় এবং রাজার খেদমতে নিয়োজিত হয়, আর যখন রাজা একটি স্বপ্ন দেখলেন - অদ্ভুত এক স্বপ্ন - ঐ ব্যক্তি তাহলে কোনোদিন বলতেন না যে, হ্যাঁ, আমি এক লোকের কথা জানি, যে আপনার স্বপ্নের ব্যাখ্যায় সাহায্য করতে পারবে। আর এটা যদি কোনোদিন না ঘটতো...জানেন? স্বপ্নটা কী ছিল? দেশে সাত বছর হবে প্রাচুর্যের, আর পরবর্তী সাত বছর দেশে কোন ফসল ফলবে না, কোন উৎপাদন হবে না, কোন ফসল সংগ্রহ করা হবে না, মানুষ দুর্ভিক্ষে মারা যাবে। যদি ইউসুফ (আ) জেলে না যেতেন এবং সেই সময় তাঁকে মুক্তি দেওয়া না হত ঐ স্বপ্নের ব্যাখ্যা করার জন্য, তাহলে দেশ অর্থনৈতিক, ফাইনানসিয়াল এবং সামাজিক এক দুর্যোগে পতিত হত। লক্ষ লক্ষ শিশু দুর্ভিক্ষে মারা যেত। একজন শিশু কষ্ট স্বীকার করল কয়েক বছরের জন্য, আর এই এক শিশুর কষ্ট স্বীকারের ফলে আল্লাহর পরিকল্পনা ছিল অগণিত পরিবারকে, অগণিত পিতা-মাতাকে অনাহারে সন্তান হারানোর বেদনা থেকে রক্ষা করবেন। এই পরিকল্পনার কারণে যে, ইউসুফ (আ) জেল থেকে ফিরে এসে স্বপ্নের ব্যাখ্যা করবেন এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিবেন।

আমার এক বন্ধুর নাম হয়তো আপনারা শুনে থাকবেন, তার নাম রবার্ট ডেভিলা। আমি ঐ বোনকে তার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলাম। সে বলল, সে তার কথা শুনেছে। মানুষটা তার শরীরের কোন অঙ্গ নাড়াতে পারে না, শুধু মুখমণ্ডল ছাড়া। সে তার শরীরের কোন অংশ নাড়াতে পারে না। সে কী এমন অন্যায় করেছে যার কারণে এমন অবস্থায় পতিত হল? কিছুই না। কিন্তু কত মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেছে তার এই অক্ষমতার দরুণ? কত শত মানুষ এই ঘটনার কথা শুনে আল্লাহর পথে ফেরত এসেছে? কত শত মানুষ আল্লাহর প্রতি অকৃতজ্ঞ ছিল - যদিও তারা মুসলিম ছিল কিন্তু নামে মাত্র মুসলিম ছিল - এবং সিদ্ধান্ত নিলো যে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করবে কারণ ঐ মানুষটি একটি বিছানায় শুয়ে আছে? তার কষ্ট, দুর্ভোগ লক্ষ লক্ষ মানুষের জন্য হেদায়াতের কারণে পরিণত হল। বুঝতে পারছেন?
কখনো কখনো আমি আপনি কষ্টকর অবস্থায় পতিত হই, যা আসলে খুবই সামান্য মূল্য এমন অসংখ্য কল্যাণ আর এমন অসংখ্য উপকারের জন্য, যা হয় এখন আমার কাছে আসবে নতুবা আখিরাতে আমার কাছে আসবে। আল্লাহর কাছে ফেরত যাওয়ার পর আমি এর উপকার ভোগ করবো।

এখন, আমি মারিয়াম সালামুন আলাইহা নিয়ে আলোচনা করতে চাই। যখন ঐ বোন আমাকে তার সমস্যার কথা বলছিল সাথে সাথে আমার মারিয়াম সালামুন আলাইহার কথা মনে পড়লো। কারণ, মারিয়াম সালামুন আলাইহার ক্ষেত্রে...এমনকি ছোট বয়সেও ...... তার জন্ম আশ্চর্যজনক, তার জন্মের কথা কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। খুব বেশি সংখ্যক মানুষের জন্মের কথা কুরআনে উল্লেখ করা হয়নি। মা একটি ছেলে সন্তান আশা করছিলেন। কিন্তু তাঁর একটি মেয়ের জন্ম হল। আর আল্লাহ বলেন - " وَلَيْسَ الذَّكَرُ كَالْأُنثَىٰ - ওয়া লাইসাস জাকারু কাল ঊনসা।" (৩:৩৬) যার অনেকগুলো গভীর অর্থ রয়েছে। আমি এখন শুধু একটি অর্থ হাইলাইট করছি। "এই মেয়েটি অন্য কোনো ছেলের মত নয়। এই মেয়েটি স্পেশাল।" প্রসঙ্গত, দয়া করে এই কথাগুলো মনে রাখবেন, পরেরবার আপনাদের কেউ যদি সন্তান সম্ভাবা হয়ে থাকেন। আপনি আশা করছেন, আপনার মা আশা করছে, আপনার বাবা আশা করছে, আপনার চাচাতো-খালাতো ভাইবোনেরা আশা করছে একটি ছেলে শিশুর জন্ম হবে। কিন্তু, একটি মেয়ের জন্ম হল। তখন, মনে রাখবেন আল্লাহ মারিয়াম সালামুন আলাইহার জন্মের মত কারো জন্মের কথা এভাবে হাইলাইট করেননি। মেয়ে সন্তান পাওয়া সম্মানের। মেয়ে সন্তান পাওয়া আল্লাহর একটি উপহার। মেয়ের জন্ম হলে অসন্তুষ্ট হওয়া আসলে মুশরিকদের বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ মুশরিকদের সম্পর্কে বলেন - وَإِذَا بُشِّرَ أَحَدُهُم بِالْأُنثَىٰ ظَلَّ وَجْهُهُ مُسْوَدًّا وَهُوَ كَظِيمٌ - “তাদের কাউকে যখন কন্যা সন্তানের সুসংবাদ দেয়া হয়, তখন তার মুখ কালো হয়ে যায় আর সে অন্তর্জ্বালায় পুড়তে থাকে।” (১৬:৫৮) মেয়ে সন্তান পাওয়া আল্লাহর পক্ষ থেকে আশীর্বাদ এবং সম্মান। মেয়ের জন্ম হলে যদি অসন্তুষ্ট হয়ে পড়েন তাহলে আপনি শুধু আল্লাহর উপহারেরই অসম্মান করছেন না, আপনি কুরআনের আয়াতকেও অসম্মান করছেন। এই কথাগুলো মনে রাখবেন। যাইহউক, এগুলো শুধু প্রাসঙ্গিক কিছু কথা।

এই শিশুর জন্ম হল। তাঁকে আসলে বিশেষ একটি জায়গা দেওয়া হল, তখনকার সময়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে। যাকারিয়া (আ) তাঁর দেখাশোনা করতেন। আর যখনি তিনি তাঁর খোঁজখবর নেওয়ার জন্য আসতেন - কারণ, মারিয়াম (আ) আল্লাহর ঘরে থেকে আল্লাহর ইবাদাতে নিজেকে উৎসর্গ করলেন। كُلَّمَا دَخَلَ عَلَيْهَا زَكَرِيَّا الْمِحْرَابَ وَجَدَ عِندَهَا رِزْقًا - “যখনই যাকারিয়া মেহরাবের মধ্যে তার কছে আসতেন তখনই কিছু খাবার দেখতে পেতেন।” (3:37) তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এগুলো কোথায় পেলে তুমি? এই ফলগুলোর তো এখানে উৎপাদনও হয় না। এমনকি এগুলো এই সিজনেরও নয়। এইগুলো শীতকালে হয়, আর ঐগুলো গরমকালে জন্মে। তুমি এসব ফল কোথায় পেলে? তিনি উত্তর দিতেন - قَالَتْ هُوَ مِنْ عِندِ اللَّهِ - এগুলো আল্লাহর কাছ থেকে বিশেষভাবে এসেছে। এই ফলগুলো আমার নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে।

ভাবতে পারেন এমন একজনের কথা? যার দুআ এমনভাবে কবুল হয় যে, আকাশ থেকে তাঁর জন্য খাদ্য অবতীর্ণ হয়!! তাই, যখন ঐ বোন আমাকে বলছিলেন তাঁর দুআ কবুল হয়ে যায়, আমি সাথে সাথে মারিয়াম সালামুন আলাইহার কথা মনে করলাম। কি অলৌকিকভাবে আল্লাহ তাঁর ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতেন, এমনকি খাদ্যের মত বিষয়েও!! যা আমরা নিজেরাই উঠে গিয়ে নিয়ে আসতে পারি। তাঁকে এমনকি সেজন্যেও উঠতে হয়নি!! খুবই স্পেশাল এক কিশোরী। খুবই স্পেশাল এক নারী। এখন, এই নারী সম্পর্কে যে ব্যাপারটি আজকে গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরতে চাই তা হল, পরবর্তীতে তাঁর জীবনে কি ঘটেছিল। তিনি তখন তরুণী, একদিন তাঁর নিকট এক ফেরেশতার আগমন ঘটল। ফেরেশতা বলল, সে একটি বাচ্চার মা হতে যাচ্ছে। তাঁর মাথায় প্রথমে আসল, আমি তো বিবাহিত নই, আমি মা হব বলে তুমি কী বোঝাতে চাচ্ছ? لَمْ يَمْسَسْنِي بَشَرٌ - আমাকে তো কোনো পুরুষ স্পর্শ করেনি। আমার বাচ্চা হবে বলে তুমি কী বোঝাতে চাচ্ছ!! كَذَٰلِكِ قَالَ رَبُّكِ - এমনিতেই হবে। তোমার পালনকর্তা বলেছেন।" (১৯ঃ ২০-২১) আমি দুঃখিত, আমরা এসেছি শুধু সংবাদ জানাতে। এটা হবে কি হবে না সে ব্যাপারে পরামর্শ করতে আমরা আসিনি। সেই সিদ্ধান্ত ইতোমধ্যে নেয়া হয়ে গেছে, তুমি একটি বাচ্চার মা হতে যাচ্ছ।
এখন, তিনি পুরোপুরি আতঙ্কিত। আমি কী করবো! তিনি আল্লাহর কাছে ফিরে আশা করতে পারেন এমনটি যেন না হয়। কিন্তু, এটা তো ঘটবেই। আপনাদের জন্য আমি পরের কিছু ঘটনা এখন বর্ণনা করছি। যেন উপলব্ধি করতে পারেন এই নারী কেমন এক কঠিন পরীক্ষায় পড়েছিল। বাচ্চার জন্মের পর, তিনি তাঁর নিজ শহরে ফিরে আসলেন। সমাজের সবাই তাঁকে দেখত দুনিয়াত্যাগী আল্লাহ ওয়ালা নারী হিসেবে, এমন নারী যে আল্লাহর ইবাদাতে সবসময় নিয়োজিত থাকতো, এমন নারী যাকে তাদের নবী জাকারিয়া (আ) সমর্থন জানিয়েছিলেন, এমন নারী যিনি জাকারিয়া (আ) এর তত্ত্বাবধানে বড় হয়ে উঠেন। তো, মসজিদের আশেপাশের সবাই সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন, আর তিনি একটি বাচ্চা কোলে করে এগিয়ে আসছেন।

সবাই তখন একসাথে তাঁকে অপমানিত করা শুরু করল। ''কীভাবে তুমি এমন কাজ করতে পারলে? নিজের কী সর্বনাশ করে ফেলেছ তুমি?'' পর্দার অপর পাশে আজকের জুমুয়ার নামাজে অনেক মহিলাও উপস্থিত আছেন। আপনারা জানেন, কোনো মুসলিম নারী এমন অবস্থার কথা কল্পনাও করতে পারেন না যেখানে তিনি একটি বাচ্চা কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আর মানুষ বলছে এই বাচ্চা বৈধ নয়। তার পক্ষে এমন ধরণের অপমানের কথা কল্পনায়ও আনা সম্ভব নয়। কোনো মুসলিমের পক্ষে সম্ভব নয়। আর আমরা পুরুষরাও এই ধরণের অভিযোগের কথা কল্পনা করতে পারব না, আমাদের বোনের জন্য, আমাদের মায়ের জন্য, আমাদের মেয়ের জন্য। এমন কষ্টের কথা আমরা ভাবতে পারি না। এটা আমাদের চিন্তার বাহিরে।

একজন মুসলিমের জন্য আমাদের মান-মর্যাদা আমাদের জীবনের চেয়েও মূল্যবান। আত্মমর্যাদার যে চেতনা আল্লাহ আমাদের দান করেছেন তা আমাদের কাছে আমাদের জীবনের চেয়েও বেশি মূল্যবান। আর তিনি জানতেন তিনি যখন নিজের এলাকায় ফেরত যাবেন তখন লোকজন এমন কথাই বলবে। তাঁর পেছনে বলাবলি করলে এক কথা। কিন্তু, তারা লোকসম্মুখে তাঁর মুখের উপর বলছে। একেবারে সরাসরি তাঁকে বলছে। এখন, আমি আপনাদের আবার পেছনে নিয়ে যাচ্ছি যে, তিনি কীভাবে এই সমস্যার মোকাবেলা করলেন।

কারণ, যত দুআ-ই তিনি করেন না কেন আল্লাহর সিদ্ধান্তে কোন পরিবর্তন হবে না। আল্লাহ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাঁকে এই পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হবে। তাঁকে সমাজের সামনে এভাবে দাঁড়াতে হবে। তখন, তিনি কী করলেন?
যখন প্রসব বেদনা শুরু হলো, তিনি বলে উঠলেন - يَا لَيْتَنِي مِتُّ قَبْلَ هَٰذَا - "হায়, আমি যদি কোনরূপে এর পূর্বে মরে যেতাম!" (19:23) আশা করছি সন্তান প্রসবকালে মারা যাবো। তাঁর মন-মস্তিষ্ক পুরাটা এই চিন্তায় চরম আতঙ্কিত। কারণ, সামনে যে অপমান সইতে হবে তার থেকে মৃত্যুর মাধ্যমে সহজে অব্যাহতি পাওয়া যাবে। কুরআনের অন্য কোথাও কারো মৃত্যু কামনা করার কথা উল্লেখ নেই। শুধু এই জায়গায় উল্লেখ আছে। একবার চিন্তা করে দেখুন। কেন তিনি মৃত্যু কামনা করছেন?
আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা স্বীকার করছেন যে, কখনো কখনো মানুষ এমন কঠিন মানসিক আঘাতে জর্জরিত হবে যে মৃত্যু কামনা করে বসবে। এমন পরিস্থিতিতেও মানুষ পড়বে। ঠিক এমনই এক চরম পরিস্থিতিতে তিনি পড়ে গেলেন। আর আল্লাহ এটা স্বীকার করলেন এবং কুরআনে রেকর্ড করে রাখলেন। يَا لَيْتَنِي مِتُّ قَبْلَ هَٰذَا - আমি এটা পড়ার পর প্রচণ্ড ধাক্কা খেলাম। কীভাবে তিনি এমন কথা বলতে পারলেন! জানেন তো? আমাদের রাসূল (স) বলেছেন - لاَ يَتَمَنَّيَنَّ أَحَدُكُمُ الْمَوْتَ - "তোমাদের কেউ যেন মৃত্যুর আকাঙ্ক্ষা না করে।" তোমাদের মৃত্যু কামনা করা উচিত নয়। কেউ কখনো সহজে মৃত্যু কামনা করে না। কিন্তু, তিনি এখানে মৃত্যু কামনা করছেন! কেন? এটা অত্যন্ত কঠিন এক পরিস্থিতি। মারাত্মক এক অবস্থা। তো, তিনি যে অপমানের সম্মুখীন হতে যাচ্ছেন তা মৃত্যুর চেয়েও খারাপ। তাই, তিনি বললেন - يَا لَيْتَنِي مِتُّ قَبْلَ هَٰذَا -"হায়, আমি যদি কোনরূপে এর পূর্বে মরে যেতাম!"
এই কথা কুরআনে উল্লেখ করার কারণ আছে। দুনিয়ার এই জীবনে মানুষ অপমানজনক পরিস্থিতিতে পড়বে। আর এর থেকে মুক্তির কোনো উপায় চোখে পড়বে না। অনেককে তাদের পরিবারের সম্মুখীন হতে হবে, মিথ্যা অপবাদের সম্মুখীন হবে, অতীতের কোন ভুলের মোকাবেলা করতে হবে, কে জানে? তাদেরকে এমন ধরণের মানসিক আঘাতের মোকাবেলা করতে হবে। তখন, তারা মারিয়াম সালামুন আলাইহার উদাহরণে সান্ত্বনা খুঁজে পাবেন।

কিন্তু, তিনি এখানেই থেমে যাননি। তিনি বললেন - وَكُنتُ نَسْيًا مَّنسِيًّا - এখানে দুইটি শব্দ। নাসইয়ান মানসিইইয়া। খুবই অসাধারণ শব্দযুগল। তারা বলে 'ফায়াল এবং ফিয়েল' এই দুইটি ওজন...তারা নিসি-ও বলে, এক কিরায়াতে এটাকে নিসইয়ান, অন্য কিরায়াতে নাসইয়ান পড়া হয়। 'জিবহ' এর মত। আরবি ভাষায় দুই ধরণের শব্দ আছে, জিবহ এবং মাজবুহ। একইভাবে, নাসি এবং মান্সি। এই শব্দগুলোর প্রথমটা আসলে ব্যবহৃত হয়...আমি আপনাদের জন্য লিখে এনেছি (আরবি) কোনো প্রাণীকে অর্থাৎ কোনো ছাগল বা ভেড়াকে আপনি ততক্ষণ পর্যন্ত 'জীবহ' বলবেন না, যতক্ষণ না এটি জবাই করার উপযুক্ত হয়। এটাকে এখনো জবাই করা হয়নি। জবাই করা হয়ে গেলে এটাকে বলা হয় 'জাবিহ' বা 'মাজবুহ।' জবাইয়ের আগে না, আগে বলা হয় 'জিবহ।'

তিনি দুইটি শব্দ ব্যবহার করলেন। তাঁর কথাটির সাধারণ অনুবাদ করা হয়, "হায়! যদি আমি মরে যেতাম, যদি মানুষের স্মৃতি থেকে বিলুপ্ত হয়ে যেতাম!" এভাবেই অনুবাদ করা হয়। কিন্তু, এখানে যে দুইটি শব্দ আছে সেটা উনারা ভুলে গেছেন। একটা শব্দ 'নাসইয়ান' অর্থ আসলে... তিনি তো মসজিদ থেকে অনেক দূরে, ঠিক না? তিনি এখন বাড়িতে অবস্থান করছেন না। "আমি আশা করছি, কেউ যেন কোনোদিন আমাকে মিস না করে।" তারা যেন এই প্রশ্নটাও না করে যে, মারিয়াম কোথায় গেল? আমি যদি অদৃশ্য হয়ে যেতাম, যদি মানুষের স্মৃতি থেকে বিলুপ্ত হয়ে যেতাম, এই মুহূর্তে। কারো যেন কোনোদিন আমার কথা মনেও না হয়। এটা হলো 'নাসি' এর অর্থ। কারো যেন এই চিন্তাও মাথায় না আসে যে একসময় আমার অস্তিত্ব ছিল। এমন অনেকেই আছে যারা এত কঠিন হতাশা এবং উদ্বেগের ভেতর দিয়ে যায় যে, ঘর থেকেই বের হয় না। তারা ঘর ছেড়ে বের হয় না। ফোন রিসিভ করে না। টেক্সট মেসেজের কোন জবাব দেয় না। মানুষের সঙ্গ তাদের আতঙ্কিত করে তোলে। তারা এত বেশি মানসিক যন্ত্রণা অনুভব করে যে, তাদের ইচ্ছে হয়, যদি তারা মানুষের স্মৃতি থেকে বিলুপ্ত হয়ে যেত। আসলে, কেউ যদি তাদের দরজায় করাঘাত করে, তারা ভাবে, হায়! যদি তারা আমার কথা ভুলে যেত। হায়! যদি আমার কারো সাথে আর দেখা না হত। তারা সবকিছু থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিজের মাঝেই বাস করতে চায়। এর নাম হলো, নাসইয়ান।

তিনি ইতোমধ্যে আশা করছেন যেন তাঁর মৃত্যু হয়, কেউ যেন তাঁর খোঁজ করতেও না আসে। পরবর্তীতে, অনেক বছর পার হয়ে গেলে কেউ যদি না জানে তাঁর কী হয়েছে, মানসিইইয়ান, সবাই যেন তাঁকে সম্পূর্ণরূপে ভুলে যায়। ভবিষ্যতেও তাঁর কোন উল্লেখ কোথাও যেন না থাকে। আমি আশা করছি, কেউ যেন এই মুহূর্তে আমার কথা মনে না করে, এবং আমি ভবিষ্যতেও যেন সবার স্মৃতি থেকে সম্পূর্ণ অদৃশ্য হয়ে যাই।
আমি এই মহান নারীর পরীক্ষার উপর গুরুত্তারোপ করতে চেয়েছি কারণ, ইনি এমন একজন নারী যার দুআ সাথে সাথেই কবুল হয়ে যেত। তাঁকে এমনকি খাদ্যও চাইতে হয়নি, এমনিতেই তাঁর জন্য ফল-ফলাদি এসে উপস্থিত হত। আর আল্লাহ তাঁকে এমন পরিস্থিতিতে ফেললেন। আল্লাহ তাঁকে এমন পরীক্ষায় ফেললেন। একবার চিন্তা করে দেখুন।
এই জন্য না যে, আল্লাহ তাঁকে ঘৃণা করেন। এই জন্য না যে, আল্লাহ তাঁর কথা ভুলে গেছেন। এই জন্য না যে, আল্লাহ তাঁকে অপমানিত করতে চান। শেষে দেখা যায়, এই সমস্ত কিছুর মাধ্যমে আল্লাহ আসলে তাঁকে সম্মানিত করলেন। সবকিছু এই জন্য ঘটেছে যে, আল্লাহ তাঁকে সম্মানিত করতে চান।

কোনো অপমানের ভয় তিনি করছিলেন? তাঁর অপমানের ভয় ছিল, মানুষ বলবে, তুমি বিয়ে ছাড়াই এই সন্তানের মা হয়েছ। তোমার এটা হারাম ছেলে। মানুষ এটাই বলবে। আর জানেন তো বাচ্চার নাম কী ছিল? তাঁর নাম ছিল ঈসা (আ)। কুরআনে কোনো নবীর নামের সাথে তাঁর পিতা বা মাতার নাম উল্লেখ করা হয়নি, শুধু ঈসা (আ) ছাড়া। ঈসা-ব না মারিয়াম, ঈসা-ব না মারিয়াম, ঈসা-ব না মারিয়াম। বার বার উল্লেখ করা হয়েছে। ঈসা মারিয়ামের ছেলে। ঈসা মারিয়ামের ছেলে। কুরআনে কোথাও কি আছে, মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহর ছেলে ? কুরআনে কোথাও কি পান ইয়াকুব ইসহাকের ছেলে? ইসহাক ইব্রাহিমের ছেলে? ইউসুফ ইয়াকুবের ছেলে? পেয়েছেন কখনো? না, না।
অনেক বার আল্লাহ যখনই এই রাসূলকে সম্মানিত করেছেন, সাথে সাথে তাঁর মাকেও সম্মানিত করেছেন। সুবহানাল্লাহ।

প্রসঙ্গত, বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ। আরবরা যখন ইবন বলে বা এমনকি সেমেটিক মানুষেরা যখন ইবন বলে, ইবন উল্লেখ করার ঠিক পরপরই তারা পিতার নাম উল্লেখ করে। তারা পিতার নাম বলে। আপনার নামের শেষাংশ আসে পিতার কাছ থেকে। আল্লাহ এই সাধারণ নিয়মের বাহিরে গিয়ে মানুষকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, না, তাঁর কোন পিতা নেই; আর আমি সাধারণ নিয়মের বাহিরে গিয়ে এই মাকে সম্মান দেখাবো। ঈসা-ব-না মারিয়াম বলার মাধ্যমে। প্রতিবার।

আল্লাহ এই অপমানের কথা উল্লেখ করেছেন অন্য কারণে। আর এই বিষয়টা বলেই আমার খুৎবার সমাপ্তি টানছি। আজকের খুৎবার একজায়গায় আমি বলেছিলাম, কখনো কখনো আপনার কষ্ট অন্য মানুষের মুক্তির কারণে পরিণত হবে। আপনি সমস্যায় পড়েছেন, কারণ, এটা আপনার থেকেও বড় কোনো উদ্দেশ্য সাধন করবে। আপনি তখন তাদের জন্য সাদাকায়ে জারিয়ায় পরিণত হবেন। আপনার কারণে তারা ভালো কিছু অর্জন করবে।
মারিয়াম সালামুন আলাইহার এই কষ্ট থেকে... প্রতিবার যখন কোনো নারী অপমানিত হবে, প্রতিবার যখন কোনো নারী অপবাদের শিকার হবে, প্রতিবার যখন কোনো নারী কামনা করবে যদি সে মরে যেত পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার চেয়ে - তখন সে মারিয়াম সালামুন আলাইহার কষ্টের মাঝে নিজের সান্ত্বনা খুঁজে পাবেন।

আর প্রত্যেকবার যখনই কোনো নারী সান্ত্বনা খুঁজে পাবে মারিয়াম সালামুন আলাইহার মর্যাদা এতে আবারো বেড়ে যাবে, আবারো বেড়ে যাবে, আবারো বেড়ে যাবে। সুবহানাল্লাহ।
আমাদের দুআর মাধ্যমে আমরা আল্লাহর সাথে সংযোগ স্থাপন করি। আমাদের দুআ এমন কিছু নয় যার মাধ্যমে এই দুনিয়া জান্নাতে পরিণত হবে। পৃথিবীর এই জীবনে পরীক্ষা থাকবেই। আমাদের চেয়ে বহুগুণে উত্তম মানুষদের জীবনে সমস্যা ছিল। আর এটা ঠিকাছে। আল্লাহ বলেন - لَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنسَانَ فِي كَبَدٍ - "আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি অত্যন্ত কষ্ট ও শ্রমের মাঝে।" (৯০:৪) কষ্ট-ক্লেশ জীবনের অংশ। দুআর উদ্দেশ্য হলো, আমাকে আপনাকে এই কষ্টগুলো মোকাবেলায় সাহায্য করা। আর কখনো ভুলে যাবেন না যে, আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন। সময় কঠিন যাক বা সহজ যাক।
আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা আমাদের সেসব মানুষদের অন্তর্ভুক্ত হওয়া থেকে রক্ষা করুন যারা ঈমান হারিয়ে ফেলে, আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা আমাদের মর্যাদা দান করুন, এবং আমাদের এই কথা স্মরণে রাখতে সাহায্য করুন যে, মানুষ আমাদের যতই অপমান করতে চেষ্টা করুক না কেন... মানুষ আপনাকে ছোট করতে চাইবে, মানুষ আপনাকে অপমানিত করতে চাইবে যেভাবে তারা মারিয়াম সালামুন আলাইহাকে অপমান করেছিল, কিন্তু আল্লাহ এখনো আপনাকে সম্মান দান করেন।

লোকে আপনার সম্পর্কে কী মনে করে আর আল্লাহ আপনার সম্পর্কে কী মনে করেন এর মাঝে বিশাল পার্থক্য আছে। কারণ, আপনি যদি লোকের কথা মানেন তাহলে মারিয়াম ছিলেন সমাজের সবচেয়ে অপমানিত, অপদস্থ ব্যক্তি। আর যদি আল্লাহর কথা মানেন তাহলে তিনি ছিলেন মানব ইতিহাসের সবচেয়ে মর্যাদাবান নারীদের একজন। তাই, আমরা আল্লাহর কথা মানবো। আল্লাহ আমাদের সম্মানিত করেছেন। তিনি বলেন - وَ لَقَدۡ کَرَّمۡنَا بَنِیۡۤ اٰدَمَ - আর আমি তো আদম সন্তানদের সম্মানিত করেছি। (১৭:৭০)

আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা আমাদেরকে তাঁর নিকট সম্মানিত মানুষে পরিণত করুন, মানুষের নিকট সম্মানিত করার পূর্বে। বারাকাল্লাহু লিই ওয়ালাকুম ফীল কুরআনিল হাকিম। ওয়ানাফা'নিই ওয়া ইইয়াকুম বিল আয়াতি ওয়া জিকরিল হাকিম।

--- নোমান আলী খান

পঠিত : ৬৩৭ বার

মন্তব্য: ০