Alapon

ইয়াবার আসর


ছেলেটির মুখে জলন্ত সিগারেট। দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গিমা বলছে, সে কারও জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু কার জন্য অপেক্ষা করতে পারে?



 



একটু পরেই টিএসসি চত্বরে একটি বসে যাওয়া গলা থেকে আওয়াজ এল, ‘দুনিয়ার মজদুর, এক হও, এক হও’।



ছেলেটি জলন্ত সিগারেটটিকে বাটার স্যান্ডেল দিয়ে পিষে, সেই মিছিলের দিকে দৌড় দিল। মিছিলের পিছনে পিছনে চুপচাপ হাটতে লাগল। এই মিছিল একসময় কলাভবনে গিয়ে শেষ হল।



 



মিছিল শেষ হতেই অনুরূপের হাতটি ধরে বলল, ‘মামা, হবে নাকি?’



তার কথা শুনে অনুরূপের চোখ দু’টি জ্বলে উঠল। হবে মামা। মান্টু (মানি অর্থাৎ টাকা) দাও, তোমার রুমে পৌঁছে যাবে। অনুরূপের হাতে এক হাজার টাকার একটি নোট দিয়ে, ছেলেটি তার হলের দিকে হাটা শুরু করল।



 



ছেলেটির নাম, রাফসান রাহবার। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। স্কুলে পড়ার সময় একবার বাবার সঙ্গে ঢাকায় বেড়াতে এসেছিল। তখন বাবা তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পুরোটা ঘুরিয়ে দেখান। এর ঘুরিয়ে দেখার ফলাফল স্বরূপ, রাফসান সিদ্ধান্ত নিল, সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই ভর্তি হবে।



 



কমার্স থেকে এইচ.এস.সি দেবার পর ‘গ’ ইউনিটি ভর্তি পরীক্ষা দিল। ‘গ’ ইউনিটে নিবেই সর্বমোট ৯৩০ জন। পরীক্ষার রেজাল্টের রাফসানের সিরিয়ার এল ১০৩০। অনেকেই বলল, ‘হবে। তোমার বিবিএ তে পড়ার স্বপ্ন পূরণ হবে।’



কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর হল না। ‘ঘ’ ইউনিটে পরীক্ষা দিয়ে অবশেষে সে ‘আরবী’ বিষয়ে ভর্তি হবার সুযোগ পেল।



 



রাফসান ভর্তি হল ঠিকই, কিন্তু নিয়মিত ক্লাস করতো না। তাকে ভার্সিটিতেও খুব একটা দেখা যেত না। ভার্সিটির প্রথম দিনে সামিহা নামের একটি মেয়ের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। মেয়েটি নিজে থেকেই কেন জানি পরিচিত হবার জন্য এগিয়ে এল। কেউ পরিচিত হতে চাইলে তাকে তো আর ফিরিয়ে দেওয়া যায় না। রাফসান, অনেকটা বাধ্য হয়েই তার সঙ্গে পরিচয় হল। এরপর তার সাথে কয়েকদিন কথা হয়েছে মাত্র।



 



একবার রাফসান কয়েক সপ্তাহ ধরে ক্লাসে যায় না। তার কোন খোঁজ-খবরও কেউ জানে না। এমনকি সে কাউকে তার মোবাইল নাম্বারটিও দেয় নি। একদিন দুপুরবেলা রাফসান তার হলের রুমে ঘুমিয়ে আছে। এমন সময় একজন এসে বলল, ‘ভাই নিজে আপনাকে একজন ডাকতেছে।’



রাফসান অনেকটা বিরক্তি নিয়ে জানাল দিয়ে তাকিয়ে দেখল, সামিহা!



 



নীলক্ষেতের মামা হোটেলে দু’জনে একসঙ্গে খেতে খেতে অনেক কথা বলল। দু’জনে কথা বলল বললে ভুল হবে। বরঞ্জ বেশির ভাগ সময়টা সামিহাই বকবক করে গেল। সামিহা চলে যাবার সময় আফসানের মোবাইল নাম্বারটি নিয়ে গেল।



এরপর থেকে তাদের নিয়মিত দেখা এবং কথা হতে লাগল।



একদিন সামিহা বলল, ‘তোমাকে সবসময় হতাশ দেখায়। তোমাকে একজায়গায় নিয়ে যাবো। তাতে তোমার ভাললাগবে। যাবে?’



রাফসান সংক্ষিপ্ত উত্তর দেয়, ‘যাবো।’



 



এরপর এক সন্ধ্যায় সামিহা তাকে টিএসসির মোড়ে আসতে বলে। তারপর সামিহা তাকে নিয়ে টিএসসির খোলা ময়দানে নিয়ে উপস্থিত হল। সেখানে আগে থেকেই আরো কয়েকজন ছিলেন। তাদের মধ্যে একজনকে নেতা গোছের মনে হল এবং তিনিই বক্তব্য দিচ্ছিলেন। বক্তব্যে তিনি একটি শ্রেণীহীন এবং বৈষম্যহীন সমাজের কথা তুলে ধরেন। একটি সুখী পৃথিবীর চিত্র তুলে ধরেছেন। রাফসানের বেশ মনে ধরে যায়। তখন সে আরও জানতে চায়।



তার হাতে তুলে দেওয়া হল কার্ল মার্কস, লেলিন এবং চে’ গুয়েভারার ডায়রী, সেইসাথে দেশী কিছু লেখকের বই।



 



এরপর রাফসানের সঙ্গে এই দলটির সম্পর্ক দিন দিন বাড়তে থাকে। রাফসান নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। এই সমাজ, এই দেশ তথা পুরো পৃথিবী বদলানোর স্বপ্ন দেখে। আর এই স্বপ্ন সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে দেখতে থাকে। এরপর রাফসান পার্টির প্রোগ্রামে নিয়মিত উপস্থিত হতে শুরু করল। এই্সব প্রোগ্রামে ‍উপস্থিত হতে হতে, একসময় সে সিগারেট শুরু খাওয়া শুরু করল। চেইন স্মোকার হবার আগেই একদিন পার্টির এক নেতা তাকে ‘নিমাই আসর’ এ নিয়ে গেল।



 



‘নিমাই আসর’ বলতে গাঁজার আসর। এই আসরেই রাফসানের সঙ্গে গাঁজার পরিচয় ঘটে। নিমাই আসর পেরিয়ে আজ সে বাবার আসরে পৌঁছে গেছে। বাবার আসর বলতে ইয়াবার আসর।



 



এখন আর আফসান সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখে না। এখন সে দেশ পরিবর্তনের কথা ভাবতে পারে না। সত্যিকথা বলতে সে এখন আর নিজেকে নিয়েই ভাবতে পারে না। রাফসানের কাছে এখন সবকিছুই বস্তাপঁচা থিউরী মনে হয়। শ্রেণীহীন বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার পিছনে আসলে আর একটি নতুন পুঁজিবাদি রাষ্ট্র গড়ে তুলার প্রয়াসমাত্র। যেমনটা রাশিয়া গড়ে তুলেছে। দেশের মানুষের কোন সম্পত্তি নেই। অথচ সমাজতান্ত্রিক দলের নেতারা এক একজন হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক।



 



এই বস্তাপঁচা থিউরী আর বস্তাপঁচা আন্দোলন, রাফসানকে নতুন করে হাতাশার সাগরে ডুবিয়েছে। এখান থেকে রেহাই পাবার কোন পথ দেখা যাচ্ছে না। মুক্তি হিসেবে সে দেখছে, বাবার আসর। ইয়াবাই হয়তো তাকে এইসব থেকে মুক্তি দিতে পারে। মুক্তিদিতে পারে বিবিএ পড়তে না পারার হতাশা থেকে। মুক্তিদিতে পারে এইসব বস্তাপঁচা থিউরী থেকে। তাই, রাফসানের রুমে জমে উঠেছে আসর। ইয়াবার আসর।

পঠিত : ৭২৫ বার

মন্তব্য: ০