Alapon

গোপন ক্যামেরা ও মাইক্রোফোন...



আজ বৃহস্পতিবারের বিকালের ক্লাসটা ক্যান্সেল হওয়ায় ভাবলাম খালার বাসা থেকে ঘুরে আসি। আবার সামনের রোববারও সরকারি ছুটি আছে, সব মিলিয়ে বেশ কয়েকদিন সময় পাওয়া যাবে।

হলে থাকা হলেও এমন সময় সুযোগ পেলে প্রায়ই খালার বাসায় যাওয়া হয়, যদিও পরীক্ষার চাপ থাকায় গত মাসদুই যাওয়াও হয় নি । তো আজকে গিয়ে বেল বাজাতেই দরজা খুললো শুভ ভাই।
- আরে সামিহা না? ভেতরে আয়। কেমন আছিস?
- শুভ ভাইয়া? তোমাকে তো চিনতেই পারি নি। এইতো ভালো, তুমি কেমন আছো?
- ভালো আলহামদুলিল্লাহ। বাবা-মা বা রিফা, কেউ তো বাসায় নেই এখন। আসতেও রাত হবে, ফোন দিয়ে আসবি না? যাহোক, তুই যা রিফার রুমে।

বলেই শুভ ভাই তার রুমে গিয়ে দরজা চাপিয়ে দিলো। আমার শুরুতে একটু আনইজি লাগলেও পরে ভালো লাগলো এই ভেবে, যাক, অনেকদিন পরে ভাইয়ার সাথে আড্ডা দেয়া যাবে। বাসায় কেউ নেই, আসতেও দেরি হবে, এই সুযোগে যদি দীর্ঘদিনের জমানো কথা শেয়ার করা যায়...।

শুভ ভাই আমার খালাতো ভাই, বছর দেড়েকের বড়, পড়াশোনা করেছেন ঢাকার বাইরের এক স্বনামধন্য প্রকৌশন বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাই এই গত সাড়ে তিন বছরের ভার্সিটি লাইফে ভাইয়ার সাথে সম্ভবত কখনোই দেখা হয় নি। আমরা ছোটবেলায় দীর্ঘসময় একত্রে বেড়ে উঠেছি, খালু ট্রান্সফার হয়ে ঢাকা আসার আগে পর্যন্ত। তখন হাইস্কুলে উঠেছিমাত্র, তখন থেকেই ভাইয়ার প্রতি আমার আলাদা একটা টান ছিলো। আমি ভাইয়াকে শুরুতে চিনতে পারি নি তার এই তিন - সাড়ে তিন বছরের পরিবর্তনের কারণে; ভাইয়ার মুখে লম্বা দাড়ি আর মাথায় টুপি দেখে। শুভ ভাই এমনিতে বেশ হ্যান্ডসাম, নতুন লুকে তাকে বেশ মানিয়েছে।

যাহোক, রিফার রুমে গিয়ে ফ্রেশ হলাম। বুঝতেই পারছেন, রিফা আমার খালাতো বোন; আমি এ বাসায় আসলে ওর রুমেই থাকি। রুমটা অনেকখানি নিজের রুমের মতোই আমার কাছে। কিন্তু আজকে রুমের মাঝে বেশিক্ষণ স্বস্তিতে বসতে পারছিলাম না, মনটা উশখুশ করতেছিলো। উঠে শুভ ভাইয়ের দরজায় নক করতে গিয়ে দেখলাম, দরজা ভেজানো থাকলেও খোলা রয়েছে, তাই ঢুকে পড়লাম। ভাইয়া বিছানায় হেলান দিয়ে বসে বই পড়ছে। তবু জিজ্ঞেস করলাম,
- ভাইয়া কী করছো?
- এইতো বই পড়ছি...
- একা একা বসে থেকে বোর হচ্ছিলাম, তাই ভাবলাম তোমার সাথে কিছুক্ষণ গল্প করি।
- দেখ সামিহা, এই বাসার সব জায়গায় সিসি ক্যামেরা ফিট করা, সাথে গোপন মাইক্রোফোন, সবকিছু দেখা আর শোনা যাচ্ছে। এখন আমরা প্রাপ্তবয়স্ক দুইজন এমন খালি বাসায় এভাবে গল্প করা, দেখলে বা শুনলে কি আমাদের বাবা-মা পছন্দ করবে?
আমি একটু শকড হলাম। আমার আসলে কী বলা উচিত? ভাইয়াই বলতে শুরু করলো,
- করবে না। তুই বরং রুমে যা। আমি মাকে ফোন দিয়েছি, ওনারা যত তাড়াতাড়ি পারবেন, চলে আসবেন, বললেন তো সন্ধ্যার আগেই। আমি এখন নামাজে বের হবো।
- কিন্তু নামাজে তো এখনো প্রায় এক ঘণ্টা বাকি।
- হুম, সমস্যা নেই। আমি মসজিদে যাচ্ছি। এখন রুমে যা, আমি বের হলে দরজাটা লাগিয়ে দিস।

ভাইয়া বের হওয়ার পরে আমার একটু খটকা লাগলো। যদিও ভাইয়া ইঞ্জিনিয়ার মানুষ, বাসায় এমন যন্ত্রপাতি বসানো অসম্ভব না, তবুও… আসার পরে একটা ক্যামেরাও তো চোখে পড়লো না। আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম, পুরো বাসাটা খুঁজে দেখবো। কিন্তু যা সন্দেহ করেছিলাম, তা-ই ঠিক, কোনো ক্যামেরাই তো নেই। তাহলে ভাইয়া মিথ্যা বললো কেন? কিছু কি আঁচ করতে পারলো? নাকি অন্য কিছু?

নামাজেরও বেশ অনেকটা সময় পরে ভাইয়া বাসায় ফিরলো। দরজা খুলতেই “মা আর রিফা প্রায় চলে এসেছে” বলে নিজের রুমের দিকে হাঁটা দিলো। আমি একটু জোরেই বললাম,
- ভাইয়া, দাঁড়াও।
- বল।
- তুমি আমাকে মিথ্যা বললে কেন?
- কই মিথ্যা বললাম?
- এই যে বললা পুরো বাসায় ক্যামেরা আর মাইক্রোফোন সেট করা?
- হ্যাঁ, তো?
- কিন্তু আমি তো পুরো বাসা তন্নতন্ন করে খুঁজেও এমন কিছু পেলাম না। তুমি আবার নামাজের জন্য এই প্রায় দশগুণ সময় বাইরে কাটিয়ে আসলে আমাকে একা বাসায় রেখে, আমি তো ভয়ও পেতে পারতাম, আমার কোনো সমস্যাও হতে পারতো। আসলে তুমি আমাকে এড়াতে চাইছো।

এক নিশ্বাসে কথাগুলো বললাম আমি। অপেক্ষা করে আছি ভাইয়ার জবাবের।
- দেখ সামিহা, আমি তোকে এড়াতে চেয়েছি সত্য, কিন্তু আমি মিথ্যা বলি নি। হ্যাঁ, বাহ্যিক কোনো ক্যামেরা বা মাইক্রোফোন নেই সত্য, কিন্তু তুই জানিস না আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনে বলেছেন আল্লাহু সামিউন বাসির, অর্থাৎ আল্লাহ সব শুনেন এবং দেখেন? তিনি তো আমরা যা কিছু গোপনে আর প্রকাশ্যে করতেছি, সবই দেখছেন এবং শুনছেন। তাঁর দেখা আর শোনা তো এই পাওয়ারফুল ক্যামেরা আর মাইকের থেকেও পাওয়ারফুল। তিনি তো আমাদের প্রতিটা মোমেন্টের প্রতিটা মুভমেন্ট দেখছেন, শুনছেন, রেকর্ড করছেন; এই ভিডিও হয়তো আবার কেয়ামতের মাঠে সবার সামনে প্লে করা হবে। যে কাজ আমরা বাবা-মায়ের সামনে, সমাজের অন্য কারো সামনে করতে আনইজি বোধ করি, সেটা দুনিয়ার সবার সামনে প্লে করলে কেমন লাগবে বল তো?

স্তব্ধ হয়ে শুনছি আমি। আসলেই তো এভাবে ভেবে দেখি নি, যদি আমার বেডরুমের আনাচে-কানাচে সব জায়গায় এমন ক্যামেরা আর মাইক্রোফোন সেট করা থাকে যা বাইরের সবাই দেখছে, তাহলে বিষয়টা কেমন হয়? এমনকি আমার মাইন্ডও যদি রিড করা হয়? আমি এখন যা যা করতেছি, সব কি করতে পারি আসলে? চিন্তার ছেদ পড়লো শুভ ভাইয়ের কথায়,
- শোন, তুই আমার জন্য গায়রে মাহরাম। তোর সাথে দেখা করাই তো আমার জায়েজ নেই, সেখানে বসে গল্প করা তো বহুদূর। তুই তো জানিস, যখন নির্জনে এমন দুইজন নারীপুরুষ একত্রিত হয়, তখন সেখানে তৃতীয় ব্যক্তি হয় শয়তান। দেখ, আমি তোকে আল্লাহর জন্যই পছন্দ করি, তাই আমি চাই না যে তুই বা আমি, কেউই শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে জাহান্নামে যাই। এ কারণেই তোকে এড়িয়ে যেতে চেয়েছি। আর তোকে একা কোথায় রেখে গেলাম? আল্লাহর ভরসায় রেখে গিয়েছি না? রুমে যা, রিফাকে নিয়ে মা এখনই এসে পড়বে, তোকে আর বোর হতে হবে না।

বলেই ভাইয়া তার রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো। আর দরজার এ পাশে দাঁড়িয়ে রইলাম সদ্য জন্ম নেয়া এক নতুন "আমি"।

- এস এম মোস্তাসিম বিল্লাহ

পঠিত : ৬৩৩ বার

মন্তব্য: ০