Alapon

একটি উত্তম ভবিষ্যতের প্রত্যাশায়...



আমি আসলেই এই আয়াত নিয়ে কথা বলতে চাই। যদিও এটা নিয়ে আগে অনেকবার আলোচনা করেছি, কিন্তু এই মসজিদে করিনি। আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা বলেন - وَلَا تَقُولَنَّ لِشَيْءٍ إِنِّي فَاعِلٌ ذَٰلِكَ غَدًا - (১৮:২৩) এটা একটা আয়াত। আল্লাহ বলেন -"কোন বিষয় সম্পর্কে কক্ষনো বল না যে, ‘ওটা আমি আগামীকাল অবশ্যই করবো।" এটা কখনো বলো না। তিনি আসলে বলেননি - বলো না, লা তাকুল। তিনি বলেছেন - লা তাকুওলান্না। বলার সাহসও করো না, কক্ষনো না, যেকোনো কিছু সম্পর্কে যে, আমি অবশ্যই আগামী কাল এটা করবো।

আপনি যদি আয়াতের এখানে থেমে যান, তাহলে দৃশ্যত সমস্যা দেখা দেয়। কারণ, আপনার বস বলেন, "আপনাকে অবশ্যই এই এসাইনমেন্ট আগামীকাল জমা দিতে হবে।" আপনি তখন বলেন, "অবশ্যই। আমি আগামীকাল জমা দিবো। সিওর, সিওর, ইনশাআল্লাহ।" কখনো কখনো আপনি ইনশাআল্লাহ বলেন, আবার কখনো কখনো বলেন না। কিন্তু, মানুষ নিশ্চয়তামূলক ওয়াদা করে সবসময়।

- "হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি নিশ্চিত যাবো।"
- "তুমি কি দাওয়াতে আসছ?"
- "হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি নিশ্চিত যাবো।"
- "কিরে, জুমায় যাবি তো?"
- "হ্যাঁ, হ্যাঁ, অবশ্যই, অবশ্যই।"

আমরা এসব নিশ্চয়তামূলক কথা বলি সবসময়। পরের আয়াতে গিয়ে আল্লাহ এই বিষয়টা সম্পূর্ণ করলেন। তিনি বলেন - إِلَّا أَن يَشَاءَ اللَّهُ - “আল্লাহ ইচ্ছা করলে বলা ব্যতিরেকে।” একমাত্র ব্যতিক্রম হলো, আমার এটা করার ইচ্ছা শতভাগ, যদি আল্লাহ ইচ্ছে করেন। এই জন্য মুসলিম সংস্কৃতিতে, আমরা যখন ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলি, আমরা ইনশাআল্লাহ শব্দ ব্যবহার করি। আল্লাহ যদি চান। "আগামীকাল ৩ টায় তোমার সাথে দেখা হবে, ইনশাআল্লাহ।"

অর্থাৎ, আল্লাহ যদি সিদ্ধান্ত নেন যে, তোমার সাথে আমার দেখা হবে না -- সেটা আমার নিয়ন্ত্রণের বাহিরে। আমার ইচ্ছা আছে। কিন্তু, আল্লাহর পরিকল্পনা আমার পরিকল্পনা থেকে ভিন্ন হতে পারে। আমার পরিকল্পনা থেকে আমি প্রতিজ্ঞা করছি। কিন্তু, যদি ঝড় শুরু হয়, ভূমিকম্প হয় অথবা গাড়ি নষ্ট হয়ে যায়, আমি জানি না, আজ এবং আগামীকালের মধ্যে আল্লাহ যে কোন কিছুর সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। ভবিষ্যৎ আমার হাতে নয়। তাই, আমাকে এই ইনস্যুরেন্সের দাবিটা পরিষ্কার করে নিতে হবে। এবং বলে রাখতে হবে যে, এটা আল্লাহর হাতে। কারণ, এটা ভবিষ্যতের ব্যাপার। মুসলমানরা জানে, ভবিষ্যৎ তাদের হাতে নয়।
এখানে আমাদেরকে ভারসাম্যের শক্তিশালী একটি দিক সম্পর্কে বুঝতে হবে।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে মুসলমানরা, সুবহানাল্লাহ, যখন আমরা আল্লাহর বই থেকে দূরে সরে যাই, এমনকি আমাদের ধর্মের সুন্দর শিক্ষাগুলোকেও আমরা কুৎসিত বানিয়ে ফেলি। তাদেরকে বাহিরে থেকে সুন্দর মনে হয়, কিন্তু, যখন আল্লাহর বইয়ের সাথে সম্পর্ক হারিয়ে ফেলেন, যখন আল্লাহর রাসূলের (স) এর সুন্নাহর সাথে যুক্ত না থাকেন-- তখন সেই একই সুন্দর বিষয়গুলো কুৎসিত কিছুতে রূপান্তরিত হয়। আমাদের অনেকেই এই অপরাধে অপরাধী।
তাই, আমরা যখন বলি ইনশাআল্লাহ, তারমানে সম্ভবত না। আমরা এখন এটাই করি। - "তুমি কি আসতেছ?"
- " অ্যাঁ, ইনশাআল্লাহ"
যার অর্থ হলো, আমি আসলে নিশ্চিত নই। আমি সিওর না। তাহলে, আমরা এখন ইনশাআল্লাহ ব্যবহার করি কোন প্রতিশ্রুতি এড়ানোর জন্য। এই আয়াতগুলো প্রতিশ্রুতি এড়ানোর জন্য নয়। বস্তুত, ইন্নি, ফাইলুন, জালিকা, গাদান -- খুবই শক্তিশালী শব্দসমষ্টি।
আমি নিশ্চিত, আমি অবশ্যই আগামী কাল এটা করতে যাচ্ছি। গ্যারান্টিসহকারে কোন অঙ্গীকার করা, প্রতিশ্রুতি দেয়া এবং অবশ্যই করবো বলে প্রতিজ্ঞা করা - আদতে মূল সমস্যা নয়। বস্তুত, আপনার তো এমনটা করা উচিত। আপনার তো আসলেই শক্ত প্রতিশ্রুতি দেয়া উচিত। আপনার তো না ভেবেচিন্তে প্রতিশ্রুতি দেয়া উচিত নয়। যদি করতে না পারেন, তাহলে বলে দিন যে, করতে পারবেন না। যদি সেখানে যেতে না পারেন বলে দিন - আমি যেতে পারবো না। কিন্তু, যদি কথা দেন, তাহলে তাতে অটল থাকুন। তাতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকুন।

তারপর এর সাথে যোগ করে বলুন, এটা একমাত্র ঘটবে না যদি আল্লাহ এমন কিছুর সিদ্ধান্ত নেন যা আমার নিয়ন্ত্রণের বাহিরে। এটাই "ইল্লা আন ইয়াশা আল্লাহ।" "ইল্লা আন ইয়াশা আল্লাহ" মানে এটা না যে, যদি আমি দেরিতে উঠি তাহলে আসতে পারবো না বা যদি আমার মুড ভালো না থাকে। এরজন্য আপনি ইনশাআল্লাহ ব্যবহার করেন না। তখন সেটা হবে এই শক্তিশালী কথার অপব্যবহার। আপনি বুঝতে পারছেন, স্বীকার করছেন যে, সবকিছু আপনার নিয়ন্ত্রণে নেই। আল্লাহ আপনাকে অঙ্গীকার করার সামর্থ্য যেমন দিয়েছেন, সেই সাথে সেই অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করার সামর্থ্যও দিয়েছেন। আপনার যদিও কিছু সামর্থ্য আছে কিন্তু আল্লাহ হলেন, ওয়া হুয়া আলা কুল্লি শাইইন কাদির - (সকল বিষয়ের উপর সর্বশক্তিমান) তিনি আপনাকে পথের মাঝখানে থামিয়ে দিতে পারেন, আপনার সকল নিয়ত থাকা সত্ত্বেও। আপনার সকল ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও। এটা হলো "ইল্লা আন ইয়াশা আল্লাহ" বাক্যাংশের মূল অর্থ।

কিন্তু, এরপর আল্লাহ যোগ করেছেন - অজকুর রব্বাকা ইজা নাসিত - তোমার রবের উল্লেখ করো যখন ভুলে যাও। ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং, আল্লাহ এখানে বলেননি, ইন নাসিত - যদি তুমি ভুলে যাও। তিনি বলেছেন, যখন তুমি ভুলে যাও। 'যদি' এবং 'যখন' এর মাঝে বিশাল পার্থক্য আছে।

যদি কিছু ঘটে মানে - এটা ঘটতে পারে পারে আবার না-ও ঘটতে পারে। আর যদি বলা হয় 'যখন' তুমি ভুলে যাও, আল্লাহ গ্যারান্টি দিচ্ছেন - কারণ, আল্লাহ গ্যারান্টি দিতে পারেন, আমি পারি না - আল্লাহ গ্যারান্টি দিচ্ছেন আপনি এবং আমি ভুলে যাবো। আমরা ভুলে যাবোই। এমন ঘটবেই, যখন আমরা ভবিষ্যতের কোনো ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দিবো কিন্তু ইনশাআল্লাহ বলতে ভুলে যাবো। আমরা মনে মনে পরিকল্পনা করবো...কখনো কখনো আপনি হয়তো মুখে বলেন না... প্রসঙ্গত, আরবিতে "কাউল বা বলা" দ্বারা শুধু জিহ্বা দিয়ে বলাকে বোঝানো হয় না, এমনকি মনে মনে কিছু বলাও 'কাউল' দ্বারা বোঝনো হয়। যেমন, আমরা বাংলায় বলি, আমি মনে মনে বলেছি। এই চিন্তাটাও...অনেক সময় আপনি এভাবে চিন্তা করেন, আমি অবশ্যই এটা বা ওটা করবো। এমনকি সেই চিন্তার সাথেও ইনশাআল্লাহ যুক্ত থাকা উচিত। এমনকি সেই মনে মনে বলা কথার সাথেও।

মাঝে মাঝে ইনশাআল্লাহ যুক্ত থাকে না। মাঝে মাঝে শুধু আমার মাথায় পরিকল্পনা থাকে, এই সপ্তাহে এই কাজটা করবো, পরের সপ্তাহে ঐটা করবো, আগামী কাল অমুক জায়গায় যাবো, এরপর ঐ মিটিং-এ যোগ দিবো -- আচ্ছা মনে থাকবে। কিন্তু, ইনশাআল্লাহর কথা আপনার মনে ছিল না। আর মনে থাকা উচিত ছিল।

অনেক সময় আপনি হয়তো কারো সাথে ফোনে কথা বলছেন আর ভবিষ্যতের কোনো ব্যাপারে ওয়াদা দিলেন। 'তোমার সাথে রাতের খাবারে যোগ দিবো।' 'ঠিকাছে, দেখা হবে তাহলে।' আসসালামু আলাইকুম বলে রেখে দিলেন। এরপর মনে হলো, ওহ! আমি তো ইনশাআল্লাহ বলিনি। তারমানে এটা নয় যে, আপনি আবার তাকে কল করে বলবেন, ইনশাআল্লাহ বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। তাই, এখন বলছি, ইনশাআল্লাহ। না, এমনটা করবেন না। সেই ব্যক্তিকে ইনশাআল্লাহ শুনতে হবে না। আল্লাহ আজ্জা শুনতে চান যে, আপনি এটা বলেছেন। আপনাকে শুধু আপনার রবের দিকে ফিরে বলতে হবে, ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ বলেন - وَاذْكُر رَّبَّكَ إِذَا نَسِيتَ - "আর তোমার রবের কথা স্মরণ করো যখন ভুলে যাও।"

- নোমান আলী খান

পঠিত : ৪৬৫ বার

মন্তব্য: ০