ভাষা সৈনিকদের জবানে বাঙালিদের অবস্থান
তারিখঃ ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১৪:৫৩
ভাষা আন্দোলন ছিল বাঙালীর কিছু অংশের দাবী। বাঙালিরাই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে ছিলেন না। আজ এই বিষয় নিয়ে লিখছি। এটাকে লিখা বললে ভুল হবে। এটা মূলত সংকলন। যারা ভাষা সৈনিক ছিলেন তাদের জবানীতেই আমরা দেখবো ঐ সময় পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ আসলে কী চেয়েছিল?
ভাষা আন্দোলনের আলোচনায় যার কথা সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হওয়া উচিত তার নাম প্রিন্সিপ্যাল আবুল কাসেম। তিনি ১৯৪৭ সালে ঢাবির তরুণ অধ্যাপক। তার নেতৃত্ব এবং কর্মতৎপরতায় প্রতিষ্ঠিত হয় তমুদ্দুনে মজলিশ। আবুল কাসেম সাহেব ভাষা আন্দোলনের মূল সংগঠক। তাকে যখন প্রশ্ন করা হল, দেশ বিভাগের পর রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কিত চিন্তা ভাবনা ও পরিবেশ কেমন ছিল?
জবাবে তিনি বলেন, দেশ বিভাগের পর পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা হতে পারে কিনা এ নিয়ে চিন্তাভাবনা করার মত খুব কম লোকই ছিল। শুধু তাই নয়, অনেকে প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্যভাবে উর্দুর সমর্থক ছিলেন। তার ঐতিহাসিক কারণও ছিল। অখণ্ড ভারতে বর্ণহিন্দুরা কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভার মাধ্যমে হিন্দীকে যেমন ভবিষ্যত রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার সব রকমের চেষ্টা চালাচ্ছিলেন- তেমনি মুসলমানরাও হিন্দীর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণের যুক্তি ও দাবী পেশ করে সোচ্চার হয়ে উঠেন। এ ব্যাপারে কংগ্রেসের সর্বোচ্চ নেতৃবৃন্দের হিন্দীর প্রতি সমর্থন মুসলমানদেরকে উর্দুর প্রতি ঠেলে দেওয়া ত্বরান্বিত করে। দেশ বিভাগের পর পাকিস্তানের শাসক মহল হতে একদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে অবহেলা করা হয়। অপর দিকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে প্রথমে পূর্ব-পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) শিক্ষিত সমাজ চরম উদাসীন থাকে।
আবুল কাসেম সাহেব বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রচারণার জন্য একটি বই লিখেছেন। যেখানে তিনি যুক্তি দিয়ে লিখার চেষ্টা করেছেন কেন রাষ্ট্রভাষা বাংলা হওয়া জরুরী? বইটি ক্যাম্পাসে কেমন সাড়া জাগিয়েছিল?
এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, সত্যিকারে বলতে কি, এ বইটি কেনার মত ৫ জন লোকও প্রথমে ক্যাম্পাসে পাওয়া যায় নি। মজলিসের কর্মীদের সঙ্গে করে বইটি নিয়ে অনেক জায়গায় ছুটে গিয়েছি কিন্তু দু'এক জায়গায় ছাড়া প্রায় সব জায়গা হতেই নিরাশ হয়ে ফিরে এসেছি। পাকিস্তান লাভের সফলতা তখন সারা জাতিকে মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছে। এ সময় রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে একাধিক ভাষার প্রশ্ন তোলা যে কত মারাত্মক ক্ষতিকর', আর বিশেষ করে পাকিস্তানের জন্য ২টি রাষ্ট্রভাষা যে কত বড় “অবাস্তব” প্রস্তাব তাই যেন সেদিন সকলে বুঝাবার চেষ্টা করতেন। কেউ বলতে চাইতেন এটা ‘পাগলামী’ ছাড়া আর কিছু নয়।
ক্যাম্পাসে তখনকার শ্রেষ্ঠ শিক্ষা কেন্দ্র “মুসলিম হল” ও “ফজলুল হক হলেও” আমরা রাষ্ট্রভাষা বাংলার ব্যাপারে বৈঠক করার চেষ্টা করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছি। শুধু তাই নয়, আমরা রুমে রুমে গিয়েও ব্যক্তিগত আলোচনা চালিয়েছি, কিন্তু দু’একজন ছাড়া প্রায় ছাত্রই এ বিষয়ে বিরূপ ভাব দেখিয়েছেন। "উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলেই বা কি, এ নিয়ে মাথা ঘামাবার কিছু নেই।' এই ছিল তখনকার সাধারণ মনোভাব।
সত্য কথা বলতে কি সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে ছাত্র ও কর্মীদের এত চেষ্টা সত্ত্বেও জনসাধারণ এ আন্দোলনের বিরুদ্ধাচরণ করতে থাকে। তার সংগে যোগ হয় সরকারী প্রচার। অতিপ্রগতিশীলদের কয়েকটি গোপন পোস্টারকে ভিত্তি করে নির্লজ্জভাবে সরকার প্রচার করতে থাকে যে এটা রাষ্ট্রের শত্রুদের কাজ। ফলে জনসাধারণ আরো ক্ষেপে উঠে। এ সময়ে ইউনিভার্সিটির নিকটস্থ তমদ্দুন মজলিসের অফিসটি স্থানীয় লোকেরা লুট করে-প্রকাশ্যভাবে ভীতিপ্রদর্শন করে অফিসটি উঠিয়ে দেয়। বলাবাহুল্য যে, এ মজলিস অফিসই ছিল সংগ্রাম পরিষদের তথা ভাষা আন্দোলনের কেন্দ্রীয় অফিস।
ঢাকার জনসাধারণ ভাষা আন্দােলনের ফলে খুবই ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে। তারা ভাষা আন্দোলনকে সন্দেহের চোখে দেখতে থাকে। মজলিস কর্মীদের ও ছাত্রদের তখন শহরে প্রবেশ একেবারে অসম্ভব হয়ে পড়ে। মজলিস কর্মী মোঃ সিদ্দিকুল্লা (সলিমুল্লা হলের তৎকালীন জেনারেল সেক্রেটারী) ছদ্মবেশে বলিয়াদি প্রেসে হ্যাণ্ডবিল ছাপাতে গিয়ে কসাইটুলীতে বন্দী হন এবং তাঁকে কেটে ফেলার মুহুর্তে জনৈক দয়াশীল লোকের দ্বারা মুক্ত হয়ে পলায়ন করতে সমর্থ হন। আমার নিজের উপর কয়েকবার হামলা হয়। ঢাকা কলেজের অধ্যাপক এ,কে,এম, আহসান সাহেবকেও মারপিট করা হয়। এইভাবে ছাত্র ও কর্মীরা রমনাতে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে।
যদিও প্রিন্সিপ্যাল কাসেম সাহেব বলেছেন, নির্লজ্জভাবে সরকার প্রচার করেছে ভাষা রাষ্ট্রের শত্রুদের কাজ। কিন্তু কাসেম সাহেব সেই গোপন পোস্টারগুলো এড়িয়ে যেতে পারেন নি। ভাষা আন্দোলনের পক্ষে সেসব পোস্টারে ইসলাম ও পাকিস্তানকে কটাক্ষ করা হয়েছে। কমিউনিস্টদের প্রচারণা চালানো হয়েছে। কাসেম সাহেব যদিও ইসলামবিরোধী নন তারপরও তিনি তার আন্দোলনকে জমানোর জন্য হিন্দুত্ববাদী, কমিউনিস্ট ও ইসলামবিরোধীদের সহায়তা নিয়েছেন। যার দরুণ ঢাকার জনসাধারণের কাছে ভাষা আন্দোলনের আবেদন নষ্ট হয়ে যায়। এটি স্পষ্ট ষড়যন্ত্র হিসেবে প্রতীয়মান হয়।
বাঙলার পক্ষের লোকেরা কয়েকশো স্বাক্ষর জড়ো করে কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের নিকট তাদের দাবীর পক্ষে জনমত আছে তা বোঝাতে চেয়েছেন। এর বিপরীতে বাঙলা বিরোধী আন্দোলনও তখন জমে উঠে। এই প্রসঙ্গে আবুল কাসেম বলেন, এদিকে উর্দু সমর্থক আন্দোলন গড়ে উঠে। স্বনামখ্যাত মৌলানা দীন মোহাম্মদ সাহেব প্রমুখকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন মহল্লায় ও মফস্বলের বহুস্থানে উর্দুকে সমর্থন করে বহু সভা করা হয়। এঁরা কয়েক লাখ দস্তখত যোগাড় করে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে এক মেমোরেণ্ডাম পেশ করেন। পথেঘাটে ইস্টিমারে এ স্বাক্ষর সংগ্রহের কাজ চলে। স্বাক্ষর সংগ্রহের পর কয়েকজন নাম করা ব্যক্তি করাচীতে গিয়ে সরকারের কাছে পেশ করে আসেন।
মিডিয়া সাপোর্টও খুব একটা ছিল না বাংলার পক্ষে। আবুল কাসেমের ভাষায়, তখনকার ঢাকার “মর্নিং নিউজ" ও সিলেটের “যুগভেরী” জঘন্যতমভাবে ভাষা আন্দোলনের বিরুদ্ধে লিখতে থাকে। ‘মর্নিং নিউজ’ সম্পাদকীয়তে ও চিঠিপত্র বিভাগে মজলিসকে রাষ্ট্রদ্রোহী প্রতিষ্ঠান বলে ঘোষণা করা হয়। 'যুগভেরী’ একদিন এমনও লিখে যে, তমদ্দুন মজলিস একটি ভয়ঙ্কর বিপ্লবী প্রতিষ্ঠান। ভাষা আন্দোলনের এ সংগঠন ঢাকাতে সমান্তরাল সরকার (Porollel Government) প্রতিষ্ঠা করে ট্যাক্স আদায় করছে।
ঢাকা ভার্সিটির ছাত্রদের মধ্যেও বাঙলা-বিরোধী আন্দোলন জমে উঠে। এই প্রসঙ্গে কাসেম সাহেব বলেন, বাঙালি ছাত্র সমাজের একটা অংশও তখন উর্দু সমর্থক আন্দােলনে যোগ দেয়। রায় সাহেব বাজার হতে এরূপ এক ছাত্র মিছিল বের হয়ে ঢাকা কলেজে আসে। আন্দোলনের সময় ফজলুল হক হল হতেও ছাত্রনেতা শামছুল হুদা সাহেবের নেতৃত্বে বাংলা বিরোধী এক ছাত্র মিছিল বের করা হয়। এক সময় ঢাকার নবাব সাহেব ফুলতলায় (ঢাকা স্টেশন) আমাদের এক মিছিলে লোক লেলিয়ে দিয়ে লাঠিপেটা করান। এ হামলায় বিখ্যাত সমাজকমী নাজির আহমদ সহ আমরা বহুজন আহত হই।
ভাষা আন্দোলনে তমুদ্দুনে মজলিশ জনসাধারণের সমর্থন পাওয়াতো দূরের ব্যাপার ঢাবির ছাত্রনেতাদের কাছে পেলেও ছাত্রদের নিরঙ্কুশ সমর্থন পায়নি। এর মধ্যে কবি হাসান হাফিজুর বহু উর্দু সমর্থক ছাত্রকে মারধর করেন। এতে পরিস্থিতি আরো বিরূপ হয়। ভাষা নিয়ে প্রথম সহিংসতা শুরু করে ভাষা আন্দোলনকারীরা এই ব্যাপারে কাসেম সাহেবের জবানীতেই শুনুন,
"১৯৪৮ সনের প্রথম দিক। এত বিপত্তি সত্বেও আন্দোলন চলতে থাকে। ধর্মঘটে যোগ দেয়ার জন্য রেল শ্রমিকের সংগে ও কেন্দ্রীয় কর্মচারী সমিতির সাথে আমি যোগাযোগ করি। নির্দিষ্ট দিনে ২২শে মার্চ ইউনিভার্সিটি প্রাঙ্গনে মিটিং হয়। মিটিং-এর পর মিছিল বের হয়। মিছিলকে হাইকোর্ট পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খলভাবে এগিয়ে নেয়া হয়। কিন্তু ইতিমধ্যে মন্ত্রীত্বলোভীদের সমর্থকেরা অন্যান্য স্যাবোটিয়ারদের সঙ্গে মিলে কতকগুলো অশোভন কাজ করে বসে।
বহু ঘন্টা ধরে সেক্রেটারিয়েট ঘিরে রাখা হয়। জনৈক মন্ত্রীকে সেক্রেটারিয়েট হতে বের করা হয় এবং তিনি বাঙলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে না পারলে পদত্যাগ করবেন বলে লিখিতভাবে প্রতিশ্রুতি দিতে বাধ্য হন ও আগাম পদত্যাগ পত্র লিখে দেন। সে পদত্যাগ পত্র আমার কাছে দেয়া হয়। আমি নিজে এগিয়ে গিয়ে সেক্রেটারিয়েটের সামনের প্রাঙ্গন হতে তাকে রক্ষা করি।ইতিমধ্যে এই খবর শহরে ছড়িয়ে পড়ে। খবর আসে যে কিছু লুংগি পরা শহরের গুণ্ডা সেক্রেটারিয়েটে ঢুকে পড়েছে। তখন তাদের আক্রমণের ভয়ে ছাত্ররা সেক্রেটারিয়েট ছেড়ে চলে যায়। এ সময়ে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
মন্ত্রী জনাব আবদুল হামিদ সাহেবের বাগান নষ্ট করা হয়। আর একজন মন্ত্রীর দাড়ি ধরে অপমান করা হয়। সেক্রেটারিয়েটের জনৈক নিরীহ পুলিশকে আধমরা করে রাখা হয়। এর ফলে জনসাধারণের মধ্যে দারুণ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। তারা ছাত্রদের মারার জন্য সলিমুল্লা হল ও ফজলুল হক হল আক্রমণ করবে বলে খবর আসতে থাকে। ছাত্রদের নিয়ে আমরা সারা রাত গোট বন্ধ করে ছাদে উঠে পাহারা দিতে থাকি। এক বিভীষিকাময় অবস্থার মধ্যে কয়েক দিন সকলকে সময় কাটাতে হয়।
- ভাষা আন্দোলনঃ সাতচল্লিশ থেকে বায়ান্ন/ পৃঃ ৩২-৩৩, ৩৬-৩৭, ৪৫-৪৭
ভাষা আন্দোলনে কমরেড তোয়াহা এক উজ্জ্বল নাম। তিনি যদিও সেসময়ে প্রকাশ্যে মুসলিম লীগ করতেন তবে অনেকেই তাকে কমিউনিস্ট হিসেবে সন্দেহ করতো। সেই সন্দেহকে মিথ্যে হতে দেন নি তোয়াহা। পরবর্তিতে সরাসরি কমিউনিস্ট পার্টির নেতা হিসেবে কাজ করেছেন। জনবিচ্ছিন্ন ভাষা আন্দোলন পরবর্তিতে ঢাবির ছাত্রদের ভালো সমর্থন পেয়েছিল। এর কৃতিত্ব কমরেড তোয়াহার।
বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার দাবী ঢাকার তৎকালীন স্থানীয় জনসাধারণের মাঝে কি ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল? এই প্রশ্নের জবাবে কমরেড তোয়াহা বলেন,
জনসাধারণকে এমন একটা ধারণা দেয়া হচ্ছিল যে, রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবী তুলে ছাত্ররা পাকিস্তান ও ইসলামিক আদর্শের খেলাপ কাজ করছে। বিশেষ করে তৎকালীন মহল হতে ভাষা আন্দোলনের বিরুদ্ধে নানাভাবে ঢাকার স্থানীয় জনসাধারণকে উত্তেজিত করা হচ্ছিল। ফলে সিদ্দিক বাজার, নাজিরা বাজার প্রভৃতি সংশ্লিষ্ট এলাকার স্থানীয় জনগণ একদিন মারমুখো হয়ে এসে তমদ্দুন মজলিস অফিসে হামলা চালায় এবং সব কিছু তছনছ করে দেয়। এ ঘটনার পর পরই আমি অন্যান্য তমদ্দুন মজলিস কর্মীদের সাথে অফিসের কাগজ-পত্র সরিয়ে আনি।
এসময় একদিন রাষ্ট্রভাষা বাংলার স্বপক্ষে ইশতেহারবিলি করতে গিয়ে ছাত্ররা একদিন চকবাজারে জনতা কর্তৃক ঘেরাও হয়। তখন পরিস্থিতি খুবই প্রতিকূল ছিল। ছাত্ররা উত্তেজিত জনতার সামনে অসহায় অবস্থার সম্মুখীন হয়। এসময় গোলাম আযম সাহস করে এগিয়ে যান। তিনি চিৎকার করে জনতার উদ্দেশ্যে বলেন, “আরে ভাই আমরা কি বলতে চাই তা একবার শুনবেন তো।” এই বলেই তিনি রাষ্ট্রভাষা বাংলা হলে পূর্বপাকিস্তানের জনগণের কি উপকার হবে তার ওপর ছােট-খাট বক্তৃতা দিয়ে উপস্থিত জনতাকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন।
- ভাষা আন্দোলনঃ সাতচল্লিশ থেকে বায়ান্ন/ পৃঃ ৫৬- ৫৭
অধ্যাপক শাহেদ আলী তমুদ্দুন মজলিসের অন্যতম সংগঠক। সেই সাথে ভাষা আন্দোলনের প্রথম দিককার অগ্রগামী যোদ্ধা। ভাষা আন্দোলনের মুখপাত্র "সৈনিক" পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন তিনি।
রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবী প্রশ্নে তখন যে প্রতিকূল পরিবেশ বিরাজ করছিল সে সম্পর্কে নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, পরিবেশ একেবারেই প্রতিকূল ছিল। সাধারণ ছাত্ররাও প্রথমে ততটা গভীরভাবে রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নটি ভেবে দেখেনি। আর মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সমাজ তো রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীটি প্রথম থেকেই ভালো চোখে দেখেন নি। পুরোনো ঢাকাতে ভাষার দাবী নিয়ে কোন আলাপই করা যেতো না। আর পুরোনো ঢাকার কথাই বা বলি কেন? আমার নিজের জেলা সিলেটের অবস্থাও ছিল তার চেয়ে সঙ্গীন। সেখানে ভাষার দাবী নিয়ে মুখ খোলার কোন উপায় ছিল না। সবাই তখন পাকিস্তান নিয়ে বিভোর! নতুন বিতর্ক শুনতে কেউ রাজী নয়। ’৪৮ সালে আমি সিলেটের এম, সি, কলেজে গেলাম মজলিসের উদ্যোগে ভাষা প্রশ্নে কিছু আলাপ-আলোচনা করতে। কিন্তু বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবী নিয়ে অনেকে রীতিমত উপহাস করলেন। এসব গুণী ব্যক্তিগণ এখন অতি উচ্চ সরকারী পদে অধিষ্ঠিত আছেন। তারা তখন বাংলা যে রাষ্ট্রভাষা হতে পারে এটা কল্পনাও করতে পারেন নি।
সিলেটে তমদ্দুন মজলিসের সেক্রেটারী জনাব দেওয়ান মোহাম্মদ ওহিদুর রেজা চৌধুরীর উদ্যোগে রাষ্ট্রভাষা বাংলার স্বপক্ষে মিটিং আহবান করা হয়। কিন্তু জনমত এত প্রতিকূল ছিল যে মিটিং থেকে জোর করে মাইক কেড়ে নেয়া হলেও আমাদের কিছু করার ছিল না।
তিনি আরো বলেন, সারা দেশে (ভাষা আন্দোলন) বিস্তৃতি লাভ করাতাে দূরের কথা ঢাকাতেও অনেক স্থানে রাষ্ট্রভাষার স্বপক্ষে প্রচার চালাতে গেলে নাজেহাল হতে হতো। পুরোনো ঢাকার চকবাজার, সিদ্দিকবাজার, কলতাবাজার প্রভৃতি এলাকায় সবসময় রাষ্ট্রভাষার দাবী নিয়ে কথা বলা যেতো না। কলতাবাজার, রায়সাহেব বাজার দিয়ে ছাত্রদের নিরাপদে আসার উপায় ছিলনা। ছাত্র দেখলেই তারা এইসব আন্দোলনে জড়িত থাকার কারণে মারধর করতো। তাই আমরা নবাবপুর রোড দিয়ে না এসে শাখারী পট্টির ভেতর দিয়ে নয়া বাজার, বংশাল হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আসতাম।
- ভাষা আন্দোলনঃ সাতচল্লিশ থেকে বায়ান্ন/ পৃঃ ১০৪, ১১৮
অধ্যাপক গোলাম আযম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে এক অনুজ্জ্বল ব্যাক্তি। যদিও ভাষা আন্দোলন শুরুর সময়ে তিনি ডাকসুর জিএস ছিলেন এবং জিএস হিসেবে ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন তথাপি পরবর্তিতে ৭১ এ তিনি পাকিস্তানপন্থী ছিলেন বলে তার এই কর্মকান্ড চাপা পড়ে। তৎকালীন ঢাকার সাধারণ বাঙ্গালিদের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি বলেন,
পাকিস্তান আন্দোলনের সময় থেকেই সিদ্দিক বাজার, বংশাল ও চকবাজার এলাকা মুসলিম প্রধান বিধায় যে কোন আন্দোলনের প্রতি জনসমর্থনের জন্য সেখানে যেতে হতো। তাই একদল ছাত্র নিয়ে মিছিল সহকারে একদিন চকে গিয়েছিলাম। চুংগা ফুঁকে রাষ্ট্রভাষার স্বপক্ষে শ্লোগান দিচ্ছি। জেলের প্রধান ফটক অতিক্রমকালে জেলের ভেতর থেকেও আমাদের গ্রেফতারকৃত সাথীরা শ্লোগানে সাড়া দিয়ে আমাদের সমর্থন জানালো। চক পর্যন্ত যেতে যেতে আমরা তাদের শ্লোগান শুনলাম।
চকবাজার মসজিদের পাশে যখন ভাষার দাবীতে চুংগার মাধ্যমে বক্তৃতা দিচ্ছিলাম, তখন সরকার সমর্থক এবং রাষ্ট্রভাষা বাংলার কিছু বিরোধী লোক হামলা করে, আমার হাত থেকে চুংগা কেড়ে নিয়ে মাথায় ও গায়ে চুংগা দ্বারা মারতে থাকে। আমরা বুঝিয়ে তাদের শান্ত করার চেষ্টা করি।
টিনের চুংগা ফুকে পুরোনাে ঢাকার আরো অনেক জায়গায় বক্তৃতা করেছি। শ্লোগান দিয়েছি-“বাংলা উর্দু ভাই ভাই, উর্দুর সাথে বাংলা চাই'। ভাষা প্রশ্নে তাদের সমর্থন পাওয়া যায়নি। তবে বাংলার বিপক্ষে সব জায়গা থেকে হামলা হয়নি। পুরোনো ঢাকায় মাওলানা দীন মুহাম্মদ (মরহুম), মাওলানা জাফর আহমদ ওসমানী, মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী প্রমুখের প্রভাব থাকায় এখানকার অধিবাসীরা উর্দুর পক্ষে ছিল।
তদানীন্তন প্রাদেশিক সরকার রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নটিকে ভারতের উস্কানী ও হিন্দুদের আন্দোলন বলে প্রচার করায় জনমনে এ সম্বন্ধে সন্দেহ ছিল। এ কথা অস্বীকার করা যায় না যে, এ আন্দোলনে সবাই একই উদ্দেশ্যে শামিল হয়নি। আরেকটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে। পূর্ব-পাক সাহিত্য সংসদের একজন সক্রিয় সদস্য হিসেবে সৈয়দ আলী আহসানের সাথে আমার খানিক পরিচয় ছিল। সে সূত্রে তার সাথে পুরোনো রেডিও অফিসে (বর্তমান বোরহান উদ্দীন কলেজ) রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে একবার কথা কাটাকাটি হয়েছিল। তিনি রাষ্ট্রভাষা বাংলার বিরোধী ছিলেন। এমনি ধরনের আরো অনেকে ছিলেন। এতে প্রমাণিত হয় অনেক বুদ্ধিজীবী এবং সুধীমহলের সমর্থন তখনও বাংলার পক্ষে ছিল না।
কারা ভাষা আন্দোলনের বিরোধীতা করেছিল? এমন কথার জবাবে অধ্যাপক গোলাম আযম বলেন, এঁদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের লোক ছিলেন। কেউ কেউ কায়েদে আযমের অন্ধ অনুরাগী। কায়েদে আযম যা বলেছেন এর বিরোধিতা করার কথা এঁরা চিন্তা করতেও পারতেন না।
এ দেশের ওলামা সমাজ উর্দুর পক্ষে ছিলেন। এর কারণ হয়ত তাদের পরিচিতি বাংলার চেয়ে উর্দুর সাথে ছিল ঘনিষ্ঠতর। এ প্রসংগে পল্টনে মাওলানা দীন মোহাম্মদ সাহেবের এক জনসভার কথা মনে পড়ে, তিনি সভায় উর্দুতে বক্তৃতা শুরু করলে আমরা ছাত্ররা 'বাংলায় বলুন' বলে ধ্বনি তুলি। তখন তিনি বলে উঠেন, “সিনেমা হলে উর্দু ছবি না হলে মন ভরে না, এখন চান বাংলায় বক্তৃতা’। আমরা চুপ করে যাই। আমাদের তেমন সমর্থকও ছিল না। তখন তিনি উর্দুতেই বক্তৃতা করেন।
খাজা নাজিমুদ্দীন সাহেবের সমর্থকরা উর্দুর পক্ষে ছিলেন। কারণ পাকিস্তানের সংহতির জন্য তারা একটা রাষ্ট্রভাষার প্রয়োজনীয়তা বোধ করতেন এবং এজন্য ভাষা আন্দােলনকারীদের তারা হিন্দু কমিউনিষ্টদের এজেন্ট মনে করতেন।
আর একটা শ্রেণীও বাংলা ভাষার বিরোধিতা করেছেন। এরা সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপটে উর্দুকে হিন্দির বিরুদ্ধে মুসলিম জাতির সাধারণ ভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইতেন।
- ভাষা আন্দোলনঃ সাতচল্লিশ থেকে বায়ান্ন/ পৃঃ ১২৩ - ১২৫
কাজী গোলাম মাহবুব ১৯৪৮ সাল থেকে ভাষা আন্দোলনে যুক্ত হয়েছেন। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের তিনিই ছিলেন আহবায়ক। জনগণের মাঝে ভাষা আন্দোলনের কি প্রতিক্রিয়া হয়েছিল?
উত্তরে তিনি বলেন, জনগণের মাঝে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ঢাকার অধিবাসীরা এসব তৎপরতার বিরুদ্ধে ছিল। তাদের মনোভাব ছিল, পাকিস্তান সবেমাত্র দুধের বাচ্চা, আর তোমরা এর মুখের দুধের বোতল নিয়ে টানাটানি শুরু করেছো? তাই ছাত্রদের রাষ্ট্রভাষার স্বপক্ষে তৎপরতাগুলো তারা ভালো চোখে দেখতো না। অনেক শিক্ষিত লোকের মাঝেও এ ব্যাপারে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল।
- ভাষা আন্দোলনঃ সাতচল্লিশ থেকে বায়ান্ন/ পৃঃ ১৬৬
ডাঃ সাঈদ হায়দার ১৯৫২ সালে ঢাকা মেডিকেলের শেষ বর্ষের ছাত্র ছিলেন। মেডিকেলের ছাত্রদের মধ্যে তিনিই নেতৃত্ব দেন।
ভাষা আন্দোলনের সময়কার ঘটনার কথা স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ১৯৪৭ সালের শেষের দিকের ঘটনা। সম্ভবত ডিসেম্বরের দিকে। দিনক্ষণ সঠিক মনে করতে পারছি না। আমাদের পলাশী ব্যারাকের ছাত্রাবাসের সামনের রাস্তায় ভাষা প্রশ্নে প্রথম প্রতিরোধ দ্বন্দ্ব সংঘটিত হলো। ছাত্রাবাসের সামনের সেই রাস্তাটি লেভেল ক্রসিং পেরিয়ে সোজা সলিমুল্লাহ হলের সামনে এসে মিশেছিলো। সেদিন এ রাস্তা দিয়ে জন পঞ্চাশেক লোকের এক মিছিল উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার স্বপক্ষে শ্লোগান দিতে দিতে নাজিরাবাজার ও মৌলভীবাজারের দিক থেকে এসে হাজির হয়। এদের অধিকাংশই ছিল পুরোনো ঢাকার স্থানীয় অধিবাসী এবং নবাবদের সমর্থক। প্রতিরোধ এলো, তাদের অগ্রগতিকে বাধা দিতে বেরিয়ে এলো ছাত্ররা। সে এক খণ্ড যুদ্ধ।
- ভাষা আন্দোলনঃ সাতচল্লিশ থেকে বায়ান্ন/ পৃঃ ২৬৪
তৎকালীন সময়ে শিল্পী কাজী আবুল কাসেমের অংকিত একটি কার্টুন। এই কার্টুন দেখেও আন্দাজ করা যায় ভাষা আন্দোলন ইসলামের প্রতিপক্ষ হিসেবে অবস্থান নিয়েছে। সদ্য জন্ম নেয়া মুসলিম রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে একটি ষড়যন্ত্র।
পাঠক আপনি এখন নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন এটা কি আসলে বাঙালিদের আন্দোলন ছিল? না কি বাঙালিদের মধ্যকার একটি ক্ষুদ্র অংশের? এর বিরোধীতা কি পাকিস্তানীরা করেছিল? নাকি বাঙালিরাই এর বিরোধীতা করেছিল? আজ যদি চট্টগ্রামের লোকেরা বলে চট্টগ্রামের সব অফিসিয়াল কাজকর্ম চাটগাঁর ভাষায় হবে যেভাবে রোহিঙ্গাদের ভাষা চাটগাঁ। চাটগাঁকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে হবে। সিলেটিরা যদি বলে তাদের ওখানে তাদের ভাষা চলবে। এভাবে নোয়াখালী, বরিশালরাও যদি ঝামেলা সৃষ্টি করে? তখন কি আর বাংলাদেশ থাকবে?
মন্তব্য: ০