Alapon

সবর...



“বাবা,আমি এই বিয়ে করবো না। দয়া করে আমাকে এই লোকের সাথে বিয়ে দিবেন না।”
অনেক সাহস নিয়ে কথাটা বলেছিল সেদিন।জবাবে কয়েকটা চড় আর তিরস্কার পেয়েছিল অরু।

৫বছর আগে...

(১) অরু আর নূর দুইজন একই কলেজে পড়াশোনা করছিল।একদম অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব ছিল তাদের।নূরের আচার-আচরণ, রবের প্রতি ভালবাসা ইত্যাদি অরুকে প্রচুর মুগ্ধ করতো।মুসলিম পরিবারে জন্ম হলেও ধর্ম সম্পর্কে তেমন কোন জ্ঞান ছিল না তার।নূরের সাথে পরিচয় হওয়ার পর ধীরে ধীরে সেও অন্ধকার জগৎ হতে আলোর পথে চলা শুরু করেছিল।নূর তার জীবনে রবের দেওয়া অন্যতম অনুগ্রহ ছিল।

জীবন খুব ভালভাবেই কাটছিল।দুই বান্ধবী একসঙ্গে দ্বীনের পথে চলছিল।যদিও অরুর পথে মাঝে মাঝে বাধা আসতো কিন্তু নূরের সহযোগিতায় সে কখনো ভেঙে পড়তো না।হঠাৎ করেই অরুর জীবন বদলে গেল।তার সব সুখে গ্রহণ লেগেছিল। বাবা এমন একটা লোকের সাথে বিয়ে দিতে চেয়েছিল যার দ্বীন সম্পর্কে কোন ধারণা নেই, বিন্দুমাত্র নেই! যেটা আছে সেটা হল কাড়ি কাড়ি টাকা। অনেক বুঝিয়েছিল তার মা'কে।কিন্তু বাবার জেদের কাছে অবশেষে হেরে গেল সে।আসিফের সাথে বিয়েটা আটকানো সম্ভব হয়নি আর। সময়ের সাথে তার নিয়তি মেনে নিয়েছিল অরু।

(২)
বিয়ের পর সামান্যতেই আসিফের নানা অত্যাচার, রাগ সহ্য করতো সে। আক্ষেপ ছিল না,যেখানে নিজের মা-বাবার কাছেই সে বোঝা ছিল সেখানে অন্যের কাছে সম্মান পাওয়া তো আকাশ-কুসুম ভাবনা।এর মাঝেই তার দুঃখের গল্পে এক চিলতে সুখ দিয়েছিলেন রব।তার কোলে এসেছিল পরী।রূপকথার পরীরা যেমন জাদু করে ঠিক তেমনি তার মেয়েও জাদু করতে পারে, একবার তাকালেই যেন সব কষ্ট কমে যায়। তাই শখ করে নাম দিয়েছিল পরী!কিন্তু আসিফের কাছে পরীর আগমন তেমন সুখকর ছিল না।তার মতে মেয়েরা হল বোঝা, তার উপর প্রথম সন্তান মেয়ে। সে তো চেয়েছিল একটা ছেলে যে তার বংশের প্রদীপ হবে।

এই আক্ষেপে অরুর উপর নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে গেল।মেয়ের দিকে তাকিয়ে সব মুখ বুজে সহ্য করতো সে।মনে মনে বলতো,নিশ্চয়ই রবের সাহায্য নিকটে।

বছর দুয়েক পরে অরুর মধ্যে আবার নতুন অস্তিত্বের আগমন ঘটলে, সে ভেবেছিল,এবার হয়তো আসিফের পরিবর্তন হবে।কিন্তু তার নিয়তিতে অন্যকিছু ছিল।আল্ট্রা রিপোর্ট দেখে ডাক্তার যখন বলেন, মেয়ে হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, তখন আসিফের ধৈর্যের বাধ ভেঙে গেল।মুহূর্তেই অগ্নিমূর্তি ধারণ করে রাগের মাথায় অরুকে প্রহার করতে থাকে। এক পর্যায়ে এতজোড়ে ধাক্কা দেয় যে মুহূর্তেই সব শেষ হয়ে যায়। অরুর মা হওয়ার স্বপ্ন ভেঙে গুড়িয়ে যায়।অল্পের জন্যে পরপারে যাওয়া হয়ে উঠেনি তার।বাবা এসেছিল সেদিন হাসপাতালে। অরু তাকায়নি।তার মতে,এ মানুষগুলোও দায়ী তার বাচ্চার মৃত্যুর জন্যে।

(৩)
কিছুদিন পর এক অদ্ভুত ঘটনা হল।হাসপাতাল থেকেই বাবা অরুকে বাড়ি নিয়ে গেল সাথে আসিফের সাথে সব সম্পর্কের ইতি টেনে দিল।সেদিন প্রথম মনে হয়েছিল,তার বেঁচে থাকা না থাকায় বাবার একটু হলেও যায় আসে।সেদিন আসিফ কে বলেছিল,
"আপনার জন্যে আমার বাচ্চা দুনিয়ার আলো দেখেনি। অথচ আপনার চোখে বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নেই।জানেন,ফিরাউন এখনো আছে, আপনার মতো মানুষের রূপেই বেঁচে আছে।মনে রাখবেন, আমার রব কখনো কারও সাথে অবিচার করেন না,তিনি ন্যায়বিচারক।অপেক্ষার প্রহর গুনা শুরু করুন।"

সেদিন রাতে বাবা বলেছিল, "অরু মা,আমায় ক্ষমা করে দে।আজ আমার জন্যে তোর জীবন নষ্ট হয়ে গেল।আমিই নিজ হাতে আমার মেয়ের জীবন ধ্বংস করে দিলাম!" এই প্রথম অরু বাবার চোখে রাগ,অহংকার দেখে নি।শুধু অনুশোচনা আর অশ্রু দেখেছিল।
সে বলেছিল,"বাবা, সব আমার নিয়তি, রবের পরীক্ষা ছিল।আপনি নিজের সম্মানের কথা না ভেবে যে, আমাকে আর আমার পরীকে ঐ নরপশুর কারাগার হতে মুক্ত করেছেন তাতেই আমি খুশি। আমার কোন আক্ষেপ নেই আর।শুধু বলবো, টাকা থাকলেই মানুষ সুখী হয় না,রবের সন্তুষ্টি অর্জনের মধ্যেই রয়েছে জীবনের প্রশান্তি! "

(৪) বাবা নেই আজ দেড় বছর। পরীর বয়সও চার হয়েছে। আসিফ তখনই নতুন সংসার শুরু করেছিল এখন জমজ ছেলের বাবা।সমাজ নামক হিংস্র প্রানীর আক্রমণও বেড়েই চলছে।অরু হতাশ হয় না।এখন সে একজন মুসলিমাহ এবং মা।এদের যে সহজে ভেঙে পড়তে নেই। গতকাল বড় ভাই এসেছিল তার এক বন্ধুর প্রস্তাব নিয়ে অরুর কাছে।প্রায়ই এরকম প্রস্তাব আসে।বাবা মারা যাওয়ার পর থেকেই ভাবীর কাছে বোঝার পাত্রীতে পরিণত হয়েছে সে।

ভদ্রলোকের স্ত্রী গত হয়েছে তিন বছর। নাম সাদাফ।ভীষণ ভালবাসতো নাকি স্ত্রী কে।কিন্তু ছেলের জন্মের সময়ই মারা গিয়েছিল।এতদিন দাদী দেখতো বাচ্চা কে।কিন্তু কিছুদিন আগে তিনিও রবের কাছে চলে গেলেন।তাই বাধ্য হয়েই অরুকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন। ভদ্রলোকের ছেলেকে দেখেছিল অরু।নাম উমর।ভীষণ আদুরে একবারের জন্যে মনে হল সে যেন তার হারানো সন্তানকে ফিরে পেয়েছে।তাই বাচ্চার কথা ভেবে এই প্রস্তাব এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি তার।

বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে এসব স্মৃতিচারণ করছিল অরু।আজও অন্তরে রক্তক্ষরণ হয় তার সে অনাগত সন্তানের কথা ভেবে।আকাশও যেন কান্না করছে তার কষ্টে। পরমুহূর্তেই ভাবে, আছিয়া আলাইহিস সালামও তাঁর সন্তানদের হত্যা হতে দেখেছেন নিজ স্বামীর হাতেই।তিনি তো তাদের আর্তনাদও শুনেছেন।কই তিনি তো ভেঙে পড়েন নি।সবর করেছেন,রবের উপর হতাশ হন নি।আমার সন্তান তো দুনিয়ায় আসার আগেই চলে গিয়েছে। তাছাড়া রব তো আমায় পরী দিয়েছেন।এটাই কি যথেষ্ট না কৃতজ্ঞ হওয়ার জন্যে?

অন্তর থেকে জবাব আসে,'হ্যাঁ, যথেষ্ট। নিশ্চয়ই আমার রব আমায় ভালবাসেন।'

(৫)সাদাফের সাথে অরুর বিয়ে হয়েছে বেশ কিছুদিন হলো। কিন্তু তাদের মাঝে অনেক দূরত্ব। এই সম্পর্ক যেন দায়িত্বের সম্পর্ক। এ নিয়ে বিন্দুমাত্র কষ্ট নেই অরুর।সেই স্বপ্ন অনেক আগেই মাটিচাপা দিয়েছে সে।সাদাফ অন্তত তাকে সম্মান করে এটাই অনেক।
কিছুদিন আগে পরীর বেশ জ্বর এসেছিল।সেদিন অরু সাদাফের অন্যরূপ দেখেছে।সারারাত জেগে জলপট্টি দিয়েছিল সে। মেয়ের সামান্য জ্বরেই যেন দিশেহারা অবস্থা।অরু বলেছিল,
'অনেক রাত হয়েছে,আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন।আমি আছি তো পরীর সাথে!'

সাদাফ বেশ রাগ করে বলেছিল,
'পরী আমারও মেয়ে।আমার বাচ্চা অসুস্থ আর আমি নিশ্চিন্তে ঘুমাবো তুমি ভেবেছো কেমনে? এতটাও দায়িত্বজ্ঞানহীন বাবা নই আমি!'
সেদিন অরু অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল শুধু।রব অন্তত তার মেয়ের কপালে বাবার আদর রেখেছেন। অতঃপর আজ তার মেয়ে সত্যিকারের বাবা পেয়েছে।সারারাত এই সুখে বালিশ ভিজিয়েছে অরু।
পরী আর উমর কে নিয়ে ভালোই দিন কাটছিল অরুর।এর মধ্যেই বিয়ের এক বছর শেষে অরুর জীবনে নতুন রঙ এসেছিল। সেদিন সাদাফের মুখে প্রথম 'প্রিয়তমা ' ডাক শুনেছিল সে।মুহূর্তেই যেন সব বদলে গেল তার জীবনে। সেদিন সাদাফ বলেছিল,
"প্রিয়তমা! অতঃপর আজ সময়ের কাটায় এক বছর পার করেছি তোমার সঙ্গে। তুমি হলে সেই বহু প্রতীক্ষিত বৃষ্টি যা আমার হৃদয় মরুভূমিতে করেছে সজীবতার সৃষ্টি। তুমি এক অদ্ভুত অনুভূতি যার গভীরতা জানা নেই কতখানি, শব্দে যদি ব্যক্ত করা যেত তবে বলতাম,'ভালবাসি'! কিন্তু প্রিয়তমা এর গভীরতা যে তার চেয়েও বেশি।শুধু জানতে চাই জান্নাতেও কি হবে মোর অর্ধাঙ্গিনী?আমি যে হতে চাই চিরকালের সঙ্গী !!"
সেদিন অরু কিছুই বলেনি,বলতে পারেনি!শুধু মাথা দুলিয়েছিল।সুখের অশ্রু যে সহজে থামে না,থামানো যায় না!!

(৬)আজ ৩০বছর পর...
সেদিন শুনেছিল,আসিফের নাকি ক্যান্সার হয়েছে। ছেলেরা তার সকল সম্পত্তি নিজেদের নামে করে চিকিৎসা খরচের ভয়ে তাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে এসেছে।সেদিন অরু মনে মনে বলেছিল, ' আসিফ, সেদিন ছেলের শোকে আপনি আমার বাচ্চাকে হত্যা করেছিলেন।আমার জীবন ধ্বংস করেছিলেন। অথচ বিন্দুমাত্র অনুতপ্ত ছিলেন না আপনি।আজ যে ছেলের আশায় সেগুলো করেছিলেন তারাই আপনাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছে।ভয় নেই,আপনাকে আমি ক্ষমা করে দিয়েছি অনেক আগে। আমি তো জানি, আমার রব কখনো তার বান্দার প্রতি অবিচার করেন না।শুধু সবর করতে হয়!আজ আপনার পরিণতিতে একটি আয়াতই মনে আসছে,
"এটি তোমার দুই হাতের কর্মের কারণে, আল্লাহ বান্দাদের প্রতি জুলুম করেন না!" (২২:১০)

আজও মুশুলধারে বৃষ্টি হচ্ছে।জানালার গ্রিল ভেদ করে অরু নিষ্পলক চেয়ে আছে আকাশ পানে।প্রকৃতি যেন সতেজতা ফিরে পেয়ে খিলখিল করে হাসছে।আজ সে আকাশের কান্না দেখছে না এই বৃষ্টির পানিতে। রবের অনুগ্রহ যেন চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে তার হাতে।
আনমনে বলে ওঠে সে, "হে আমার রব,আমি তো আপনাকে ডেকে কখনো ব্যর্থ হইনি!"[সূরা মারইয়াম-৪]

- জান্নাত

পঠিত : ৩৭৬ বার

মন্তব্য: ০