Alapon

|| স্মৃতিতে আটাশে ফেব্রুয়ারি : প্রীতিতে সাঈদি ||

আজ ২৮ শে ফেব্রুয়ারি। তেরো সালের এই দিনের একটা রায়কে কেন্দ্র করে নারী-শিশু-বৃদ্ধসহ খুন করা হয়েছে প্রায় দুশোজনের কাছাকাছি নিরীহ নিরাপদ মানুষকে । মানুষগুলোও নিজের প্রাণের মায়াকে তুচ্ছ আর নগন্যজ্ঞান করে নেমে পড়েছে ময়দানে । বুলেট-বোমা আর টিয়ারগ্যাসের কোনো পরোয়া করে নি মোটেও । তাদের চোখের সামনেই একের এক নিরীহ মানুষ বুলেটবিদ্ধ হচ্ছে, লাশ হয়ে বাড়ি ফিরছে কেউ কেউ, তবুও তারা নির্বিকার! একজন মানুষকে মানুষ এতো ভালোবাসে। সেই ভালোবাসার জন্যে জীবনটা পর্যন্ত বিলিয়ে দিতে পারে -সত্যিই অবাক করার মতো। সেই মানুষটাকে আমিও প্রচন্ডরকম ভালোবাসতাম। ভালোবাসিও। হতে চাইতাম সেই মানুষের মতোই। যেখানে যে পথেই যেতাম মানুষটার কন্ঠ কানে বেজে আসতো। কখনো ছিলো সেই কন্ঠে তীব্র হুংকার, কখনো প্রবল মায়া, কখনো শিশুর মতোই কান্নাঝরে পড়তো সে কন্ঠ থেকে । তিনি আর কেউ নয়, বাংলার এবং বিশ্বেরও চিরচেনা একটি নাম - আল্লামা দেলওয়ার হোসাইন সাঈদী ( হাফিজাহুল্লাহ) !

দীর্ঘ সময় থেকে বাংলাদেশের মানুষের মন-মননে তিনি যতোটা প্রভাব বিস্তার করেছে, এরকমটা কম মানুষই পেরেছে। এতোটা জনপ্রিয়তা আর কোনো ধর্মীয় কিংবা রাজনৈতিক নেতা আজ অবধি বাংলাদেশে পায় নি, কখনো পাবে কিনা -তাও ভাবার বিষয়। তিনি ছাড়া দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তির জন্যে বাংলাদেশের মানুষ এমন করে জীবন দিয়েছে -এমন নজির আমার সম্মুখে নেই।

তাফসির মাহফিলগুলোকে সত্যিকারের তাফসিরের মাহফিল হিসেবেই তিনি গড়ে তুলেছেন। পাশাপাশি ইসলামি হুকুমাত এবং ভারতীয় মুশরিকদের আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধেও বজ্রকঠিন ভূমিকা পালন করেছেন। যার কারণে তিনি চক্ষুশূল হয়ে পড়েন তাদের।

এবার গ্রেফতার এবং ফাসির আদেশ দেওয়ার পূর্বেও তিনি আরো গ্রেফতার হয়েছেন। সর্বপ্রথম ১৯৭৫ সালের জুলাইয়ে শেখ মুজিবুর রহমান তাঁকে খুলনায় একটা মাহফিলে আলোচনা করে ফেরার পথে গ্রেফতার করে। এবং তার ১৭ দিনের মাথায় গিয়ে মুজিব খুন হয়। বিভিন্ন মাহফিল-সমাবেশে ওনাকে গুলি-বোমা মেরে হত্যা করার প্রচেষ্টা করা হয়। ১৯৭৩ সালে খুলনার একটা মাহফিলে বামপন্থীরা ওনাকে লক্ষ্য করে গুলিও বোমা হামলা চালায়। পাবনার পুস্পপাড়া কামিল মাদ্রাসায় ওনাকে মাহফিলে খুন করতে আড়াল থেকে গুলি চালায় কমিউনিস্ট পার্টির লোকজন। এই কমিউনিস্টরা তখন খুবই বেশি শক্তিশালি ছিলো। তাই তারা কোনো ইসলামি জলশা-মাহফিল সহ্য করতে পারতো না! সেই দিনের হামলায়ও তিনি বেঁচে যান। ওনার সাথে ছিলেন তখন সেই মাদ্রাসার প্রধান মুহাদ্দিস। গুলির আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে শাহাদাত বরণ করেন তিনি, সেখানেই। এইভাবে অসংখ্যবার তিনি হামলার শিকার হন , আর আল্লাহর রহমতে তিনি আজো অক্ষত আছেন।

এবার আওয়ামি লিগ ফাসির আদেশ দিলেও বাংলাদেশের ইসলাম প্রিয় মানুষের প্রতিবাদের মুখে, আত্মত্যাগের কারণে তারা পিছিয়ে যায়। যাবজীব্বন কারাদণ্ড দিয়ে ওনাকে ধীরে ধীরে হত্যার আয়োজন করে। কিন্তু তবুও তিনি বিচলিত নয়। সামান্যতম মনোবলও হারান নি। কোনো ধরনের কম্প্রোমাইজ আজো করেন নি। আমরা মহান ইমামদের, সাহাবিদের জীবনীতে দেখেছি -শতো নিষ্পেষণেও জালিমের কাছে মাথানিচু করেন নি তারা , আজ আমরা আল্লামা সাঈদিকেও বাস্তবেই দেখি আমাদের পূর্বসূরীদের মতোই সুদৃঢ় ঈমানের অধিকারী , আর তৃপ্ত হই, উদ্দিপ্ত হই -ওনার ঈমানের অবিচলতা দেখে। এই ভেবে আনন্দিত হই যে, আমার মতো কোটি কোটি মানুষজন এই মহান মানুষের মতোই হতে চেয়েছে, চেয়েছি।

আমরা আমাদের শৈশব কৈশোরে তাঁকে খুবই ফলো করতাম। নিজেকে মনে মনে সাঈদি হিসেবে কল্পনা করতাম। দলমত নির্বিশেষে কোটি কোটি মানুষও তাই চাইতো। তা-ই করতো। আসোলে দল কী মত কী -তা বুঝতামও না। শুধু এতোটুকুনই বুঝতাম আর স্বপ্ন দেখতাম -একদিন আমিও সাঈদি হবো, কুরআনের কথাগুলো বিলিয়ে যাবো। অনেক মানুষকে জান্নাতের পথের যাত্রী বানাবো। নিজেও হবো। আমার ভেতর সেই স্বপ্ন তৈরি করে দিয়েছেন আমার নানা। আমার নানা। আল্লাহ নানা জানের কবরকে ফিরদৌসের বাগানে পরিণত করুন। যখন পিচ্চি ছিলাম, হিফয পড়াবস্থাতেই আমার একজন উস্তাদ আমাকে রেদওয়ান হোসাইন সাঈদিই ডাকতো। সে কারণে আমিও শখের বশে নিজের নামের সাথে সাঈদি যুক্ত করতে শুরু করি। আমার এবং তাদের সেই স্বপ্ন আজও স্বপ্নই রয়ে গেছে। হতে পারিনি কুরআনের পাখি খ্যাত আল্লামা সাঈদির মতো সেই কুরআনের পাখি।

আমার চোখে কমই পানি আসে, যতোই কষ্ট পাই না কেনো, পানি আসে না। কিন্তু ওনার গ্রেফতার থেকে ফাসির আদেশ পর্যন্ত সময়গুলোতে আর নিজেকে সংবরণ করতে পারি নি। সারাক্ষণ সারাদিন যাবত চোখের জলে বুক বাসতো। কতোবার চেয়েছি সেই দিন মানে আটাশে ফেব্রুয়ারিতে আমিও গিয়ে প্রতিবাদে শামিল হই , কিন্তু আমি একে তো ছোটো মানুষ আবার শিবিরের সাথেও আমি সক্রিয় না। তার ওপর আবার যেই এলাকায় থাকতাম সেখানে পুলিশের যুদ্ধযুদ্ধ ভাব নিয়ে অবস্থান। তাই সবমিলিয়ে কোনো সাহস এবং সুযোগ পাই নি। কিন্তু মুনাজাতে চোখের পানি ঢেলে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করে প্রিয় মানুষটার জন্যে কান্না করেছি। আর কিছুক্ষণ পরপর টিভি নিউজের দিকে তাকিয়ে পরিস্থিতি অবলোকন করার চেষ্টা করেছি। লাশের পর লাশ আর বুলেটের আঘাতে আহত হওয়া দেহের পর দেহগুলো দেখে আরশের মালিকের কাছে এই ভয়াল পৈশাচিকতার বিচার চেয়েছি। বাংলাদেশের ইতিহাসে একদিনে তখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ খুনের রেকর্ড দেখেছি। কীভাবে পুলিশ তারই দেশের নাগরিকদের পাখির মতোন গুলি করে খুন করতে পারে -বিশ্ববাসী তা নিজ চোখে দেখলো।

এখনো বহু বহু মানুষ লোকটার জন্যে চোখের জল ঢেলে আল্লাহর কাছে কান্না করে। খোঁজ খবর নেয়। এলাকার বহু বৃদ্ধ মানুষ এখনো বাড়ি এলে জিজ্ঞেস করে -সাঈদি হুজুরের কী খবর ? তিনি কি ছাড়া পাবে না! জালিম কি ওনাকে মুক্তি দিবে না!! কিচ্ছু বলার থাকে না সহজ সরল সেই মানুষগুলোকে। অথচ ওল্লাহি - ওই মানুষগুলো জামায়াতে ইসলামী তো দূরের কথা, কোনো রাজনীতির সাথেই যুক্ত না। রাজনীতি কি বুঝেও না। বুঝে না কোনো ধর্মীয় ফেরকাও!

মুশরিকদের তাবেদার সরকার মিথ্যে অপবাদে তথাকথিত মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচার করতে ওনাকে বন্দী করলেও সরকার নিজেই সেই ঘৃণ্য বর্বরোচিত ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করতে তারচে বড়ো মানবতা বিরোধী অপরাধ পরিচালনা করেছে তার জনগণের ওপর। একদিন কড়ায়-গণ্ডায় এ-সব অপরাধের বিচার হবে। দুনিয়ায় না হলে আল্লাহর আদালতে তো রেহাই হবে না কারো । ইন শা অাল্লাহ !!
সেই প্রতিক্ষায় দিনগুনি....

|| স্মৃতিতে আটাশে ফেব্রুয়ারি : প্রীতিতে সাঈদি ||
~রেদওয়ান রাওয়াহা

পঠিত : ৬৬৮ বার

মন্তব্য: ০