Alapon

সর্বাবস্থায় কি জিকির করা যাবে?


সর্বাবস্থায় কি জিকির করা যাবে?

একবোন জানতে চেয়েছেন যে, তিনি সর্বোচ্চ পরিমানে জিকির করতে চান এবং জিকির করার মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদাত করতে চান যত বেশি সম্ভব। আর তিনি সবসময় জিকিরে লিপ্ত থাকার অভ্যাস গড়ে তুলতে চাচ্ছেন। তাই, তিনি জিজ্ঞেস করছেন, জিকির কি করা যাবে অজুহীন অবস্থায়, মাসিক অবস্থায় এবং নাপাক অবস্থায়? তিনি আরো জানতে চেয়েছেন, দৈনন্দিন কাজ করার সময় কি জিকির করা যাবে? যেমন, শপিং করার সময়, বাসের জন্য অপেক্ষারত অবস্থায়? আর সে সময় তিনি আসলে মনোযোগ দিতে পারেন না, এমতাবস্থায় কি জিকির করার অনুমতি আছে নাকি গুনাহ হবে? কারণ, জিকির করার সময় তো পূর্ণ মনোযোগ দিতে হয়।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা কুরআনে বলেছেন - يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اذْكُرُوا اللَّهَ ذِكْرًا كَثِيرًا - হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে অধিক স্মরণ কর। وَسَبِّحُوهُ بُكْرَةً وَأَصِيلًا - এবং সকাল-সন্ধ্যায় আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর। (৩৩ঃ ৪১-৪২)
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা কুরআনে আরও বলেছেন - وَالذَّاكِرِينَ اللَّهَ كَثِيرًا وَالذَّاكِرَاتِ - "আল্লাহর অধিক যিকরকারী পুরুষ ও যিকরকারী নারী।" (৩৩:৩৫)
তাহলে আল্লাহ আমাদেরকে কুরআনে আদেশ করেছেন অধিক পরিমাণে জিকির করার জন্য। তাই, আল্লাহর জিকির করার জন্য আমাদের চেষ্টা করা উচিত যত বেশি সম্ভব। আর রাসূল (স) বলেছেন - এক ব্যক্তি এসে তাঁকে জিজ্ঞেস করল, আপনি আমাকে কী করার উপদেশ দান করেন? রাসূল (স) বলেন - তোমার জিহ্বাকে সর্বদা আল্লাহর জিকিরে নিয়োজিত রাখো।
অন্য একটি হাদিসে এসেছে - এক বয়স্ক ব্যক্তি এসে বলল, ও আল্লাহর রাসূল! অন্য যুবক সাহাবীদের মত আমি এতোটা শক্তিশালী নই যে, বেশি বেশি নামাজ পড়বো এবং রোজা রাখবো। তাই, আমাকে এমন কিছু বলুন যা করে আমি তাদের সমমর্যাদায় পৌছতে পারি। তখন, রাসূল (স) তাঁর জিহ্বা স্পর্শ করে বললেন,(আলাইকা বি জিকরিল্লাহ) আমি তোমাকে আদেশ করছি যে সর্বদা আল্লাহর জিকির করতে থাকো।
একটি হাদিসে কুদসিতে এসেছে, আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন, أَنَا عِنْدَ ظَنِّ عَبْدِيْ بِيْ - আমি আমার বান্দার নিকট তেমন যেমন সে আমার সম্পর্কে ধারণা করে। সে যদি কোন সভায় আমাকে স্মরণ করে, তাহলে আমি তাকে তাদের চেয়ে উত্তম ব্যক্তিদের (ফিরিশতাদের) সভায় স্মরণ করি। সুতরাং সে যদি তার মনে আমাকে স্মরণ করে, তাহলে আমি তাকে আমার মনে স্মরণ করি...।
মূল পয়েন্ট হলো, আপনি যত বেশি আল্লাহর জিকির করবেন তত বেশি আল্লাহর কাছাকাছি হতে পারবেন।
এখন, আপনার প্রশ্নের দুইটি দিক আছে। এক, আমি কি যে কোন অবস্থায় জিকির করতে পারব? উত্তর হলো, হ্যাঁ সর্বসম্মতিক্রমে। আলহামদুলিল্লাহ্‌। এই বিষয়েই একেবারেই কোন মতানৈক্য নেই। সকল স্কলার বলেছেন, আপনি আল্লাহর জিকির করতে পারবেন… সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ্‌, আস্তাগফিরুল্লাহ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ - যা কুরআনের কোন তিলাওয়াত নয় - আপনি আল্লাহর জিকির করতে পারবেন, দুআ করতে পারবেন ওজু অবস্থায়, ওজু ভেঙ্গে গেলেও, যদি আপনি নাপাক অবস্থায় থাকেন, যদি মাসিক অবস্থায় থাকেন -- এটা কোন ব্যাপার না। আল্লাহর জিকির করা যাবে এবং করা উচিত যে কোন অবস্থায়।
আল্লাহ কুরআনে উল্লেখ করেছেন - الَّذِينَ يَذْكُرُونَ اللَّهَ قِيَامًا وَقُعُودًا وَعَلَىٰ جُنُوبِهِمْ - যাঁরা দাঁড়িয়ে, বসে, ও শায়িত অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে। এখানে ইঙ্গিত হলো, আপনি সর্বাবস্থায় আল্লাহর জিকির করবেন। আয়েশা (রা) মন্তব্য করেন - আল্লাহর রাসূল (স) সর্বাবস্থায় আল্লাহর জিকির করতেন। তিনি সর্বদা আল্লাহ জাল্লা জালালুহুর জিকির করতেন। তাই, আপনাকে বিশেষ কোন অবস্থায় থাকতে হবে না বা কোন দিকে মুখ করতে হবে না, অথবা নিজের উপর কোন শর্ত আরোপ করতে হবে না - আল্লাহর জিকির করা যাবে এবং করা উচিত যে কোন অবস্থায়।
শুধু এক অবস্থায় জিকির করতে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। আর সে অবস্থা হলো, ওয়াসরুমে (টয়লেটে) থাকাবস্থায় মুখে জিকির করা। সে সময় জিহ্বা দিয়ে জিকির করা উচিত কাজ হবে না। এমনকি সে সময়ও আল্লাহর কথা মাথায় আনা যাবে কিন্তু, মুখে নয়। ইকরিমা (র) - সাহাবাদের বিখ্যাত এক ছাত্র - তিনি ওয়াসরুমে থাকাবস্থায় জিহ্বা দিয়ে জিকির করতেন না। তিনি বলেন - আমি ওয়াসরুমে থাকাবস্থায় অন্তর দিয়ে জিকির করতাম। তিনি বলেছেন - ওয়ালাকিন বি কাল্বিহি। তাহলে, বিখ্যাত তাবীঈর কথা হলো, যখন তুমি ওয়াসরুমে থাকো, তোমার জিহ্বা দিয়ে জিকির করো না, কিন্তু তোমার অন্তর দিয়ে, যদি কোন চিন্তা আসে আর সে চিন্তার জন্য তুমি আল্লাহকে ধন্যবাদ দিতে চাও, আল্লাহর কোন নেয়ামতের কথা যদি তোমার মনে আসে, তখন তুমি মনে মনে আল্লাহর প্রশংসার কথা স্মরণ করতে পারো। কিন্তু জিহ্বা দিয়ে নয়।

এখন, প্রশ্নের দ্বিতীয় অংশের জবাব। আমাকে কি সবসময় মনযোগী বা খুশু অবস্থায় থাকতে হবে? কারণ, আমরা জানি কুরআন খুশু অবস্থায় পাঠ করা উচিত এবং আমাদের পক্ষে যতটুকু সম্ভব মনোযোগ দেওয়া উচিত। জিকিরের জন্য আপনাকে খুশু অবস্থায় থাকতে হবে না। এটা একটা অভ্যাসে পরিণত হতে পারে আর আপনি অভ্যাসের জন্য পুরস্কৃত হবেন। তৎসত্ত্বেও, পুরস্কারের পরিমাণ, পুরস্কারের মান নির্ধারিত হবে আপনার নিয়তের মান অনুযায়ী।
অতএব, আপনি যদি জিকির করতে অভ্যস্ত হোন তার জন্য পুরস্কার পাবেন -- যে কোন অবস্থায়। মনে করুন, মার্কেটে গিয়েছেন আর নিচু আওয়াজে বলছেন সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ্‌। এই অভ্যাসের জন্য আপনি পুরস্কার পাবেন। আল্লাহ আপনার উপর রহমত বর্ষণ করবেন, সকল কাজে বারাকাহ দিবেন।
কিন্তু, এই বিষয়ে কোন প্রশ্নের অবকাশ নেই আপনি যদি অন্তর থেকে সুবহানাল্লাহ বলেন, মুখে যা বলেছেন তা আসলেই বুঝাতে চেয়েছেন, সত্যই আল্লাহর গুণকীর্তন করতে চেয়েছেন -- এতে কোন সন্দেহ নেই যে এই ধরণের জিকিরের মর্যাদা অন্য লেভেলের। অন্যদিকে কেউ যদি অভ্যাস বশত বলে, সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ্‌, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবর -- সে তার চেয়ে অনেক অনেক উত্তম যে কখনোই জিকির করে না।
অতএব, শুরুতে অভ্যাস গড়ে তুলুন। খুশু বা আন্তরিকতা গড়ে তোলার এটাই প্রথম পদক্ষেপ। কারণ, সবকিছুর স্তর আছে। আপনি তো শুরুতেই সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছতে পারবেন না। তো, প্রথম স্তর হল, সার্বক্ষণিক আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার জিকির করার অভ্যাস গড়ে তুলুন। আল্লাহকে স্মরণ করার জন্য নিজেকে প্রশিক্ষিত করে তুলুন -- যেখানেই থাকেন না কেন। আল্লাহর প্রশংসায় নিজেকে নিয়োজিত করুন।
সেরা জিকির হলো চারটি। সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার। এই চারটি জিকির করার মাধ্যেম আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হোন। নিজের জীবনের প্রতিটি নিঃশ্বাসে, প্রতিটি পদক্ষেপে, প্রতিটি ফ্রি সময়ে, এই জিকির-আজকারগুলো বলতে থাকুন। এরসাথে যদি আরো যোগ করতে চান, বলুন, লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ, আস্তাগফিরুল্লাহ, রাব্বানা আতিনা ফিদ দুনিয়া হাসানাতাও ওয়া ফিল আখিরাতে হাসানা ওয়া কিনা আজাবান নার। এভাবে বিভিন্ন দুআ করতে থাকুন। তাহলে, আপনার সারাদিন আল্লাহর জিকিরে পূর্ণ থাকবে।
আর আল্লাহর শাস্তি থেকে বাঁচার অন্যতম শক্তিশালী একটি উপায় হলো এই জিকির। আমাদের রাসূল (স) বলেছেন - মুসনাদে ইমাম আহমদের একটি হাদিস - "আল্লাহর জিকিরের চেয়ে কোন কিছু মানুষকে বেশি জাহান্নাম থেকে বাঁচাবে না।" অন্য কথায়, মানুষকে জাহান্নাম থেকে সবচেয়ে বেশি বাঁচাবে আল্লাহর জিকির।


-- শায়েখ ইয়াসির কাদি।

পঠিত : ৫০১ বার

মন্তব্য: ০