Alapon

|| তাঁরা : বদলে দিয়েছে বদলে গিয়েছে -০১ ||



একটা মুখরোচক শ্লোগান আমরা হরহামেশাই দেখতে পাই, আমাদের চোখের সমুখে। সেই শ্লোগান হোলো— "বদলে যাও বদলে দাও ! " কিন্তু কী বদলাবো, কীভাবে বদলাবো? কাকে বদলাবো-কতোটুকু বদলাবো? কী আদর্শকে সামনে রেখে-কাকে এবং কাদের সামনে রেখে, কার থেকে কী শিক্ষা নিয়ে আমরা বদলে যাবো বা বদলে দেবো—সেই বিষয়ের স্পষ্ট ধারণা নেই আমাদের। কিংবা দেয়া হয় না , অথবা এমন কিছুকে বা কাউকে সামনে এনে বলে "এভাবে বদলে যাও, এটাকে বদলে দাও " যার বা যেটার সাথে দেখা যাচ্ছে আমার আদর্শের স্পষ্ট সংঘাত !

আমরা যেহেতু মুসলিম , আল্লাহর গোলাম, মুহাম্মাদ স্বল্লাল্লাহু অা'লাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মাত ; আমাদের আদর্শ যেহেতু ইসলাম এবং আমাদের অনুপ্রেরণা যেহেতু আসহাবে রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু অা'লাইহি ওয়াসাল্লাম, সেহেতু কীভাবে আমাদের বদলে যেতে হবে, কীভাবে বদলে দিতে হবে, আল্লাহর হাবিব মুহাম্মদ স্বল্লাল্লাহু অা'লাইহি ওয়াসাল্লাম কীভাবে ওনার সাথিদের কীভাবে বদলে দিয়েছেন কিংবা তারা কীভাবে বদলে গিয়েছেন— আমাদের কাছে যদি সে বিষয়টি স্পষ্ট থাকে , তা যদি আমাদের জানার সীমানায় থাকে তাহলে আমরা তা মানার শামিয়ানাও শামিল করতে পারবো, একদিন না একদিন। ইন শা অাল্লাহ ! এইসব আমাদের জানার সীমানায় থাকলে অন্য কারো বদলে যাওয়া কিংবা বদলে দেওয়ার সাময়িক কিছু চটকদার শব্দ শুনে আমরা বিভ্রান্ত হবো না, বিভ্রান্ত হয়ে আমরা আমাদের শেকড় বদলে ফেলবো না। আমরা তখন কীভাবে কতোটুকু আমাদের বদলাতে হবে তা জেনে নিজেদেরকে সত্যিকারার্থেই যথাযথভাবে বদলাতে পারবো, পারবো পৃথিবীটাকেও বদলে দিতে। তাহলে চলুন , কথা আর না বাড়িয়ে আজকে একটি গল্প শুনি, আর দেখি শিক্ষার্থী হিসেবে সেই গল্প থেকে কতোটুকু শিক্ষা নিতে পারি বদলে যাওয়ার আর বদলে দেওয়ার ! আজকে আমরা আমাদের বদলে যাওয়ার আর বদলে দেওয়ার এই পাঠটা নেবো বিখ্যাত সাহাবি, আল্লাহর রাসুলের প্রিয় সাথি আবু উবাইদা ইবনুল যাররাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে।

তখন মুসলিম জাহানের খলিফা উমার ইবনুল খাত্তাব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)। তিনি ইসলামি ভূখণ্ড বৃদ্ধির জন্যে , তাওহিদের বিশুদ্ধ বার্তা ছড়িয়ে দেবার জন্যে একের পর এক বাহিনি প্রেরণ করতে লাগলেন, আশেপাশে। চারিদিকে। তার-ই ধারাবাহিকতায় ইয়াযিদ ইবন আবু সুফিয়ান , শুরাহবীল, আমর ইবনুল আস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা) প্রমুখ সাহাবিদের সমন্বয়ে একটি সম্মিলিত বাহিনি সিরিয়ায় ও এর আশপাশের অঞ্চলে অভিযান পরিচালনা করার জন্যে পাঠানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এই সম্মিলিত বাহিনির সর্বাধিনায়ক নিয়োগ করলেন আবু উবাইদা ইবনুল জ্বাররাহকে (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) ।

সকলকে অভিযানে পাঠিয়ে দেয়ার পরে খোঁজ-খবর নেয়ার উদ্দেশে আমিরুল মু'মিনীন স্বয়ং নিজেও সফরে বের হোলো। আমিরুল মু'মিনীন সফরে এসেছে শুনে সকলে তাঁর সাথে দেখা করতে এলো। অতঃপর একে একে সকলেই তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করে গেলেন। একপর্যায়ে আমীরুল মুমিনীনের সম্মুখে এসে হাজির হলেন জেনারেল আবু উবাইদা ইবনুল যাররাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)। অন্যান্যদের তুলনায় তিনি এতোটাই সাদামাটা অবস্থায় সামনে এলেন যে, তাঁর দর্শনে তিনি অসম্ভবরকম স্তম্ভিত হয়ে পড়লেন ৷ গায়ে তাঁর অতি সাধারণ আরবীয় পোশাক। যে উটে তিনি চড়েন, সেই উটের লাগামটিও নিতান্তই নগন্য। খুবই সাধারণ একটা রশি।

তাঁর এই হালত দেখে আমিরুল মু'মিনীন উমার ইবনুল খত্তাব ( রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) তাঁর বাসস্থানে যান। সেখানে গিয়ে তিনি আরো ভড়কে গেলেন। তিনি দেখতে পেলেন —তাঁর বাহিরের যাপিত যে জীবন— ভেতরের জীবন তারচেয়েও অধিক সরল। আরো অধিক সাদামাটা। তিনি ইসলামি খিলাফায় খলিফার নিয়োকৃত সেনাবাহিনীর একজন সর্বাধিনায়ক জেনারেল। সেই তাঁর নিকট তাঁর বাসভবনে একটি ঢাল-তলোয়ার ও উটের একটি হাওদা ছাড়া আর কিচ্ছু নেই!

মুসলিম জাহানের খলিফা , আমিরুল মু'মিনীন এসব দেখে ওনাকে বললেন :
- হে আবু উবাইদা ! আপনি আপনার জন্যে যা প্রয়োজন , সেই প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের বন্দোবস্তো তো করে নিতে পারতেন। তিনি বুঝাতে চাইলেন —একজন সেনাপ্রধান হিসেবে তো এসব বিষয় আপনার প্রাপ্যই। বাইতুলমাল থেকে তো আপনার জন্যে ফাণ্ড বরাদ্দ আছেই । আছে মাজলিশে শুরায় এর জন্যে বাজেটও পাশ করা!
- কিন্তু আবু উবাইদা ইবনুল যাররাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু) জবাব দিলেন— ইয়া আমীরুল মু’মিনীন! আমাদের জীবনধারণের জন্যে স্রেফ এতোটুকুনই যথেষ্ট। এরচে' বেশি কিছুর প্রয়োজন নেই আমার।
-
- তাঁর পরিচালিত ইসলামি রাষ্ট্রের এতো বড়ো একজন দায়িত্বশীল মানুষ এতোটা মিতব্যয়ী, জীবনজুড়ে তাক্বওয়ার এতোটা বর্ণিলরূপ —দেখে তাঁর অন্তরে যেনো এক অনির্বচনীয় প্রশান্তির হিন্দোল বয়ে যেতো লাগলো। নির্বাক হয়ে পড়লেন আমিরুল মু'মিনীন!

আরো একবার খলিফাতুল মুসলিমীন, আমিরুল মু'মিনীন উমার ইবনুল খত্তাব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) চার হাজার দিরহাম আবু উবাইদা ইবনুল যাররাহ ( রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ) নিকট পাঠালেন। হাদিয়া স্বরূপ। সেসব ওনার হস্তগত হবার সাথে সাথে তিনি সমুদয় অর্থই নিজের অধীন সৈনিকদের মধ্যে বিলি-বণ্টন করে দিলেন। রাখলেন না নিজের জন্যে একটি পয়সাও। বিষয়টি উমার ইবনুল খত্তাবের কানে গেলো। এইশুনে তিনি অবাক-খুশি হন। মন্তব্য করেন— আলহামদুলিল্লাহ ! ইসলামে এমন লোকও আছে!!

তিনি এত্তো বড়ো একটা সেনাবাহিনীর সিপাহসালার হওয়া সত্ত্বেও চলন-বলন ছিলো সাধারণ সৈনিকদের মতোই। এতোটাই সরল-সাধারণ যে , সৈনিকদের সাথে একসঙ্গে থাকলে তিনি যে বিশাল একটা সেনাবাহিনীর প্রধান সিপাহসালার তা বুঝা যেতো না। একবার এক রোমান দূত এসে জিজ্ঞেস করে —আপনাদের সেনাপতি কে ? সৈনিকরা আঙ্গুল উঁচিয়ে তাঁকে দেখিয়ে দিলো। তখন লোকটি সেনাপ্রধান আবু উবাইদা ইবনুল যাররাহ'র ( রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ) এমন স্বাভাবিক অবস্থান দেখে এবং সাদামাটা পোশাক অবলোকন করে ভীষণ আর্শ্চান্বিত হয়ে গেলো!

এখন দেখুন, আমরা যদি এভাবে কোনো ছোট্ট একটা পদও পাই। সেই পদ পেয়ে দায়িত্বশীল হবার পরিবর্তে কী করি —নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। সুইজ ব্যংকে টাকা পাচারের বন্দোবস্তো করি। হাঙ্গেরিতে বাড়ি করি। সিঙ্গাপুরে ফ্ল্যাট কিনি। আমার চোদ্দগুষ্ঠিকেও করে দিই। যেই পদে, যেই চেয়ারে যিনিই আসীন হই না কেনো —সেই চেয়ারের যাচ্ছেতাই ব্যবহার করে থাকি। কোনো একটা সংগঠন , কোনো একটা প্রতিষ্ঠান এবং রাষ্ট্রের ক্ষুদ্র একটা পদও যদি অধিকার করতে পারি — আমার প্রাপ্য সকল সুবিধে আদায় তো করিই , অন্যের অধিকারেরও বারোটা বাজিয়ে দিই। কোনো হাদিয়া -উপঢৌকন আমার নামে আসলে তা তো কড়ায়-গণ্ডায় আদায় করিই —অন্যেরগুলোও ভাগিয়ে নিই।

যদি কখনো ছোট্ট একটা দলের, কোনো একটা ভুঁইফোঁড় সংগঠন-সংস্থারও ক্ষুদ্র একটা পদের মালিক হই , তখন আমার ভাবসাব হয় অন্যরকম। আমার দাপটে আমার গরমে, আমার অহংকারে— আমার আশেপাশে ভেড়াও দায় হয়ে যায় ! নিজেকে যতোভাবে প্রদর্শন করা যায় তার কোনোটা করতেও কসুর করি না। বাস্তব দুনিয়ার বিষয়টি বাদ-ই থাকুক না—অনলাইনের দিকেই তাকিয়ে দেখুন , এখানের একটু ভালো পরিচয় থাকলে, কিছুটা সেলিব্রিটি টাইপের হয়ে ওঠলে আমাদের অবস্থা কেমন হয় !! আরো অনেক কিছুই বলা যায়। কিছুটা না বলা-ই থাকুক না। সব তো আর বলার দরকার নেই। নিজ দায়িত্বেও কিছু বিষয় বুঝে নিতে হয়।

আবু উবাইদা ইবনুল যাররাহ ( রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ) কী করেছেন, কীভাবে করেছেন তা তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি। কীভাবে, কোন পদ্ধতিতে বদলে যেতে হয়-বদলে দিতে হয় — তার উজ্জ্বল উদাহরণ তিনি। তাঁর এবং তাঁদের বদলে যাওয়া আর বদলে দেওয়া শুধু শ্লোগান নির্ভর নয়। তাঁর এবং তাঁদের বদলে যাওয়া আর বদলে দেওয়া হোলো সত্যিকারের বদলে যাওয়া !

|| তাঁরা : বদলে দিয়েছে বদলে গিয়েছে -০১ ||
~রেদওয়ান রাওয়াহা

পঠিত : ২৮৮ বার

মন্তব্য: ০