Alapon

মাওলানা মওদূদী ও ইকামতে দ্বীন



মাওলানা মওদূদীকে নিয়ে বড় একটি অভিযোগ তিনি নাকি ইকামতে দ্বীনের জিগিরে ‘তাখরীবে দ্বীন’ বা দ্বীনকে বিকৃত করে ফেলেছেন অথবা দ্বীনের আসল রুহ থেকে বিচ্যুত হয়েছেন। তাঁর মতবাদ নাকি রাজনৈতিক। সাইয়্যেদ আবুল হাসান নদভী, মাওলানা ওয়াহিদুদ্দিন খান, শাইখুল ইসলাম তাকী উছমানীসহ অনেকের অভিযোগ অনেকটা এমনই।
(আগেভাগে বলে রাখি, আমি মাওলানার দলের কেউ নই, কস্মিনকালেও নই, আমি সেই দলের কোনো অংশ নই। অতিপ্রিয় একজন আলেমের ব্যাপারে 'অযৌক্তিক' -যৌক্তিক নয়- অভিযোগের খণ্ডন- এতটুকুই আমার চেষ্টা, আর কিছুই নয়। অনেকে মওদূদীর ব্যাপারে কলম ধরলেই মনে করে ‘ভাই মনে হয় জামাত’; আসলে না, আমি ওই দলের কেউ নই।)
.
অভিযোগঃ “তারা রাজনীতির ইসলামীকরণ করতে গিয়ে ইসলামকেই রাজনীতি সর্বস্ব একটি মতবাদ ও আন্দোলন হিসাবে চিত্রিত করেছেন। আবেদ ও মা’বুদের মাঝে সুনিবিড় সম্পর্ক স্থাপনকারী ইবাদত সালাত ও হজ্জ ইত্যাদিকেও রাজনৈতিক ব্যাখ্যার মাধ্যমে প্রাণহীন ও বিরস বানিয়ে ছেড়েছেন। আল্লাহর মুহাব্বাত, রুহানিয়্যাত, ফিকরে আখিরাতের পরিবর্তে তাদের মন ও মানসে শুধু ক্ষমতা, বস্তুচিন্তা ও ইহকাল-ভাবনা।” (মাওলানা আবু সাবের আবদুল্লাহ, খেলাফত ও রাজনীতিঃ ইসলামী দৃষ্টিকোণ, ভূমিকা)
“এ কথা পরিষ্কার হয়ে গেলো যে, দ্বীন মূলতঃ রাষ্ট্রের (হুকুমত) নাম, শরীআত হলো, সে রাষ্ট্রের বিধান।” (মুফতী মনসূরুল হক, মওদূদীর ভ্রান্ত মতবাদ)
.
আসলে এ অভিযোগ একেবারেই সঠিক নয়। মাওলানা মওদূদী এসব বিষয়কে অনেক আগেই স্পষ্ট করে দিয়েছেন। তিনি একস্থানে বলছেন,
“মানবজীবনের গোটা ব্যবস্থাকে তার সমস্ত দিক ও বিভাগ (দর্শন, দৃষ্টিভংগি, ধ্যানধারণা, ধর্ম ও নৈতিকতা, চরিত্র ও আচরণ, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, সাহিত্য ও সংস্কৃতি, সভ্যতা ও সমাজব্যবস্থা, অর্থনীতি ও রাজনীতি, আইন ও আদালত, যুদ্ধ ও সন্ধি এবং যাবতীয় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক) সহ আল্লাহর দাসত্ব ও নবীগণের হেদায়াতের ওপর প্রতিষ্ঠিত করে দেয়া।” (আন্দোলন, সংগঠন কর্মী, পৃঃ ৪৪-৪৫; জামায়াতে ইসলামীর উদ্দেশ্য ইতিহাস কর্মসূচী, পৃঃ ১)
.
আমরা যে জিনিস প্রতিষ্ঠিত করতে চাই, কুরআনের পরিভাষায় তার অর্থবহ নাম হচ্ছে ‘দ্বীনে হক’ অর্থাৎ, সেই জীবনব্যবস্থা (দ্বীন) যা সত্যের (নবীগণের আনীত হেদায়াত অনুযায়ী আল্লাহর দাসত্ব ও আনুগত্যের) ওপর প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু এটাকে বোঝানোর জন্য আমরা কখনো কখনো ‘হুকুমতে ইলাহিয়া’ পরিভাষাটি ব্যবহার করেছি। এর অর্থ অন্যদের নিকট যা-ই হোক না কেন, আমাদের নিকট আল্লাহ তা’আলাকে প্রকৃত শাসক ও হুকুমকর্তা স্বীকার করে নিয়ে গোটা ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক জীবনকে তাঁর শাসন ও হুকুমের অধীনে পরিচালিত করাই কেবল এর অর্থ। এ হিসেবে শব্দটি পুরোপুরি ‘ইসলাম’ এর সমার্থক। এরই ভিত্তিতে আমরা এই তিনটি পরিভাষা (দ্বীনে হক’ হুকুমতে ইলাহিয়া, ইসলাম) সমার্থক শব্দ হিসেবে ব্যবহার করি। আর সেই মহান উদ্দেশ্য হাসিলের চেষ্টা সংগ্রামের নাম দিয়েছি আমরা ‘ইকামতে দ্বীন’ ‘শাহাদাতে হক’ ও ‘ইসলামী আন্দোলন’। (আন্দোলন, সংগঠন কর্মী, পৃঃ ৪৪-৪৫; জামায়াতে ইসলামীর উদ্দেশ্য ইতিহাস কর্মসূচী, পৃঃ ৭)
.
তবে দীর্ঘদিন যাবত উপনিবেশে থাকার দরুণ রাজনীতির একটা খণ্ডিত চিত্র মনের মাঝে আপনা আপনিই অঙ্কিত হয়ে যায় বলে মাওলানার ইকামতে দ্বীনের ধারণা বুঝতে একটু সমস্যা হয়ে যায়। মাওলানা পরিষ্কার বলেছেন, তিনি নিছক রাষ্ট্র অর্থে কোনো রাষ্ট্র কায়েমের দাওয়াত দেন না, ‘শুষ্ক’ ও ‘বিরস’ রাজনীতি করার দাওয়াতও তিনি দেননি। তিনি বলেছেন,
“আমাদের দাওয়াত সম্পর্কে সাধারণত বলা হয় যে, আমরা ইসলামি রাষ্ট্র কায়েম করার দাওয়াত দিয়ে থাকি। হুকুমতে ইলাহিয়া শব্দে স্বতঃই একপ্রকার ভুল ধারণার সৃষ্টি হয়- অনেকে আবার ইচ্ছা করেই একে কেন্দ্র করে ভুল ধারণা সৃষ্টি করার চেষ্টা করে। সাধারণত লোকে মনে করে, কিংবা তাদেরকেই বুঝাতে চেষ্টা করা হয় যে, ইসলামি রাষ্ট্র বলতে একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা বুঝায় মাত্র। আরো বলা হয় যে, বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিবর্তে সেই বিশেষ রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করাই আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য.........সেহেতু খুব সহজেই বুঝানো হয় যে, আমরা হুকুমত দখল করতে চাই......আমাদেরকে দুনিয়ার বা পার্থিব স্বার্থবাদী আখ্যা দেওয়া হয়। অথচ মুসলমানদের দ্বীন-ইসলাম এবং পরকালের জন্যই কাজ করা দরকার, দুনিয়ার জন্য নয়.........অথচ আমাদের বই-পুস্তক উদার ও মুক্ত দৃষ্টিতে পাঠ করলেই প্রত্যেকেই অতি সহজেই বুঝতে পারেন যে, নিছক একটা রাষ্ট্র-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠাই আমাদের উদ্দেশ্য নয়। প্রকৃতপক্ষে মানুষের সামগ্রিক জীবনে ইসলাম নির্ধারিত পরিপূর্ণ বিপ্লব সৃষ্টি করাই আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য। এই বিপ্লবের জন্য আল্লাহ তা’আলা নবী প্রেরণ করেছেন।” (ইসলামী দাওয়াত ও কর্মনীতি, পৃঃ ৬)

.
“এ কারণেই আমরা যখন ‘ইকামতে দ্বীন’ শব্দ ব্যবহার করি, তখন তার অর্থ কেবলমাত্র মসজিদে দ্বীন কায়েম করা কিংবা কয়েকটি ধর্মীয় আকীদাহ-বিশ্বাস ও নৈতিক বিধান প্রচার করা-ই আমরা বুঝাই না। বরঞ্চ, আমাদের নিকট এর অর্থ হলো- ঘরবাড়ী, মসজিদ, মাদ্রাসা, কলেজ, ইউনিভার্সিটি, হাট-বাজার, থানা, সেনানিবাস, কোট-কাচারী, সংসদ, মন্ত্রীসভা, দূতাবাস, সর্বত্রই সেই এক খোদার দ্বীন প্রতিষ্ঠিত করতে হবে, যাকে আমরা আমাদের রব এবং মা’বুদ বলে মেনে নিয়েছি। আর এসব কিছুর ব্যবস্থাপনা সেই রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শিক্ষানুযায়ী পরিচালিত করতে হবে, যাকে আমরা আমাদের প্রকৃত পথপ্রদর্শক বলে স্বীকার করে নিয়েছি।” (আন্দোলন, সংগঠন কর্মী, পৃঃ ৪৮; জামায়াতে ইসলামীর উদ্দেশ্য ইতিহাস কর্মসূচী, পৃঃ ১০)
.
“ইসলামী জীবনব্যবস্থার প্রতিষ্ঠাই মুসলমানদের জীবনের মূল লক্ষ্য। একটি নিছক জাতীয় রাষ্ট্র কায়েম করা তাদের লক্ষ্য নয় বরং দুনিয়ার সামনে আল্লাহর বিধানের বিজয় পতাকা উড্ডীন করতে পারে এমন একটি বিশুদ্ধ ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করাই তাদের জীবনের মূল উদ্দেশ্য। কৃষ্টি ও সংস্কৃতি, সমাজব্যবস্থা, অর্থব্যবস্থা ও নৈতিক পরিবেশ যেখানে খাঁটি ইসলামের ভিত্তিতে গড়ে উঠবে, যার আইন আদালত ফৌজ পুলিশ ও দূতাবাস পৃথিবীর সামনে ইসলামের আদর্শ তুলে ধরবে, সে ইসলামি রাষ্ট্র কায়েম করাই প্রত্যেক মুসলমানের জীবনের প্রকৃত লক্ষ্য। এরুপ একটি ইসলামি রাষ্ট্র কায়েম হলে ইসলাম ও কুফরের মধ্যে কি পার্থক্য” এবং ইসলাম সর্বদিক দিয়ে সকল মানবরচিত সভ্যতা ও মতবাদের চাইতে কত উচ্চ ও উৎকৃষ্ট তা জগতবাসী সহজেই উপলব্ধি করতে পারবে। মুসলমানদের এ উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যকেই আমরা জামায়াতে ইসলামীর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নির্ধারণ করেছি। ইসলামের পরিভাষায় একে বলা হয়।” (জামায়াতে ইসলামীর উনত্রিশ বছর, পৃঃ ২৩)
.
বরংঞ্চ মাওলানা মওদূদী যখন রাষ্ট্র, ইকামতে দ্বীন বলেন তখন তাঁর উদ্দেশ্য হয়- পৃথিবীর সামনে আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা দ্বীনে হককে পরিপূর্ণ স্থাপন করা। যেই দ্বীনে আল্লাহ ও বান্দার মাঝে নিবিড় সম্পর্ক আছে, সুস্থ মা’রিফাত আছে, সত্য আধ্যাত্মিকতা আছে, বান্দার আখিরাতের মুক্তি আছে, দুনিয়ার মুক্তি আছে, দুনিয়াতে এমনভাবে জীবনযাপনের নিশ্চয়তা আছে যা তাকে আখিরাতের পাথেয় অর্জনে বাধা সৃষ্টি না করে বরং সহায়তা করবে।
“বরঞ্চ কেবল এ উদ্দেশ্যেই চেয়েছিলাম, যেন একটি নিরেট ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়, যা পৃথিবীর সামনে ইসলামি জীবনব্যবস্থার পূর্ণাঙ্গ নমুনা উপস্থিত করবে।” (আন্দোলন, সংগঠন কর্মী, পৃঃ ৪৫; জামায়াতে ইসলামীর উদ্দেশ্য ইতিহাস কর্মসূচী, পৃঃ ৯)
.
অনেকে মাওলানার এ ধরণের কার্যক্রমকে ইমামিয়া ফির্কা ও খারেজী মতবাদের নামান্তর বলেছে, বিশেষত বর্তমানের মাদখালীদের তো এসব বলার ক্ষেত্রে জুড়ি নেই। আসলে বাস্তবার্থে এমন কিছুর দাওয়াতই মাওলানা দেননি। ‘ইনিল হুকমু ইল্লালিল্লাহ’ কেবল খারেজীদের স্লোগান নয় বরং এটা ইসলামেরই শ্লোগান। তিনি পরিষ্কার বলেছেন,
“আমাদের এই মত ও নীতিকে ‘খারেজী’ মতবাদ বলে ব্যাখ্যা করা আহলুস সুন্নাহ ও খারেজী মতবাদ সম্পর্কে অজ্ঞতারই প্রমাণ। আহলুস সুন্নাহর আলেমগণের লিখিত উসূলগণের গ্রন্থাবলীর যেটি ইচ্ছা খুলে দেখুন। দেখবেন, তাতে লেখা রয়েছে হুকুমদানের অধিকার আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট.........” (আন্দোলন, সংগঠন কর্মী, পৃঃ ৫০; জামায়াতে ইসলামীর উদ্দেশ্য ইতিহাস কর্মসূচী, পৃঃ ১৩)
.
তিনি তো দ্বীন প্রতিষ্ঠা বলতে বোঝেন এমন এক উম্মাত যারা নিজেরা ইসলামকে মানার পাশাপাশি গোটা বিশ্বমানবতাকে ইসলামের সত্যতা, এর মর্যাদা, এর হক্কানিয়্যাত, এর গুণাবলী, এর উপকার, এর বার্তা খুলে খুলে মানুষের বোধগম্য উপায়ে পেশ করে ইসলামের সত্যতার প্রতি ঈমানের আহ্বান জানাতে থাকবেন। মাওলানা মওদূদী এই একটি বিষয়ে একটি বক্তৃতাই দিয়েছেন, যা ‘শাহাদাতে হক’ আর বাংলায় ‘সত্যের সাক্ষ্য’ নামে ছেপেছে। কিতাবটা পড়লেই মাওলানার মিশন ও দাওয়াতের বিষয়টা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। সংক্ষিপ্তভাবে পড়ে নিন,
.
“আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাহয় যেভাবে ইসলামের গোটা জীবনব্যবস্থা চিত্রিত হয়েছে এ অধ্যায়ে তা প্রামাণ্য ও যুক্তিপূর্ণ পন্থায় বিস্তারিতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। আমরা সুস্পষ্টভাবে পেশ করা চেষ্টা করেছি- ইসলামের আকীদাহ-বিশ্বাস কি? ঈমানের পরিচয় কি? বিশ্বজগত ও মানুষ সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি কি? ঈমানের পরিচয় কি? তার যাবতীয় ইবাদাতের উদ্দেশ্য কি? মানুষের চরিত্র ও আচরণকে সে কোন ছাঁচে ঢেলে সাজাতে চায়? তার সভ্যতার মৌলিক নীতিমালা কি? সে তার সংস্কৃতি, অর্থনীতি, সামাজিক ব্যবস্থা ও রাজনীতির ক্ষেত্রে কি কি নিয়মনীতি চালু করতে চায়? তার প্রকৃতির সাথে কোন ধরণের শিক্ষাব্যবস্থা সামঞ্জস্যশীল? অতীতে সে মানবজীবনের সমস্যাবলী কীভাবে সমাধান করে এসেছে আর বর্তমানেই-বা কীভাবে সমাধান করতে পারে? আমাদের সাধ্যানুযায়ী আধুনিক শিক্ষিত লোকদের সন্তুষ্ট করবার মত পন্থায় আমরা এ বিষয়গুলো উপস্থাপনি করেছি। কিন্তু এ কাজ দ্বারা একটি বুদ্ধিবৃত্তিক খেদমত আঞ্জাম দেয়াই আমাদের উদ্দেশ্য ছিলো না। বরঞ্চ


প্রথমদিন থেকেই আমাদের উদ্দেশ্য ছিলো, যারা বুঝে শুনে ইসলামের অনুসারী হবে তারা বাস্তবে যেন ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে প্রস্তুত হয়। এ কারণেই আমরা প্রতিটি পদক্ষেপে লোকদের বুদ্ধিবৃত্তিকে সন্তুষ্ট করবার সাথে সাথে তাদের মন মানসিকতাকেও উৎসাহিত করবার চেষ্টা করেছি।” (জামায়াতে ইসলামীর উদ্দেশ্য ইতিহাস কর্মসূচী, পৃঃ ১৮)
.
প্রশ্ন হচ্ছে, ইসলাম কি পৃথিবীর অনেক ধর্মের মাঝে নতুন একটি সংযোজন? নাকি ইসলাম সত্য দ্বীন? কুরআন কি গীতা আর বাইবেলের মাঝে একটু উচ্চমানের অলঙ্কারসমৃদ্ধ এক কিতাব নাকি তাঁর মাঝে এক বিরাট ম্যাসেজ বা বার্তাও আছে? মুসলিমরা কি পৃথিবীতে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানদের মত তথাকথিত আধ্যাত্মিকতা (spirituality) নিয়ে পড়ে থাকার জন্যই পয়দা হয়েছে নাকি আল্লাহ ও মা’বুদের মাঝে নিবিড় সম্পর্কের বাহিরেও মুসলিম উম্মাহ হিসেবেও তাদের একটা দায়িত্ব আছে? যদি ইসলাম সত্য হয়ে থাকে, কুরআন কেবলমাত্র পুরাতত্ত্ব আর গালগল্পভরা ধর্মগ্রন্থ না হয়ে থাকে আর মুসলিমরা যদি পৃথিবীতে আর দশটা জাতির মত না হয়ে থাকে তবে তবে ইসলামের আবেদন কি? কুরআনের বার্তা কি? মুসলিমদের দায়িত্ব কি? মাওলানা একে বর্ণনা করেছেন এভাবে,
.
“মুসলমান এমন একটি জাতির নাম- যার দুনিয়ায় নিজস্ব মিশন রয়েছে। ইসলাম কখনো পেশাদার প্রচারকদের দ্বারা প্রচারিত হয়নি এবং প্রতিটি মুসলমান মুসলমান হিসেবেই একজন প্রচারক। তার শুধু নিজের মুসলমান হওয়াই যথেষ্ট নয় বরং নিজের আচার-আচরণ, আলাপ-ব্যবহার, চালচলন, স্বভাব-চরিত্র মোটকথা প্রতিটি বিষয় দ্বারাই তাকে ইসলাম প্রচার করতে হয়।” (জামায়াতে ইসলামীর উনত্রিশ বছর, পৃঃ ১২)
“ইসলাম মূলত এ জন্য দুনিয়ায় আসেনি যে, কুফরী ব্যবস্থার অধীনে দেশ শাসিত হবে এবং মুসলমানরা এ বাতিল শাসন ব্যবস্থার পদানত হয়ে থাকবে। ইসলাম এসেছে এ জন্যে যে, পৃথিবীতে কর্তৃত্ব ও প্রভুত্বের চাবিকাঠি মুসলমানদের হাতেই নিবদ্ধ থাকবে আর অমুসলিমরা তার অধীন হয়ে থাকবে। এই তত্ত্বানুসন্ধানকালে আমি এ সত্যও উপলব্ধি করতে সক্ষম হই যে, মুসলিম জাতির ন্যায় ইসলামী রাষ্ট্রও একটি মিশনারী রাষ্ট্র হয়ে থাকে এবং তা ন্যায়নীতি ও সুবিচার, সততা, দরিদ্রের সেবা এবং অন্যান্য সদাচরণের দ্বারা সারা দুনিয়ার সামনে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব ও ন্যায়নিষ্ঠতার সাক্ষ্য দেয়, তার আইন আদালত, পুলিশ, সেনাবাহিনী, কূটনৈতিক বিভাগ মোটকথা তার প্রতিটি কাজে মুসলমান ও অমুসলমানের মধ্যকার পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একটি জাতি ও রাষ্ট্রকে ইসলাম কি রঙে রঞ্জিত করে আর কুফরই-বা তার কি রুপ দেয় তা পরিষ্কার হয়ে যায়। এ দিক থেকে ইসলামি রাষ্ট্র মূলত একটি প্রচার ও দাওয়াত সর্বস্ব রাষ্ট্র।” (জামায়াতে ইসলামীর উনত্রিশ বছর, পৃঃ ১৪)
.
হ্যাঁ, মাওলানা নেতৃত্ব পরিবর্তনের জন্য অনেক জোর দিয়েছেন, তা ঠিক। উনি বলেছেন,
“এই সত্য বিধান কায়েম করতে হলে নেতৃত্বের পদ ও কর্তৃত্বের সকল চাবিকাঠি সমাজের সর্বাপেক্ষা অধিক ঈমানদার, সৎ ও আদর্শবাদী লোকের হাত অর্পণ করতে হবে। এরুপ রাষ্ট্র বিপ্লব সাধন ছাড়া দ্বীন ইসলামের মূল লক্ষ্য ও দাবী কখনোই পূর্ণতা লাভ করতে পারে না।” (ইসলামী আন্দোলনের নৈতিক ভিত্তি, পৃঃ ৯)
“ইসলামের দৃষ্টিতে সৎ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা একটি কেন্দ্রীয় ও মৌলিক উদ্দেশ্য বিশেষ এবং অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ।” (ইসলামী আন্দোলনের নৈতিক ভিত্তি, পৃঃ ১০)
.
এটা বস্তুবাদী ভাবধারার কারণে নয় বরং ইসলাম যে বার্তা পেশ করছে, তাকে সকল মানুষের জন্য open end, উন্মুক্ত, আবেদনময় করে তোলার জন্য নেতৃত্বকে তিনি মৌলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছেন। আমি-আপনি যদি এ পয়েন্টকে অগুরুত্বপূর্ণ কিংবা ‘নস্যি’ বলে মনে করি; যদি আমাদের মনে হয় হিটলার ক্ষমতায় থাকবে আর আমরা প্রতিনিয়ত মিডিয়া-পত্র-পত্রিকায় নাস্তিকতা আর পেম-ভালোবাসা আর অশ্লীলতার বয়ান শুনেও দেদারসে দ্বীনের ওপর অটল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবো; যদি আমাদের মনে হয় প্রতিনিয়ত মনস্তত্ত্বকে ইসলামবিরোধী কমেন্ট খাইয়ে নিজের মাংস-হাড্ডি-মজ্জাকে আল্লাহ আল্লাহ যিকর করাতে পারবো, তবে এক্ষেত্রে মাওলানার সাথে বিরোধ কিংবা মতভেদ চলতেই পারে। তবে বেইনসাফী করে উনাকে বস্তুবাদী কিংবা নিছক রাজনীতিপাগলা বলে খাটো করবেন না।
.
অনেকে মনে করেন মাওলানা ইকামতে দ্বীনের ভুল ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর সাথে তাফসীরের কিতাবাদির কোনো মিল নাই। আসলে না, বরং তাওহীদ প্রতিষ্ঠা করা, দ্বীনের ওপর অটল-অবিচল থাকা, দ্বীনের বিধান নিজে মানা, অপরকে দাওয়াত দেওয়া, আমরু বিল মা’রুফ ও নাহি আনিল মুনকার করে, জিহাদের ময়দানে থেকে দ্বীনকে প্রতিটি ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া এবং ইসলামের প্রকৃত রুপ তুলে ধরে সত্যের সাক্ষ্য দেওয়ার সকল প্রক্রিয়াই মাওলানার কাছে ‘ইকামতে দ্বীন’ বা দ্বীন প্রতিষ্ঠা। পড়ুন মাওলানার ভাষাতেই,


“পরন্তু, এই উদ্দেশ্য যেহেতু উচ্চতর সামগ্রিক প্রচেষ্টা ছাড়া হাসিল হতে পারে না, এজন্যই এমন একটি সৎ ও আদর্শ জামায়াত গঠন করাও অপরিহার্য যা সবসময়েই ইসলামের সত্য নীতি অনুসরণ করে চলবে এবং ইসলামকে পরিপূর্ণরুপে প্রতিষ্ঠিত করা, স্থায়ী রাখা এবং তাকে ঠিকভাবে পরিচালিত করে যাওয়া ভিন্ন আর কোনো উদ্দেশ্যই হবে না। সারা পৃথিবীতে একটি মাত্র লোক যদি ঈমানদার হয়, তবুও সে একাকী বলে এবং নিজেকে নিঃসম্বল মনে করে বাতিল শাসনব্যবস্থার প্রভাব সন্তুষ্টচিত্তে স্বীকার করা কিংবা ‘দুটি বিপদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা সহজতম বিপদকে গ্রহণ করার’ অবাঞ্চিত কূট-কৌশলের আশ্রয় নিয়ে কুফরী ও ফাসেকী ব্যবস্থার অধীনে নামেমাত্র ধর্মীয় জীবনযাপন করার সুবিধা ভোগ করা তার পক্ষে আদৌ বাঞ্চনীয় নয়। বরং সেই একাকী ও নিঃসঙ্গ ঈমানদার ব্যক্তিরও কর্তব্য হচ্ছে বিশ্বমানবকে আল্লাহর মনোনীত জীবনবিধান গ্রহণ করার আহ্বান জানানো। তার এই আহ্বানের প্রতি কেউ ভ্রূক্ষেপ মাত্র না করলেও সমগ্র জীবনভর ইসলামের সত্য ও দৃঢ় পথে দাঁড়িয়ে থাকা এবং লোকদেরকে আহ্বান জানানো ও আহ্বান জানাতে জানাতে মৃত্যু মুখে ঢলে পড়া তার কর্তব্য।” (ইসলামী আন্দোলনের নৈতিক ভিত্তি, পৃঃ ১১)
“এহেন জীবনের মূলনীতি তাতে সীমাহীন দুঃখ-দুর্দশা, বিপদ-মুসিবত, ক্ষতি-লোকসান বরদাশত করতে হলেও এই জীবনে এর কোনো ‘সুফল’ পাওয়া না গেলেও জীবনের গতিধারায় একবিন্দু পরিমাণ বক্রতা সৃষ্টি করা সম্ভব হবে না।” (ইসলামী আন্দোলনের নৈতিক ভিত্তি, পৃঃ ১৯)
আপনি যদি মনে করেন সালাফরা এমন ব্যাখ্যা দেননি, এসব কথা সালাফদের ব্যাখ্যা বহির্ভূত, তাই আপনি মাওলানার কথাকে ছুঁড়ে ফেলবেন, তবে ফেলুন, তবে একটু ইনসাফ করতে ভুলবেন না যেন!
.
মাওলানার কাছে ইকামতে দ্বীন প্রত্যেক নবীরই দায়িত্ব ছিলো। রাখুন! রাখুন! আগে থেকেই দৌড় দেবেন না, মাওলানা নবীদের আগমণের কি উদ্দেশ্য বলেছেন তা তো আগে শুনে নিন। মাওলানা বলছেন,
“আল্লাহর দাসত্ববিমুখতা, ধর্মহীনতা, আল্লাহর আনুগত্য করে চলার প্রতি উপেক্ষা, নিজেদের মনগড়া নিয়ম-বিধানের অনুসরণ এবং আল্লাহর সামনে জবাবদিহি করার অনিবার্যতা সম্পর্কে অবিশ্বাস-এগুলোই ছিলো দুনিয়ার মূলগত দোষ-ত্রুটি......বস্তুত মানুষের মধ্যে আল্লাহর দাসত্ব ও আনুগত্য করে চলার অকৃত্রিম নিষ্ঠা এবং আল্লাহর সামনে জবাবদিহি করার প্রতি সন্দেহাতীত বিশ্বাস সৃষ্টি করার জন্যই দুনিয়াতে আম্বিয়ায়ে কেরাম এসেছিলেন। উন্নত নৈতিক চরিত্রের বিকাশ সাধন এবং সুষ্ঠু মূলনীতির ভিত্তিতে মানবজীবনের পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা করা, মঙ্গল ও কল্যাণের স্বতস্ফূর্ত ফল্গুধারা প্রবাহিত করা এবং অন্যায় ও পাপের সকল উৎস বন্ধ করাই তাদের মূল লক্ষ্য ছিলো। বস্তুত দুনিয়াতে নবীদের আগমণের এটাই ছিলো একমাত্র উদ্দেশ্য......” (ইসলামী আন্দোলনের নৈতিক ভিত্তি, পৃঃ ৪৪)
যদি আপনার কাছে মনে হয় আসলে নবীরা এসেছেন আমাদেরকে কেবলমাত্র এবং কেবলমাত্র নামায আর যাকাত দেওয়া এবং আল্লাহর সাথে নিবিড় সম্পর্কস্থাপন শেখাতে; তা আপনি মনে করুন, তবে তখন শুআইবের ওজন পূর্ণ করার দাওয়াত দেওয়া, মুসার ফিরআউনবিরোধী দুঃসাহস দেখানো, আল্লাহর প্রতি ঈমানের দাওয়াতদানের পাশাপাশি বনী ইসরাঈলদের মুক্তিদানের শর্ত জুড়ে দেওয়া; ইব্রাহীমের (আলাইহিমুস সালাম) নমরুদের সাথে তর্কে লিপ্ত হতে যাওয়ার বিষয়গুলোও একটু ভেবে দেখবেন।

পঠিত : ১১৭০ বার

মন্তব্য: ০