Alapon

একজন মুসলিম ভবিষ্যতের ব্যাপারে সবসময় আশাবাদী।



কখনো কখনো আপনার পরিকল্পনা এবং আল্লাহর পরিকল্পনা একই রকম হয়। যেমন- কখনো আপনি ইচ্ছা করলেন কোথাও যাওয়ার আর আল্লাহও আপনাকে সেখানে যাওয়ার সুযোগ করে দিলেন। কোনো একটি কলেজে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছা করলেন আর আল্লাহও আপনাকে সেই কলেজে ভর্তি হওয়ার সুযোগ প্রদান করলেন। সিদ্ধান্ত নিলেন দ্রুত গ্র্যাজুয়েট হওয়ার, আল্লাহ্‌ও আপনাকে দ্রুত গ্র্যাজুয়েট হওয়ার সুযোগ দান করলেন। তাহলে, আপনার প্ল্যান অনুযায়ী কাজগুলো সুসম্পন্ন হয়ে যাচ্ছে। এর অর্থ হলো, আপনার প্ল্যান এবং আল্লাহর প্ল্যান একই ছিল। সেই একটি বিষয়ের জন্য।

কিন্তু, মাঝে মাঝে আপনার এবং আল্লাহর পরিকল্পনা একই রকম থাকে না। অনেক সময় ভাবছিলেন দশ বছর ধরে এই চাকরিটা করবেন, কিন্তু ছয় মাস পরে আপনাকে ছাটাই করে দেওয়া হলো। অনেক সময় কোনো একটা ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার আবেদন করলেন, আপনার সবকিছুই ছিল সেরা, কিন্তু তবু চান্স পেলেন না। অন্যদিকে, আপনার চেয়ে অনেক কম যোগ্যতাসম্পন্ন বহু ছেলে/মেয়ে চান্স পেয়ে গেল। এমনটা অহরহ ঘটে। অনেক সময় আপনার এবং আল্লাহর পরিকল্পনা একই রকম থাকে না। এই আয়াতগুলো শিক্ষা দিচ্ছে - সবসময় সবকিছু আমার পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করবে না। তবুও আমাকে পরিকল্পনা করে যেতে হবে। তবুও আমাকে চেষ্টা করে যেতে হবে। কিন্তু, দিনশেষে, আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা সিদ্ধান্ত নিবেন পরিকল্পনাটি বাস্তবায়িত হবে কি হবে না। এটাই হলো- ওয়াজ কুর রাব্বাকা ইজা নাসিইত।

এরপর আসছে এই আয়াতের সবচেয়ে শক্তিশালী অংশ। আমি এর উপর অতিরিক্ত কিছু সময় ব্যয় করতে চাই। কারণ, এটা আসলেই সমগ্র কুরআনের অন্যতম সুন্দর একটি শিক্ষা, আমার মতে। যদি একজন মুসলিম এটা বুঝতে পারে, তার জীবনটা সহজ হয়ে যাবে। وَقُلْ عَسَىٰ أَن يَهْدِيَنِ رَبِّي لِأَقْرَبَ مِنْ هَٰذَا رَشَدًا - “আশা করি আমার প্রতিপালক আমাকে এর চেয়েও সত্যের নিকটবর্তী পথে পরিচালিত করবেন।” (18:24) এই শব্দগুলো হলো একটি দুআ। দু'আর চেয়েও এটা আশায় পরিপূর্ণ একটি বিবৃতি।

চলুন, এই দৃষ্টিকোণ থেকে এর সাথে পরিচিত হই। আপনি ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করছেন শুধু 'عَسَىٰ -' আসা' শব্দটি ব্যবহৃত হওয়ার দরুণ। আরবিতে যাকে বলা হয় 'হারফুত তারাজ্জি বা ফি'লুত তারাজ্জি' - এমন ক্রিয়াপদ যা আশা প্রকাশে ব্যবহার করা হয়। আল্লাহ্‌ আমাদের এই আয়াতে শেখাচ্ছেন, একজন মুসলিমকে অবশ্যই ভবিষ্যতের ব্যাপারে আশাবাদী হতে হবে। কুরআনের প্রতি আমার ঈমান আমাকে ভবিষ্যতের ব্যাপারে আশাবাদী করে তোলে। আমি পরোয়া করি না খবরে কী আসে, আমি পরোয়া করি না গতকাল কী ঘটেছে, এর আগের দিন, এর আগের দিন, বা এর আগের দিন কী ঘটেছে। আমি মুসলমানদের এমন গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত হব না যারা বসে বসে বলে:

"উম্মাহর পরিস্থিতি দিন দিন শুধু খারাপ থেকে আরও খারাপ হচ্ছে। ও আল্লাহ্‌! আর সামনে পরিস্থিতি শুধু আরও খারাপ হবে। সামনে আরেকটা ট্রাজেডি আসছে, আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি। দেখো কী ঘটে। তুমি মনে করেছ ৯/১১ খারাপ ছিল? ও মাই গড! ঐটা আসলে কিছুই না। দেখো, এখন উম্মাহর কী হয়। এবং দেখো, তারপর কী হয়।"

এই মনোভাব সরাসরি কুরআনের আয়াতটির বিরোধী। শুধু 'আসা' শব্দটির কারণে। আপনার তো এই আশায় বুক বাঁধার কথা যে, আল্লাহ্‌ পরিস্থিতি উন্নত করে দিবেন। আপনার নিজের জন্য, আপনার চারপাশের মানুষের জন্য, মানবতার জন্য - আপনার তো এই দৃষ্টিভঙ্গি থাকার কথা। তারপর তিনি বলেন... আর নিজের ভবিষ্যতের ব্যাপারে কী বলবেন? "عَسَىٰ أَن يَهْدِيَنِ رَبِّي" - "সম্ভবত, আমার রব আমাকে পথ দেখাবেন।" তিনি আমাকে হেদায়েত দিবেন। নিজের ভবিষ্যতের জন্য সবচেয়ে আশাবাদী কোন জিনিসটি আপনি পেতে পারেন?

সবাই ভালো চাকরি চায়। ভালো অর্থনৈতিক অবস্থা চায়। ভালো পারিবারিক অবস্থা চায়। সুস্বাস্থ্য চায়। আমরা এগুলোর সব চাই। কিন্তু জানেন? সবচেয়ে মৌলিক যে জিনিসটি আমার আপনার প্রয়োজন, যা অক্সিজেনের চেয়েও বেশি মূল্যবান, তা হলো - আল্লাহর হেদায়েত। একবার এটা পেয়ে গেলে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু, হেদায়েত না পেলে... সবকিছু থাকলেও আপনার আসলে কিছুই নেই। সুতরাং, এই আয়াত আশাবাদী করে তোলে যে, আল্লাহ্‌ আমাকে পথ দেখাবেন। "আসা আন ইয়াহদিয়ানিই রব্বী।" আমার প্রভু আমাকে পথনির্দেশনা দান করবেন, তিনি আমাকে ভুলে যাবেন না। ভবিষ্যতের জন্য ওয়াদা দেয়ার সময় আমি তাঁর স্মরণ করবো, তাহলে তিনিও ভবিষ্যতে আমাকে স্মরণ করবেন। ইনশাআল্লাহ্‌ বলার মাধ্যমে আমি তাঁকে স্মরণ করলাম। যেহেতু আমি তাঁর কথা মনে করেছি - যখন ভবিষ্যতের কথা আসে - তিনিও আমাকে স্মরণ করবেন। فَاذْكُرُونِي أَذْكُرْكُمْ - সুতরাং তোমরা আমাকে স্মরণ কর, আমিও তোমাদের স্মরণ রাখবো। (২:১৫২) আমার নাম উল্লেখ করো, আমিও তোমাদের নাম উল্লেখ করবো।

এখন, আল্লাহ্‌ আপনাকে হেদায়েতের গ্যারান্টি দিচ্ছেন। পুনরায় বলছি, এখানে মুসলমানদের বোঝার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাপার রয়েছে। সারা পৃথিবী জুড়ে বহু মানুষের মাঝে - অনেকের সাথে আমার কথা হয়েছে - এই প্রশ্ন আছে। আল্লাহর শপথ! এই গ্রহের যে প্রান্তেই যান না কেন, মানুষের একই বিভ্রান্তি রয়েছে। একই প্রশ্ন, বার বার। আর সবচেয়ে কমন যে প্রশ্নটি আমি শুনি তা হলো, মানুষ বলে -
" ইসলামের এতো বেশি দল-মত রয়েছে, কুরআনের ব্যাখ্যায় এতো বেশি ভিডিও আছে, বা হাদিসের ব্যাখ্যায়, কেউ এটা বিশ্বাস করে, কেউ ওটা বিশ্বাস করে, এই হুজুর অমুক ফতোয়া দেয়, ঐ হুজুর তমুক ফতোয়া দেয়, আমি কি এই হুজুরকে মানবো নাকি ঐ হুজুরকে মানবো? কেউ বলে এটা হালাল, কেউ বলে এটা হারাম— মনে হয় যেন আমি কিছুই জানি না। সবকিছুই বিভ্রান্তিকর। এতো বেশি দল মত!! আমি কীভাবে হেদায়েত পাব? কীভাবে আমি জানব যে আমি সঠিক বিষয়টা অনুসরণ করছি? কীভাবে জানবো? আমার পক্ষে তো এতো বেশি তথ্য প্রসেস করার সম্ভব নয়।"

আর আমি এর সাথে একমত। আমরা এখন মাত্রাতিরিক্ত তথ্যের যুগে বাস করছি। সত্যিই তাই। আমরা প্রতিনিয়ত এতো বেশি মত আর পথের সাথে পরিচিত হচ্ছি, এমনকি ইসলামের ভেতরেও। এই হলের ভেতরে বসা শ্রোতাদের দিকে লক্ষ্য করুন। যদিও আমরা এই এলাকার - আমাদের প্রায় সবাই - আপনি যেভাবে ইসলাম শিখেছেন তা আপনার পাশের জনের থেকে খুবই আলাদা। যেসব শিক্ষক আপনি পেয়েছেন, যেসব মানুষের সঙ্গ লাভ করেছেন, যে পাঠগুলো শিখেছেন তা আপনার পাশের জনের থেকে একেবারেই ভিন্ন।
অতএব, আমরা যেভাবে ইসলামের সাথে পরিচিত হয়েছি তার মাঝে বহু ভিন্নতা রয়েছে। তাই, কোনো ব্যক্তি সহজেই বিভ্রান্ত হয়ে পড়তে পারে যে, কীভাবে আমি বুঝবো যে আমি সঠিক ইসলাম অনুসরণ করছি। জানেন? এই আয়াত হলো তার জবাব।

আমি কারো হেদায়েতের নিশ্চয়তা দিতে পারি না। ইউটিউবও কারো হেদায়েতের গ্যারান্টি দিতে পারে না। গুগলও কারো গাইডেন্সের গ্যারান্টি দিতে পারে না। এবং কোনো মানুষও হেদায়েতের নিশ্চয়তা দেয় না। এটা আমাদের আশা যে, আল্লাহ স্বয়ং আমাকে ব্যক্তিগতভাবে হেদায়েত দিবেন। হেদায়েত অন্য কোথাও থেকে আসতে পারে না। আপনার কাছে কোনো তথ্য না থাকতে পারে অথবা আপনি তথ্যের সাগরে ডুবে থাকতে পারেন—এটা কোনো ব্যাপার না। আল্লাহ আপনাকে কতটুকু সঠিক পথে চালিত করবেন তা নির্ভর করে আপনি আল্লাহর কাছে কতটা হেদায়েত চান, তার উপর। অন্য কারো কাছে নয়। আর একবার আল্লাহর কাছে সঠিক রাস্তা চাওয়ার পর আপনাকে আর বিচলিত থাকতে হবে না। কারণ, আপনি শতভাগ নিশ্চিত থাকুন যে, আল্লাহ আপনাকে সঠিক পথ দেখাবেন।
তিনি কাউকে ফিরিয়ে দেন না। আল্লাহর কাছ থেকে হেদায়েত পাওয়া কঠিন নয়। এটা কঠিন নয়। আল্লাহ হেদায়েতের পথ বিস্তীর্ণরূপে খোলা রেখেছেন - যারা চায় তাদের জন্য। আমাদেরকে শুধু সেসব মানুষের অন্তর্ভুক্ত হতে হবে যারা হেদায়েত কামনা করে। শুধু এটুকুই।

এই আয়াতটি সূরাতুল কাহাফের অন্তর্গত। সূরা কাহাফ নিয়ে কথা বলে শেষ করতে পারবো না, এই খুৎবায়। এই গুহার অধিবাসীরা যাদের কথা আমরা প্রতি শুক্রবারে পড়ে থাকি, এই মানুষগুলোর আশপাশে কোনো নবী ছিল না, কোনো আলেম ছিল না, কোনো শেইখ ছিল না, কোনো সাহাবী ছিল না—নিজেদের জন্য তারা নিজেরাই ছিলেন। আর তারা এমন এক এলাকায় বাস করতেন যেখানে সবাই মূর্তি পূজা করতো। তারা একটি উপসংহারে পৌঁছেন যে, সৃষ্টিকর্তা শুধু একজন। তারা শুধু বললো, আমরা এগুলোর উপাসনা করতে পারি না। لَن نَّدْعُوَ مِن دُونِهِ إِلَٰهًا - “আমরা কখনও তাঁর পরিবর্তে অন্য কোন উপাস্যকে আহবান করব না।” আর এতোটুকুর কারণেই আল্লাহ্‌ তাঁদেরকে হেদায়েত দিলেন। অন্য কোনো জ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও। কোনো ওহী তাঁদের কাছে ছিল না, কিছুই না। আল্লাহর তাঁদেরকে হেদায়েত দেওয়ার জন্য এতোটুকুই যথেষ্ট ছিল।

আর তিনি তাঁদেরকে এতো বেশি হেদায়েত দান করেন যে, আজকের দিনে যারা বছরের পর বছর ধরে দীনের জ্ঞানার্জন করে, তাঁরা এই যুবকদের কাহিনী অধ্যয়ন করেন—যারা কিছুই জানতো না। ঐ ওলামাদের সাথে তুলনা করুন, যারা তাঁদেরকে নিয়ে অধ্যয়ন করে। কারণ, এই যুবকরা আল্লাহর হেদায়েত পেয়েছিল। কারণ, আল্লাহ্‌ তাঁদেরকে পথ দেখিয়েছেন। আপনার পরিস্থিতি যত অন্ধকারাচ্ছন্নই হোক না কেন, যত হতাশাজনকই হোক না কেন—আপনার যদি আল্লাহর উপর আশা থাকে, এটাই যথেষ্ট। শুধু এটাই যথেষ্ট।

- উস্তাদ নোমান আলী খান

পঠিত : ৪৩২ বার

মন্তব্য: ০