Alapon

হাফিজিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী নির্যাতন এবং কিছু কথা...



বছর চারেক আগে বিশেষ কাজে চট্টগ্রাম গিয়েছিলাম। কাজ শেষে ঘুরতে গিয়ে আসরের নামাজ পড়তে নিকটস্থ একটি মসজিদে গেলাম। মসজিদটা ছিল বেশ বড়ো এবং সেই মসজিদের পশ্চিম দিকে ছিল একটি সানবাঁধানো পুকুর। পরিবেশটা সত্যিই মনোমুগ্ধকর ছিল।

ওজু করতে গিয়ে দেখি ওজু খানায় দুজন ৯-১০ বছর বয়সি শিশুকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। তারপরও তাদের পাহারা দেওয়ার জন্য মাদ্রাসার অপর এক ছাত্রকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সেই পাহারাদার আর দুই বন্দি মিলে বেশ গুজুর গুজুর করে গল্প করছে, আর হুজুরকে দেখা মাত্রই পাহারাদার ছাত্র সচেতন হয়ে ওঠে এবং হাক ছেড়ে বলে, এই কোনো কথা বলবি না। কথা বলবি তো উস্তাদরে বইলা দিবো।

আমি সেই পাহারাদার শিক্ষার্থীকে জিজ্ঞেস করলাম, এদের অপরাধ কী? সেই ছাত্র বললো, ‘তারা বাড়ি যাওয়ার জন্য ছুটি চেয়েছিল, কিন্তু ছুটি দেওয়া হয়নি। তারপর তারা কাউকে কিছু না জানিয়ে চুপি চুপি বাড়ি চলে যায়। আজ সকালে উস্তাদ গিয়ে তাদের বাড়ি থেকে ধরে এনে এখানে শিকল দিয়ে বেঁধে রেখেছে। পাহারাদার শিক্ষার্থী যখন আমাকে তাদের গল্প বলছিল, তখন বন্দি দুজনের চোখে-মুখে আঁকুতি ভেসে উঠছিল। হয়তো তারা ভেবেছিল, আমি তাদের জন্য কিছু করতে পারবো। কিন্তু আমারও তো কিছু করার ছিল না।

এতো গেল হাফিজিয়া মাদ্রাসার কথা। আমি যখন ক্লাস এইটে পড়ি, তখনকার কথা বলি। আমি যে স্কুলে পড়তাম সেই স্কুল এখন সরকারি মডেল স্কুল হয়ে গেছে। তো আমাদের যিনি ইংরেজি ফাস্ট পেপার পড়াতেন, সেই স্যার ছিলেন বয়োবৃদ্ধ। মানে চাকরি জীবনের একদম শেষপ্রান্তে চলে এসেছেন। তো তিনি একদিন ক্লাস নিতে নিতে আমাকে একটা প্রশ্ন করলেন, কিন্তু আমি জবাব দিতে পারলাম না। এরপর স্যার লাঠি দিয়ে আমার বাহুতে গুনে গুনে ১৫ টা বাড়ি দিলেন। আমার বাহুতে সাথে সাথে রক্ত জমাট বেধে কালো হয়ে গেল।

সেই স্যারের এমন মাইর দেওয়ার ঘটনা সেটাই প্রথম ছিল না। বরং, তরুণ বয়সে স্যার এর চেয়েও মারাত্মক ছিলেন। আমাদের এলাকায় এখনো এমন কয়েকজনকে পাওয়া যাবে, যারা সেই স্যারের মাইর খেয়ে স্কুল যাওয়াই বন্ধ করে দিয়েছে। পরবর্তীতে তারা আর পড়াশোনাই করতে পারেনি।

দুটো ঘটনা বললাম। একটা হাফিজিয়া মাদ্রাসার ঘটনা আর একটা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ঘটনা। দুটো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। কিন্তু পার্থক্য হলো, হাফিজিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনা ঘটলে পুরো মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থাকে দ্বায়ি করা হয় এবং মাদ্রাসা শিক্ষা বন্ধ করে দেওয়ার দাবি জানানো হয়। আর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীকে নির্যাতনের ঘটনা ঘটলে পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে দ্বায়ি করা হয় না, দ্বায়ি করা হয় শুধু সেই শিক্ষককে। আর এই নির্যাতনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে কেউ জেনারেল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দেওয়ার কথাও বলে না।

আসলে যারা শিক্ষার্থীকে নির্যাতনের ঘটনা কেন্দ্র করে মাদ্রাসা বন্ধ করে দিতে চান, তারা আসলে এই সমস্যার কোনো সমাধান চান না। বরোঞ্জ তারা ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চান। অর্থাৎ, এই সুযোগে পুরো মাদ্রাসা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে চায়। কিন্তু এটা কখনোই কাম্য নয়।

হাফিজিয়া মাদ্রাসাগুলোতে যে শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে না তা নয়, ঘটছে! কিন্তু সেই অনুপাতটা এমন নয় যে, পুরো মাদ্রাসা ব্যবস্থা বন্ধ করে দিতে হবে। তবে এই নির্যাতন বন্ধ করতে মাদ্রাসা কতৃপক্ষদের অবশ্যই সচেতন হতে হবে। আর এই নির্যাতনের ঘটনাগুলোকে একটি মেজর সমস্যা হিসেবে গণ্য করে তা সমাধানের পথ বের করতে হবে। প্রয়োজনে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের নিয়মিতক কাউন্সিলিং করাতে হবে। হাফিজিয়া মাদ্রাসার শিক্ষকরা মূলত পরিবার থেকে দূরে থাকে, আর সে কারণে তাদের মন-মেজাজের ভারসাম্য কম থাকে। সে কারণে সম্ভব হলে মাদ্রাসা কতৃপক্ষ যেন পরিবার কাছে রাখার ব্যবস্থা করে, সে দিকে নজর দিতে পারে। সেইসাথে ক্লাস রুমগুলোকে সিসি ক্যামেরার আওতাভুক্ত করতে হবে।

আর এমন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে সেটাকে স্বীকার করে জড়িত শিক্ষকের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। যেন পরবর্তিতে আর কেউ শিক্ষার্থী নির্যাতনের সাহস না করে।

পঠিত : ৬৯২ বার

মন্তব্য: ০