Alapon

চট্টগ্রাম - নোয়াখালী শব্দ যুদ্ধ



মধ্যযুগে আরাকান ছিল সমৃদ্ধ অঞ্চল। দক্ষিণ ভারতে ব্যবসা, সাহিত্য ও নৌবাহিনীতে তারা ছিল অদ্বিতীয়। আরাকান মগ ও মুসলিমদের দ্বারা কখনো এককভাবে, কখনো যৌথভাবে শাসিত হয়ে আসছিল।

আরাকানীদের রাজত্ব ছিল বর্তমান রাখাইন, কক্সবাজার চট্টগ্রামের ভাটিয়ারি পর্যন্ত। তবে সন্দ্বীপ মোহনা ও ফেনী নদী ছিল নোয়াখালী ও আরাকানের শেষ সীমানা। আরাকানীদের মোটা দাগে মগ হিসেবে চিহ্নিত করা হতো নোয়াখালী তথা বাংলা অঞ্চলে।

আরাকানী মগরা প্রায়ই বাংলা আক্রমণের চেষ্টা করতো। আর সেই সুবাদে তাদের প্রথম কোপটা পড়ে নোয়াখালীতে। নোয়াখালী সাহিত্যিকেরা মগদের ডাকাত ও লুটেরা হিসেবে চিহ্নিত করতো। এজন্য তারা মগদের প্রতি শব্দ প্রয়োগ করেছে 'মগের মুল্লুক'। মগদের সাথে জোটবদ্ধ হয়ে নোয়াখালী আক্রমণ করতো পর্তুগীজরা।

এই পর্তুগীজ ও তাদের দালালদের জন্য নোয়াখালীর লোকেরা শব্দ তৈরি করে 'ফিরিঙ্গি'। 'ফিরিঙ্গি' মানে হলো ইউরোপীয় জাত। মানে ইউরোপিয়ান দ্বারা অবৈধভাবে জন্ম নিয়েছে।
মধ্যযুগের গর্বিত জাতি আরাকানীরা বাঙালিদের হীন চোখে দেখতো। তাই তারা নোয়াখালীর লোক তথা বাঙালিদের জন্য একটি তুচ্ছার্থে একটি শব্দ ব্যবহার করতো। আর সেটা হলো 'বৈঙ্গা'।
আমি যখন ২০০৮ সালে চট্টগ্রামে বসবাস করার জন্য যাই তখন এই শব্দের আক্রমণ আমার ওপর করা হয়। এই শব্দটা চট্টগ্রামবাসী বিশেষত নোয়াখালী অঞ্চলের জন্য ব্যবহার করে। আমি প্রথম ভেবে নিয়েছি বৈঙ্গা মানে বহিরাগত। এটা এখন এই অর্থেই ব্যবহার হয়।

তবে বৈঙ্গার উৎপত্তি হলো বঙ্গিয়া থেকে। ১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বৃহত্তর চট্টগ্রাম সম্পূর্ণভাবে আরাকান রাজাদের অধীনে শাসিত হয়। তখন বঙ্গদেশ ছিল চট্টগ্রামের জন্য বিদেশ। আরাকান-চট্টগ্রামের এর আগেকার ইতিহাস ছিল অস্পষ্ট। আরাকান-শাসিত চট্টগ্রামের বাইরে নোয়াখালী হতে শুরু করে বাংলাভাষী অধ্যুষিত বাকি অঞ্চল বঙ্গ, বঙ্গদেশ, বাঙলা, বাঙ্গালা প্রভৃতি নামে পরিচিত ছিল।

তন্মধ্যে বঙ্গ ছিল সবচেয়ে পরিচিত নাম। আরকান-চট্টগ্রামের অধিবাসীদের কাছে বাংলাভাষী এলাকা বিশেষ করে প্রতিবেশী বর্তমানে নোয়াখালী নামে পরিচিত এলাকা বঙ্গ নামে পরিচিত ছিল। বঙ্গদেশের লোকদের আরাকান-চট্টগ্রামের লোকজন তুচ্ছার্থে বঙ্গিয়া > বইঙ্গা > বৈঙ্গা ডাকা শুরু করে। বৈঙ্গা মানে বঙ্গের লোক।

১৬৬৬ সালের পর থেকে আরাকানের সমৃদ্ধি কমতে থাকে। উল্টো বাংলা স্ট্রং হতে থাকে। তখন দিল্লির শাসক হলে আওরঙ্গজেব বা আলম-ই-গীর (পৃথিবীর শাসক)। এই মুঘল শাসকের সময় বাংলার সুবাহদার (মুঘলদের গভর্নর) ছিলেন শায়েস্তা খান। নোয়াখালীর সামন্ত রাজারা শায়েস্তা খাঁ-এর কাছে আর্জি করেন যাতে তাদেরকে মগদের আক্রমণ থেকে উদ্ধার করা হয়।

শায়েস্তা খান তাঁর পুত্র বুজুর্গ উমেদ খানকে দায়িত্ব দেন নোয়াখালীর মানুষদের চট্টগ্রামের দস্যুদের হাত থেকে রক্ষা করা জন্য। উমেদ খাঁ পরিস্থিতি অনুধাবন করে সিদ্ধান্তে আসলেন, শক্তিশালী নৌবাহিনী না হলে আরাকানীদের অত্যাচার থেকে বাঁচা কঠিন হবে।

তাই তিনি নোয়াখালীতে একটি শক্তিশালী নৌবাহিনী গঠনের কার্যক্রম হাতে নিলেন। তখন সন্দ্বীপের শাসক ছিলেন দিলাওয়াল খান। তার সহায়তায় নোয়াখালীতে উমেদ খান নৌবাহিনী গঠন করেন। একইসাথে উমেদ খান পর্তুগীজদের সাথে মগদের সম্পর্ক নষ্ট করে দেন।

পর্তুগীজরা পক্ষ ত্যাগ করে নোয়াখালীর নৌবাহিনীতে যুক্ত হয়। অন্যদিকে মুঘলদের ছিল শক্তিশালী স্থলবাহিনী। উভয় দিক থেকে সাঁড়াশি আক্রমণ করে চট্টগ্রাম দখল করেন উমেদ খান। মগরা বিতাড়িত হয়। নোয়াখালীর মানুষ ও চট্টগ্রামের মুসলিমরা নির্যাতন থেকে রক্ষা পায়।

১৫০০ সাল থেকে ১৬৬৬ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রামের অফিসিয়াল নাম ছিল ফিরিঙ্গিদের দেওয়া পোর্টো গ্র্যান্ডে। উমেদ খান নাম পরিবর্তন করে রাখেন ইসলামাবাদ। চটগ্রামবাসীর সবচেয়ে বড় দূর্গ আন্দারকিল্লাকে উমেদ খান মসজিদ ও লাইব্রেরিতে পরিণত করেন।

এভাবেই চট্টগ্রাম বৈঙ্গাদের দখলে আসে। আজ পর্যন্ত বৈঙ্গাদের সাথেই তাদের জীবনযাপন। বৈঙ্গারা জিতে গেলেও বৈঙ্গারা বৈঙ্গা গালি শোনা থেকে মাহরুম হচ্ছে না। তবে আমি মনে করি বঙ্গিয়া তথা বৈঙ্গারা তাদের বৈঙ্গা পরিচয় নিয়ে হীনমন্য না হয়ে চাইলে গর্বিত হতে পারে।

একসময়ের বিখ্যাত জাতি আরাকানীরা আজ বেশ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেল। হারিয়ে ফেললো তাদের শৌর্য।

পঠিত : ৫৭০ বার

মন্তব্য: ০